এক. চিহ্নের টানে
আমি আগে না জানিয়া সখিরে কইরে পিরীতি আমার দুঃখে দুঃখে জীবন গেলো, সুখ হইলো না এক রতি…।
দিল ঠাণ্ডা করার জন্য অনেকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার শরীফে যান। সেই মাইজভান্ডার শরীফের বার্ষিক ওরছে চট্টগ্রামের দাউদুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয় নেত্রকোনার ছৈয়দ মিজানুর রহমানের । দুজনের মধ্যে কথাবার্তা বেশি দূর এগোয় নাই। সেই সামান্য আলাপেই মিজান জানান তার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। গীতিকবি উকিল মুন্সীর বাড়ির কাছাকাছি। মিজান উকিলের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েছিলেন ২০১১ সালের বর্ষায়। বাড়ির উঠোনে উকিল মুন্সীর কবর। পাশেই বেতাই নদী। নদীর কূল ভেঙ্গে কবর তলিয়ে যাবার অবস্থায় পৌছেছে। খবরটা দাউদের মনে দাগ কাটে। ঠিক করে উকিলের কবর দেখতে যাবে। মিজানের নাম্বার টুকে রাখে।
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। কুষ্টিয়ায় লালন আখড়ার দোল পূর্ণিমার অনুষ্ঠান শেষে দাউদ ঢাকা আসে। উকিল মুন্সীর বাড়ি যাওয়া নিয়ে আগেই উঠে ছিলো। এবার সেটা পাকা হলো। হাতে সময় থাকলে সুসং-দুর্গাপুর, গারো পাহাড় ঘুরে আসব। সাথে নেত্রকোনার আদি গয়ানাথের আসল বালিশ মিষ্টি তো আছে। উকিলের বাড়িতে যাবার পরিকল্পনার মূলকথা হলো তার কবর সংরক্ষণের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেটা দেখা। কিন্তু এই বিষয়ে আমার মনে খুঁতখুঁত করছিল। দুইদিন পর তেইশ ফেব্রুয়ারী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী কাজী এন্টারপ্রাইজের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জিজ্ঞেস করি, উকিল মুন্সীর ভাব-চিন্তা জানা ও বুঝার জন্য তার গানই তো যথেষ্ট। সেখানে কবর সংরক্ষণের দরকার কি? তার উত্তর, সাধক পুরুষদের রুহানী ক্ষমতা হয়তো কিছু মানুষ তাদের বাণী দিয়ে আর কিছু দ্বারা হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। যদিও দুই ধরণের জানা সমার্থক নয়। তা সত্ত্বেও, তাকে ভালোভাবে বুঝতে গেলে চোখে দেখা চিহ্ন দরকার। তাহলে ভাব মানে ইন্দ্রিয়াতীত নয়! চিহ্ন দিয়ে অতীতের বহমান ধারার সাথে সম্পর্ক তৈরী হয়। চিহ্ন না থাকলে আমরা কাকে জানতে চাই অথবা কি হারিয়েছি সেই প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকে না। আরেকটা বিষয়- দাউদের ধারণা উকিল মুন্সী কোন সুফী সিলসিলার অনুসারী না হয়ে পারেন না। গুরুবাদী ধারায় না গিয়ে এই ধরণের গান লেখা যায় না। আমি তার সাথে পুরোপুরি একমত হলাম না।
কিন্তু চিহ্ন কি দেয় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে থাকল। যদি বলি উকিল মুন্সীকে জানতে চাই- তার এক মানে হলো গানের বাণীর মর্ম উদ্ধার। কেন না, এই গান না হলেও তার অন্য কোন তাৎপর্য থাকত কিনা, সেই প্রশ্ন তুলে তো লাভ নাই। অচিন উকিল মুন্সীর দিকে যাত্রার শুরু তো গানকে সামনে রেখে। সে অর্থে নিছক কবরের দেখার মধ্যে তাকে বুঝার সম্পর্ক নাই। এর বাইরে কি আছে সেটাও আমরা নিশ্চিত না। তাহলে কি শুধুমাত্র গানের বাণী দিয়ে বুঝা যাবে নাকি অন্য কিছু!
