উঁহু, বলিউডের সালমান খান নন। জন্মসূত্রে বাংলাদেশি এই সালমান খান হচ্ছেন একজন শিক্ষাবিপ্লবী, যাঁর নাম জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের চিরাচরিত একঘেয়ে পড়াশোনার নিয়ম পালটে কীভাবে একে মজাদার করে তুলছেন এই মানুষটা, তা নিয়ে গত বছরের জুলাইতে wired.comএ প্রকাশিত হয়েছিল সাংবাদিক ক্লাইভ থম্পসনের এই লেখাটা ((http://www.wired.com/magazine/2011/07/ff_khan/all/1)) – যার অনূদিত আর কিছুটা রূপান্তরিত সংস্করণ দুই পর্বে পড়তে পারবেন আমার এই ব্লগবাড়িতে।
সালমান খান শেখার ধরন বদলে দিচ্ছেন যেভাবে – ১
খানের লেকচার শুনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর আপনি যদি লাভজনক প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি কোন শিক্ষামূলক ভিডিও দেখতে যান, সেগুলো বিরক্তিকর রকম মেকি শোনাবে কানে। কোষঝিল্লীতে সোডিয়াম-পটাশিয়াম পাম্প কীভাবে কাজ করে, তা নিয়ে তৈরি একটা ইউটিউব ভিডিও বের করে আমাকে দেখালেন খান তাঁর ডেস্কে বসে। লেকচার শুরু হলে সুরেলা এক নারীকণ্ঠ এমন ঢঙে পড়া বোঝাতে শুরু করলো, যেন ধরেই নিয়েছে যে তার শ্রোতারা সব নির্বোধ। “কী আর বলবো, আমি তো টানা এক মিনিট ধরেও এই জিনিস শোনার কথা ভাবতে পারি না,” তিনি বলেন।
শিক্ষকেরা সচরাচর এড়িয়ে যান, গণিতের এমন সব খুঁটিনাটি লুকোনো সমস্যাও খান চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেন – বেশ কিছু শিক্ষার্থীর মুখেই এরকমটা শুনেছি আমি। এখনও কোন কিছু ঠিকমত বুঝতে পারে নি, এমন একজন মানুষের চিন্তাভাবনা অনুসরণ করতে পারার একটা আশ্চর্য ক্ষমতা আছে খানের। “এ থেকে বি-তে কীভাবে যেতে হবে সেটা আপনি আগে থেকেই জানেন – এমন কোন ধারণা মনে না রেখে খান সবসময়েই প্রত্যেকটা সমস্যা ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করেন,” ব্রান্নানের মন্তব্য।
“খানের এই সবকিছু চমৎকারভাবে বোঝাতে পারার ক্ষমতাটা আসলেই মুগ্ধ হওয়ার মত। একজন মানুষ একাই যে কীভাবে এতগুলো বিষয়ে দক্ষ হতে পারেন ভাবলে অবাক লাগে,” গেট্স বলেন।
গত নভেম্বরে ওয়েবসাইট থেকে ক্লাসরুম সহায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘খান একাডেমি’: সেবার লস আল্টস স্কুল বোর্ডের এক সদস্য খানের সাথে কথা বলে জানালেন, তারা ক্লাসে তাঁর পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখতে ইচ্ছুক। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য তিনটা স্কুল তাদের ক্লাস দিতে রাজি হল – ফিফ্থ গ্রেডের দুটো(যার একটার শিক্ষিকা হলেন কামি থরডারসন) আর সেভেন্থ গ্রেডের দুটো।
ছেলেমেয়েরা ঠিক কীভাবে কিছু শেখে – তা নিয়ে শিক্ষকদের জরুরি কিছু ধারণা দিতে পারবেন বলে খান ভাবছিলেন। তিনি এমন একটা ড্যাশবোর্ড পদ্ধতি তৈরির কথা ভাবলেন – যেটা কোন্ শিক্ষার্থী কতগুলো ভিডিও দেখেছে, কতগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, কোন্গুলো পেরেছে/পারে নি সব মিলিয়ে প্রত্যেকের সম্পর্কে একটা করে আলাদা রিপোর্ট দেবে। এসব ব্যাপারে এমনিতে শিক্ষকদের ধারণা খুব কম থাকে – বলাই বাহুল্য। কুইজ, বাড়ির কাজ আর নিজেদের বিচারবুদ্ধি দিয়ে তাঁরা বোঝার চেষ্টা করেন কে কতটা বুঝতে পারছে – কিন্তু এই পদ্ধতি অনেকটাই অনুমাননির্ভর। যত দিন যায়, এভাবে কোন শিক্ষার্থীর অগ্রগতি যাচাই করা ততটাই কঠিন হয়ে পড়ে। ড্যাশবোর্ড এই অবস্থা বদলাতে চমৎকার কাজ করতে পারে, খান বলেন।
