আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
যে মোরে করিল পথের বিবাগী-
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,
যে গেছে বুকে আঘাত করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।
যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,
আমি দেই তারে বুকভরা গান,
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি।
যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী,
আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,
কত ঠাঁই হতে কত কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।
সেপ্টেম্বর ২১, ২০০১
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে বন্ধুর গ্যাস স্টেশনে সেদিন সকালে কাজ করছিলেন এক বাংলাদেশি। নাম তার রইস উদ্দিন ভূঁইয়া। হঠাৎ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে একজন মানুষ, হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। ডাকাত ভেবে তড়িঘড়ি করে তাকে ক্যাশ সাধতে না সাধতেই মুখে প্রচণ্ড যন্ত্রণা রইসকে বুঝিয়ে দিল যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সে যাত্রা মরতে মরতে বেঁচে গেলেও, তার ডান চোখ হয়ে পড়ে প্রায়ান্ধ, মাথার ভেতর দারুণ যন্ত্রণা দিতে থেকে যায় ৩৫টিরও বেশি গুলির টুকরো। পরবর্তীতে চাকরি, বাসস্থান, এমন কি বাগদত্তাকেও হারাতে হয়েছে তাঁকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
ঘটনার শুরু…
ওপরের ঘটনার ১০ দিন আগের কথা। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার দিন। মার্ক অ্যান্থনি স্ট্রোম্যান নামে এক টেক্সানের বোন মারা যান এই ঘটনায়। এরপর মুসলিমদের ওপর প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে আর দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দুজন দক্ষিণ এশীয়কে (একজন ভারতীয় আর একজন পাকিস্তানি) হত্যা আর একজনকে গুরুতর আহত করেন তিনি। শেষেরজনই রইস।
১০ বছর পর
২০১১ সালের জুলাই মাস। সেই স্ট্রোম্যানের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হবে খুব শীঘ্রই। এতদিনে তার মধ্যে এসেছে দারুণ পরিবর্তন। পরিবর্তনের কারণ, তার দণ্ড মওকুফ করে যাতে যাবজ্জীবন দেয়া হয়, সেজন্য চেষ্টা করছেন তার অপরাধেরই ভুক্তভোগী, বাংলাদেশের রইস। রইস তার মুক্তির জন্য টেক্সাসের গভর্নরের কাছে আবেদন করেছেন, মার্কের মত চরমপন্থীদের মৃত্যুদণ্ড রোধে সচেতনতা গড়তে চালু করেছেন “World Without Hate” ((http://worldwithouthate.org/index.php)) নামে একটি ওয়েবসাইট। রইসের বক্তব্য, তাঁর ধর্ম ইসলাম তাকে মানুষকে ক্ষমা করতে শিখিয়েছে। তাই তিনি কখনো মার্ককে ঘৃণা করেন নি, নিজের এই দুর্ঘটনার জন্য আমেরিকাকেও দোষ দেন নি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, মার্ক যা করেছে তার একমাত্র কারণ তার অজ্ঞতা, ভাল-মন্দের পার্থক্য করতে তার ব্যর্থতা। আর এভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া কখনো এ ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে পারবে না। বরং নিজের ভুল বুঝিয়ে যদি তাকে পরিবর্তিত করা যায়, তবে তিনি তার মতন অন্যান্যদেরকে জানাতে পারবেন যে ঘৃণা কখনো কোনকিছুর সমাধান হতে পারে না, আর মুসলিম মাত্রই সন্ত্রাসী নয়। ক্ষমা আর ভালবাসাই পারে ঘৃণার প্রসব করা এসব অনাচার দূর করে পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে।