আমরা যেখানে যাচ্ছি সেই স্থানের তার সাথে উকিলের বেড়ে উঠার যোগ আছে। যদিও, স্থান ইতিহাস নিরপেক্ষ বিষয়। তার ভূগোলের আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে। নানাভাবে সে সময়ের সাথে পাল্টেও যায়। কিন্তু সেই স্থানের অতীত বর্তমানের সম্পর্কের রেশ ধরে ঐতিহাসিক উকিল মুন্সীকে নিয়ে নিদেনপক্ষে কিছু অনুমান তো করা যাবে। এর বাইরে মহাপুরুষদের অনুসন্ধানের সাথে সাধারণ মানুষ আত্মিক সম্পর্ক অনুভব করে, যাকে এক অর্থে চিরায়ত নামে ডাকা যায়। তারা যেভাবে ডাকতে গিয়ে ডাকতে পারেন না- সেই অসম্ভব কি উকিল সম্ভব করেন নাই! যদি করে থাকেন, সেটা কি? শুধুমাত্র বাণীই কি সেই চিরায়ত হৃদয়ঙ্গমের খোরাক যোগাতে পারে? এর সাথে দার্শনিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক জিজ্ঞাসাও জড়িত। আপাতত এইসব প্রশ্ন নিয়েই আমাদের যাত্রা। উত্তর তো দূর কি বাত, আমরা নিশ্চিত না এই প্রশ্ন বা ভাবনার পরিচ্ছন্ন রূপ আমাদের সামনে হাজির হবে কিনা। দেখা যাক কি হয়। এলাহি ভরসা।
মহাখালি বাস টার্মিনাল থেকে বরাবর সকাল এগারোটায় বাস ছাড়ল। এর আগে কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছিলো বিকেল চারটার মধ্যে পৌছে যাবো। কিন্তু সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নামলাম মোহনগঞ্জ।এই অঞ্চলের মোহনগঞ্জ, ঠাকুরকোনা, সুসং-দুর্গাপুর সব জায়গায় একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছি- গাড়ীতে টিকেট কেটে উঠতে হয়, সময় মতো ছাড়ে কিন্তু পথে কতক্ষণ থামবে তার কোন বাধা-ধরা নিয়ম নাই। একবার তো দুর্গাপুর থেকে শ্যামগঞ্জ যাওয়ার পথিমধ্যে পেছনের গাড়ীর জন্য এক ঘন্টা অপেক্ষা করল। ঢাকার বাইরে গেলে মনে হয় মানুষের হাতে অফুরন্ত সময়!
মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরে নেমে দেখি বিদ্যুৎ নাই। মিজানকে মোবাইল করা হলো। এই অবসরে রুটি আর পরোটা খেয়ে নিলাম। মিজান আসলেন তার বন্ধু ফয়সলকে নিয়ে। দুইজনেই স্থানীয় কলেজে প্রথম বর্ষে পড়ে। কুশল বিনিময় শেষে প্রথম কাজ হলো থাকার থাকার হোটেল ঠিক করা। মোহনগঞ্জ স্টেশনের পাশে শাপলা হোটেলে উঠলাম। মোহনগঞ্জ স্টেশন চালু হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। ঢাকার কমলাপুর স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জগামী নিয়মিত ট্রেন আছে। এইখানকার মাছ বাজার বেশ বিখ্যাত। শাপলা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা খারাপ না। বোর্ডারে ভর্তি।
মিজান জানিয়ে গেলেন পরদিন সকালে আমাদের নিয়ে উকিলের অঞ্চলে যাবেন। চিন্তার বিষয় হলো কিভাবে যাওয়া যায়। মিজান গিয়েছিলেন বর্ষার সময়। বর্ষাকালে পুরো অঞ্চল পানিতে ভেসে উঠে। ট্রলারে করে হাওর হয়ে একেবারে উকিলের ভিটায় উঠা যায়। আমরা জিগেস করলাম- সেখানে এমন কারো সাথে কি দেখা হবে যিনি উকিল মুন্সীকে নিয়ে তথ্য দিবেন। তিনি জানালেন সেখানে দেখা হবে উকিল মুন্সীর মেয়ের সাথে। আমরা অবাক হলাম। উকিল মুন্সী যে সময়ের বলে জানি তাতে তার মেয়ে এতো বছর বেচে থাকার কথা না। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর যে তথ্য পেয়েছিলাম- তা ১৯২০ সালের দিকের কাহিনী। সে বইয়ে তাকে নিঃসন্তান বলা হয়েছে। সে সময় তার স্ত্রীও মারা যান। কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যকে মোবাইল করলে জানান, উকির মুন্সী মারা গেছেন একশ বছর আগে। সত্যি বলতে কি- উকিল মুন্সীকে নিয়ে যতটুকু জানা ছিলো সেই সামান্য জ্ঞানের উৎস হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাস ও বারী সিদ্দীকীর গাওয়া কয়েকটা গান। প্রসঙ্গত: এই উপন্যাস ছাড়া উকিলকে নিয়ে কোন লেখাজোখা চোখে পড়ে নাই- কেউ হদিসও দিতে পারেন নাই।