গুগল আর গেট্সের কাছ থেকে অর্থসাহায্য পেয়ে ২০১০এর শরতে খান একজন প্রোগ্রামার (বেন কামেন্স) আর একজন ডিজাইনার (জেসন রসফ)কে নিয়োগ দিলেন; আর অন্য সব কাজের সাথে এই ড্যাশবোর্ড বানানোর দায়িত্বও দিয়ে দিলেন তাদের হাতে। ব্যবসাজগতে এধরনের দক্ষতা মাপার সফ্টওয়্যারের ব্যবহার আজকাল এত বেশি বাড়ছে, শিক্ষকেরা যে এতে খুব একটা মুগ্ধ হবেন এমনটা ভাবেন নি দুজনের কেউ-ই। অথচ মুগ্ধ তো হলেনই, তাঁরা রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! “যতবারই আমরা কিছু তথ্য যোগাড় করে একটা চার্ট বানাতাম, সেটা দেখে শিক্ষকেরা আকাশ থেকে পড়তেন,” কামেন্স বলেন। “এমন কিন্তু না যে এই ড্যাশবোর্ড অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কিছু। অথচ তাঁদের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হত এমন জিনিসের অস্তিত্বই কখনও ছিল না!”
লস আল্টসের এগান জুনিয়র হাইয়ের গণিতের শিক্ষিকা কোর্টনি ক্যাডওয়েল হচ্ছেন এসব বিস্মিত শিক্ষকদের একজন। তাঁর ক্লাস দেখতে গেলে তিনি আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন ল্যাপটপে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের রিপোর্টগুলো দেখাতে। কোন্ বাচ্চা কোন্ বিষয় নিয়ে পড়ছে, কতগুলো ভিডিও দেখেছে, কতগুলো সমস্যা সমাধান করেছে – রঙিন সব চার্টভর্তি এসব তথ্য দেখাতে লাগলেন তিনি আমাকে। বাসায় কে কতক্ষণ পড়াশোনা করেছে সেটা পর্যন্ত সফ্টওয়্যারটা জানিয়ে দিচ্ছিল ক্যাডওয়েলকে!
“এ কী!” এক ছাত্রের অ্যাকাউন্টে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি। “ক্রিস্টোফার সিস্টেম্স অফ ইকুয়েশন্স আর ভগ্নাংশের বিয়োগ করছে!” বোঝাই যাচ্ছিল, ৫ মাস ধরে ব্যবহারের পরেও এই সফ্টওয়্যার এখনও তাঁকে অবাক করে চলেছে। তথ্যগুলোতে একবার চোখ বুলিয়েই বুঝলাম, ছেলেমেয়েরা চমৎকার গতিতে এগোচ্ছে: দেখা গেল কোন বাচ্চা অনেকক্ষণ ধরে একটা সমস্যা নিয়ে পড়ে আছে, হঠাৎ সেই জট ছেড়ে গেলে তরতর করে এগিয়ে হয়তো বা দুই-একদিনের ভেতরেই কয়েকটা নতুন বিষয় পুরোপুরি আয়ত্ত করে ফেলেছে সে।
এই পদ্ধতিতে ক্যাডওয়েল এর মধ্যেই এতটা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, যে অন্যান্য ক্লাসে পুরনো নিয়মে পড়াতে গেলে ক্লান্ত হয়ে পড়েন তিনি। “ওসব ক্লাসে কুইজ কিংবা কোন পরীক্ষা নিতে গিয়ে যদি দেখি যে কেউ কিছু জানে না, কিংবা কেউ যদি অনেক ভাল করে ফেলে – হতভম্ব হয়ে পড়ি আমি।”

ঘরে বসেই লেকচার শুনতে পারে কার্পেন্টারের মত বাচ্চারা