শেষের কথা
রইসের উদ্যোগ মার্ককে দারুণভাবে নাড়া দিয়ে যায়। সেই সাথে ছুঁয়ে যায় সারা বিশ্বের মানুষকে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মার্ক পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের শুভেচ্ছা পান। অজ্ঞতা আর ভুলবশত তিনি যে কাজ করেছিলেন তা-ও বুঝতে পারেন। রইস নামের স্বদেশী মানুষটির এই কাজ আমাদের বাংলাদেশিদের সামনে একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
“কী চমৎকার ব্যাপার! কেবল যে আমার বন্ধুরা তা-ই না, গোটা মুসলিম সমাজেরও একটা বড় অংশ এই ভাবনার সাথে একাত্ম হয়েছে। আমার কিংবা রইসের চাইতেও বড় এই শক্তি, কিন্তু এর শুরু রইসের ক্ষমা থেকেই। আমার বিশ্বাস, ঘৃণা ছড়ানোর সংস্কৃতি বন্ধে নানান রকম মানুষকে একসাথে নিয়ে আসার এই -ই সুযোগ ।”
~ মার্ক স্ট্রোম্যান ~
মার্কের জীবন বাঁচাতে রইসের চেষ্টা শেষমেশ সফল হয় নি। কিন্তু তিনি পেয়েছেন আরও অনেক কিছু। মার্ককে বাঁচানোর সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছিল ১২০০০ মানুষ। রইসের বিশ্বাস, স্রষ্টা কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়েই তাঁকে সেই দুর্ঘটনার পরও বাঁচিয়ে তুলেছেন। ঘৃণা যেন আর কোন মানুষকে অপরাধ করতে উৎসাহ না দেয়, মানুষ যেন বুঝতে পারে যে ঘৃণা পৃথিবীকে কেবল পিছিয়েই নিয়ে যাবে – এই বোধ ছড়িয়ে দেওয়াকে তিনি এখন নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন।
***
প্রায় বছরখানেক আগের কথা। ছোট্ট একটা কাজের জন্য রইস ভূঁইয়াকে নিয়ে একটু পড়াশোনা করেছিলাম ইন্টারনেটে। মনে আছে, সেদিন আমার মত কঠিনহৃদয় মানুষের চোখও ভিজিয়ে দিয়েছিলেন রইস।
নিজের জীবন নিয়েও অনুশোচনা হয়েছিল সেদিন। এই আপাত ঝুঁটঝামেলাহীন জীবন থেকেও খুঁজে খুঁজে কত শত ফাঁকফোকর বের করে প্রতিনিয়ত অভিযোগ করে চলি, সে কথা মনে হয়েছিল। কারও আচরণে সামান্য কষ্ট পেলেও কেমন করে পুষে রাখি সেটা মনের ভেতর, সেটাও। ক্ষমা করার কথা মনেও আসে না তখন একবারের জন্য।
অথচ এই মানুষটা! তার চরম ক্ষতি করলো যে, তাকেই কিনা উল্টো ভালবাসছেন! ঠিক ছোটবেলায় পড়া ‘প্রতিদান’ কবিতার মতন। ঐ কবিতার বাস্তব উদাহরণ যেন রইস।
অথচ চিন্তা করে দেখলে কি মনে হয় না, আমাদের সবারই এমন মানুষ হওয়ার কথা ছিল? যুক্তি দিয়ে যদি ভাবি, ঘৃণাকে ঘৃণা দিয়ে লড়তে গেলে কি আসলেই কোন ফায়দা পাওয়ার কথা মাথায় আসে কারোর? কেউ কোনদিন কিছু পেয়েছে এভাবে? বরং রইসের মত করে যদি আমরা সবাই ভাবতে শিখতাম, এমনভাবে কাজ করতাম যেন আমাকে আঘাত দেওয়ার পর সে মানুষ আর কখনও কাউকে একইভাবে আহত করতে না পারে, তাহলে কেমন হত পৃথিবীটা?
রইসের কথা যখন জেনেছিলাম তখন থেকেই খুব ইচ্ছা হচ্ছিল সবাইকে তাঁর কথা জানাই। লিখি লিখি করতে করতে, কিছুদিন আগে যখন ইসলামবিদ্বেষী ছবি তৈরির প্রতিবাদের ফল হিসেবে একজন মানুষ নিহত হলেন তখনও কিছু লেখা হল না। আর তারপর আমার নিজের দেশেও যখন কাছাকাছি ঘটনা ঘটলো, তখন মনে হল এখনও যদি মুখ না খুলি, তাহলে আর কবে?
