উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে (১ম পর্ব)
চার. উদাসী জীবন
মনের দুঃখ মনে রইলোরে বুঝলিনারে সোনার চান। চন্দ্র সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান।
রহিমা খাতুন বললেন, ‘তিনি তো উদাসী মানুষ ছিলেন’। কিন্তু এই উদাসী মানুষের জীবন সহজ ছিলো না। দুলাল কমান্ডারের মতে- ভবঘুরে যাকে বলে তাই হলো উকিল মুন্সী। বয়সকালে তিনি ছিলেন লম্বা চাওড়া। দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো সুন্দর। গলা ছিলো বেশ চড়া। তার গান রেকর্ড করা নিয়ে একটা গল্প আছে। একবার তিনি গান রেকর্ড করতে কলকাতা গিয়েছিলেন। গান রেকর্ড হয় না। কারণ চড়া গলায় যখন টান দেন রেকর্ড ফেটে যায়। তারা জানান, উকিলের আযান অনেক দূর থেকে শুনা যেতো। ঠিক এখনকার মাইকের আযানের মতো। বেতাই নদীর দুই কূলের দুটি মসজিদে তিনি ইমামতি করেছিলেন। রাজিয়া খাতুন জানান, তিনি আব্বাস উদ্দিনের সময়ের মানুষ।তার গান গাওয়ার আলাদা কোন মেজাজ ছিলো না। তিনি যেকোন জায়গায় গিয়ে গান গাইতে পারতেন।
দুলাল কমান্ডারের বরাতে জানা যায় উকিল মুন্সী জীবদ্দশায় বেশ সম্মান পেয়েছিলেন। তিনি একটা ঘটনা উল্লেখ করেন। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জনসমাবেশে উকিল মুন্সী গান গেয়েছেন। নেত্রকোনায় একবার মাওলানা মনজুর হকের বিরাট মাহফিল হয়। সেখানে হক সাহেব উকিল মুন্সীকে দিয়ে মোনাজাত করান।
উকিল মুন্সীর মূল নাম আবদুল হক। তার মাকে বলা হতো উকিলের মা। কেউ কেউ বলে তার মায়ের ইচ্ছে ছিলো ছেলেকে উকিল বানাবেন। সেই থেকে উকিলের মা। আর যেহেতু মসজিদে ইমামতি ও মক্তবে পড়াতেন তাই মুন্সী। এইভাবে তার নাম উকিল মুন্সী। তার জন্ম সাল জানা যায় না। হাওর বেষ্টিত উপজেলা খালিয়াজুরির বোয়াইলে উকিল মুন্সীর জম্ম। এই খালিয়াজুরি হলো ময়মনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত চরিত্র মহুয়া মলুয়ার আদি বাসস্থান। অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলও ঐতিহ্যিকভাবে শিল্প সংস্কৃতি ও খেলাধূলায় সবসময় প্রাণবন্ত। জারি সারি ভাটিয়ালীর সাথে এই অঞ্চলের কুস্তি-নৌকাবাইচও বিখ্যাত। সেই সাংস্কৃতিক আলো-হাওয়ায় উকিলের বেড়ে উঠা। উকিল প্রায় একশ বছরের বেশি সময় বেঁচে ছিলেন।
দুলাল কমান্ডার, ছোটখাট এই মানুষটি এসেছেন মোহনগঞ্জের পাশের উপজেলা মদন থেকে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যুদ্ধে তার সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শিল্পী বারী সিদ্দিকীর বড়ো ভাই হাসেম। তিনি বলেন-তিনি উকিল মুন্সীর বিষয়ে কোন মিথ্যা বলছেন না। হামে চ্যায়হে সাচ বাত বলতা হ্যায়, কিসিকা লোকসান নেহি। মদন খালিয়াজুরিরও পাশের উপজেলা।
