নৌকা ও প্রজন্মের কথা

বেশ হুট-হাট করেই নৌকাটাতে চড়ে বসলাম। গলা হাঁকিয়ে বললাম মাঝিকে, “সলিম ভাই, চলেন দেখি, ওপার থেকে একটা রাউণ্ড মেরে আসা যাক।” মাঝবয়েসী হাড় জিরজিরে শরীরের সলিম ভাই কোনো কথা না বলে বৈঠা তুলে নিলো; সাথে ওর ছেলেটাও এগিয়ে এসে নৌকায় হাত লাগালো। নৌকাটাকে পাড় থেকে ঠেলে দিয়ে চড়ে বসলো নিজেও। আর এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো আমাদের বৈকালিক নৌকাভ্রমণ।

আমরা বলতে মোটে জনাছয়েক ভার্সিটিপড়ুয়া যুবক। এ মুহূর্তে নৌকাটাতে যাত্রী বলতেও তাই। ছিমছিম এ নদীটা আমাদের ক্যাম্পাস লাগোয়া। ক্যাম্পাসে আমাদের বেশ প্রভাব আছে। আর সে সূত্রেই এ এলাকার সবাই আমাদেরকে চিনে এবং সমীহ করে। অবশ্য না করেই বা উপায় কি; আমরা যে সোনার ছেলে!

 

সলিম মাঝি একতালে বেয়ে যেতে থাকলো তার শরীরেরই মতো জীর্ণ ভগ্নশরীরের নৌকাটাকে। আর এদিকে আমরা মানে শহীদুল ভাই, গুলাম ভাই, রকি, কিসলু, বিপ্লব আর আমি মেতে উঠলাম জমজমাট আড্ডাতে। বিকেলটা সুন্দর। আমরা গান গাইতে থাকলাম। সেই সাথে শহীদুল ভাইয়ের সৌজন্যে স্পেশাল ব্র্যাণ্ডের সিগারেট। এখানে কিসলু ছাড়া গানের গলা কারোরই তেমন ভালো নয়। বরং এইসব গলায় স্লোগানই ভালো যায়। তবু হেঁড়ে গলার চিৎকারে বিদীর্ণ করতে থাকলাম শান্ত নদীতীরের শান্ত বিকেলটাকে। তারপর একসময় আড্ডা থিতিয়ে এলো। শান্ত নদীটা কি এক অজ্ঞাত যাদুতে সবাইকে সম্মোহিত করে ফেলেছে। তখন কিসলুই শুধু গলা ছাড়ল। এ ছেলেটা আসলেই বেশ গায়। একে একে গেয়ে যেতে লাগলো-

 

“ও নদী রে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে…”

 

“এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা, সুরমা নদীতটে…”

 

“যদি রাত পোহালে শোনা যেত বঙ্গবন্ধু মরে নাই…”

 

সন্ধ্যার আঁধারটা যেন ঝুপ করেই নেমে এলো। মাঝি কখন যে ওপার থেকে নৌকা ঘুরিয়েছে টেরও পাই নি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।  কিন্তু বৃষ্টিতে ভেজার মতো প্রস্তুতি কারোরই ছিল না। মাথা বাঁচাতে সবাই এসে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলাম নৌকার ছোট্টো ছঁইটাতে। নৌকাটা বেশ ছোটো। এতক্ষণ ভেতর-বাইরে ছড়িয়ে বসায় টের পাই নি।

 

রকি ওর বিশাল বপু নাড়াতে গেলে কোথায় যেন ক্যাঁক করে ঊঠলো নৌকাটা। সাথে সাথে টের পাওয়া গেলো না। কিন্তু পুরনো জীর্ণ-শীর্ণ নৌকাটার বড় কোনো ক্ষতি করার জন্যেও ওটুকুই যথেষ্ট ছিল। ছোট্ট ছিদ্রটা বড় হতে লাগলো। আর সেই সাথে ঢুকতে থাকা পানির পরিমাণও বাড়তে থাকলো। যদিও পাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছি, তবু কিছুটা আতঙ্ক বোধ করলাম। মাঝির মুখের দিকে তাকালাম। না, কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। নির্বিকারভাবে বৈঠা বেয়ে যাচ্ছে; শুধু আগের চেয়ে কিছুটা দ্রুততালে। আমি আর শহীদুল ভাই তাড়াতাড়ি গিয়ে পানি সেঁচতে লাগলাম। এভাবেই একসময় পাড় এসে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা। একে একে পাড়ে উঠে এলাম। গুলাম ভাই স্লোগান দিল, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।” এ মুহূর্তে এ স্লোগানের মাহাত্ম্য না বুঝলেও তাকে ভালো করে চিনি বলেই খুব একটা অবাক হলাম না। বরং আমরাও সমস্বরে গলা ছাড়লাম, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।”

 

