জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ক্লান্ত ছেলেটি গলায় রশিটির বাঁধন আরো শক্ত করল। চেপে বসেছে এবার ভালোভাবে। দম বন্ধ হয়ে আসছে, সে আরো চাপ দিচ্ছে…বাতাসের প্রচণ্ড সংকট…
এই মুহূর্তে বিধাতা জীবন নামের চলচ্চিত্রটিতে ‘বিরতি’ দিয়ে দর্শক সারিতে বসা আমার দিকে তাকালেন।
আমি বলে উঠলাম,”প্রভু, এ ছেলেটির জীবনে সত্যিই কোন আশা নেই?”
উত্তর এল, “আছে। বেঁচে থাকলে সে একদিন পৃথিবীর অন্যতম সুখী মানুষ হবে।”
আমি ব্যাকুল কণ্ঠে বললাম, “তাহলে ছেলেটি কেন এ মহাপাপ করছে?”
বিধাতা আমাকে বললেন,”ও জানেনা। ওর ভেতরে বিশ্বাস বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব এখন আর নেই।”
আমার কণ্ঠের ব্যাকুলতা বাড়ে, “তাহলে আমাকে একটু পাঠান না ওখানে?আমি জানিয়ে আসি?”
প্রার্থনা গ্রাহ্য হল।
ছেলেটিকে সব জানালাম আমি, অনেক বুঝালাম। কিন্তু কোন বিকার নেই…সে আরো জোর করছে…তার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে…আমি ছুটে গিয়ে থামাতে গিয়ে ছিটকে পড়ার পর মনে পড়ল, আমি শুধু জানানোর অনুমতি নিয়ে এসেছি এখানে…আর বেশি কিছু না।
ছেলেটির গলা দিয়ে অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে…আমার চোখের সামনেই এটা হবে…আমি জানি আর বেশিক্ষণ নেই…ঘামছি আমি, কাঁপছি…
চেতনা হারালাম।
চোখ খুলে দেখি ওই ছেলেটার হৃৎপিণ্ডটি কাঁটাতারে ঝুলানো…আর ২টা বড় বড় রামদা নিয়ে দুজন মানুষ ওটার দিকে এগুচ্ছে…
নামিয়ে আনছে ওই ধারালো অস্ত্রগুলো নিষ্পাপ হৃৎপিণ্ডটির উপর…একবার না, বারবার।
চোখ পড়ল একজনের মুখের দিকে। থমকে গেলাম। হতবাক।
ওই ছেলের চেহারার সাথে এতো মিল…!পাশের জন? একজন মহিলা।
ভালো করে তাকালাম পুরুষটির দিকে।
ঘুম ভেঙে যাওয়ার আগ মুহূর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম পুরুষটি ছিল ছেলেটির বাবা।
দুঃস্বপ্ন দেখে এত অস্থির অবস্থা বোধহয় আমার ছোটবেলাতেও হয়নি। কী দেখলাম এটা? কেন দেখলাম?
উত্তরটা পাই আমি ঢাবি ক ইউনিটের পরীক্ষা শেষ হওয়া আর ফলাফলের মাঝের সময়টুকুতে।
দুঃস্বপ্ন না আমি বাস্তব দেখেছি। দেখেছি পরীক্ষা আশানুরূপ না হওয়ায় ফলাফলের আগেই ভেঙে চুরে একাকার হয়ে যেতে, পাগলের মত প্রশ্নটা নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় নষ্ট করতে, কাঙালের মত খুঁজে বেড়াতে উত্তর…জানতে, কতটা খারাপ দিয়েছে পরীক্ষা- ফলাফল পাওয়ার আগেই। নিজের উপর এতদিনের গড়ে তোলা বিশ্বাস এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজেকে ফেলে দিতে নির্বাক কৃষ্ণগহ্বরে।
একদম সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রিয় মানুষগুলোকে যখন এভাবে নিজেকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করার আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠতে দেখি, প্রচণ্ড কষ্ট হয়। যে মানুষটি একটা দিনের বাজে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সারাজীবনের ভাল ফলাফলকে ভুলে গিয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করা শুরু করে, এমনকি ফলাফল দেওয়ার আগেই, তার মানসিক অবস্থা কতটা খারাপ হতে পারে?
