ছাত্রত্ব কি এখন শুধুই কলঙ্ক????

হলাম না আমি ছাত্র, হলাম না বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা একজন দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব। দিলাম না বাবা-মায়ের এত দিনের তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নের এতটুকু দাম। ক্ষতি কী তাতে? ভুল কী করছি আমি? কেন ছাত্র হব? কিসের আশায় বিজ্ঞানের সহস্র সূত্র, সহস্র সমস্যার সমাধান করব? হিসাব বিজ্ঞানের হিসাব মেলাবো বা সমাজ সংস্কারের জন্য সমাজ বিজ্ঞানীদের সেই উক্তিগুলো প্রতিনিয়ত আওড়াবো? কেন?
কোন রাজনৈতিক দলের পোষ্য ছাত্র নামধারীর হাতে আমার হাজারও সহপাঠীর চোখের সামনে নির্মম ভাবে খুন হওয়ার জন্য! প্রকাশ্য দিবালোকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়ার সামনে ঐসব নরখাদকের আরেকটা শিকার হওয়ার জন্য? এর জন্যই কি এত চড়াই উৎরাই পার করে বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় পা রাখা? এর জন্যই কি হাজারো স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে, বাবা-মাকে দূরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা?

কি নিয়ে কথা বলছি বুঝতে বোধহয় পারছেন। গতকাল হঠাৎ সময় নিউজে দেখলাম একটি ছেলেকে আরও কিছু ছেলে রামদা দিয়ে কোপাচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম হয়ত আগের কোন ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে, এদেশে তো অহরহই ঘটছে এঘটনা। তার দুই একটা ভিডিও ফুটেজ থাকাটা তো অস্বাভাবিক না। কিন্তু অবাক হলাম যখন পুরো ব্যাপারটা ভালো করে দেখালো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে পুলিশ-মিডিয়ার সামনে ধারালো অস্ত্র, বন্দুক নিয়ে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া করছে আমাদের দেশের সোনার ছেলেরা ! ছাত্র শিবির আর ছাত্রলীগ ! বাহ ! একজনকে দেখলাম হাতের নিশানা কত সুন্দর , মাত্র কয়েক গজ দূর থেকে দাঁড়িয়ে একজন ছাত্রের পা বরাবর পরপর দুইটা গুলি করল, এতেও যেন তাদের ক্ষুধা মিটল না। এরপর শুরু করল দুইজন দুই পাশ থেকে কোপানো, রামদা দিয়ে। এটা তো এখনকার ট্রেডিশন হয়ে গেছে, তো সমস্যা কী? আবার অফিসে বসে থাকা পিতৃতুল্য স্টাফদের তাড়া করতেও তারা ছাড়ে নি, দুই একটা কোপ দেওয়ারও চেষ্টা করেছে।

অবাক হওয়ার পালা শেষ হয় নাই, এরপর এখনকার সামাজিক যোগাযোগের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে দেখলাম কেউ কেউ শিবিরকে বাহবা দিচ্ছে যে অনেক দিন পর গর্জে উঠল তারা ! আবার একদল লীগকে বাহবা দিচ্ছে অনেক দিন পর গর্জে উঠল তাদের আগ্নেয়াস্ত্র !! বাহ ! ! বাহ ! ! কত নীতিবান আমরা ? কত নিষ্ঠতা আমাদের নিজ নিজ দলের প্রতি, তাই না??

এই আমাদের ছাত্ররা !

 

