রাতারগুল- জলের বুকে জীবন

মাইরের উপর কোন ঔষধ নাই- এই কথাটা আর যাই হউক আমাদের দেশের মানুষের জন্য শতভাগ সত্য । একমাত্র ডান্ডার ভয়েই আমরা চুপ থাকি, আইন মেনে চলি, নিয়ম ফলো করি। সেনানিবাসে ঢুকলে সব ড্রাইভারই সোজা হয়ে যায়, সিগন্যালে দাঁড়ায় ঠিক মত, মাথায় হেলমেট পড়ে, গাড়ির কালো গ্লাস নামিয়ে দেয়- আমরা যে কত ভদ্র আর নিয়মতান্ত্রিক হতে পারি সেটা কেবল সেনানিবাসেই দেখা যায়। সেখান থেকে বের হবার সাথে সাথেই সব উধাও ।

 

সুনসান নিরব একটা রিজার্ভ ফরেষ্ট, নৌকার বৈঠার পানি কাটা ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই, হয়ত কোন কালে পাখি ছিল বানর ছিল- এমন একটা জায়গায় গিয়ে নিরবতা উপভোগের চেয়ে ভাল আর কোন কিছু কি হতে পারে ??

আমরা কি আর ভাল জিনিষ উপভোগ করি- হঠাত শুনি গগন বিদারি চিতকার, হৈ হুল্লোড় বিনা করনে, ক্ষনে ক্ষনে এমনটাই চলছে – পাখি বানর যদি কোন কালে থেকেও থাকে এখন কেন নেই সেটা সহজেই অনুমেয়। আর চিতকারই বা কি কারনে হতে পারে সেটাও বুঝলামনা।

কিছু জায়গায় গেলে মুগ্ধতায় মুখ দিয়ে শব্দ বের হতেই পারে আবার কিছু জায়গায় মুগ্ধ হয়ে সেটা শুধু অবলোকন আর উপভোগ করাই শ্রেয় । অবশ্য এই বিভাজনটা কে করে দিবে !!! তবে জঙ্গলে গেলে নিরব থাকাটাই সব জায়গার নিয়ম, আমাদের এখানে সেটা বাস্তবায়ন করার কেউ নেই, তাই আমরা থাকি আমাদের মতন ।

সাড়ে পাঁচ বছর সিলেটে থেকেও কোনদিন জানলামনা এখানে রাতারগুল নামে একটা রিজার্ভ ফরেষ্ট আছে যেটা আবার সোয়াম্প ফরেষ্টও !!! বছরের বেশিরভাগ সময় যার গাছগুলোর অর্ধেক পানির নিচে থাকে । হঠাত করে প্রথম আলোতে এই খবর দেখে কি করে কখন যাওয়া যায় সে নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেখি আরজুর ফোন। সে আর জামিল ঠিক করেছে যাবে, এখন ঠিক করা দরকার কখন যাবে। আরজু ফেসবুকে একটা ইভেন্ট ক্রিয়েট করে ক্রেজী ট্রাভেলারদের সবাইকে আমন্ত্রন জানিয়ে ফেলল, দেখতে দেখতে বার জনের দল হয়ে গেল।

কাক ডাকা ভোর না হলেও বৃষ্টি ভেজা অন্ধকারে দরগা গেটে নামলাম , তারপর আপাত বিশ্রামের জন্য একটা হোটেলে উঠা । অতীতচারন করার জন্য সবাই মিলে হাজির হলাম ইস্টিকুটুমে সকালের নাস্তার জন্য, একসময়ে যে রেস্তোরায় মাঝে মাঝেই যাওয়া হত একটু ভাল মন্দ খাওয়ার জন্য । আমাদেরকে নেয়ার জন্য মাইক্রোবাসও ততক্ষনে চলে এসেছে ।

ভার্সিটি পড়াকালীন সিলেটের বৃষ্টি নিয়ে আমাদের উক্তি ছিল- সিলেটের বৃষ্টি আর নারীর মন দুটায় বুঝা দুরুহ । রওয়ানা দেয়ার একটু পর যে শুরু হল তা আর থামার কোন লক্ষন নেই। নিত্য সঙ্গী হয়ে রইল এই বৃষ্টি । বৃষ্টি উপভোগ করলেও মনটা একটু খারাপ কারন মনমত ছবি তাহলে তোলা যাবেনা। আজ এই বৃষ্টির কান্না দেখে মনে পড়ল- না কিছুই মনে পড়ার উপায় নেই, ভাবছি ঘাটে গিয়ে নৌকা পাবত !!!

