< ১ >
কোন এক পড়ন্ত বিকেলে কোন এক সুমধুর আবৃত্তি সন্ধ্যায় আনিসের সাথে আমার প্রথম পরিচয়।
একেবারে আমার স্বপ্নে পাওয়া রাজপুত্রের মতোই আনিস। একটু একটু করে কাছে আসা তারপর মন প্রাণ খুলে একে অপরকে ভালো লাগা ভালোবাসাটা যে কখন শুরু হোল আর কখন তা বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হোল, টেরই পাইনি।
মনে হলও ওইদিনের পরিচয়। মনে হয় এইতো সেদিন, একসাথে এমনই এক ফাল্গুনের বিকেলে হাত ধরে খালি পায়ে হেঁটেছিলাম দুজনে। আমার পরনে ছিল বাসন্তী রংয়ের শাড়ি আর আনিস পরে এসেছিল সবুজ রংয়ের একটা সুতি পাঞ্জাবী। খালি পায়েই হাটতে হাটতে বুনেছিলাম আমাদের স্বপ্নের সংসার। সেদিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম যেহেতু কবিতার আসরেই আমাদের পরিচয় তাই বিয়ের পরে মেয়ে হলে নাম রাখব ‘কবিতা’ আর ছেলে হলে নাম
রাখব ‘কাব্য’।
তবে আমাদের শুভ পরিণয়ের জন্য কম ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়নি। আমার বাসা হতে প্রথমে দ্বিমত পোষণ করলেও পরে আমার কথা ভেবে মেনে নেয়া হয় আর আনিসের বাসায় এক কথায় প্রেমের বিয়ে মানে খারাপ এমন একটা মনোভাব নিয়ে হলেও আমাদের দিকে তাকিয়ে মেনে নেয়।
< ২ >
সুখের সংসার রচনায় দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম। এই সংসারকে আলোকিত করতে জন্ম নিলো কবিতা মানে আমাদের মেয়ে। মেয়ের মুখ দেখে আনিস তার সকালটা শুরু করতে লাগল আর অস্থির হয়ে থাকত কবে মেয়ের মুখ হতে ‘বাবা’ ডাক শুনবে। নিজেই স্বপ্ন বুনত মেয়েকে প্রথম কোন কবিতা শেখাবে আর মেয়ের মুখ হতে কোন কবিতাটা প্রথম শুনবে। আমিও আনিসের সাথে স্বপ্নের জাল বুনতাম কি বলে মেয়ে আমাকে ডাকবে মা, মামণি,
না আম্মি?
কবিতাময় সংসার ভালোই লাগতো। সন্ধ্যা হলেই, আনিস বাসায় ফেরার পর হতে কবিতাকে মধ্যমণি আর নীরব দর্শক সাজিয়ে আমরা আমাদের কবিতার আসর জমিয়ে ফেলতাম।
কবিতার বয়স যখন দু বছর ছুঁই ছুঁই, ঠিক তখনই লক্ষ্য করলাম কবিতা আমাদের কথার সাথে মাথা নেড়ে নেড়ে তাল মেলাতে পারে; কিন্তু একটা শব্দও বলতে পারেনা।
< ৩ >
কবিতাকে ডাক্তার দেখালাম, বলল কবিতা হয়তো দেরিতে কথা বলা শিখবে। চার বছরে পা দেবার পথে কবিতা, কিন্তু একটা শব্দ ওর মুখ হতে বের হতে দেখলাম না শুধুই আমাদের কথার সাথে তাল মেলাতে থাকত মাথা নেড়ে নেড়ে। তাই ডাক্তারের কাছে আবার নিয়ে গেলাম। ডাক্তার অনেক রকম পরীক্ষা করে জানালেন কবিতা অটিজম আক্রান্ত একজন শিশু। ওর স্বাভাবিক বিকাশের জন্য দরকার সকলের অক্লান্ত ধৈর্য আর সেবা।
কবিতার পরিবর্তে অন্য কারো মুখেতো বাবা ডাকটা শুনতেই হবে আনিসের তাই কবিতার বয়স যখন ছয় তখন এলো আমাদের পুত্র সন্তান কাব্য। কিন্তু নিউমোনিয়া হয়ে কাব্য কিছুদিন আলোকিত করে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। এখানেই যেন আনিসের কুসংস্কার আচ্ছন্ন পরিবার নতুন অপবাদ দেবার সুযোগ খুঁজে পেল। তাই আনিসের কানের কাছে প্রতিদিন বলতে লাগল আমরা নাকি পাপ করেছি মানে প্রেমের বিয়ে তাই আমাদের সন্তানদের আজ এ
অবস্থা। একটা মানুষ কেমন করে অন্যের প্ররোচনায় পাল্টে যায় তা আমি আনিসকে দেখে জানতে পারলাম। আনিস আবার বিয়ে করে।
আর আমি আমাদের, না আমাদের কেন হবে! কবিতা আমার, তাকে নিয়ে নিয়ে আলাদা থাকতে লাগলাম। আমি যে মা, তাই ওকে ছেড়ে যাই কেমন করে। আর সেই সাথে ওকে ভর্তি করিয়ে দিলাম একটা স্পেশাল চাইল্ডের স্কুলে আর আমিও সেখানে নিলাম চাকরি।
এখন আমার কবিতার মতো কাব্যদের নিয়ে আমার ভালোই দিন কেটে যাচ্ছে। আমি এখন সবার মা মামণি আম্মু আর আম্মি। তাদের পরিচয় করিয়ে দিতাম আমাদের বাংলা ভাষার সাথে কোন কিছুর সাথে তুলনা করে। ছবির মাধ্যমে তাদের শেখাতে লাগলাম। যেমন শহীদ মিনারের মাঝ স্তম্ভকে দেখিয়ে শিখালাম ‘মা’ শব্দটি আবার হাতের কৌশল রপ্ত করে তার প্রয়োজনীয় বস্তুটি কিভাবে চাইতে হয় তাও শেখাতে লাগলাম। এখন আমি একজনের নয়