ইতিহাস আর ফিকশনের তফাত মানতেই হবে। এমনও হতে পারে সামনে আমরা যা কিছু আবিষ্কার করব তারও রূপ বিষয়ীগত চাহিদা দ্বারা নির্ধারিত হবে। তাই সত্য দাবির বদলে ন্যুনতম ভরসার আশা হয়তো আমরা করতে পারি- কিছু তথ্য তো জানা যাবে। সে যাই হোক, তখনকার অবস্থা নিয়েই বলি- অজ্ঞতা সংশয় আর উৎকন্ঠার পাখনা মেলে দিলো। আমরা কোন উকিল মুন্সীকে খুঁজতে এসেছি? দাউদকে বললাম, হয়তো নাতনীকে তারা মেয়ে বলছে। সে বলল, হতে পারে।
সকালে পরিচয় হলো মিজানের বাবা ছৈয়দ আছিউর রহমানের সাথে। বেশ মিষ্টি করে কথা বলেন। দাওয়াত করলেন তার বাড়ি ঘুরে দেখার জন্য। পরবর্তীতে শুধু বাড়ি দেখা নয়- দুপুর ও রাতের খাবার খেয়েছি তার বাড়িতে। তিনি মাইজভান্ডার শরীফের ভক্ত। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে তার পীরের নির্দেশে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। তার পিতৃভূমি চট্টগ্রামের টেকনাফ। তার আছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। তরীকতের পথে নিবেদিত প্রান মানুষটি আগলে রেখেছেন অনেক অজানা তত্ত্ব ও তথ্য। তার স্ত্রীর সংগ্রহে আছে জালাল উদ্দিন খাঁর জালাল গীতিকার প্রথম সংস্করণসহ বিভিন্ন সাধকের গানের বই।
এই অঞ্চলের মানুষ খুব সহজ করে কথা বলে। প্রশ্নও করে সোজাসুজি- কোন রাখ-ঢাক নাই। কথার মধ্যে কৌতুহল প্রকাশ পায়। শুনতে ভালোই লাগে। পরিচয় হয়েছিলো স্কুল শিক্ষক রইস মনরমের সাথে। রইস মনরম প্রতিভাবান ব্যক্তি। গান ও কবিতা লেখেন। নিজের বাড়িতে বাচ্চাদের নাচ, গান ও আবৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের সাথে উকিলের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও তিনি যেতে পারেন নাই। তিনি আমাদের বলেছিলেন সাত্তার পাগলার কথা। সময়ের অভাবে সাত্তার পাগলার সাথে দেখা করতে পারি নাই। তবে ফুটবল নিয়ে তার গানটি পড়েছিলাম। ছেলেকে ফুটবল খেলতে মানা করার ভেতর দিয়ে দুনিয়া নিয়ে কি চমৎকার গান লিখেছেন।
জৈনপুরে বেতাই নদীর ধারে উকিল মুন্সীর বাড়ীটি মোহনগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে। আগেই বলেছি বর্ষাকাল হলে সুবিধা ছিলো ট্রলার নিয়ে হাওড়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু ফাল্গুন মাসে সেখানে পানি নাই। আছে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। সেটাও নাকি দেখার মতো দৃশ্য। ব্যাটারীচালিত অটোতে করে যাওয়ার চিন্তা ছিলো। কিন্তু কোন গাড়ীওয়ালাই রাজী হয় না। আক্ষরিক অর্থে সেখানে কোন রাস্তা নাই। পরে দেখেছি আসলে যা আছে তা হলো রাস্তার কংকাল। শেষ পর্যন্ত মুশাবিদা হলো মোটর সাইকেল করে বেতাই নদীর পাড় পর্যন্ত যাবো। সেখান থেকে নদী পার হয়ে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। দুইশ টাকা ভাড়ায় মোটর সাইকেল পাওয়া গেল। ড্রাইভারের নাম কাজল। কাজল ভাই আমাদের তিনজনকে নিয়ে উড়াল দিলেন।
…. …. …. …. …
দুই. দিক ভূলানো পথ
আত্ম সুখে সুখী যারা প্রেম রতন কি চিনে না , পীরিতি সকলেই বুঝেনা । যে মইজাছে রূপের সনে কালির লেখা তার কি মানে মনে, ও সে ভয় করেনা ঝড়-তুফানে পার হয়ে যায় যমুনা। পীরিতি বিষম খেলা চণ্ডীদাস যে রূপে ভুলা গো , তেমনি লাইলির প্রেমে মজনু ভুলা লাইলার নাম আর ছাড়েনা। উকিলে গায় মনরে কানা, প্রেমের ঢেউ কি তোর লাগেনা, ও সে এই জন্মের পীরিতের খেলা ভাঙলে খেলা থাকেনা।
বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় সাহিত্যকীর্তির অন্যতম হলো ময়মনসিংহ বা মৈমনসিংহ গীতিকা। গত দুইশত বছরে সেই ময়মনসিংহ গীতিকা (ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা আর কিশোরগঞ্জ) অঞ্চলে জন্ম নেয়া প্রভিতাধর মানুষদের একজন উকিল মুন্সী। এই অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য গীতিকবিরা হলেন রশিদ উদ্দিন, জালাল খাঁ, চান খাঁ পাঠান, তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, দুলু খাঁ, আবেদ আলী, উমেদ আলী, আবদুল মজিদ তালুকদার, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, ইদ্রিস মিয়া, আলী হোসেন সরকার, চান মিয়া, জামসেদ উদ্দিন, গুল মাহমুদ, প্রভাত সূত্রধর, আবদুল হেকিম সরকার, খোরশেদ মিয়া, মিরাজ উদ্দিন পাঠান, আব্দুল হাকিম এবং আনোয়ারা বেগম। এই তালিকার শেষ দিকের বেশ কয়েক জন এখনো বেঁচে আছেন। এই গীতিকবিদের রেশ থেকে আলাদা করা যায় না আশেপাশের জেলাগুলোকে, যেমন- সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখানে জন্মেছেন হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আবদুল করিমের মতো গীতিকবিরা।
উকিলের বাড়ীর পথেই ফিরে আসি। ধুলোর রাজ্যে আমরা হারিয়ে যাই নাই- পেছনে রেখে যাচ্ছিলাম ধুলোর ঝড়। পথের দুইপাশে চোখের শান্তির জন্য অনেক কিছূ ছিলো। যতদূর চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। ফসলের মাঠ। এর ভেতর দিয়ে নিঃসঙ্গ রাস্তাটা ঘুমিয়ে থাকা ক্ষত-বিক্ষত পরাজিত এক অজগর যেন। পরাজয়ের ক্ষোভে এই দুনিয়াকে দুইভাগ করে মিলিয়ে গেছে কোন অসীমে। আমরা সাওয়ার হয়েছি সেই অজগরের পিঠে। মাঝে মাঝে ধানের ক্ষেতে দাড়িয়ে থাকা দুই একটা গাছকে অন্য রকম লাগে। এরমধ্যে জঙ্গল মতো দুইটা জায়গা পড়ল। একটাতে শুধুমাত্র এক জাতের গাছ দেখলাম। মিজান জানালেন এই গাছের নাম করচ। বেটে ধরনের মোটা গুড়ির গাছ। মাথায় এলোমেলো চুলের মতো ডাল-পালা। পরে জেনেছি শুধুমাত্র হাওর অঞ্চলে এই গাছ হয়। ফেরার পথে করচ বনে নেমেছিলাম।
কাজল ভাই অভিজ্ঞ ড্রাইভার। দুইপাশের ফসল ক্ষেত আর করচ বন দেখতে দেখতে মিনিট চল্লিশেক পর বেতাই নদীর পাড়ে হাজির হলাম। এই জায়গায় বেতাই নদী দুটি ধারা হয়ে দুই দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নদী পার হতে টাকা লাগে না। এরজন্য আছে এজমালি ব্যবস্থা। নদীর দুই তীরে দুটি খুঁটি পোঁতা। তাতে একটা দড়ি বাধা। দড়ি ধরে টান দিলে নৌকা চলতে থাকে। বেশ মজার অভিজ্ঞতা। কাজল ভাইয়ের ফোন নাম্বার টুকে রেখে জানালাম, ফেরার ঘন্টাখানেক আগে তাকে কল দেয়া হবে।
নদীর ঢালু পার বেয়ে উঠতেই জৈনপুরের কালিবাজার। বিশাল বট গাছের নীচে গোটা কয়েক দোকান। চা-বিড়ি, মুদি আর দর্জি সবই আছে। না থেকে উপায় নাই। এখান থেকে শুকনো মওসমে উপজেলা সদর বা কাছাকাছি অন্য হাটে যেতে তাদের মেলা ঝক্কি পোহাতে হয়। মটর সাইকেল অপ্রতুল, এছাড়া মটর সাইকেলে ছড়ার সামর্থ্য বেশির ভাগ মানুষের নাই। আমরা দয়ালের চায়ের দোকানে ঢুকলাম। দরকার মতো ধুলো-ধূসর হাত মুখ ধোয়া হলো। লাল চা খেয়ে একজন মুরুব্বীকে জিজ্ঞেস করলাম উকিল মুন্সীর বাড়ি কোথায়? জানালেন কাছেই। আরো জানালেন- এই গ্রামের কলম মেম্বার উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই। তিনি উকিল মুন্সীর যাবতীয় তথ্য জানাতে পারবেন। আমাদের পথ দেখাতে একজন এগিয়ে এলেন- কামরুল ভাই। কালিবাজারেই তার দর্জির দোকান আছে। স্ত্রীর সাথে মিলে চালান। সেটা আবার তার বসত বাড়িও। আসার সময় তার দোকান কাম বাড়িতে জিরিয়ে ছিলাম। হাটতে হাটতে নানা কথা হচ্ছিল। বর্ষাকালে কেউ মারা গেলে কবরের ব্যবস্থা কি? দাউদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন- বর্ষাকালে এখানে কবর দেয়ার মতো জায়গা খুব কমই থাকে। সবকিছু পানির নীচে তলিয়ে যায়। যাদের নিজস্ব উচু কবরস্থান নাই- তাদের লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়।