আধভেজা শরীরটা যথাসম্ভব ঝেড়ে নিয়ে আমরা ক্যাম্পাসের দিকে রওনা হলাম। তার আগে শহীদুল ভাই মাঝির দিকে দু’খানা শতী-নোট বাড়িয়ে দিলেন। না দিলেও যে চলত না, এমন নয়। এখানে কোনো কিছুর বিল পরিশোধ করাটা যে সম্পূর্ণই আমাদের মর্জির উপর তা সাধারণ মানুষ বলতে গেলে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছে। তবু আজকের আবহ আর নৌকার ফাটল শহীদুল ভাইয়ের মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন এনেছে। দেখলাম বেশ উদারভাবেই পিচ্চিটাকেও আরও একশ টাকা হাতে গুজে দিলেন।

 

অবশ্য শহীদুল ভাইয়ের এত উদার হওয়ার পিছনে আরও একটা কারণ থাকতে পারে। গত দুইরাতে ভালই ইনকাম হয়েছে। যেসব হারামজাদারা আগে মাল ছাড়তে গড়িমসি করতো, সপ্তাহখানেক আগে বজলুর দোকানে ঘটনাটার পর তারাও বেশ লাইনে চলে এসেছে। আর হল থেকে কালাম এর হারামীগুলারে বের করতে পারায় গোটা হলটাই এখন আমাদের। এ বছর তাই সিট-বিজনেসটাও ভালোই জমার কথা।

 

নদীর পাড়ের বিলকিসএর দোকান থেকে দু’বোতল করে ভদকা আর হুইস্কি নিয়ে নিল গুলাম ভাই। এটা রাতের পার্টির জন্য। তারপর স্লোগান দিতে দিতে এই পল্লী এলাকার সিক্ত সন্ধ্যাবেলাটাকে বিদীর্ণ করে আমরা ক্যাম্পাসের দিকে পা বাড়ালাম। শুধু যাবার আগে একবার পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখি, সলিম মাঝি তখনো বৃষ্টি উপেক্ষা করে নৌকার দেখভালে ব্যস্ত। তার মুখটা তখনো আগের মতোই নির্বিকার, তবু বোঝা যায় তার যত চিন্তা ঐ জীর্ণ নৌকাটাকে নিয়েই।

 

আমরা তখন নিজেদের আমোদে ব্যস্ত; জীর্ণ নৌকা আর ঐ শীর্ণ লোকটাকে ভাবার সময় কোথায়….

 

শুধু কেন জানি এই অর্বাচীনের মনে পড়লো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালির কথা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কথা। তিনি গড়েছিলেন একটি স্বপ্ন কে; একটি স্বাধীন দেশ, সোনার দেশ গড়ার স্বপ্ন। আর আমরা? স্বপ্নপূরণে নয়, যেন মেতে উঠেছি সর্বনাশা ভাঙ্গনের খেলায়; ধ্বংসের তাণ্ডবে……

 

স্তব্ধ হলাম নিজের কাছেই। মনে মনে বললাম, “হে দিনবদলের যোদ্ধা, তোমাকেই যে আগে বদলাতে হবে……”

বাংলামায়ের ছেলে সম্পর্কে

বাইশবছরের তরুণযুবা, যে স্বপ্ন দেখে আকাশছোঁয়ার, পথ চলে অফুরান আত্মবিশ্বাসে। ভীষণ ভালোবাসে এই দেশটাকে, চেষ্টা করে রাজনীতি সচেতন থাকার। ভালাবাসে লেখালেখি করতে। কখনো কখনো মুখভর্তি দাঁড়ি-গোঁফে হেঁটে ফিরে চাঁদনী রাতে কিংবা ভরদুপুরে, পিচঢালা রাস্তায় কিংবা গেঁয়ো মেঠোপথে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। পাশাপাশি জড়িত আছে বেশকিছু দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের সাথে। এইতো---
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

5 Responses to নৌকা ও প্রজন্মের কথা

  1. জ্ঞানচোর বলেছেনঃ

    শিরোনাম দেখেই ভেবে নিয়েছিলাম, সুনিচিন্তিত একটা নাগরিক পোস্ট এটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল লিখনে, নৌকা প্রজন্মের প্রতিক নামে একটা সংগঠনের লিখা দেখেছি।
    বঙ্গবন্ধুর নৌকা একটা জাতিকে ধারন করেছিল। বাঙ্গালী জাতির নিজস্ব পরিচয়ের যে অনুভূতি তৈরী করেছেন আমাদের তৎকালীন বুদ্ধিজীবিরা, সামনে থেকে সেই অনুভূতিকে রাজনৈতিক আন্দোলনে পরিণত করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী আসনটি জয় করে নিয়েছেন তিনি।

    বর্তমানে তাঁর মতো সুযোগ্য নেতৃত্ব দরকার আমাদের।

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    বর্তমান প্রজন্মের জন্য একটি নৌকা ও শক্ত হাতের মাঝি সত্যি আজ বড্ড প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।