ক্যাডওয়েল তাঁর স্কুলের একটু পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদেরকে গণিত শেখান। এদের অনেকের বাবা-মাই অন্য দেশ থেকে এসেছে, তাই বাসায় তারা পড়াশোনায় তেমন সাহায্যও পায় না ইংরেজি-না-জানা পরিবারের কাছ থেকে। গত শরতে তার সেভেন্থ গ্রেডের ক্লাসে যারা এলো, তাদের অনেকের থার্ড গ্রেডের গণিত করার জন্য দরকারি দক্ষতাও ছিল না! কিন্তু ‘খান একাডেমি’র কারণে ঠিক সময়মত প্রত্যেককে সাহায্য করতে পারায় আশ্চর্য ব্যাপার ঘটলো: বছরের অর্ধেক যেতে না যেতেই সবার স্কোর ১০৬%এরও বেশি বেড়ে গেল। এক মেয়ের উন্নতির হার এত বেশি – ৩৬৬%! “গণিত এত বিচ্ছিরি লাগতো আমার,” খুশিমনে বললো মেয়েটা, “কিন্তু এখন বরং মজার লাগে।” বছরের শুরুতে যেই মেয়ে মৌলিক ভগ্নাংশ পারতো না; তাকে আমি সেদিন দেখলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে খানের সফ্টওয়্যারে ভগ্নাংশের জটিল সব বড় বড় ভাগ করতে।
পয়েন্ট, ব্যাজ, অ্যাওয়ার্ড এসব হল সফ্টওয়্যারে খানের টীমের নতুন সংযোজন – গেইমে যেমনটা থাকে, তেমন পুরস্কারের ব্যবস্থা। এসব পুরস্কার ছেলেমেয়েদের উৎসাহকে কোন্ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে সেটা দেখে লস আল্টসের শিক্ষকেরা এক কথায় নির্বাক! সান্তা রিতা এলিমেন্টারিতে কেলি র্যাফার্টির ফিফ্থ গ্রেডের ক্লাসে গিয়ে দেখি বাচ্চারা খুশিমনে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, একজন আরেকজনের ল্যাপটপে তার স্কোর কত হল সেটা দেখে আসছে, দরকারমত সাহায্যও করছে। ভাগ অঙ্ক নিয়ে বসে আছে এক ছেলে, তাকে দেখিয়ে র্যাফার্টি বললেন, “৫০০র মত গুণের অঙ্ক করে ফেলেছে ও এর মধ্যেই। এই কাজ আমি কোনদিন ওকে দিয়ে করাতে পারতাম বলে মনে হয়? কক্ষনো না! ঠিক কিসে যে ওদের আগ্রহ জাগে – ভাবতে আসলে অবাকই লাগে।” বলতে বলতেই ড্যাশবোর্ডে দেখলেন, এক শিক্ষার্থী আগের দিন মাঝরাত থেকে দুটো পর্যন্ত জেগে ছিল অঙ্ক করার জন্য।
অবশ্য খানের সাইটে যে কোন দুর্বলতা নেই এমনও নয়, বিশেষ করে যেসব বাচ্চারা কম্পিউটার ব্যবহার করে অভ্যস্ত তারা সহজেই ফাঁকফোকর বের করে ফেলে। অনুশীলন করতে গিয়ে ফাঁকি দেওয়ার উপায়ও বের করে ফেলেছে তারা – যেমন লগারিদমের এমসিকিউতে সবসময় তিন নম্বর উত্তরটাই ঠিক হয়।
আবার, শিক্ষকেরা যে তাদের সব কাজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারে – এটাও পছন্দ করছে না কিছু ছেলেমেয়ে। “আমার কেমন যেন অদ্ভুত লাগে এটা,” আমার সামনেই ১২ বছরের ম্যাডি জিব বললো ক্যাডওয়েলকে। “মনে হয় যেন আমাদের পারদর্শিতার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছেন আপনি! শিক্ষিকা হিসেবে এটাই যে আপনার দায়িত্ব সেটা জানি, কিন্তু তবুও।”