রাহবার কামরুল ভাই রাস্তা দেখিয়ে নিলে গেলেন বেতাই নদীর কূলে উকিল মুন্সীর বাড়ি। বাড়ির উঠানে বড়ই গাছের নিচে দুটি কবর। কাচা-পাকা বড়ইয়ের ভারে গাছটি নত। আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের মঞ্জিলে পৌছে গেছি। কিন্তু নিছক কারো কবর কি মঞ্জিল হতে পারে! নাকি একে উপলক্ষ্য করে আরো বড়ো কিছুর প্রত্যাশা করছি। তখন মানে হলো এটা শুধুমাত্র শুরুর নিশানা। দেখা যাক নিশানার নিশানা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যায়।
পাশাপাশি দুটি কবর। উকিল মুন্সীর পাশে তার ছেলে সাত্তার মিয়ার (আবদুস সাত্তার, এই অঞ্চলে মোটামুটি সব নামের পেছনে মিয়া যোগ করা হয়) কবর। তিনিও বিখ্যাত কবি ও গায়ক ছিলেন। গীতিকবি আবদুস সাত্তারের নাম জানা ছিলো। তিনি উকিল মুন্সীর ছেলে এই তথ্য আমাদের কাছে একদম নতুন। আবদুস সাত্তারের গানের বই আছে। আবদুস সাত্তারের কথা শাহ আব্দুল করিমের সাক্ষাৎকারেও উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে পরে আসছি।
চারদিকে নতুন ইটের অতি সাধারণ গাথুনী। আগের গাথুনী তুলে নতুন করে করা হয়েছে। দেখে মনে হলো আগের গাথুনী ছিলো ডাবল ইটের আর এখন সিঙ্গেল। দেখলেই বুঝা যায় বর্ষায় নদীর পানি বাড়লে পাশের রাস্তা পেরিয়ে কবরও ডুবিয়ে দিতে পারে। বেতাই নদীর সামনে বাঁক নেয়ার কারণে স্রোত এখানে এসে বেশি ধাক্কা দেয়। আমাদের দেখে বাড়ীর লোকজন এগিয়ে এলেন। চার-পাঁচজন মহিলা, একজন তরুন আর অনেকগুলো বাচ্চা। এরপর একজন বৃদ্ধও এগিয়ে এলেন। বৃদ্ধ জানালেন তিনি উকিল মুন্সীকে দেখেছিলেন। উকিল মুন্সী যখন মারা যান এই বৃদ্ধের বয়স ছিলো পয়তাল্লিশ বছর। বর্তমানে তার বয়স ছয়ষট্টি। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে উকিল মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের পরে মারা গেছেন। তিনি বললেন, না, যুদ্ধের পাচ-ছয় বছর আগে মারা গেছেন। আমাদের আক্কেল গুড়ুম।
এই মুসিবত থেকে উদ্ধারের পথ পেতে দাউদ জানতে চাইল- উকিলের কোন শিষ্য কি বেঁচে আছেন? একজন মহিলা জানালেন, তার শ্বাশুড়ী উকিল মুন্সীর মুরিদ। তার সাথে কথা বলতে চাইলে জানালেন- তিনি বিছানায় শয্যাশায়ী। কথা বলার অবস্থায় নাই।
বেশিরভাগ সময় মানুষ দরকারি কথাটা পরে বলে। অনেকক্ষণ পর যেন একজনের মনে পড়ল। তিনি বললেন, উকিলের বেটা সাত্তারের বউ এখনো জীবিত আছেন। কোথায় তিনি? এরমধ্যে একজন খবর নিয়ে আসলেন, তিনি গোসল করছেন। এই ফাঁকে আমরা চারপাশটা ঘূরে দেখছিলাম। কবর থেকে দুই কি তিন গজ পরে নদীর ঢালু তীর। এরপর নদী কিছুদূর গিয়ে বাঁক নিয়েছে । নদীতে এখন পানি নাই। কাদা আছে তলদেশে। সেই কাদায় একটা নৌকা নিয়ে বাচ্চারা টানাটানি করছে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদীর মতোই এই নদী বর্ষাকালে একদম ফুলেফেপে উঠে।
… … … … …
তিন. শুয়াচান পাখি আমার
শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি, আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি। তুমি আমি জনম ভরা ছিলাম মাখামাখি, আজ কেন হইলে নিরব মেলো দুটি আঁখি। বুলবুলি আর তোতা ময়না কত নামে ডাকি, শিকল ভেঙ্গে চলে গেলে কারে লইয়া থাকি। তোমার আমার এই পিরিতি চন্দ্র সূর্য্ স্বাক্ষী, হঠাৎ করে চলে গেলে বুঝলাম না চালাকিরে পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি।
সদ্য ওজু করা এক বৃদ্ধা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পড়নে কচু পাতা রঙের শাড়ী। বয়েস আন্দাজ করা যাচ্ছিল না। তার নাম রহিমা খাতুন। একজন বললেন, ইনি উকিল মুন্সীর বেটার বউ। আমরা সালাম জানালাম। বৃদ্ধা জানতে চাইলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি। সে খবর জানানোর পর বললেন- ঠিক আছে নামাজ পরে আদায় করবেন। আগে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিবেন। অদেখা উকিল মুন্সীর অনেক কিছু তার বয়ানে জানা গেলো।
সম্ভবত ১৯৮০-৮১ সালের দিকে উকিল মুন্সীকে অনেক শোক পোহাতে হয়। সে সময় তার স্ত্রী মারা যান। উকিল মুন্সীর স্ত্রীর মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস পর বড় ছেলে আবদুস সাত্তার মারা যান। রহিমা খাতুনের জবানে জানা যায় এই শোক উকিল ভীষণভাবে দুর্বল করে দেয়।
মোটামুটি আট মাসের ভেতরই বউ আর ছেলের পর উকিল মুন্সীও মারা যান। উকিল মুন্সীর জীবনকাল নিয়ে আগে থেকেই আমরা বিভ্রান্ত ছিলাম। হুমায়ুন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসের কাহিনী ধরে ভেবে ছিলাম উকিল মুন্সী মুক্তিযুদ্ধের আগে বা ব্রিটিশ শাসনামলে মারা গেছেন। অথচ উকিলের ছেলের বউয়ের মতে সেই মৃত্যু ঘটেছে ১৯৮০ – ৮১ সালে। সেই প্রসঙ্গে বলে রাখি বারী সিদ্দীকীর বরাতে জানা যায় মৃত বউয়ের শিয়রে বসে উকিল মুন্সী বিখ্যাত শুয়াচান পাখি গানটি রচনা করেন। উকিলের গানের সাথে সাথে শিষ্য রশিদ উদ্দিন এই সুরে উকিলকে সান্ত্বনা দেন। বারী সিদ্দীকী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের দুটো অংশই গেয়ে থাকেন। আবার কিছু বইয়ে লেখা আছে এই গানটি রশিদ উদ্দিনের।
কিন্তু রহিমা খাতুন এই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার দিকে গেলেন। তিনি বললেন, এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শীদকে। পীরের ব্যাপারে দাউদ আগে থেকে নিশ্চিত ছিলেন। আমার অবস্থা হলো- কিছুটা নড়েচড়ে বসলাম।
পীর যখন মারা যান, উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়… গানটি গাওয়ার পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান। এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেই উপলক্ষ্যে উকিল গানটি রচনা করেন। উকিল রহিমাকে এই ঘটনা জানিয়েছেন। এভাবে গানের মানে যখন পরিবর্তন হয়ে যায়- তখন অন্য গানগুলো নিয়েও কথা চলে আসে। তার মধ্যে একটা হলো আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে। তার আগে রহিমার খাতুনের মুখে উকিলের পীরের বৃত্তান্ত জানা যাক।
রহিমা খাতুন জানান, উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচি’র মোজাফফর মিয়া। যিনি সাহেব বাড়ীর মোজাফফর আহমেদ (রঃ) নামে পরিচিত। এই দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি, জাহাগীর দরবার শরীফ নামে পরিচিত। নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জের দুরত্ব কম নয়। কিশোরগঞ্জ অথবা সুনামগঞ্জ জেলা পার হয়ে নেত্রকোনা থেকে হবিগঞ্জ যেতে হয়। বর্ষাকালে উকিল মুন্সী হয়তো নৌকা নিয়ে হাওর পার হয়ে আসতেন। কিন্তু শুকানো মওসুমে সেই পীরদর্শন কেমন ছিলো?