প্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলহোর অপ্রিয় বই ‘আলেফ’ থেকে নেয়া অসম্ভব প্রিয় এই কবিতাটা সবাইকে সাথে নিয়ে না পড়লে অপরাধ হবে।

দুর্ঘটনার পর রইস
The tears I shed, I forgive.
The suffering and disappointments, I forgive.
The betrayals and lies, I forgive.
The slandering and scheming, I forgive.
The hatred and persecution, I forgive.
The punches that were given, I forgive.
The shattered dreams, I forgive.
The dead hopes, I forgive.
The disaffection and jealousy, I forgive.
The indifference and ill will, I forgive.
The injustice in the name of justice, I forgive.
The anger and mistreatment, I forgive.
The neglect and oblivion, I forgive.
The world with all its evil, I forgive.

কারাগারে মার্ক স্ট্রোম্যান
Grief and resentment, I replace with understanding and agreement.
Revolt, I replace with music that comes from my violin.
Pain I replace with oblivion.
Revenge, I replace with victory.

মেয়ের সাথে মার্ক
I will be able to love above all discontentment.
To give even when I am stripped of everything.
To work happily even when I find myself in the midst of all obstacles.
To dry tears even when I am still crying.
To believe even when I am discredited.

"Sight is gone from one eye, but my vision has never been clearer." - রইস
কোন ধর্মই আসলে সহিংসতা সমর্থন করে না।
যারা ধর্মানুরাগী শুধু তারাই জানেন কথাটা কী অতিমাত্রায় সত্যি।
ধর্মান্ধদের সাথে তাদের পার্থক্য এখানেই।
ধর্মের সৌন্দর্য অনুভব করতে পারাটাও একটা বিশাল ব্যাপার।
থিমটা অসাধারণ।
ভাই রইসের জন্য শ্রদ্ধা।
লেখার বিষয়ে বলব, শুরুটা আরেকটু অন্যভাবে করা যেত কি?
মানে ঘটনাগুলোর টার্ন হঠাৎ হঠাৎ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, বুঝতে একটুখানি সময় লাগল।
অবশ্য এটা তাড়াহুড়ায় পড়া। আমার দোষই বেশি হবে হয়ত।
তাড়াহুড়ায় পড়ার জন্য না। তাড়াহুড়ায় লেখার কারণে। আর লেখাটা একটা খসড়া লিফলেটের জন্য ছিল মূলত, এডিট করার সময় পাই নি। চাপের মধ্যে আছি, জানোই তো। 🙂 একটু সময় পেয়ে নিই, ভাবছি শুরু থেকে আমার সবগুলি পোস্ট একদিন এডিট করতে বসবো। 😀
অনেক সুন্দর লিখা
গল্পটা সুন্দর যে! 🙂
এই ঘটনাটি যখন পত্রিকায় পড়েছিলাম প্রথম, জাস্ট অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম! যেই বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের এত হাহাকার, যে আমরা নিজেরাই কথায় কথায় বলি “বাঙ্গালি জাতটাই খারাপ!” সেই বাংলাদেশেই এমন মানুষ জন্মায়। যে ইসলাম নিয়ে দম আটকানো ঘৃণার বিষবাষ্প বাতাস ভারি করে রেখেছে, সেই ইসলাম কোমলতা কঠোরতার মিশ্রণে কত ব্যালেন্সড একটা জীবনব্যবস্থা! সেই জীবনব্যবস্থারই অনুসারী এই রইসরা।
ক্ষমা করতে পারাটা সহজ নয় হয়তো, কিন্তু ক্ষমায়ই নিহিত থাকে মুক্তি। অনেকের মাঝেই প্রবণতা দেখি এভাবে বলতে, এত উদার হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভব না। ভুলে যাওয়া সম্ভব না এতকিছু…ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘৃণায় আটকে থাকা শ্বাসকষ্ট থেকে ক্ষমার সুনীল আকাশে পাখির মত ডানা মেলে উড়তে কত অসাধারণ লাগে সে যে ক্ষমা করে শুধু সেই বুঝতে পারে।
ও আরেকটা কথা, প্রথমে লেখা হল গুলি করা মানুষের মধ্যে একজন ভারত আর একজন পাকিস্তানের, তার মধ্যে একজন রইস। পরে দেখলাম রইস বাংলাদেশের। এটা কি ভুল হয়েছে কোন কারণে?