উকিলের বাবার নাম মওলানা গোলাম রসুল। তার বেশ নাম ডাক ও টাকা পয়সা ছিলো। উকিলের মায়ের বাড়ি জালালপুরের ধলা চৌধুরীর বাড়ি নামে পরিচিত। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা কাজলীর মেজর জে. মতিন উকিলের মামাতো ভাই। উকিল নিজেও বিয়ে করে জালালপুর থাকতেন। বিয়ে নিয়ে প্রচলিত আছে, উকিল মুন্সী বিয়ের আগেই সেই অসাধারণ রূপসী নারী লাবুশের মা-র প্রেমে পড়েন। তিনি বিরহকাতর হয়ে গান বাঁধেন- ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।
জালালপুরে উকিল প্রায় চল্লিশ বছর ছিলেন। রতন চেয়ারম্যানের বন্ধুত্বের সুত্র ধরে উকিল মুন্সী মোহনগঞ্জ থানার জৈনপুরে আসেন। জালাল পুরের সেই বাড়িটি এখনো আছে। উকিল মুন্সীর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে। আবদুস সাত্তার বা সাত্তার মিয়া ও নুর ইসলাম বা পুলিশ মিয়া। দুই ছেলে মারা গেছেন। দুই মেয়ে এই পাড়াতেই থাকেন। আয়েশা আক্তার ও রাজিয়া খাতুন। বড় মেয়ের সাথে দেখা হয় নাই। তিনি অসুস্থ্য। ছোট মেয়ের কথা আগেই উল্লেখ করেছি।
খুবই অল্প বয়সে উকিলের বাবা মারা যান। এরপর মামারা তার মাকে আবার বিয়ে দেন। তখন থেকে উকিল মুন্সী ভবঘুরে হয়ে যান। সেই সময় কিছুদিন ঘাটুগানের দলেও ছিলেন। এই তথ্য অবশ্যই তার পরিজনরা দেন নাই। ভবঘুরে উকিল বাবার সম্পত্তির দিকে না তাকিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলে যেতেন। সেই থেকে গানের দিকে তার ঝোক বাড়ে। আস্তে আস্তে পৈতৃক সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যায়। প্রথম জীবনে পীরের বাইয়ত নেয়ার আগে পর্যন্ত তিনি পালা গান গাইতেন। পরে পীরের নির্দেশে পালা গান ছেড়ে দেন। তিনি শুধুমাত্র একতারা দিয়ে গান গাইতেন। পীরের কাছে কখন বাইয়াত নিয়ে ছিলেন তা জানা যায় না। সম্ভত ১৯৫০ সালের আগের ঘটনা এটি।
দুলাল কমান্ডার জানান-১৯৫৪ বা তারও আগে থেকে তিনি উকিল মুন্সীর কাছে পড়েছেন। মহারাণীর ভিক্টোরিয়ার ছবি আঁকা বাল্য শিক্ষার হাতে খড়ি হয় উকিলের হাতেই। তিনি অনেক শ্লোক পড়াতেন। তিনি উকিলের আশি বছর বয়স থেকে দেখেছেন। দুলাল কমান্ডার উকিলের ছেলে সাত্তারের বন্ধু। আবদুস সাত্তার ছিলেন পাকিস্থান আমলের মেট্রিক পাশ, ময়মনসিংহের বাউল সম্মেলনে গোল্ড মেডেলিষ্ট। দুলাল কমান্ডার সাত্তারের বউ রহিমা খাতুনকে বোন বলে ডাকেন।
রহিমা খাতুনের বাপের বাড়িও বোয়ালীতে। তিনি সাত বছর বয়স থেকে মক্তব্যে উকিল মুন্সীর কাছে পড়তেন। উকিল মুন্সী তাকে ভালো ভালো কিতাব উপহার দিতেন। এসব বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। এক সময় উকিল রহিমা খাতুনকে তার ছেলের জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলে তার মা-বাবা আপত্তি জানায়। কেন না আবদুস সাত্তার ছিলেন বিবাহিত। নানা ঘটনার পর পরবর্তীতে রহিমা খাতুনের বিয়ে হয় আবদুস সাত্তারের সাথে।
