উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে (১ম পর্ব)
উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে (২য় পর্ব)
আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়।নিঠুর বন্ধুরে বলেছিলে আমার হবে মন দিয়াছি এই না ভেবে স্বাক্ষী কেউ ছিলো না সে সময় ও বন্ধুরে। স্বাক্ষী শুধু চন্দ্র তারা একদিন তুমি পড়বে ধররে বন্ধু ত্রিভূবনের বিচার যেদিন হয় রে বন্ধু।নিঠুর বন্ধুরে দুঃখ দিয়া হিয়ার ভেতর একদিনও না লইলে খবর একি তোমার প্রেমের পরিচয় ও বন্ধুরে। মিছামিছি আশা দিয়া কেন বা প্রেম শিখাইয়া দূরে থাকা উচিত কি আর হয়। নিঠুর বন্ধুরে বিচ্ছেদের বাজারে গিয়া তোমার প্রেম বিকি দিয়া করব না প্রেম আর যদি কেউ কয় ও বন্ধুরে পাষাণ বন্ধুরে। উকিলের হয়েছে জানা কেবলি চোরের কারখানা বন্ধু চোরে চোরে বেয়াইয়ালা হয় রে বন্ধু।
দুলাল কমান্ডারের চোখের জল দেখে সকলের মন খারাপ হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছেন- এই গ্রামের মানুষ যদি উকিলের জন্য কিছু করতে না পারেন বা সম্মান দেখাতে না পারে তবে তিনি উকিলের কবর তার গ্রামে নিয়ে যাবেন। বাংলাদেশের মানুষ যদি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরশ্রেষ্ট মতিউর রহমানের কবর পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারে, তিনি কেন উকিলের কবর তার গ্রামে নিয়ে যেতে পারবেন না। আরো জানালেন এখানে মাজার গড়ার পরিকল্পনা করেছেন। উকিলের ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুনের প্রথম কথা ছিলো- আমার বাবার কবরটা যেন মাজার হয় সেজন্য তোমরা কিছু কর।
দুলাল কমান্ডার নিজ গ্রাম মদনে প্রতিষ্ঠা করেছেন উকিল মুন্সী স্মৃতি সংসদ। তিনি সেই সংসদের সভাপতি। সেখানকার এমপি তাদের সংগঠনকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। সেই সংগঠনের প্রায় এক লক্ষ টাকার বাদ্যযন্ত্র আছে। তিনি উকিল মুন্সীর কবর সংরক্ষনের জন্য জৈনপুরের জনৈক মতি মিয়াকে তিরিশ হাজার টাকা দেন। সেই লোক কবরের পুরানা ভিত উপড়ে নামমাত্র ইট দিয়ে চারপাশের কবরের চারপাশ চিহ্ন দিয়ে রাখেন। সেখানে আবার পুরানো ইট ব্যবহার করা হয়েছে। এটা নিয়ে দুলাল কমান্ডারের আক্ষেপের অন্ত নেই। তাকে বার বার অশ্রুসিক্ত করছিলো।
সেই শুক্রবারে দুলাল কমান্ডার এসেছিলেন উকিল মুন্সীর ওরছ বিষয়ে কথা বলতে। তিনি জানান ফাল্গুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখ ওরছ হবে। উকিলের মৃত্যুর পরের বছর থেকে না হলেও এই ওরছ অনেক বছর ধরে হয়ে আসছে। দূর-দূরান্ত থেকে অনেক লোক আসে। ওরছ উপলক্ষ্যে সারারাত গান বাজনা হয়।