এই দরবারে প্রতি বছর মার্চ মাসে বার্ষিক ওরছ হয়। মোজাফফর আহমেদ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী। মোজাফফর আহমেদের ছেলে কুতুব শাহও একজন পীর। তাদের তরিকা হলো চিশতিয়া। রহিমা খাতুনের দাদা পীরের আস্তানা চট্টগ্রামের মিজরাইল শরীফ। কক্সবাজারের কাছাকাছি। মিজরাইল শরীফ সম্পর্কিত কোন তথ্য আমরা প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাই নাই। তবে কক্সবাজারের কাছাকাছি সাতকানিয়ায় আছে মির্জারখিল দরবার। তবে রহিমা খাতুন মিজরাইল শরীফ বলতে এই দরবারকে বুঝিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে আরো অনুসন্ধানের পর আমরা নিশ্চিত হতে পারব। উকিল মুন্সী মোজাফফর আহমেদের পাঁচ খলিফার একজন। উকিলেরও কয়েকজন মুরিদ ছিলো। এখন রহিমা খাতুনের চাচী শাশুড়ী ছাড়া উকিলের কোন মুরিদ জীবিত নাই। পীরের ছেলের কুতুব শাহের কাছে তিনি আর তার স্বামী মুরিদ হন। এই বিষয়ে পরবর্তী অনুসন্ধানের ইচ্ছা আছে। তিনি আরো জানান- পীরের নাতি বলেছেন, উকিল মুন্সীকে আমার দাদা খেলাফত দিয়েছেন। তাকে শুধু উকিল মুন্সী বলবেন না- বলবেন হযরত উকিল মুন্সী।
উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই কলম মেম্বার (মতিউর রহমান) পীরের শানে রচিত একটি গান শুনান। এই গানটির রচিয়েতা উকিলের ছেলে আবদুস সাত্তার। আমরা মোবাইল রেকর্ড থেকে যেটুকু গান উদ্ধার করেছি গানটি হলো এই রকম- সরওয়ারে মদিনা তুমি আল্লাহর ওলি কুতুবুল আকতার শাহ পীর বদলে নুরে আলামীন জাহাগীর দরবার শরীফ রিচি করিলা তরাফ….ওহে নিরাশার আশা আসিয়া … ভক্তের আশা।
আষাড় মাইসা ভাসা পানিরে পূবালি বাতাসে, বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি,আমার নি কেউ আসে … এই অঞ্চলের বাইরে উকিলের জনপ্রিয় তিন বা চারটি গানের একটা। এই গানটি বারী সিদ্দীকীর কন্ঠে লেখক হুমায়ুন আহমেদ তার শ্রাবন মেঘের দিন চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। বাংলায় নারী ভাব নিয়ে গান গাওয়ার প্রচলন অনেক পুরানা। সেই ভাব বাংলার সর্বত্র আছে। বিরহী নারী ভাব সংগীতে তীব্র দ্যোতনা তৈয়ার করে, যা পুরুষ দিয়ে বুঝা যায় না। আত্মা-পরমাত্মা ও গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে এই ভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। উকিল মুন্সী ঘাটু গানের দেশের মানুষ। এই গানে পুরুষ রাধা বেশ নিয়ে কৃষ্ণের জন্য বিরহের গান গায়। যেহেতু আমরা পীর-শিষ্যের সম্পর্ক জেনেছি সেই দিক থেকে এই গানের স্বতন্ত্র্য তাৎপর্য হলো আষাঢ় মাসে সবাই নাইওর যায় কিন্তু উকিল যেতে চান কার্তিক মাসে। কেন? তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় পীরের মৃত্যু তারিখ থেকে। কেন না, উকিলের পীর মারা গেছেন কার্তিক মাসের শেষ দিকে। পীর-মুর্শেদের সম্পর্কের মধ্যে এটা খুব সাধারণ বিষয়- ভক্ত তার পীরের মৃত্যু দিনে মৃত্যু বরণ করতে চান। সেই আকুতি এই গানে প্রকাশ পেয়েছে। সব নাইওরী আষাঢ় মাসে বাপের বাড়ী গেলেও উকিলের নাইওর হবে কার্তিক। কিন্তু সেটা হয় নাই। উকিল মুন্সী মারা যান পৌষ মাসের দুই তারিখে।
পরে উকিল মুন্সীর ভক্ত মুক্তিযোদ্ধা দুলাল কমান্ডার আমাদের আরো কয়েকটি গানের লাইন শুনান। যেগুলো পীরের তরফে লেখা এই তথ্য না জানলে সঠিক মর্ম উদ্ধার করা কঠিন। প্রথম গানটি হলো- দক্ষিন হাওয়ারে লাগিস না মোর গায়, গায়ে লাগলে আগুন জ্বলে । দক্ষিনে হাওয়ারে চোখে নাহি দেখা যায়, দ্বিগুন জ্বালা লাগিলে আমার গায় ……। এই গানের দক্ষিন দেশ মানে পীরের দেশ। হবিগঞ্জ এই অঞ্চল থেকে দক্ষিণ দিকে। যে দেশে যেতে হয় হাওরের পর হাওর নৌকা বেয়ে। দক্ষিন দিকের হাওয়া তো পীরের গায়ে লেগে তারপর উকিলের অঞ্চলে আসবে। অথচ উকিল পীরের কাছ থেকে দূরে। এই হাওয়া তার কাছে পীরের পবিত্র স্পর্শ নিয়ে আসে। এই স্পর্শ এই আশেক বুঝতে পারে, যা না দেখার বিরহ আরো বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয় গানের কথায় সেটা আরো স্পষ্ট হয়। এই হাওয়ার মতোই পীরের খবর উকিলের বিরহ ব্যথা বাড়িয়ে দেয়। সে ব্যথা উকিল কেমনে সহ্য করেন!