গোয়াইন ঘাট যখন পৌঁছালাম তখন বৃষ্টিটা একটু কমে এলেও নৌকা ছাড়ার সাথে সাথে আসল রুপ নিয়ে হাজির হল সে, মনের সব দুঃখ নিয়ে যেন মেঘ ঝড়ে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে , চেঙ্গির খাল দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকা –

 

নদীর বুকে বৃষ্টি পড়ে

পাহাড় তারে সয়না ।

বৃষ্টির দুঃখ দেখে আমরা আর বেশীক্ষন মন খারাপ করে থাকতে পারলামনা, তাকে উপভোগ করাই শ্রেয় । বৃষ্টি দেখার জন্য নদীর মাঝে নৌকায় বসে থাকার চেয়ে আর ভাল কোন জায়গা হতে পারেনা ।

দেড় ঘন্টার নৌভ্রমন শেষে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম রাতালগুলের কিনারায়। সেখানে অনেক মাঝিই তাদের কোষা নৌকা নিয়ে ভ্রমনকারীদের অপেক্ষায়।

দুপাশে ঘন হিজলের বন, হিজল গাছগুলোর সাত আট ফিট পানির নিচে বাকি অংশ উপরে। ঝুপ করে গাছগাছালির ফাঁক গলে আমরা ঢুকে গেলাম ভেতরে, সেখানে দেখি আরো অনেক গুলো নৌকা, সেটা কোন সমস্যা না হলেও সমস্যা হচ্ছে তাতে বসা লোকজনের অযথা চিতকার । যাই হউক আমরা আমাদের মত করে তিনটি নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ালাম ।হঠাত করে দেখি আমরা আগের জায়গায়, মেজাজটায় খারাপ হয়ে গেল মাঝির উপর, বেটা ফাজলামি করে একটু ঘুরিয়েই আমাদেরকে নিয়ে এসেছে। ঝাড়ি টারি দিয়ে আবার নৌকা ভাসানো হল, এত অল্প ঘোরায় আমরা সন্তুষ্ট নই। ধরা খেয়ে মাঝির ও মনে হয় রাগ চাপল, সাথে ঝুম বৃষ্টি।

মাঝি আমাদেরকে এবার এমন সব ঝোপের মাঝখান দিয়ে চলল তাতে নৌকার আগানোই কঠিন, ফলাফল মাঝে মাঝে ছাতা সহ আমরা চিত পটাং হয়ে যাচ্ছিলাম। ক্যামেরা সব ব্যাগে , আমরা জলের জীবন দেখছি।

ফেরার পথে কি সমস্যার কারনে ইঞ্জিন বন্ধ করল মাঝি, ভ্রমনের সবচেয়ে সুন্দর সময় ছিল ওটা। দুপাশে বৃস্তিন্ন হাওয়ের মাঝে চরম নিরবতা – আমাদের হালকা কথাবার্তা ছাড়া আর কোন শব্দ নেই , নৈসর্গিক নিরবতা উপভোগের জন্য এরচেয়ে ভাল আর কোন জায়গা হয়না ।

দুপাশে নানা রকম পাখিদের মেলা আর তার সাথে জলের বুকে মানুষের বসতবাড়ি। আমাদের শহুরে আক্ষেপ থেকে শত শত মাইল দুরে এই নিস্তরঙ্গ বসবাস। চারপাশে পানি আর মাঝখানে টিলার মত জায়গায় দুতিনটি ঘর, পানির সাথেই তাদের বসবাস, পানিই তাদের নিয়তি, নৌকা নিত্যসঙ্গী ।

 

ফিরে এসে সামান্য বিশ্রাম, তারপর অনেক অনেক দিন পর নিজের চেনা গন্ডি শাহজালাল ভার্সিটিতে, যার প্রতিটি ইট বালির সাথে আমার সখ্যতা, স্মৃতিময় হাজারো দিনের একসাথে ফিরে আসা । মদিনা মার্কেট, চাচার টং, আম্বরখানা, লন্ডনী রোড, লাভলী রোড, জিন্দাবাজার…………….সে সব অন্য গল্প তোলা থাক অন্যকোন দিনের জন্য ।