রহিমা খাতুনের মতে, বিয়ে হয়েছে সংগ্রামের পরে। রহিমা খাতুনের বিয়ে যদি সংগ্রামের পরে হয় তাহলে উকিল মুন্সীর পীর মারা যান সংগ্রামের পরে। কেন না উকিল মুন্সী সেখান থেকে এসেই তার পীরের মারা যাওয়ার খবর রহিমা খাতুনকে দেন। তাহলে শুয়াচান পাখি গানটি মুক্তিযুদ্ধের পরে লেখা।কিন্তু মুশকিল হলো এই অঞ্চলের মানুষের সময় নিয়ে হিসেবে গণ্ডগোল আছে। সুতরাং, সেই প্রসঙ্গ আপাতত থাক।
১৯৮০-৮১ সালে উকিল মুন্সীর বউ মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর ছেলে আবদুস সাত্তার জ্বরের শরীর নিয়ে দূরে কোথাও গান গাইতে যান। অসুস্থ্যতা বাড়লে তিনি সেখানে মারা যান। পর পর দুটো শোকে উকিল মুন্সী মুষড়ে পড়েন। এই সময় উকিল মুন্সী বাড়ির বাইরে যেতেন না। শরীরের বেগতিক দশার কারণে ততদিনে ইমামতি ছেড়ে দিয়েছেন। সারাক্ষণ বাড়ির উঠানে ছেলের কবরের কাছে বসে থাকতেন। কখনো কখনো বড় নাতি বুলবুলকে বলতেন- সাত্তারের কবরের কাছে বসে বেহেলা বাজাতে। রহিমা খাতুন আপত্তি করতেন- কবরের কাছে বসে বেহেলা বাজানো কেন?
স্বামী মারা যাবার সাত মাস পর রহিমা খাতুন বাপের বাড়ি বোয়ালীর জালালপুর চলে যান। যাবার কালে উকিল মুন্সী তাকে বলেন- দাবি রাইখও না। বাচ্চাদের কষ্ট দিও না। তুমি আর বিয়ে কইর না। এই জীবন মেনে নাও। তোমার সাথে এই শেষ দেখা। এর আটদিন পর রহিমা খাতুনের কাছে খবর গেলো তার শ্বশুর মারা গেছেন। এর আরো পরে রহিমা খাতুন এই বাড়িতে ফিরে আসেন। তার চার মেয়ে, দুই ছেলে। এরা কেউ এখানে থাকে না। উকিলের ভিটায় এখন তিনি একা থাকেন। উকিলের কথা মতো অল্প বয়সের সেই বৈধব্য তিনি মেনে নিয়েছেন। ভেজা চোখে বললেন- তারা খুব গরীব। উকিলের স্মৃতি রক্ষার জন্য কিছু করার সামর্থ্য তাদের নাই।
উকিলের মৃত্যুর বছর একদম নিশ্চিত হওয়া যায় নাই। দুলাল কমান্ডার আর কলম মেম্বারের মতে-এটা বঙ্গবন্ধু বা এরশাদের শাসনামল না।এর মাঝামাঝি সময়। উকিলের মেয়ে রাজিয়া জানিয়েছিলেন তার এক ছেলের বয়স ত্রিশ বছর। যার জন্ম উকিলের মৃত্যুর এক বছর আগে।
উকিলের গানের সংখ্যা কারো জানা নাই। উকিল মুন্সী প্রায় অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় সংগীত সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। সেই হিসেব তার গানের সংখ্যা বিপুল হবার কথা। রহিমা খাতুন নিজেও গীতিকার। তিনি উকিল মুন্সী ও আবদুস সাত্তারের গান সংগ্রহ করছেন। তার কাছে উকিল মুন্সীর বাষট্টিটি গান আছে। দুলাল কমান্ডারও উকিলের গান সংগ্রহ করছেন। তার কাছে আছে চল্লিশটির বেশি গান। দুলাল কমান্ডারের কাছে গান সংগ্রহের খাতাটি সবসময় থাকে। তিনি যেখানে যান সাথে করে নিয়ে যান, যদি উকিলের গান জানে এমন কারো সাথে দেখা হয়ে যায়। তাদের ইচ্ছে একদিন উকিল মুন্সীর গানের সংকলন বই আকারে বের হবে।
… … … … …
পাঁচ. সঙ্গের সাথী
রজনী প্রভাত হলো ডাকে কোকিলা, কার কুঞ্জে ভূলিয়া রইলাম শ্যাম চিকন কালা। আতর গোলাপ দিয়া সাজাইলাম বাসর, ফুলের শয্যা হইল বাসি, নইলে প্রাণেশ্বর, কি করি এখন কোন দুশমনে, বাঁকে বাঁধে আমার প্রানধন…।
