আব্দুল জব্বার মাস্টার। এ নামেই তিনি এলাকাতে সুপরিচিত। অসম্ভব সাদা-সিধা একজন মানুষ। সবসময়ই তাকে দেখতাম সাদা ধবধবে পাঞ্জাবির সাথে সাদা পাজামায়। মুখের শ্বেত-শুভ্র দাঁড়ি-গোঁফে এমন একটা সুফী-সাধকী বেশ ফুটে উঠতো যে শ্রদ্ধায় মাথাটা আপনিই নুয়ে আসতো। বস্তুতই তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার যোগ্য একজন মানুষ।
অষ্টমশ্রেণীতে আমাদের গণিত ক্লাস নিতেন। তখনো শারীরিক শাস্তির ব্যাপারে স্কুলগুলোতে এতটা নিষেধাজ্ঞা-কড়াকড়ি ছিলো না। আমাদের স্কুলের টিচার্স কমনরুমেই ছিলো দেশী-বেতের এক বিশাল ভাণ্ডার। তবুও তাঁকে কখনও শ্রেণীকক্ষে বেত নিয়ে ঢুকতে দেখি নি। কিন্তু বেতের ভয়ে নয়, আমরা দুষ্টের শিরোমণিরা সব দুষ্টুমি ছেড়ে মন্ত্র-মুগ্ধের মতো তাঁর ক্লাসে থাকতাম শুধুমাত্র তাঁর ক্লাস নেওয়ার গুণেই। স্কুলের কি ভদ্র, কি দস্যি সব ছেলেরাই তাঁকে এক অন্য উচ্চতায় স্থান দিয়েছিলো।
এই শিক্ষাপাগল, অসম্ভব মানবিকতাবোধসম্পন্ন মানুষটি স্কুলে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায় ছোট্টো একটি ঘটনা থেকে।
আমরা তখন ক্লাস টেনে। সেসময় আমাদের সাথেরই কিছু বখাটে, মাস্তান টাইপের ছেলে ক্লাসের একটা মেয়েকে প্রায়শই উত্ত্যক্ত করতো। তো, মেয়েটার বাবা হেডস্যারের কাছে নালিশ দিলো। হেডস্যার ছেলেগুলোকে আর তাদের অভিভাবকদেরকে টিচার্স কমনরুমে ডাকলেন। বিচারের পর শাস্তি ঠিক হলো যে ওদের প্রত্যেককে দশটি করে বেতের বাড়ি দেয়া হবে এবং লিখিত নেয়া হবে যে, ভবিষ্যতে এ ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেলে স্কুল ত্যাগে বাধ্য থাকবে। এদিকে হেডস্যার নিজে বেত দিতে কিছুটা বিব্রতবোধ করছিলেন, কারণ ছেলেগুলো ছিলো এলাকার প্রভাবশালী পরিবারের এবং খুবই বেপরোয়া প্রকৃতির। তিনি বেত তুলে দিলেন জব্বার স্যারের হাতে। জব্বার স্যারের কাছ থেকে হাত পেতে বেতের বাড়ি নিয়ে ছেলেগুলো মাথানিচু করে বেরিয়ে গেলো, একটি টু শব্দও না করে। অথচ কিছুদিন আগেই হেডস্যারের কাছ থেকে ঝাড়ি খেয়ে ওরা হেডস্যারের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করেছিলো এবং তাঁর নামে খারাপ খারাপ কথা লিখে এলাকার দেয়ালগুলো ছেয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু হেডস্যার প্রমাণ আর সাক্ষীর অভাবে সবকিছু জেনেও কিছুই করতে পারেন নি। অথচ এদিন জব্বার স্যারের এই দশটি বেত্রাঘাত যেন ওদেরকে সারাজীবনের জন্যই বদলে দিলো। তাই তো এরপর থেকে আর কখনোই ওদের নামে স্কুলে কোনো নালিশও আসে নি, অভিযোগও শোনা যায় নি। বরং প্রতি ক্লাসে ফেল করা এই ছেলেগুলোই মেট্রিকে A, A- গ্রেড নিয়ে পাস করেছিলো।
#
বেশকয়েকবছর পর ঈদের বন্ধে বাড়ি গেলাম। তো, ঈদের পরদিন বন্ধুরা একটা পুনর্মিলনীতে একত্রিত হয়েছি। স্যারের প্রসঙ্গ আসতেই বন্ধু সলিম বলে উঠলো, “জানিস, কাল ঈদের নামাজ শেষে স্যারের সাথে দেখা হয়েছিলো। স্যারের শরীরটা একদম ভেঙ্গে গেছে রে। আমি সালাম করে উঠতেই দেখি তাঁর চোখে জল, অথচ মুখে হাসি নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস?”