১৯৫২ সালে ছাত্ররা রাজপথে ছিল, ১৯৭১ এ করেছি মুক্তিযুদ্ধ। একটা দেশের ছাত্রসমাজের জন্য এর চেয়ে গর্বের আর কিইবা হতে পারে? যে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ছাত্ররা জ্বলজ্বল করছে সে দেশে নিজেকে একজন ছাত্র পরিচয় দিতে পারাটা তো অনেক গর্বের ব্যাপার ছিল। কিন্তু দিনকে দিন কই হারিয়ে যাচ্ছে সেই ছাত্রত্ব ! ৭১ এ তো দেশের জন্য দেশের মঙ্গলের জন্য কলম ফেলে অস্ত্র তুলে ধরা কিন্তু আজ ! আজ কিসের জন্য ? কয়েকটা স্বার্থান্বেষী দলের জন্য , তাদের কিছু চাটুকারদের জন্য। আমি জানি এখনও আমাদের চারপাশে সেই ভাল ছেলেগুলো আছে যাদের পদচারণায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুখর হয়ে উঠে, সেই ছেলে-মেয়েগুলো যাদের চঞ্চলতায় আশেপাশের মানুষগুলো অন্যরকম এক পৃথীবির স্বাদ পায়। কিন্তু কোথায় যেন তার ছিড়ে গেছে, আমরা সবাই যেন এক নীরব পুতুল হয়ে বসে আছি। মনে হয় যেন আমার কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটাই বড় কথা, আশপাশ নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার কই? কাল আমার ক্লাস টেস্ট তো পরশু হচ্ছে ল্যাব ভাইভা! আমার কি আর সময় আছে নাকি এসব নিয়ে ভাবার ? খুব বেশি হলে ফেসবুকে একটা ধিক্কার বাণী লিখে দেই, ব্যস আমাদের দ্বায়িত্ব শেষ ! কিন্তু এভাবে করে কি চলতেই থাকবে ? তাহলে কি দরকার আর এত কষ্ট করে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে আসার ? কে জানে কাল আপনিই হয়ত রাস্তার কোণে মরে পড়ে থাকবেন আপনারই কোন সহপাঠির হাতে থাকা রামদা’এর কোপ খেয়ে বা আপনার কোন বন্ধু থাকবে আপনার জায়গায় বা নিজেই হয়ত অন্যের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে জোশের বসে নিয়ে নিলেন একটা তরতাজা প্রাণ ! কি ভাবছেন ? আপনি কেন খুনি হতে যাবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়জন ছেলে খুনি হবে বলে ঠিক করে আসে বলুন তো ? কয়জনের বাবা-মা তাকে খুনি হতে পাঠায়? তাহলে এই যে খুন খারাপি হচ্ছে এগুলো কারা করছে? আমরাই তো, তাই না ? আপনি-আমি সবাই এর ভাগীদার? কি এমন হয় ওদের জীবনে যে নিজের ভাইয়ের মত ছেলেটির জীবন নিতে ওদের হাত কাপে না ! যেই ছেলে হয়ত রোগী মরে যাবে এই ভয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ছেড়ে দেয় সেই ছেলে কেন নির্দ্বিধায় রগ কাটে সহপাঠীর? কি বা কারা এর পেছনের শক্তি? বা কিসের আশায় এই ছেলেগুলো ও পথে পা বাড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত? টাকা? খ্যাতি? নাম? ভবিষ্যত ?? কী??? একটিবার ভেবে দেখেছেন এই যে যারা এইসব দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে খুন খারাপি করছে তারা দেশের কি পরিমাণ ক্ষতি করছে? নিজে একজন নামকরা ব্যক্তিত্ব হতে পারত , হতে পারত দেশ বদলে দেওয়া নেতা, কিংবা অসাধারণ একজন ডাক্তার, কবি। তা তো হচ্ছেই না বরং খুন করছে এরকম আরও সহস্র স্বপ্নকে? আমাদের দেশ মেধাশূন্য হবে না কেন?

পুরো লেখাটায় ক্ষোভ মাখানো। জানি দিনকে দিন নিজের প্রতিও ভরসা উঠে যাচ্ছে। তবে আর দশজন মানুষের মত আমিও মনে করি একদিন ভোর হবেই, সবাই ভাবতে শিখবে। এভাবে করে নিজেদের নষ্ট করে ফেলবে না। এই যতটুকু সময় তারা এইসব কুৎসিত কাজ করে নষ্ট করছে, মানুষের শান্তি নষ্ট করছে সেই সময়ে হয়ত আরও অনেক ভালো কাজ করতে পারত। এদেশের মানুষ দুবেলা খেতে পারে না, তাই সব সময় স্বপ্ন দেখে কোন একদি হয়ত তাদের দিন ফিরবে আর কান্ডারি ভাবে এই আমাদের। একদিন আমাদের হুশ ফিরবে, আমরা পেছনে তাকিয়ে দেখব অনেক সময় পেরিয়ে গেছে তারপরও কাজ করব, সব সুন্দর হয়ে যাবে। হয়ত রূপকথা লাগছে কিন্তু একদিন সময় আসবেই যেদিন আর কোন ছাত্রকে তার বন্ধুর কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইতে হবে না। যেদিন আর ছাত্রদেরকে নরখাদক বলার মত কেউ থাকবে না।

ভোর হয়নি
আজ হল না
কাল হবে কিনা তাও জানা নেই
পরশু ভোর ঠিক আসবেই
এই আশাবাদ তুমি ভুলো না।

আরও http://bdnews24.com/bangla/details.php?cid=2&id=206741

অক্ষর সম্পর্কে

স্বপ্নবাজ মানুষ একজন। আশাবাদ আর নিরাশার দোলাচালে আশাকেই শেষ পর্যন্ত সঙ্গী করতে চাই। আর স্বপ্ন দেখি একদিন দেশের জন্য কিছু করার, স্বপ্ন দেখি ছোট্ট করে হলেও কিছু একটা করার যা একটা প্রজন্মের গতিপথ পরিবর্তন করবে এবং অবশ্যই সেটা যেন হয় ইতিবাচক কোন পরিবর্তন। এখন পড়াশোনা করছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে। গণনা যন্ত্রের উপর পড়াশোনা করছি ঠিকই কিন্তু যন্ত্র শব্দটাই আমার কাছে বিরক্তিকর। ফেসবুক লিঙ্ক- www.facebook.com/akkhar21
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে চিন্তাভাবনা, সচেতনতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

8 Responses to ছাত্রত্ব কি এখন শুধুই কলঙ্ক????

  1. sheikh irfan বলেছেনঃ

    একদিন সূর্যের ভোর, একদিন স্বপ্নের ভোর, একদিন সত্যের ভোর আসবেই ……

  2. শাফায়েত বলেছেনঃ

    আরো একটি সুন্দর লেখা @অক্ষর। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠলেই সবাই কেন যেন নিজেকে খুব বড় কিছু ভাবতে থাকে,অবশ্যই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ছাত্র একজন বড় কিছু কিন্তু সমস্যা হলো নিজেকে বড় কিছু ভাবতে গিয়ে সে ভাবতে থাকে সে রাস্তার উল্টা দিয়ে বাস চালিয়ে নিতে পারবে,অন্য সব মানুষকে তুচ্ছ ভাবতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের কিভাবে মানুষের জন্য কিছু করা যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করার কথা,কিন্তু দু:খজনক ভাবে বেশিভাগের জন্য কথাটা সত্যি নয়। চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি আমরা,সে সুযোগ আমাদের আছে,আমরা নিজেরা নিয়ম মেনে চলে উদাহরণ তৈরি করতে পারি,আমরা লেখালেখি করে নিজের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিতে পারি,আরো অনেক কিছু করতে পারি কিন্তু করিনা। তবে এমন অনেককেও দেখেছি যারা মানুষের বিপদে ছুটে যায়,বন্ধুর মায়ের ক্যান্সারের টাকা তুলতে রোদের মধ্যে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে, মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা তার কাছে গুরুত্বহীন হলেও রাস্তায় নেমে হাস্যকার নিয়মের প্রতিবাদ করে, তাই আশা হয়তো এখনো শেষ হয়নি।
    লেখা চালিয়ে যাও।

    • অক্ষর বলেছেনঃ

      বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমাদের যতটা না অন্যদের শেখনোর কথা, অন্যদের আদর্শ হওয়ার কথা দিনকে দিন আমরা সে পথ থেকে বের হয়ে আসছি। তবে ভাইয়া ভোর আসবেই। আশা অনেক, এখন শুধু সেই দিনটার অপেক্ষা..

  3. সামিরা বলেছেনঃ

    আসলেই ক্ষোভ মাখানো লেখা। কিন্তু অনেক বেশি সত্যি কথাগুলি।

    আমার নিজেরও মাঝে মধ্যে মনে হয় ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের’ নাম বদলে অন্য কিছু করা দরকার। এই শিক্ষা তো শিক্ষা না! কষ্ট লাগে যখন দেখি বইয়ের পড়া পড়ানোর জন্য সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা সময় বরাদ্দ থাকে, অথচ তার মধ্যে এক মিনিটও মানুষ হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয় না। এই শিক্ষার ফলাফল এ ছাড়া আর কী-ই বা হবে? ডক্টরেট করেও মানুষ এখানে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হবে – এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না?

    কিন্তু একদিন ভোর হবেই ইনশাআল্লাহ্‌ – আমিও বিশ্বাস করি। আশাবাদীদের দলে থাকতে পারাটাও এখন অনেক। 🙂

    • অক্ষর বলেছেনঃ

      শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি মূল্যবোধই শেখাতে না পারলো তাহলে তার “শিক্ষা প্রতিষ্ঠান” নামধারী হওয়ার কোন যৌক্তিকতা খুজে পাই না। আর সবচেয়ে কষ্ট পাই শিক্ষক-ছাত্র দুই অংশের জন্যই। এক অংশ শিক্ষিত নাগরিক গড়তে ব্যস্ত আরেক অংশ ঐ নাগরিক হতে ব্যস্ত কিন্তু মাঝ পথে যে আরও কত শত কিছু হারিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে দুই দলের এক দলেরও মাথা ব্যথা নেই।

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    আমিও ভোরের অপেক্ষায় আছি।
    তবু মাঝে মাঝে ভীষণ ছন্নছাড়া লাগে রে নিজেকে।
    রাবির পরিবেশ খুব খুব খারাপ হয়ে গেছে।
    প্রার্থনা করি, আর কোন ছাত্রের মা যেন এমন করুণভাবে সন্তানহারা না হন।

  5. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    এই সব ছাত্র নামের কলংকদের ছবি খবরগুলা সেইভ করে রাখলে কেমন হয়? ফিউচার রেফারেন্স এর জন্য?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।