সংবাদে কি অঙ্গ জুড়ায় সখি বিনা দরশনে, শিশিরে না ভিজে মাটি বিনা বরিষনে। যে যাহারে ভালোবাসে নয়নে নয়নেরই কোণে, তারে কি যাইরে ভোলা থাকিতে জীবনে। না দেখিয়া সংবাদ পাইলে দ্বিগুন দুঃখ বায়, যেমন কাটা গায়ে লেবুর রসে ধরে তার গায়…।
তৃতীয় গানটি হলো- এসো হে কাঙ্গালের বন্ধু তুমি দেখা দাও আসিয়া। আমার পুরা অঙ্গ জুরাইতাম তোমার চান্দ মুখ দেখিয়া।
এভাবে আরো কয়েকটি গান শুনেছিলাম যেগুলোর দ্বৈত অর্থ প্রকাশ পায়। কিন্তু আশেক-মাশুকের ভাব ছাড়া এই গানগুলো শিক্ষিত মানুষের কাছে যতই আদরণীয় হয়ে উঠুক- এর মর্ম না বুঝতে পারলে উকিল মুন্সীর গান, উপমা আর সেই হাওর অঞ্চলের উদাসী প্রকৃতিকে বুঝা সম্ভব না। হয়তো উকিলকে বুঝতে হলে আমাদের তাই করতে হবে। কিছুটা স্পষ্ট হয় যেন- এই গানের পেছনের মানুষটার হদিস জানা বড়ো প্রয়োজন। তাকে চিনতেন এমন সব মানুষের সাথে কথা বলার জরুরত তৈয়ার হলো। গানের ভাব নিয়ে যা বলছিলাম, সেই বিষয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো শাহ আবদুল করিমের গান। তার গান নিয়ে ব্যবসা হয়েছে বেশ। বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠানের বাহারী আয়োজন, বাদ্যযান্ত্রের ঝংকার ও গায়কীতে কূলহারা কলঙ্কীনি বা কৃষ্ণ আইলো রাধার কুঞ্জে মানব-মানবীর সাধারণ প্রেমের আইল টপকাতে পারে নাই। ক্ষেত্র বিশেষে সেই প্রেম শরীরের ভেতরের হৃদয়েরও খবর রাখে না। এর সাথে পরম সত্য খোঁজার বা সাধনার কোন যোগ পাওয়া যায় না। এতে অনেকের লাভ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভাবচর্চার দিক থেকে লোকসান হয়েছে ঢের।
উকিল মুন্সী এবং পীরকে নিয়ে একটা মজার ঘটনা জানিয়ে ছিলেন উকিল মুন্সীর ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুন। কাছেই তার বাড়ি। বাড়িতে খুজতে গেয়ে শুনি তিনি ডাক্তারের কাছে গেছেন। পথে উকিলের নাতনী জামাই (ছেলের দিক থেকে) ও রাজিয়া খাতুনের সাথে দেখা। আমাদের প্রশ্ন ছিলো, উকিল পীরের মুরিদ হবার পর শরিয়তের সাথে তার যোগাযোগ কেমন ছিলো?
সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন- বাবা আল্লাহওয়ালা মানুষ। নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। ছিলেন। তার সাথে পীরের সম্পর্ক ছিলো অন্য ভক্তদের চেয়ে আলাদা। পীর সাহেব নিজে গান না করলেও গানের কারণে উবিলকে বেশি স্নেহ করতেন। একবার পীরের দরগায় ওরছ ছিলো। শরীর খারাপ থাকায় উকিল যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব বেজায় রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন- উকিল মুন্সী আসলে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবা না। তার জন্য ওরছটাই নষ্ট হলো। কয়েকদিন পর উকিল মুন্সী পীরের সাথে দেখা করতে গেলেন।তিনি পীরের ঘরে ঢোকার আগেই গানে টান দেন- নিঃদুনিয়ার ধনরে…। এই গান শুনে পীর ঘর থেকে বের হয়ে উকিলকে হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল, আমাদের বললেন তারে যেন ঘরে উঠতে না দিই। আর এখন আপনি নিজেই তপস্যা ভেঙ্গে তারে নিয়ে যেতে আসলেন। পীর সাহেব কিছুই বললেন না।
এই কাহিনী বলতে গিয়ে রাজিয়া খাতুনের চেহারা ঝলমল করে উঠে। সেই মুখ আবার অশ্রুতে ভরে উঠবে।
>যেসব বন্ধুরা লেখাটি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
>আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ।
ভালো লাগল
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটা পাঠককে কতটুকু আকৃষ্ট করতে পারবে সন্দেহ ছিলো- তাই প্রথমে ছোট একটা অংশ দিয়া নিজেরে জানান দিয়ে রাখছিলাম।
সবার উৎসাহ ভালো লাগল।
পর্ব হিসেবে দেয়ায় খুশি হয়েছি! 😀
ধন্যবাদ।
আর দুইটা পর্ব করব।
অপেক্ষায় রইলাম। 🙂