অনেক সন্তানের জননী। কখন আমার বেলা কেটে যায় এদের সাথে চলতে চলতে আর এদের আবদার মেটাতে মেটাতে তা খেয়ালই থাকে না।
< ৪ >
আজ ৮ই ফাল্গুন। ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য সরকারি ছুটিও বটে। তাই ভাবলাম এতো বছর পর নিজ কর্ম ব্যস্ত দিনের ফাঁকে আপনজনের সাথে একটু সময় কাটাই। তাই বহু বছর পরে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই অবস্থিত আমার বড় বোনের বাসায় এসেছিলাম। ফেরার পথে কোন যানবাহন না পাওয়ায় কবিতাকে নিয়ে মেডিকেলের মোড় দিয়ে একটু একটু করে ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ায় আমি ব্যস্ত এমন সময় কবিতা আমার
আঁচল ধরে বারবার টানছিল। এটা আমার কাছে নতুন কিছু না। ও নতুন কিছু দেখলেই এমন করে তাই আমি ভিড় এড়ানোতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কিন্তু একটা শব্দ আমার গতিপথ রোধ করতে বাধ্য করল।
তা হল
“মা”
আমি প্রথমে খেয়াল করিনি পরে যখন খেয়াল করলাম দেখি, কবিতার এক হাত আমার আঁচলে আরেক হাত কিছুকে নির্দেশ করছে। আর ওর মুখ হতেই বের হয়ে এসেছে একটাই শব্দ যা কিনা শহীদ মিনারের মাঝ স্তম্ভকে নির্দেশ করে উচ্চারিত হচ্ছে।
কবিতার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক আর মুখ হতে বহু কষ্টে একটাই শব্দ তখন বারবার উচ্চারিত হচ্ছে।
আমি তখন মেয়ের গালে আর কপালে আদর দিয়ে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি,
“এমনই ফাল্গুনের দিনে কয়েকজন মা হারিয়েছেন তাদের সন্তানের মুখ হতে মা ডাক শোনার আশা,
আর আমি পেলাম তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমার সন্তানের মুখের সুমধুর মা ডাক শোনার ভাষা।”
পরিশিষ্ট:
অটিজম আক্রান্ত ব্যক্তিকে সহজে বোঝা যায় না। তাদেরও অন্য আর স্বাভাবিক মানুষের মত সাহস এবং দুর্বলতা দুটোই থাকে। তারা আমাদের কাছ হতে রহস্যময় বা অপার্থিব আচরণ আশা করে না। আপনার আর আমারই মতো সেও সবার কাছে ভালোবাসা আশা করে।
উৎসর্গ:
তাঁদের প্রতি যাদের জন্য আমি এমন একটি গল্প নিজ মাতৃভাষায় লিখতে পারলাম।
-আফরিন জাহান
অদ্ভুত ধরণের একটা ভালো লিখা…
চোখের পানি আটকে রাখতে পারি নি, এতো অসাধারণ লিখা।
আশা করি নিয়মিত লিখবেন, অপেক্ষায় রইলাম!
ব্যতিক্রম একটা বিষয়ে চমৎকার গল্প…।
ঐ শিশুটার জায়গায় নিজেকে ভাবলেই তার তার কষ্টটা কিছু বোঝা যায়।
আরো লিখবেন আশা করি 🙂
অসাধারণ :love:
খুব ভালো লেগেছে
আশা করি নিয়মিত লিখবেন 😀
অসাধারণ লিখেছেন তো আপু।
কেন যেন একটুও মনে হচ্ছিল না পড়ার সময়, যে এটা গল্প।
সরবে নিয়মিত চাই কিন্তু আপনাকে! 🙂
আসলেই মনেই হয়নি এটা কোন গল্প……
“এমনই ফাল্গুনের দিনে কয়েকজন মা হারিয়েছেন তাদের সন্তানের মুখ হতে মা ডাক শোনার আশা,
আর আমি পেলাম তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমার সন্তানের মুখের সুমধুর মা ডাক শোনার ভাষা।”
যেন এটি ইতিহাসের পরবর্তী অংশ। গল্প লিখতে কখনো ইচ্ছা হতো না, এটা পড়ে হলো। আরো চাই আপুনি প্লিজ
অসাধারণ আপু, পড়ে থমকে গেলাম।
আবেগে, ভালোবাসায় চোখের জলে একাকার হলাম।
পৃথিবীর সব মায়েদের জন্য ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা।
:welcome: আপু।
আপনাকে নিয়মিত দেখতে চাই।
অনেক অনেক ভালো লাগলো লেখাটা। মানুষের মনের কুসংস্কার দূর হয়ে যাক-এটা কামনা করে যাই প্রতিক্ষন।
অটিজম আক্রান্ত শিশুদের নিয়ে সচেতনতা আমাদের মধ্যে গড়ে তোলা অনেক বেশি প্রয়োজন। নিজেদের ঘরেও এমন কেউ চলে আসতে পারে যে কোন সময়।
নিয়মিত লিখবেন আশা করছি…… 🙂