রহিমা খাতুন বা দুলাল কমান্ডার দুই জনেই বললেন, উকিলের কোন শিষ্য বেচে নাই। শিষ্যদের কোন শিষ্যের কথাও তাদের জানা নাই। কিন্তু এটা যে একেবারে নিশ্চিত তথ্য তা মেনে নেয়া কঠিন। তার শিষ্যের কি শিষ্য নাই! উকিলের চিন্তার কোন পরম্পরা বা সিলসিলা না থাকলে এই কালে তাকে বুঝা মুশকিল। এছাড়া তার সমসাময়িকতা ঠিক করতে না পারলে এই অঞ্চলের ইতিহাস ও নানা পথ-মতের সম্পর্কের ধরণের দিক থেকে তাকে স্পষ্ট করে তোলা যাবে না। সে দিক থেকে তার সমসাময়িক গীতিকবিদের সাথে তার সম্পর্ক জানার জরুরত তৈরি হয়। পর্যাপ্ত তথ্যসুত্র হাতে না থাকায় এবং আমাদের অনুসন্ধান অসম্পূর্ণ হওয়ায় সে প্রসঙ্গে আপাতত দুই একটি কথা তোলা হলো।
রহিমা খাতুনের বরাতে জানা যায় সুনামগঞ্জের ধলের শাহ আবদুল করিমের (ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯১৬ – সেপ্টেম্বর ১২, ২০০৯) সাথে উকিল মুন্সীর পরিচয় ছিলো। তারা এক সাথে গান করেছেন। মোহনগঞ্জ নেত্রকোনার সীমানা ঘেষা। এরপরেই সুনামগঞ্জ জেলা। উকিলের ছেলে আবদুস সাত্তার ছিলেন আবদুল করিমের সমবয়েসী। রহিমা জানান শাহ আবদুল করিমের সাথে উকিলের বেশ সখ্যতা ছিলো।
কবি টি এম আহমেদ কায়সারের নেয়া শাহ আবদুল করিমের সাক্ষাৎকার ছোট কাগজ খোয়াবে (সেপ্টেম্বর ১৯৯৭) ছাপা হয়েছিলো। করিম তার সমসাময়িকদের সম্পর্কে সেই সাক্ষাৎকারে জানান- আমার সমসাময়িক কেউ এখন আর বেঁচে নেই। যাদের সঙ্গে গান করেছি তাদের মধ্যে সাত্তার মিয়া, কামালুদ্দিন, আবেদ আলী, মিরাজ আলী, বারেক মিয়া, মজিদ তালুকদার, দূর্বিন শাহ এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এছাড়া ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গান করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে,তাদের সবার নাম এখন আর মনে নেই। তুলনামুলক ভাবে আমার গাঢ় হৃদ্যতা ছিলো নেত্রকোনার সাত্তার মিয়ার সঙ্গে। মজিদ একদা অন্যের গান নিজের নামে গাইতো। কারন জিজ্ঞেস করলে বলতো -গানটা গাইতেছে কে? হোক অন্যের; আমি যখন অন্যের গান করি তখন আমিও তো একই ভাবের ভাবুক থাকি। আমার কথা আমি বলবোনা কেনো? জালালউদ্দিন, উকিল মুন্সী আমার চাইতে বয়সে যদিও অনেক বড় ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমি দু-এক আসরে গান করেছি।
উকিল মুন্সীর সাথে সুসম্পর্ক ছিলো নেত্রকোনার আরেকজন বিখ্যাত গীতিকবি রশিদ উদ্দিনের (জানুয়ারি ২১, ১৮৮৯ – ১৯৬৪) । শুয়াচান পাখি গানটির একটা অংশ তার লেখা। তার জনপ্রিয় একটি গান হলো- মানুষ ধরো মানুষ ভজ, শোন বলিরে পাগল মন। আরেক খ্যাতনামা গীতিকবি জালাল উদ্দিন খাঁ (এপ্রিল ২৫ এপ্রিল ১৮৯৪- আগস্ট ০১, ১৯৭২)ছিলেন রশিদ উদ্দিনের সাগরেদ। সারা জীবনের সংগীতের পেছনে ছোটা রশিদ উদ্দিন তার বাড়িকে বাউল তত্ত্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত করেন। ফলে নানা চিন্তা ও মতের গীতিকবিরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন।। এ কেন্দ্রে সহযোগী হিসেবে সাধক উকিল মুন্সী সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তার সাথে আরো ছিলেন মোহনগঞ্জ থানার হাসলার চান খাঁ, মদন থানার হাজরাগাতির পিতাম্বর রবিদাস। মধ্যাহ্ন উপন্যাসে হুমায়ুন আহমেদ জালাল উদ্দিন খাঁ-কে উকিলের শিষ্য বলে দাবি করেছেন। তিনি সিরাজ আলী নামে আরেক শিষ্যের নাম উল্লেখ করেন। রশিদ উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন খাঁকে ধরে এই অঞ্চলের গানের ধরণ, তত্ত্ব জিজ্ঞাসা ও সাধনার ধারা সম্পর্কে এবার সামান্য কিছু তথ্য জুড়ে দিলাম।
বাংলার ভাব গানের মূল নিমিত্ত হলো এই জীবন ও জগত নিয়ে অনুসন্ধান। এই অনুসন্ধানে অন্তর্ভুক্ত আছে মানুষ-মানবদেহ-প্রকৃতি, সৃষ্টিরহস্য, গুরু সাধন, নিঘোর তত্ত্ব, আত্না-পরমাত্না প্রভৃতি। এইসব চিন্তা গুরু ও ঘারাণাকেন্দ্রিক সাধনার সিলসিলা দ্বারা জারিত। এই ধরণের গানের বিকাশ যেখানে ঘটেছে, সব জায়গায় এই গানগুলো এক ধরণের সার্বজনীনতা হাসিল করে নিয়েছে। ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ সেখানে থাকে না। সেই সব গানের উপাদান আকারে যেমন থাকত হিন্দু শাস্ত্রের মহাভারত, রামায়ণ ও গীতা, একইভাবে থাকত ইসলাম ধর্মের নানা বাহাস, কোরান-হাদিস, জঙ্গনামার পুঁথি ও শহীদি কারবালাসহ প্রভৃতি। এইসব গানের বিভিন্ন ধরণ আছে। এর মধ্যে একটি হলো লড়াই। কবিগানের সেই সিলসিলা এখনো বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান। এখানে মোটাদাগে কবিগান বললেও এর আছে নানান ধরণ ও ধরণভেদে নামও আলাদা।
বাউল গান পরিবেশনের একটি বিশেষ রীতি ‘মালজোড়া’ গানের আসরে অংশগ্রহণ জালাল উদ্দিন খাঁ বেশ নাম কুড়িয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বাসাটি গ্রামে এক মালজোড়া গানের আসরে জালাল উদ্দীন খাঁ ধরাট বা প্রশ্ন রেখেছিলেন আল্লা বলতে কেউ নাই এ সংসারে, মিশে গেছে আলো হাওয়ায় বিশ্বজুড়ে তালাশ কর কারে? তার প্রতিপক্ষ বাউল ইদ্রিস এই ধরাটের উত্তর দিয়েছিলেন রশিদ উদ্দিনের একটি গানের সাহায্য নিয়ে – জালাল তুমি ভাবের দেশে চল-আল্লাকে দেখবে যদি চর্মচক্ষের পর্দা খোল, গিয়া তুমি ভাবনগরে চেয়ে থাকো রূপ নেহারে, সজল নয়নে ফটোগ্রাফ তোল, মনরঙে প্রেমতরঙ্গে তোমার দিলের কপাট খোল, দেখবে তোমার মাবুদ আল্লা সামনে করে ঝলমল। গায়ক আবদুল আলিমের কন্ঠে জনপ্রিয় হওয়া এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, এতো যত্মে গড়িয়াছেন সাই… গানটির গীতিকার রশিদ উদ্দিন। এই তর্কের গান দুটিতে মনোযোগ দিলে বুঝা যায়, তাদের চিন্তা-চেতনা ও ভাব কত উচ্চমূল্য ধারণ করে।