সব শিক্ষাকর্মীই যে খান আর তাঁর সাইটের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন এমন কিন্তু না। গ্যারি স্টেইজারের কাছে ‘খান একাডেমি’কে মোটেও উদ্ভাবনী কিছু মনে হয় নি। বহু বছর ধরে শিক্ষা বিষয়ক পরামর্শক স্টেইজার ক্লাসে ল্যাপটপ ব্যবহার চালুর চেষ্টাও করছেন। লেকচার দেওয়া আর অনুশীলন করানোর সেই পুরনো একঘেয়ে নিয়মেরই উন্নত সংস্করণ হচ্ছে এই ভিডিও আর সফ্টওয়্যার মডিউলগুলো – তিনি মনে করেন। স্কুলগুলো সব হয়ে গেছে “পরীক্ষাপ্রস্তুতির নিরানন্দ কারখানা”, সেটাকেই আরও উস্কে দিচ্ছে খানের এই উদ্যোগ। খানের কাজ “অনেকটা ‘সবার ওপরে স্কুল সত্য’ গোছের ভাবনাতাড়িত – তারা কখনোই স্কুলগুলোর কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না, কিংবা তাদের পড়ানোর কৌশলে ভুল ধরবে না”; খান যে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির জন্য কাজ করছেন তার প্রশংসা করেছেন স্টেইজার, তবে সেই সাথে এ-ও বলেছেন, অঙ্ক-না-পারা ছেলেমেয়েদেরকে যে কখনোই তাঁর পদ্ধতিতে শোধরানো যাবে না – গবেষণা এমনটাই বলে।
‘জেনারেশন ইয়েস’এর প্রেসিডেন্ট সিলভিয়া মার্টিনেজও বলেন, “তারা যা করছে – ক্লাসরুম আর বাসার কাজগুলো উলটে দেয়া – সে জিনিস আগেও ছিল।” ক্লাসরুমে প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে কাজ করছে মার্টিনেজের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এই পদ্ধতি বেশিরভাগ বাচ্চার ওপরেই কাজ করবে না বলে তাঁর ধারণা: কারণ যে ক্লাসে একটা জিনিস বুঝতে পারে না, সে যে বাসায় ভিডিও দেখে একই জিনিস বুঝতে পারবে সে সম্ভাবনা কম।
খানের সমালোচকদের বেশিরভাগই সংস্কারপন্থী – তাঁরা মনে করেন, সচরাচর পদ্ধতিতে গণিত শেখালে শিক্ষার্থীরা যে আগ্রহ হারায় তার কারণ, এতে প্রতিদিনকার জীবনের সাথে সম্পর্কহীন যান্ত্রিক সব নিয়মে সমস্যা সমাধান করতে শেখানো হয়। তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে বাচ্চাদেরকে এমন সব কাজ করতে দেওয়া যাতে তারা নিজে থেকেই গণিত আর পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলো আবিষ্কার করতে শেখে, যেমন ‘লোগো’র মত ছোটদের উপযোগী প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে দেওয়া যায় তাদেরকে। “ছেলেমেয়েরা ঠেকতে ঠেকতেই শেখে, আর এই পদ্ধতির কোন শর্টকাটও নেই,” খানের কাজের তীব্র সমালোচনা করে লেখা মার্টিনেজের ব্লগ পোস্টে এমনটাই বলা হয়েছে। একদিকে গেট্স আর খান বলছেন যে তাঁরা ক্লাসরুমটাকে প্রাণবন্ত করার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে সমালোচকদের মতে – তাঁদের উদ্যোগ আরও সাহসী হওয়া উচিত ছিল।
খান তাঁর বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন একেবারেই। “আসল ঘটনা পুরোই উলটো!” তিনি বলেন: লেকচারের ভিডিওগুলো ছেলেমেয়েরা যত ঘরে বসে দেখে নিতে পারবে, ক্লাসের বেচে যাওয়া সময়ে শিক্ষকেরা তাদের নিয়ে ততই সৃজনশীল কাজ করতে পারবেন। “এতে ক্লাস আরও স্বতঃস্ফূর্ত হবে, আরও প্রাণবন্ত হবে,” তিনি বলেন। গণিত শেখার জন্য বাচ্চাদেরকে প্রত্যেকটা সূত্র নিজে থেকে আবিষ্কার করতে হবে – সংস্কারপন্থীদের এই ধারণাটাকে তাঁর কাছে বোকামি মনে হয়েছে। “বীজগণিতের বই হাতে না পেলে আইজ্যাক নিউটন কখনও ক্যালকুলাস আবিষ্কার করতে পারতেন না।” বিল গেট্সের প্রতিক্রিয়া আরও তীব্র: “বাজে কথা সব!” তিনি বলেন। “সামান্য গুণের অঙ্কই যদি না করতে পারে কেউ, তাহলে তারা সমাজের জন্য কী করতে পারবে বলুন?”