আমার তখন পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়লো।
স্যার প্রতি ঈদে তাঁর স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন জামা-কাপড় কিনতেন। কিন্তু স্কুলশিক্ষকের সামান্য বেতনে প্রায়শই নিজের জন্য কিছু কেনা হয়ে উঠতো না। একবার ঈদের আগে শেষক্লাসে সবাই ঈদপ্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছিলাম। তখন স্যার তাঁর নিজের ঈদ নিয়ে বলেছিলেন, “ঈদ মানে হলো খুশি। আমার কত ছাত্র আজ কত বড় বড় অফিসার। ঈদের নামাজ শেষে ওরা যখন আমাকে সালাম করে, তখনকার যে অনুভূতি তার চেয়ে সুখের কি আছে, আনন্দের কি আছে?”
আমরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়ার কয়েক বছর পরেই অবসরে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে মানুষটা এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন ছাত্র-ছাত্রীদের কোলাহলে, তার কি আর বাড়িতে মন টেকে? তাই যতদিন সামর্থ্য ছিলো নিয়মিত স্কুলে আসতেন। তারপর একসময় শরীরও বাধা দিলো। শিক্ষানুরাগী মানুষটি বাঁধা পড়লেন বাড়ির চৌহদ্দিতে। মনে পড়ে আমাকে একবার বলেছিলেন, “সবুজ, তোর বাপ-চাচাদের পড়িয়েছি, তোকে পড়িয়েছি আর এখন তোর ছোটো ভাইবোনদেরও পড়াচ্ছি। আল্লা চাইলে তোর ছেলেমেয়েগুলোকেও আমিই পড়াবো।” কিন্তু হায় সে তো আর হলো না।
আজ যখন পত্রিকার পাতা খুললেই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনগুলোতে অসৎ, সংকীর্ণমনা, অর্থলিপ্সু আর চরিত্রহীন শিক্ষকের খবর চোখে পড়ে তখন নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি আর আফসোস করি, “ইশশ, আজ যদি বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষাঙ্গনে জব্বার স্যরের মতো অন্ততঃ একজন করে স্যার থাকতো!”
এইরকম শিক্ষদের জন্য বরাবরের শ্রদ্ধা।
সত্যি শিক্ষকের দায়িত্ব শুধু লেখাপড়া শেখানোতেই সীমাবদ্ধ নয়, আগামী প্রজন্মকে মানসিকভাবে শিক্ষিত করাও তার অন্যতম কর্তব্য। আজকের দিনে এমন কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে ক’জনেই বা পালন করেন?
একটা অফ টপিক প্রশ্ন করি ভাইয়া?
জব্বার স্যারের কথা শুনে ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে যে উনি কোন স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
স্কুলটার আজ কী অবস্থা?
ধন্যবাদ।
অঃটঃ স্কুলটা নোয়াখালীতে। যতদূর জানি ভালোই আছে স্কুলটা; অন্তত রেজাল্টের দিক দিয়ে।
শিক্ষা = ব্যবসা হয়ে গেছে।
আর শিক্ষকতা সন্মানের না কষাই এর মতো ব্যাপার হয়ে গেছে!
শিক্ষক হচ্ছে মানুষ বাধ্য হয়ে (আগেও হয়ত হতো, কিন্তু আগে আন্তরিকতা ছিলো। এখন সেটা অনেক কমে গেছে)।
আমার খুব লজ্জা লাগে স্যারদের সামনে দাঁড়াতে। বিশেষ করে প্রাইমারী স্কুলের স্যার ম্যাডামদের। এতটা ঋণ… আর আমি এতটা অকৃতজ্ঞ