রশিদ উদ্দিন ছিলেন এক লেংটা ফকিরের শিষ্য। অন্যদিকে জালাল উদ্দিন খায়েঁর সংগীত সাধনায় রয়েছে শাক্ত প্রভাব। তিনি কোনো এক শাক্ত সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। জালাল উদ্দিন খাঁ অনেক গান রচনা করেছিলেন। তার জীবদ্দশায় চার খণ্ডের জালাল-গীতিকা গ্রন্থে ৬৩০টি গান প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় জালাল-গীতিকা পঞ্চম খণ্ড। মোট ৭০২টি গান নিয়ে ২০০৫ সালের মার্চে প্রকাশিত হয়েছে জালাল-গীতিকা সমগ্র। জালাল তার গানগুলোকে বিভিন্ন তত্ত্বতে বিন্যস্ত করে প্রকাশ করেন। সেই তত্ত্বগুলোর নাম- আত্মতত্ত্ব, পরমতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, লোকতত্ত্ব, দেশতত্ত্ব, বিরহতত্ত্ব। জালাল উদ্দিন খাঁ ও রশিদ উদ্দিন প্রমুখের গান বইয়ে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া তাদের গান নিয়ে অনেক কথাবার্তা আছে। সেদিক থেকে উকিলকে নিয়ে তেমন কোন কাজ হয় নাই।
রশিদ উদ্দন ও জালাল উদ্দিন খায়েঁর সাথে সম্পর্কের কারণে উকিলের সময়কালটি বুঝা যায়। তিনি সম্ভবত জালাল উদ্দিন খায়েঁর সমবয়েসী। তবে তার বংশধরদের মতে তিনি একশ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন। এই তথ্য সঠিক হলে উকিল মুন্সীর জন্ম ১৮৮০ সালের আগে। রশিদ উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন খায়েঁর গানের সম্পর্কে বলার কারণ হলো- একই অঞ্চল এবং গুরু-শিষ্য হবার কারণে এই দুইজনের গানের ধরণ ও চিন্তার মাঝে নানা মিল থাকে পারে। আবার তন্ত্র-মন্ত্রগত পার্থক্য থাকতে পারে। উকিলের গানগুলো সংকলিত হলে উকিলের গানের ধরণ স্পষ্ট হওয়া যেতো। সেই ক্ষেত্রে অঞ্চলগত এবং সাধারণ বৈশিষ্ট্যের সাথে সাথে মিল-অমিল জায়গাগুলো ফুটে উঠত।
এই কথা সহজে বলা যায় এই গীতিকবিদের গান ভাবের দিক থেকে উচ্চমানের। ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের চিন্তাভাবনার স্বাধীন-স্বতন্ত্র্য রূপ আছে। মধ্যযুগের ময়মনসিংহ গীতিকা সেই স্বাধীন-স্বাতন্ত্র্য জীবন চেতনার কথাই বলে। বিশেষ করে যখন বলা হয়ে থাকে উকিলের জন্মভূমিতে মহুয়া, মলুয়ার জন্ম। সেই সময় এখনকার মানুষ কেন্দ্রের শাসন ও ধর্মীয় গোড়ামী থেকে এক প্রকার মুক্ত ছিলো। সেই প্রভাব কি পরবর্তীতে পড়ে নাই! এই অঞ্চলে টিপু পাগলার নেতৃত্বে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে ১৮২৭ সালে পরিচালিত হয় ফকির বিদ্রোহ। সেই বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়।কিন্তু এর বিশাল সাংস্কৃতিক প্রভাব থেকে যায়। এর পরে এই অঞ্চলে লেংটা ফকিরদের জলসা হতো নিয়মিত। এর প্রভাব কম নয়। আবার আমরা উকিলের দিকে ফিরলে দেখি- তিনি নেত্রকোনা বা ময়মনসিংহ অঞ্চলে স্থিতু ছিলেন না। তিনি নিজ সাধন অন্বষণে সুদূর হবিগঞ্জের রিচি’র দরবারের মোজাফফর আহমেদের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছেন। সেই দিক থেকে তিনি সম- সাময়িক অন্যদের সাথে ভেদ রচনা করেছেন। সেখানেও বুঝার বিষয় আছে।