অনেক ভাল লাগলো আপু মন্তব্যটা। 🙂
“বাঙালি জাতটাই খারাপ!” এমন কথা বললে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজের দিকেই আঙুল তোলা হয় আসলে। আর আমরা বাঙালির বাইরে আর ক’টা জাত দেখেছি যে বিচার করে ফেলি যে আমরা আলাদাভাবে খারাপ?
“দুজন দক্ষিণ এশীয়কে (একজন ভারতীয় আর একজন পাকিস্তানি) হত্যা আর একজনকে গুরুতর আহত” – রইস আহত হয়েছিলেন। আর আগের দুজন মারা গিয়েছিলেন। পরিষ্কার হয়েছে আপু? নাকি অন্য কোথাও ভুল করেছি?
ওহ!! আহত এর কথাটা চোখেই পড়ে নাই!! স্যরি আমারই ভুল :crying:
রিম এর মন্তব্যটা তুলে দিচ্ছি –
liked it a lot. i was pretty mad at some people today. my raze was so furious that i felt if i were king kong, i would have crushed them with my hands. surprisingly, this post have calmed me down. i will go take a shower now and pray for those people in my prayers. last but not least, thank you very much.
সামিরা, তুমি consistently শান্তির বার্তা ছড়িয়ে যাচ্ছ। সাধুবাদ। Charter for Peace এ individual participation করা যায় peace ambassador হিসেবে। যদি আরও অরগানাইজড হয়ে কিছু করতে চাও, চিন্তা করে দেখতে পার।
রিম আপুর জন্য: অনেকটাই অযত্ন নিয়ে লেখা, তারপরেও কারও কাজে এসেছে শুনে কী যে ভাল লাগলো!
ঘটনাটা নিয়ে যখন পড়েছিলাম প্রথম, আমার নিজের মধ্যেও অনেকটা এরকম পরিবর্তন এসেছিল। জিনিসটা সবসময় মনে থাকে না, এটাই সমস্যা। Now I’m thinking how to make myself remember things which I should never forget. কারও কোন সাজেশন আছে? 😀
আপনার জন্য: ধন্যবাদ আপু। ভেবে দেখলে হয়তো এই কাজগুলোর পেছনে আপনার কিংবা আপনাদের মত মানুষের প্রভাব খুঁজে পাওয়া যাবে। 🙂
আর Charter for Compassion নিয়ে অর্গানাইজ্ড কিছু করার কথা বলেছিলেন, সরব বোহেমিয়ানের কিছু পরিকল্পনা আছে এটা নিয়ে। তার সাথে কথা বলতে পারেন। আমরা সবাই মিলে কিছু করতেই পারি চাইলে ইনশাআল্লাহ্।
লেখাটা কিঞ্চিৎ খাপ ছাড়া লাগল।
তবে এই অস্থির সময়ে এই রকম লেখা জরুরি।
রইস এর ভিডিওটা আমার চোখেও জল এনে দিছিল। আর ওর এখনকার আপডেট জানো?
নাহ্।
পেপারে ঘটনাটার এক ঝলক পড়েছিলাম , তোমার লেখায় পুরোটা জানলাম । মার্কের মেয়েটাকে দেখে মায়া লেগেছে বেশি। বাবার অজ্ঞতার জন্যে এই জনমের বাকি সময়টুকু বেচারীকে এতিম হয়ে বাঁচতে হবে !
আটলান্টিকের ন্যায় অতলান্তিক হৃদয়ের অধিকারী রইসের জন্যে রইলো দুয়া ।
সহমত।
আমাদের সবার হৃদয় অমন হোক, সেই দুয়াও। 🙂