 

শাড়ি কেনা আমার খুব পছন্দের, সিলেটে গিয়ে মনিপুড়ি শাড়ি না কিনে ফিরে আসার কোন কারন নেই । আর শাড়ি যদি নাও কিনেন উন্দাল রেস্তোরার সাতকড়া দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস টেস্ট করতে ভুলবেননা কিন্তু ।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

16 Responses to রাতারগুল- জলের বুকে জীবন

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    মুগ্ধ মুগ্ধ মুগ্ধ!
    সৌন্দর্যের অনেক রকম শ্রেণীকরণ করা যায় মনে হয়। এটাকে লাগলো ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’। পানির মধ্যে একটা-দুটো গাছ দেখেছি, এত বেশি গাছ কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে দেখতে। জায়গার নামটাও কেমন, অদ্ভুত সুন্দর লাগলো।
    যেতে ইচ্ছা করছে খুব। ভাগ্যে থাকলে যাব কোনদিন ইনশাআল্লাহ্‌। আপনি লিখেছেনও অনেক সুন্দর করে। 🙂

    • শামসীর বলেছেনঃ

      ছোট ছোট লতানো গাছগুলোকে রাতা গাছ বলে যেগুলা দিয়ে পাটি বানানো হয় , আর সে থেকেই নাম রাতারগুল !!!

      অনেক সুন্দর নীরব সুনসান একটা জায়গা । ইনশাআল্লাহ সময় করে যাবেন একবার।

  2. অনাবিল বলেছেনঃ

    অনে………ক ভালো লেগেছে……… অদ্ভুত সুন্দর…… মাঝে মাঝে মনে হয় এত্তো সুন্দর একটা দেশ দেখেই তোহ শেষ করা যাবে না, বিদেশ ভ্রমণ করে কিভাবে!!
    খুব ইচ্ছে কখনো বেড়াতে যাবার……ইনশাল্লাহ যাবো কখনো……

    লেখাটা অনেক ঝরঝরে……নীরবতার কথা বললেন না? নৈশব্ধের ভাষা বুঝতে পারলে তবেই মানুষ নীরব থাকতো সেখানে……

    আমাদের দেশ টা এত্তো সুন্দর…………

  3. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    খুব ভালো লাগল ঃদ

    ভাই শেষের দিকের ছবিগুলার মাঝে গ্যাপ বেশি হয়ে গেছে

  4. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ইশ ইশ কী সুন্দর! খুব যেতে ইচ্ছে করছে । 🙁
    আমি শুরুতে ছবিগুলো দেখে সুন্দরবন ভাবছিলাম। নামটাও কেমন অবাঙ্গালি “রাতারগুল”! তবে সুন্দর নাম জায়গার মতই। এত সুন্দর একটা ছবিব্লগের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। 🙂

  5. একুয়া রেজিয়া বলেছেনঃ

    দারুন সব ছবি। আমিও কিছুদিন আগে সিলেট ঘুরে এলাম কিন্তু রাতারগুলের কথা জানতাম না। ঢাকায় ফিরে জেনেছি। এখন আফসোস হচ্ছে খুব।

    সবুজ গাছ দেখতে কী স্নিগ্ধ লাগে!!!

  6. শারমিন বলেছেনঃ

    দারুণ 😀

  7. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    হঠাৎ করেই রাতারগুল এর নাম শুনছি খুব। ছবি দেখে তো যাবার ইচ্ছে অনেক বেড়ে গেলো। 😯

  8. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ভাইয়া, আপনার ঘোরাঘুরির প্রতি আমি খুবই হিংসিত!
    এত অসাধারণ সব জায়গায় আপনি গেছেন!
    আমার যে কত কতদিনের শখ পুরো বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ানোর। বিদেশ নিয়ে এতটুকু আগ্রহও আমার নেই। 🙁

    কবে যে রাতারগুল যাব, টাঙ্গুয়া যাব, প্রবারনা পূর্ণিমা আর রাস পূর্ণিমার উৎসব দেখব!
    কবে? কবে? কবে? :crying:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।