একই সাথে হাওর অঞ্চলের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জীবন আচরনের আলাদা একটা দিক তো আছে। বর্ষায় এই অঞ্চলের মানুষ আক্ষরিক অর্থে পানি বন্দী। এখনো সেই অবস্থা বিশেষ উন্নতি হয় নাই। বছরে কেবলমাত্র একটি মাত্র শস্য উৎপাদন, মৌসুমি বেকারত্ব, অবসর, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যোগাযোগের অভাব, সারা বছর কাজের অনিশ্চয়তা কারণে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা সমস্যা সেখানে ছিলো্। এই ধরণের অঞ্চলে উচ্চতর ভাবের গানগুলো একই সাথে সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক অনুসঙ্গ বটে।
এইসব ঐতিহাসিক সম্পর্ক সুত্র ও ব্যক্তিক অভিমুখ উকিলের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গকে সমৃদ্ধ করেছে। অন্য গীতিকবিদের সাথে কিছুটা দুরত্ব রেখেই যেন উকিল মুন্সীর গানে সাধারণ মানুষের প্রত্যাহিক অভিজ্ঞতা ধরা পড়েছে। তার গানে প্রেম বিরহ, প্রকৃতি কাতরতা মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক অন্বেষা ফুটে উঠে। ভাটি অঞ্চলের উদাসী প্রকৃতির ভেতর দিয়ে তিনি জগতকে আবিষ্কারের চেষ্ঠায় রত যেন। সেই কাতররূপ শ্রোতাকে তার দিকে টানে। একজন গীতিকবি কি সেই কাতরতায় ডুব দেয়- যে পথ সে একাকী পাড়ি দিতে পারে না। দার্শনিক, পরমার্থিক জিজ্ঞাসা সে পথ চলায় ভর করে। সে পথ জিজ্ঞাসাকে আরো কষ্টকর করে তোলে। সেই জিজ্ঞাসার শেষ কোথায়!
ঢাকায় জেনেছি জালাল উদ্দিন খাঁয়ের সাথে পালা গানের আসরে উকিল মুন্সীর লড়াই হতো। এরমধ্যে বিখ্যাত হলো শরীয়ত-মারেফাত পালা। এই পালায় উকিল মুন্সী নিতেন শরীয়তের পক্ষে আর জালালউদ্দিন খাঁ নিতেন মারেফতের পক্ষে। তার বংশধররা নিশ্চিত করছেন তিনি ব্যক্তিগত জীবনের শেষ পর্যায়েও একনিষ্ট শরীয়তী জীবন-যাপন করেছেন। সেই দিক থেকে তার গানের মেজাজের ভিন্নতা তো ঢের রয়েছে। মসজিদের ইমামতি থেকে বুঝা যায়- তার গানের ন্যুনতম সামাজিক-ধর্মীয় স্বীকৃতি ছিলো। এখানে ইসলামের মারেফতি বয়ানের সাথে শরীয়তি চর্চার যোগ- যা তার গানকে আলাদাভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। আমার সফরসঙ্গী দাউদের ভাষায় দৃশ্যমান শরীয়তী জীবন। সেই চিহ্ন ধরে হাটলে আমরা হয়তো আরো অজানা অনেক কথা আবিষ্কার করব।
> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ ।
অপেক্ষার অবসান এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নি! 😀
কণ্ঠের জোরে রেকর্ড ফেটে যেত! 😯
স্যালুট! :huzur:
🙂
ব্যাপক উৎসাহ পেলাম।
কুষ্টিয়ায় লালন শাহের প্রোগ্রামে যাচ্ছি। ফিরে এসে বাকিটা দিচ্ছি।
ভালো থাকুন।
হিংসা হচ্ছে! এই প্রোগ্রাম এ যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। হায়রে চাকরি!
এই লেখাটা একটু সময় নিয়ে পড়ব।
দ্রুত দেয়ার জন্য ধন্যবাদ
আমিও হিংসিত।
কবে যে এমন একটা প্রোগ্রাম দেখার সুযোগ হবে! :thinking: