অ্যাকাডেমিক ক্লাস কি আসলেই বিরক্তিকর কিছু ?? আমার মনে হয়, একটা খুব শক্ত বিষয়ের সহজ উপস্থাপন জিনিসটাকে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য ও আকর্ষণীয় করে তোলে। এই ব্যাপারগুলো খুবই খেয়াল করে করা উচিত যে, সামনে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রী বা লিসেনার কীভাবে রিঅ্যাক্ট করছে। ইস্তানবুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসার পর থেকে, আমার এই পর্যন্ত হাতে গোনা কিছু টিচার ছাড়া সবাই ছিল খুবই হতাশাজনকভাবে বোরিং। তবে কোন বিষয়ে অন্যের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করা সহজ কোন কাজ না।
এখন পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি লাইফের দুটা অভিজ্ঞতার একটা ছিল লিটারেচার নিয়ে লেকচার যেটা আমার “নন ডিপার্টমেন্টাল” লেখায় প্রকাশিত এবং আরেকটা হল পিওর “ইঞ্জিনিয়ারিং” নিয়ে। আমার আজকের লেখাটা ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা বিষয়ে আমার ক্লাস প্রেজেন্টেশান নিয়ে। বলা যেতে পারে, ক্লাস নেয়ার প্রতি আমার ধারণাগুলোর রিয়েল লাইফ অ্যাপলিকেশান এখানেই করেছি। আমার সেবারের কোর্স ছিল “হাউ টু রাইট এ রিসার্চ পেপার” কোর্সটা ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে নিতে হয়। যে কোন ফ্যাকালটি থেকে যে কেউ কোর্সটা নিতে পারে।
আমার টিচার ছিলেন টিম ডেভিস। উনি ইংরেজ হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে ইস্তানবুলে পড়ান। প্রথম দিনে যা বুঝলাম স্যার মাত্রাতিরিক্ত সিস্টেমেটিক। আমাকে নিয়ে স্যার বিপদে পড়লেন। আমার কোন গ্রুপমেট নেই। অনেকে আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছে আবার কেউ এখানে একসাথে কাজ করার জন্য ডিসাইড করেছে। আমার সাথে কেউ নেই, আরেকটা কারণ আমার ফ্যাকালটির কেউ নেই। স্বাভাবিকভাবে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ছাত্র কখনই ইচ্ছা করে আমার ইলেক্ট্রিক্যাল-ইলেক্ট্রনিক্স ফ্যাকালটির রিসার্চে জয়েন করবে না। স্যার দেখলেন উনি যেমন মহা বিপদে.. তেমন আমিও। কোর্সের নিয়মাবলীর ভেতর গ্রুপ ওয়ার্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই কোর্স ছেড়ে দিলে অন্য সেশনে নিতে হবে। আমিই স্যারকে বললাম, আমি একাই পারব। স্যার আমার দিকে চেয়ে কী ভাবলেন জানি না.. আরো একবার জিজ্ঞাস করলেন সমস্যা হবে না তো ঠিক পারবে তো ? আমি বললাম, অবশ্যই পারব। এভাবেই শুরু করলাম, সবাই কাজ ভাগ করে নেয়.. আমি দেখি আর ভাবি, আমার কেউ নাই আমার একাই করা লাগবে
কোর্সের একটা বড় অংশের নাম্বার ছিল রিসার্চ পেপার প্রেজেন্টেশানে। আমাদের স্যার ছিলেন আসলে প্রাণীবিজ্ঞানের ছাত্র। উনি আমাদের একটা ডেমো দিলেন নিজেই। বিষয়টা ছিল ইংল্যান্ডের একটা বিশেষ প্রজাতির পাখির জীবন চক্র এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে। বর্ণনা দেয়ার সময় ছবি আঁকা দেখেই বুঝলাম স্যার ভাল ছবিও আঁকেন। ক্লাস শেষে স্যারের সাথে অনেক গল্প করলাম। সত্যি বলতে যারা দেশ ছেড়ে এখানে পড়াতে এসেছেন, পড়েছেন বা অন্য কোথাও নন ইংলিশ স্পিকিং কান্ট্রিগুলোতে তাদের ভাষায় পড়াশুনা করেছে… তারা ছাড়া আমার অবস্থা কেউ ভাল বুঝতো না। এই কারণেই সব বিদেশী টিচারের সাথে আমার বন্ধুর মত সম্পর্ক গড়ে উঠতো। টিম ডেভিস স্যারের দাদীর নামে এখনও ইন্ডিয়াতে একটা হাসপাতাল আছে। ওনার বাবা ব্রিটিশ অ্যাম্পায়ারের সময় ইন্ডিয়াতে