এরকম কঠিন স্নায়ুচাপের সময়ে এভাবে ভেঙে পড়ে যদি পরে ঘুরে দাঁড়াতেও পারে, মাঝের পরীক্ষাগুলোতে তার অবস্থা কি স্বাভাবিক থাকে? সে নিজের প্রতি আস্থা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে অবিশ্বাসের ফাঁস পরায় নিজের গলায়। শক্ত করে চাপিয়ে দিতে থাকে প্রতিনিয়ত। তার প্রভাব শৃঙ্খল বিক্রিয়ার মত ছড়িয়ে পড়ে তার পরের পরীক্ষাগুলোতে। অথচ সব ভর্তি পরীক্ষায় ফলাফল দেখে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হয়না! ১ নম্বরের ব্যবধানে কোথাও কোথাও কয়েকশত পরিক্ষার্থীর আগে পরে অবস্থান নির্ধারিত হয়! যে ছেলেটি ৭৫ পেয়ে ১০০০তম হয় আর যে ছেলে ৭৪ পেয়ে ১৪০০তম হয়, তাদের মেধার পার্থক্য কি আসলেই ৪০০?
জবাব কে দেবে?
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ এই আত্মহত্যাগুলোর জন্মদাতা।
প্রতিটি বাবা-মার স্বপ্ন থাকে তার সন্তানকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখার সময় তারাই থাকেন। কিন্তু সব বাবা-মা ১টা স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পরে সেটাকে সহ্য করে সন্তানের পাশে দাঁড়াতে পারেন নিজের দুঃখটাকে হাসিমুখ দিয়ে আড়াল করতে? নিজের বিধ্বস্ত সন্তানটির জন্য?
নাকি খুব কঠিন কাজটা? তাই বারবার ফলাফলের কথা, সম্ভাবনা আছে কি নেই জানতে চাচ্ছেন কুঁকড়ে যাওয়া সন্তানটির কাছে, তার নেতিয়ে পড়া স্নায়ুগুলোকে আরো ভেতরে সেঁধিয়ে দেওয়ার জন্য? একবার চিন্তা করেছেন, আপনার ঐ কথাগুলো আপনার সন্তানের হৃৎপিণ্ডটিকে কত নির্মমভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে?
আমি এখনও সন্তানের বাবা হয়নি, তাই হয়ত আমি বাবা-মার মানসিকতা বুঝব না। কিন্তু এইটুকু তো বুঝি, যে যোদ্ধা মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে, তার ক্ষতগুলোতে লবণ দিতে হয়না। চিৎকারটি এত বীভৎস হবে যে সেটা আপনাদের কান শ্রবণশক্তি হারানোর আশংকা বহন করে বেশ ভালোভাবেই।
“আগামীকাল কী হবে তা কেউ জানে না”- এই সাধারণ সহজ সরল সত্য কথাটি কতটা ভেঙে পড়লে মানুষ অবিশ্বাস করতে পারে?
এই ফাঁস পরানো আর রামদার ঝনঝনানির মাঝে আশ্রয় কি আছে?
অস্ট্রেলিয়ান সাঁতারু ইয়ান থর্প বলেছিলেন, “হারা মানে আমার কাছে ২য় হওয়া নয়। হারা মানে পানি থেকে ওঠার সময় এটা জেনে ওঠা যে আমার আরো ভালো করার সামর্থ্য ছিল।”
কোন ১ জায়গার মেধা তালিকায় অবস্থানের ভিত্তিতে তাই যেন নিজেদের আমরা চূড়ান্ত মূল্যায়ন না করি। নিজেকে নিজে মূল্যায়ন করি। কারণ এই আমাকে আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না।
শেষ পর্যন্ত, জীবনের অনিশ্চয়তাটুকু কে উপভোগ করতে শিখি।
তাহলে আর আমাদের স্বপ্ন কিংবা বাস্তবে এমন সব আত্মহত্যা আর হত্যা দেখতে হবে না, যেগুলোর কোন মামলা দায়ের করা যায় না।
জীবন সুন্দর-
যদি কেবল আপনি চান।
জীবনটা এভাবে এক নিমেষেই ছুঁড়ে ফেলার মতো কিছু না!!
এটা সবার জানার-বোঝার-উপলব্ধি করার যোগ্যতা থাকা উচিত………
জীবন সুন্দর-
যদি কেবল আপনি চান।
আর হ্যাঁ, অভিভাবক দের বোধহয় এখন বাধাধরা ধারণা থেকে বের হয়ে আসা উচিত………
সময়ের পরিবর্তনের সাথে অনেক কিছু বদলালেও, অনেক প্রয়োজনীয় ব্যাপারই বদলায় নি…
অথচ সময়টা আগের মত নেই…অনেক পথই পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে…
খুবই প্রয়োজনীয় একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন।
এবারের ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের হতাশা দেখার মতো। কোন এক অদ্ভুত কারণে, এবার ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের পরীক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিৎ কিছু বলতে পারছে না।
এ অনিশ্চয়তার জায়গায় দাঁড়িয়ে, পুরো মেধার যাচই পদ্ধতিকই প্রশ্ন করেছেন বলে, ভাল লাগলো।
লেখাটির শুরুটা মেটাফোরিক।আমার কেন জানি মনে হয়েছে, লেখক তার পরিচিত অনুভূতি থেকেই লেখাটা লিখেছেন। তারপরও, গুরুজনদের ই্চ্ছাকে সার্থক করতে গিয়ে হৃদপিন্ড কাটার যে মেটাফোর, আমার কাছে অতিরিক্ত মনে হলো। বাকি সব ভাল লেগেছে। সবচেয়ে নাড়া দিয়েছে,
এ কথাটি।
একটু মজা করই বলি, “লেখাটা আরো ভাল করা যেতো ” 😛
সত্য ঘটনা যদি বলি, তবে বলতে হয় আমি বেশ ভাগ্যবান। কারণ আমাকে এই কাটাকাটির ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। কিন্তু অনেককেই হয়েছে…
মেটাফোরের জাস্টিফিকেশন দিতে যাবো না, কিন্তু প্রিয়জনের স্বপ্ন ধ্বংস করার অপরাধবোধটা যদি প্রিয়জনের আচরণেই জেগে ওঠে, তবে কষ্টটা বোধহয় একটু বেশিই হয়!
পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, মন্তব্যের জন্য আরো বেশি! 🙂
জীবন সুন্দর-
যদি কেবল আপনি চান।
চাওয়া-পাওয়ার মনস্তত্বে অনেকেই হারিয়ে যায় কিংবা যেতে বাধ্য হয়।
বিশেষ করে আমাদের দেশে মেধা মূল্যায়নের বিষয়টিতে।
বাবা-মা-সন্তানের মানসিকতার সার্বিক পরিবর্তন তখনই হবে যখন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন সম্ভব হবে।
অর্থনৈতিক চাপের মুখে বাবা-মায়েরাও সন্তানের প্রতি বিরূপ আচরণ প্রদর্শনে বাধ্য হন।
মধ্যবিত্ত পরিবারে সন্তানের উপর তাই পারিপার্শ্বিক চাপটাও দুঃখজনকভাবে বেশিই থাকে।
যেকোন অবস্থায় স্বপ্ন দেখতে পারার কুফল বোধহয় এটা।
ঘটনা প্রবাহের আড়ালে লুকিয়ে গাল বেয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা অশ্রু কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করেনা। তাই জানাও হয়না না বলা কষ্টগুলোর কথা।
🙁
এই জীবন আক্ষেপের নয়। জীবনে শেষ সুযোগ বলে কিছুই নেই।
আর আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ গুলোতে মানুষকে চলতে হয় ভাগ্যের সহায় হয়ে !!! যা মোটেও কাম্য নয়
সমস্যাটা সিস্টেমের,প্রত্যাশা কোন সীমানা না মানলেও,
আমাদের সিস্টেম সেটার ধারেকাছেও নেই।
সিস্টেম তো আমাদেরই বদলাতে হবে!
মেইন থিম ভালো লাগছে