গণিত কিংবা রসায়নের মত যেসব বিষয়ের উত্তরগুলো নিশ্চিতভাবেই ঠিক কিংবা ভুল হয়, খানের সফ্টওয়্যার কেবল সেগুলো নিয়েই কাজ করে। কিন্তু ইতিহাসের মত আরেকটু অগোছালো, রচনামূলক বিষয়গুলো নিয়ে খানের ভিডিও তুলনামূলকভাবে কম।

খানের মতে, আকর্ষণীয় কিছু তৈরি করলে মানুষ সেটা ব্যবহার করতে বাধ্য
অন্যদিকে, লেখালেখি যদিও গণিতের মতই জটিল আর শিক্ষার্থীরা এটাতেও একই রকম খারাপ করে, এই বিষয়টা শেখার যে কোন সহজ উপায় নেই – খান আর গেট্স দুজনেই এ ব্যাপারে একমত। খানের মতে, অনলাইনে লেখা শেখানোর একটা উপায় হতে পারে – বাচ্চারা তাদের লেখা আপলোড করবে আর ক্লাসের সবাই সেটা পড়ে মন্তব্য করবে (অনেক শিক্ষক এখনও এই পদ্ধতি ব্যবহার করেন); আগামী বছরের দিকে তিনি ‘খান একাডেমি’তে একটা বিভাগ খুলতে চাইছেন, যেখানে সবাই একজন আরেকজনকে সাহায্য করবে লেখালেখি নিয়ে। সেখানে বাচ্চারা যেসব প্রশ্নের উত্তর নিজেরা বের করতে পারে না সেগুলো পোস্ট করবে, আর পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সাহায্য করবে তাদেরকে দিনের যে কোন সময়ে – আর যার উত্তর সবচেয়ে ভাল হবে তার র্যাঙ্কিং-ও তত ভাল হবে।
খানের সাফল্য তাকে স্কুল সংস্কার নিয়ে চলমান উত্তপ্ত বিতর্কের মধ্যে টেনে এনেছে। এখনকার সংস্কারকদের মতে, শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি খুবই যত্নের সাথে পরীক্ষা করা উচিত; আর তাদের উন্নতি হলে শিক্ষকদের পারিশ্রমিক যেমন বাড়ানো উচিত, অন্যদিকে ফলাফল খারাপ হলে সেজন্য জবাবদিহিতার নিয়মও চালু করা দরকার। এদের মধ্যে ওয়াল স্ট্রীট আর সিলিকন ভ্যালির বহু হর্তাকর্তা থাকলেও, খানকে এই তালিকায় ফেলতে দিতে তাঁর তীব্র আপত্তি। পাবলিক স্কুলগুলোর প্রতি তাঁর কোন খারাপ ধারণা তো নেই-ই, বরং লস আল্টসে কাজ করে বরং এসব স্কুলের শিক্ষকদের উদ্ভাবনী দিক তাঁকে মুগ্ধ করেছে বলে তিনি জানান। “আমাকে শিক্ষা সংস্কারক জাতীয় কিছু বলবেন না, ঠিক আছে?” তিনি বলেন। “আমরা রাজনীতি নিয়ে কোন যুদ্ধে নামি নি; কিছু দরকারি জিনিস তৈরি করছি কেবল।”
খান স্কুল ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তন আনলেন কিনা তা নিয়ে তাঁর নিজের তেমন মাথাব্যথা নেই। আর স্কুলগুলোর সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতেও চান না তিনি, যেহেতু তাহলে তাঁকে তাদের নিয়মকানুনগুলো মেনে চলতে হবে। এখনও পর্যন্ত নিজের বিচারবুদ্ধি ব্যবহার করেই ভিডিও আর সফ্টওয়্যারের লাইব্রেরিটা তৈরি করেছেন তিনি – প্রথমে কাজিনদের জন্য দরকারি বিষয়, আর তারপর নিজের পছন্দের কিংবা শিক্ষার্থীদের জন্য দরকারি বলে মনে হয়েছে যেগুলো, সেগুলো রেকর্ড করে। কিন্তু স্কুলগুলো একটা নির্দিষ্ট কারিকুলাম মেনে চলে, আর লস আল্টসের শিক্ষকেরা উপলব্ধি করছেন যে এর অনেক বিষয় নিয়েই খানের বিস্তারিত কোন ভিডিও নেই।