নিয়োগ পেয়েছিলেন। স্যার মশলা দেয়া খাবারের মারাত্তক ভক্ত। যাই হোক, রিসার্চে আমার বিষয় ছিল “ওয়ারলেস সেনসর নেটওয়ার্ক”, যারা এই বিষয়ে আগে থেকেই জানেন তারা বুঝতেই পারছেন এটা খুব একটা সহজ বিষয় না। আমার তো বিপদের অবস্থা কারণ লিসেনার কেউ আমার ফ্যাকালটির না। আমার ইচ্ছা ছিল যাতে সবাই বিষয়টা বুঝে মজা পায়। আমি অনেক ভেবে বের করতে লাগলাম কীভাবে সবার উপযোগী একটা প্রেজেন্টেশন বানানো যায়, যাতে একেবারে একটা বেসমেন্টের উপর ব্যসিক রিসার্চটা বুঝানো যায়। আমাদের নির্ধারিত সময় ছিল ১৫ মিনিট, বেশী হলে ২০ মিনিট। আমার ঠিক রিসার্চ পেপার প্রেজেন্টেশনের আগের দিন একটা কঠিন ইক্সাম ছিল। সবমিলিয়ে দেখা গেল পিকচার, ডেটা আর সাবজেক্ট নিয়ে গোলমাল পাকানোর অবস্থা। আমি মাথা ঠাণ্ডা করে ঠিক রাত ১১ টায় বসলাম ৩ টায় কাজ শেষ করলাম। সকালে ঘুম ঘুম চোখে পৌঁছলাম ক্লাসে।
প্রেজেন্টেশনে আমি এইবার ৩০ মিনিটে কাজ শেষ করলাম, এরপর প্রশ্নউত্তর পর্ব। অনেকেই সুন্দর প্রশ্ন জিজ্ঞাস করলো। ক্লাস শেষে সবাই চলে গেলে স্যারের সাথে কথা হচ্ছিল আমার। আমি একটু ভয় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার আপনার কেমন লাগলো প্রেজেন্টেশন ? স্যার বললেন, “জান আজকে আমি শুধু তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। তুমি আরেকটু বললেই পারতে”… আমি উত্তর করলাম, “স্যার ক্লাসে আমিই সবচেয়ে বেশী সময় নিয়েছি। আর আপনি তো আমাকে আগে তেমন কিছু বলেননি !! স্যার আমার সব বিষয়গুলো বিস্তারিত বলার সময় ছিল না, ধরুন ওইখানে যে মাইক্রোপ্রসেসর বা সেনসর ব্যবহারের ফাংশান আছে তা নিয়ে পুরা একদিনের ক্লাস পার করা যাবে”… আমি পরে ভেবে দেখলাম, আমার রিসার্চ নিয়ে স্যারের মনে বিশাল কৌতুহোলের বাসা বেঁধেছে, আমার কাছে এর চেয়ে বড় স্বার্থকতা আর কিছু হতে পারে না। আগে বলেছিলাম যে; আমাদের মধ্যে ভাল একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে.. স্যার বললেন তুমি খুব একা থাক তাই না ? তোমার কথাগুলোর মাঝে গভীর ভাবানুভূতি থেকেই যায়। আমি মুচকি হেসে বললাম, স্যার আপনার লাঞ্চের জন্য দেরী হয়ে যাচ্ছে…
ইস্তাম্বুলে ছিলাম আমি এক মাস! আফসোস আগে জানলে আপনার সাথে ঘুরাঘুরি করা যেত! এই জানুয়ারিতে। আপনার ইউনিভার্সিটির বেশ নাম শুনেছি তুর্কীদের কাছে। র্যাঙ্কও তো ভালো।
আজ আবার চোখ বুলাচ্ছিলাম ফরিদ জাকারিয়ার দি পোস্ট আমেরিকান ওয়ার্ল্ড বইটায় ঐখানে নন আমেরিকান বোরিং আন ইমাজিনেটিভ শিক্ষা ব্যবস্থার কথা আসল। আমেরিকা কিছু কিছু দিকে পিছিয়ে পড়লেও সৃজনশীলতা, রিস্ক টেকিং এ ভালো এগিয়ে আছে।
ঐ ইংরেজ ব্যাটা ইস্তাম্বুলে কী করে? মানে কেন আছে? ঐতিহ্য/ইতিহাস বা এই রকম কিছুর প্রতি আগ্রহ?
আমার নিজের প্রেজেন্টেশন দিতে ভালো লাগে! যদি আমার পছন্দের টপিক হয়! নিজেকে ঝালিয়ে নেবার ইচ্ছাতে আর কি!
থ্যাংকস আপনাকে। ইস্তানবুলেয়া আবার আসলে জানাবেন। আমি আছি আরও ২ বছর। আর ইংরেজ স্যার আছে তাঁর ইস্তানবুলের প্রতি দুর্বলতার জন্য।
আপনার লেকচার শুনবো কোন সময়। যোগাযোগ রাখলে খুশী হব।
স্যারদের প্রশংসা শুনতে আসলেই অনেক মধুর লাগে।
শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা তো শিক্ষাজীবনের অনেক বড় পাথেয়!
অনেক অনেক শুভকামনা রইল ভাইয়া। :beshikhushi:
অনেক থ্যাংকস। তা তো অবশ্যই। স্যারও অনেক বন্ধুর মত ছিলেন, তাঁর প্রেরণা আমাকে অনেক দূর এনেছে। এরকম শিক্ষকদের কাছে সবসময়ই কৃতজ্ঞ থাকতে হয়।