খান ধীরেসুস্থে এই কমতিগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাই বলে একেবারে উঠে-পড়ে লেগেছেন এমনও নয়, কারণ তিনি তাঁর সাইট নিয়ে কী করবেন তা স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করুক এমন কিছু তিনি চান না। বরং ৫০টা স্টেইটের অসংখ্য শিক্ষকের চাহিদা মেটাতে যাওয়াই এতগুলো শিক্ষামূলক সফ্টওয়্যার কোম্পানির দুরবস্থার একটা কারণ বলে তাঁর ধারণা: এতে করে পড়ানোর প্রক্রিয়াটা আরও নিরানন্দ আর একঘেয়ে হয়ে ওঠে। “আমি ফেরিওয়ালা গোছের কিছু হতে চাই না,” কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেন খান।
এক কথায় বলতে গেলে, খান আসলে স্কুলগুলোর শেখানোর নিয়ম বদলাতে চান না; বরং মানুষের শেখার ধরন পাল্টাতে চান – সেটা তারা প্রাইভেট স্কুলেই পড়ুক কি পাবলিক স্কুলে, স্কুলছাত্র হোক কি রান্নাঘরে বসে স্বশিক্ষিত-হতে-চাওয়া কোন বয়স্ক মানুষ, হোক ওহিয়ো কিংবা ব্রাজিল বা রাশিয়া অথবা ভারতের কেউ। খানের টীমের একজন এর মধ্যেই ভিডিওগুলোকে বহুল-ব্যবহৃত ১০টা ভাষায় অনুবাদের কাজ শুরু করেছেন। টীমের এখনকার ১৩ জন সদস্যের একজন তিনি। স্টার্টআপদের জন্য ক্ল্যাসিক পন্থা এটা: চমৎকার কিছু শুরু করুন, আর সেটা তাড়াতাড়ি করুন, তাহলে যাদের এটা ভাল লাগবে তারা নিজে থেকেই আপনাকে খুঁজে নেবে।
এই বসন্তে ক্যাডওয়েলের ক্লাসে ‘খান একাডেমি’ কেমন কাজ করছে সেটা দেখতে আসেন তাঁর স্কুলের অধ্যক্ষ। কানে হেডসেট গুঁজে বাচ্চারা একটা ভিডিও দেখছিল তখন। একেকজনের দেখার ঢং একেকরকম – কখনও বিরতি দিয়ে, প্রশ্ন জাগলে রিওয়াইন্ড করে আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে, আর ফাঁকে ফাঁকে নোট নিয়ে। কিন্তু সেখানে বসে ক্যাডওয়েলের নিজেকে অনেকটা বহিরাগত মনে হচ্ছিল। “বাচ্চারা সব একই ভিডিও দেখছে, একই জিনিস শুনছে, অথচ তার ওপর আমার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই – জিনিসটা খুবই অদ্ভুত!” তিনি বলেন।
কিন্তু অধ্যক্ষ এতে আপত্তির কিছু দেখেন নি। অনলাইনে ভাল মানের লেকচার ম্যাটেরিয়াল সহজলভ্য হওয়ার পর থেকে শিক্ষকেরা একটা জিনিস বুঝতে শুরু করেছেন – কোন কিছু বোঝানোর জন্য আপনার চেয়ে দক্ষ কেউ হয়তো অনলাইনেই আছে। তাহলে প্রতিযোগিতার কী দরকার? তার চাইতে বরং অন্যান্য যেসব সূক্ষ্ণ ব্যাপার মুখোমুখি সাহায্য করা ছাড়া শেখানোর কোন বিকল্প নেই, সেসবে মনোনিবেশ করাই ভাল।
‘খান একাডেমি’র নামও শোনেন নি কোনদিন, এমন কিছু শিক্ষককেও দেখা যাচ্ছে যে তাঁরা ক্লাসে খানের পদ্ধতি ব্যবহার করছেন: ক্লাস আর বাড়ির কাজগুলো উলটে দিয়ে তাঁরা গুগ্ল ডকের মত জিনিস ব্যবহার করেন, ছাত্রছাত্রীদের শেখা কতদূর হল তার ধারণা রাখতে। এসব দেখে মনে হয়, একসময় হয়তো ‘খান একাডেমি’র মত সাইটগুলো আসলেই ক্লাসের কাজগুলো বদলে দিতে পারবে।
‘খান একাডেমি’র কাঁধে ভর করে শিক্ষা ঠিক কতদূর এগোতে পারে, তা দেখার জন্য খান এখন তাঁর নিজের প্রাইভেট স্কুল খোলার চিন্তাভাবনা করছেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর স্কুলে বয়সভিত্তিক কোন বিভাজন থাকবে না, টীনএজাররা কিন্ডারগার্টেনারদের সাথে একসাথে বসে ক্লাস করবে। “এটা নিয়ে কোন গবেষণা নেই আমার যদিও, তারপরেও দেখেছি – ছোটরা বড়দের সামনে আর বড়রা ছোটদের সামনে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিণত আচরণ করে,” খান বলেন। এই পদ্ধতিতে বাচ্চারা স্কুলে থাকার সময়টাতে বেশি বেশি সৃজনশীল কাজ করতে পারবে। বোর্ড গেইমের মাধ্যমে নেগোশিয়েশন শেখাবেন তিনি, আর ইতিহাস শেখানো হবে উল্টো দিক থেকে। (“ইসরায়েলি আর ফিলিস্তিনিদের এই বিরোধের কারণ কী? চলো কয়েক বছর আগের অবস্থা দেখি। আরে, তখনও তো যুদ্ধ লেগে ছিল ওদের মধ্যে। তাহলে আরও পেছনে যাওয়া যাক…” অনেকটা এরকম); বাস্তবজীবনে বেশি কাজে লাগবে এমন বিষয়গুলো (পরিসংখ্যান, আইন, হিসাববিজ্ঞান, ফিন্যান্স) বাচ্চাদেরকে বেশি জোর দিয়ে শেখাবেন বলেছেন তিনি। একেক বাচ্চার জন্য ১০,০০০ ডলারের মত খরচ পড়বে হিসাব করে তিনি বলেন, “চাকুরিজীবী বাবা-মাদের জন্য যেটা সাধ্যের মধ্যেই থাকবে।”
খান সত্যিই যদি এমন কোন স্কুল খোলেন, তাহলে চমৎকার একটা সুবিধা পাবেন তিনি। ৫ বছরে অনলাইনে তাঁর পোস্ট করা ভিডিও দেখে শিক্ষার্থীরা ৫০ মিলিয়নেরও বেশি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে: মানুষ কীভাবে শেখে আর কোথায় গিয়ে ঠেকে যায় তার পাহাড়সমান বিশাল এক তথ্যভাণ্ডার আছে এখন তাঁর আর তাঁর টীমের কাছে। এই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে অজানা সব প্যাটার্ন আবিষ্কার করার পরিকল্পনা আছে খানের। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তার আগে ক’বার লেকচার শুনতে হয়, কোন বিষয়ে কোন্ কোন্ শিক্ষার্থী ঠেকে যাচ্ছে তা দেখে তাদের অন্য আর কী কী বিষয় আয়ত্ত করতে সমস্যা হবে – এসব বুঝতে ভাল কাজে লাগবে খানের সাইট। ভবিষ্যতে এগুলো ব্যবহার করে খান প্রত্যেক বাচ্চার শেখার ধাঁচের সাথে আরও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ জিনিস তৈরি করতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস।
কিন্তু এই ফাঁকে আরও অনেক ভিডিও রেকর্ড করতে হবে তাঁকে। অফিসে বসে হেডসেটে মাথা গলিয়ে নিলেন তিনি। এর পরের ভিডিওটা হবে ডায়াবেটিস নিয়ে, আর তার মধ্য দিয়ে “যে কোন মূহুর্তে একজন গড়পড়তা মানুষের রক্তে প্রায় এক চা-চামচ শ্যুগার থাকে” – এ ধরনের টুকটাক সব হিসাব-নিকাশও ঢুকিয়ে দেবেন তিনি শ্রোতাদের মাথায়। খুশিমনে আমাকে এই কথা বলে ঘুরে বসে খান ‘রেকর্ড’ বোতাম চেপে কথা বলা শুরু করলেন।
কী অসাধারণ ! কী ডেডিকেশান একটা মানুষের !! দুনিয়া বদলাবেই, খান সে ক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে। এখন তাঁর পথে আমাদেরকে একটু হাঁটতে হবে, এই যা !! আমাদের স্কুল-কলেজ গুলোতে কি এ পদ্ধতি অনুসরন করা যায়? আমাদের শিক্ষাবীদদের এ ব্যাপারে মাথা ঘামানোর জন্য অনুরোধ করে দেখলে কেমন হয় ?
মানুষ ভলান্টেয়ারিলি কত চমৎকার সব কাজ কত সময় নিয়ে করেন, দেখলে মনটাই ভরে যায়।
আমাদের দেশে আংশিকভাবে হয়তো যাবে, তবে পুরোপুরি আসতে সময় লাগার কথা। যেমন এখানে তো সবার কম্পিউটারে অ্যাক্সেস নাই। ল্যাপটপের ব্যবস্থা করতে পারলে তখন অনেক সহজ হয়ে যাবে হয়তো জিনিসটা।
ভেবে দেখো আর কি! তোমরাই তো ভাববা এগুলি নিয়ে। 😀
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। অনেক পরিশ্রমের লেখা বুঝা যাচ্ছে। আমি নিজেই ফাঁকিবাজ। লেখাটার অনুবাদ ফাটাফাটি হইসে। ভাল লাগছে পড়ে।
আমি নিজেও কম ফাঁকিবাজ না! :babymonkey:
ধন্যবাদ। 😀
আমি আর কতবার এই মানুষটার কাজের প্রতি ডেডিকেশনের প্রেমে পড়বো? :thinking:
একদিন যদিও আমারও এমন একটা……… (স্বপ্নাহত) 😐
দোয়া!
একটানে পড়ে ফেললাম…… 🙂
ধন্যবাদ সামিরা, চমৎকার অনুবাদের জন্য…… 🙂
একটানে পড়ার উপযোগী হয়েছে তবে! 😀
সালমান খান এর জন্য অনেক অনেক শুভকামনা । আর তাঁর এই শুভ কাজকে যিনি নিজ দায়িত্বে প্রচার কাজ করছেন, তার জন্যেও শুভকামনা । :clappinghands:
আপনার জন্যেও শুভকামনা আপা! 😀 😀
দারুণ 😀
তুমি এত কষ্ট করো কি ভাবে? 😛
চমৎকার অনুবাদ :love:
হাহা। তুমি যেভাবে কষ্ট করে পড়ো! এত বড় বড় লেখা। 😀
কীভাবে করি পরে বলবো ইনশাআল্লাহ্।
আহারে! আমার স্কুল লাইফে যদি এই সুযোগগুলো পেতাম…
সেটাই! 🙁