আমরা জানতে চাইলাম- উকিল মুন্সী মারা গেছেন পৌষ মাসে আর ওরছ ফাল্গুন মাসে? জানালেন- পৌষ মাসে এই অঞ্চলে মারাত্বক শীত থাকে। ফাল্গুন মাসে গরম-শীত মাঝামাঝি থাকে। সারারাত গান-বাজনা হয়। তাই মানুষের সুবিধা হয় এই সময়ে। কথা প্রসঙ্গে জানা গেলো ওরছ নিয়ে উকিল মুন্সীর কোন আদেশ নিষেধ ছিলো না। তবে তার পীর মেয়েদের গান করতে মানা করেছিলেন। মেয়েরা পুরুষদের মতো আসরে নয়, নিজেদের মাঝে গান করবে। তার নাতনী আলেয়া এক সময় নেত্রকোনার নাম করা গায়িকা ছিলেন। পীরের নিষেধের কারণে তিনি গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে অনেকের মধ্যে নেত্রকোনায় স্থানীয়ভাবে সালাম ও গোলাম মওলা উকিলের গান গেয়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
বারী সিদ্দীকী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কলম মেম্বার বলেন- তিনি তো মাত্র চারটা গান গেয়েছেন। রহিমা খাতুন বলেন- তার গায়কী ঠিক আছে। দুলাল কমান্ডার বলেন- কিন্তু তিনি তো উকিলের এখানে আসার সময় পান না। বারী সিদ্দীকী ও হুমায়ুন আহমেদ চাইলে উকিল মুন্সীকে পরিচিত করানো জন্য অনেক কিছু করতে পারতেন। অথচ কিছুই করলেন না। নিজেদের লাভটুকুই দেখেছেন। তবে দুলাল কমান্ডারকে বারী সিদ্দীকী কথা দিয়েছেন- উকিলের গানের বই প্রকাশ করার ব্যবস্থা করে দিবেন। মোহনগঞ্জ থাকতেই জেনেছিলাম লেখক হুমায়ুন আহমেদের নানার বাড়ি মোহনগঞ্জে। আরো জানলাম তার মামা এখন মোহনগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান।
সেদিন ছিলো হাটবার। আমরা বেতাই নদীর পাড়ের কালীবাজারে সেই দয়ালের দোকানে আবার চা খেলাম। ততক্ষনে হাট জমে উঠেছে। অনেক সবজি দেখলাম যেগুলো সচরাচর আমরা দেখি না। আমরা পেয়াজু কিনলাম।চা শেষে কামরুল ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এজমালি নৌকায় নদী পার হলাম। কাজল ভাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। মোহনগঞ্জে রওয়ানা দিলাম। বিকেলের মরা আলোয় আমরা হয়তো উকিল মুন্সীর কথা ভাবছিলাম। জানি না। আমরা তো অন্যের মনের কথা ধরতে পারি না। কিন্তু হাওর অঞ্চলের একটা বিবাগী রূপ আছে। সে রূপ হয়তো দেখা রূপের বাইরের আরো অনেক খবর রাখে। মন বলছিলো, আমি জানি আমার বন্ধূরা কি বলতে চাইবে।
উকিলের গানে আছে …আমারে নিলো না নাইওর পানি থাকতে তাজা। এই আকুতি কি শুধু গুরু-শিষ্যের মিলন না আরো বেশি কিছু! লেখাজোখায় না থাকলেও এই অঞ্চলে উকিল মুন্সীর চিহ্ন এখনো অনেকটা তাজা আছে। যদিও জানি না এই জল-মাটি-বায়ুতে তার আর কোন ছোঁয়া লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই অঞ্চলের জল মাটি বায়ু উকিলের ভাবকে ধারণ করেছে, উকিলকে কথা কইতে দিয়েছে। উকিল যখন কথা বলেছেন ভাটির সুরে বলেছেন। তার কথার রেশ তো সুদূর হিমালয় থেকে আসা জলস্রোতের মতো দুই কূল চাপিয়ে প্রকাশ করেছে নিজেকে। যেমন এই প্রকৃতি নিজেকে প্রকাশ করে। সেই প্রকাশ আমাদেরও আপ্লুত করেছে। তাই এতোদূর ছুটে আসা। তিনি গানের মধ্য দিয়ে পরিচয়ে বেঁধেছেন আমাদের অদেখা ও অচেনা ভূবনকে। সেখানে আমরাও কি নাই! আছি বলেই তো এই ক্লান্ত বিকেলে তাকে আমরা ভাবছি।
আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো উকিলের চিহ্নের খোজে। চিহ্ন সাজিয়ে রাখার নমস্যবস্তু নয়, এর ভেতরে আছে মর্মকে বুঝতে পারার অন্বেষন। কি সেই মর্ম তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তারপরও সেই মর্ম নিরেট প্রশ্ন হয়ে আমাদের সামনে হাজির। কি সেই প্রশ্ন তাও স্পষ্ট নয়- হয়তো চিহ্ন ও ভাবের ভেদ আত্নজিজ্ঞাসার মতো করেই আমাদের গলায় ঝুলে থাকে। নিয়তির মতো। হয়তো এই যাত্রার শেষে আমাদের ভেতরকার সেইসব প্রশ্নকে পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। এখনো আমরা হিসেবে মিলাতে বসি নাই- প্রশ্ন পরিচ্ছন্ন হবার আগের আর পরের কথার তফাত কি? কিন্তু এতটুকু জানি আমরা খালি হাতে ফিরছি না।
এই যাত্রায় আমরা হয়তো উকিলের ছড়িয়ে থাকা চিহ্নের সামান্য স্পর্শ করেছি। আমাদের সামনে যা হাজির হয়ে ছিলো – তা দিয়ে উকিল মুন্সীকে বুঝতে পারা যায় না- জানি। শুধু তাই নয়- আমাদের চৈতন্যের মধ্যে থাকা পূর্ব সংস্কার ও অনুমান তাকে বুঝার ক্ষেত্রে নিদারুন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো ইতিমধ্যে সেই পূর্ব সংস্কার ও অনুমানের ফাঁদে আমরা পড়ে গেছি। আমাদের যাত্রাও সেই পথের। কিন্তু দুলাল কমান্ডার বা রাজিয়া বা রহিমার জীবনে যে স্পর্শ আছে অথবা এখনো আমরা চিনি না বা জানি না এমন অনেকের কাছে উকিলের স্মৃতি মূল্যবান হয়ে আছে। আরো আছে এই অঞ্চলের অসংখ্য শিল্পীর মুখে উকিলের গান। আদি সুরে আদি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গাওয়া সেই গান। এদের পীর বা গুরুভক্তি আছে কিনা জানি না কিন্তু শিল্পের নিষ্ঠা নিশ্চয় কম নয়। তারা পুরোপুরি না হলেও আদি-অকৃত্রিম হৃদয় দিয়ে গান করেন- যা আমাদের হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করে। সেই স্পর্শ দিয়ে হয়তো আমাদের প্রশ্নেরা নিজেদের হাজির করবে। হয়তো আমরা নিজেদের সামনে হাজির হবো। এটা এক ধরণের আশাবাদ- সম্পর্কের ভেতর দিয়ে নিজেকে হাজির করা, চেখে দেখা।
কিন্তু একটা গুরুতর জায়গায় এখনো আটকে আছি। আমাদের প্রাথমিক প্রশ্নের একটা ছিলো- চিহ্নের দরকার কেন? উপরের কথাগুলোর মধ্য দিয়ে তার ধর্মতাত্ত্বিক চর্চা ও দার্শনিক দিকটা পুরোপুরি ফরসা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয় না। হয়তো কিছু বিষয় আমাদের চিন্তায় টোকা দিয়েছে মাত্র। সেই প্রশ্নের উত্তরের জন্য চিন্তার নিজের পরিধির মধ্যে কি ধরণের জবাব তৈরি থাকে- সেটা জানা যেমন জরুরী, একই সাথে জরুরী এই চর্চার সাথে যারা জড়িত তাদের সাথে মোলাকাত করা। যেহেতু সাধনার আছে নিজস্ব ধারা আর ভিন্ন ভিন্ন মোকাম। সেই মোকামে আমি আগন্তুক মাত্র। সেখানে দীর্ঘ পথ পরিক্রমাকে প্রকাশ করার বিষয়টা কি? তারপরও নিজের আশাবাদটুকু বাচিয়ে রাখতে দোষ কি! সেই খোঁজে আমাদের পরবর্তী মঞ্জিল ঠিক হয়ে যায়- হবিগঞ্জের রিচি-র দরবার। সেখানে কি পাওয়া যাবে- তা বলা মুশকিল। কিন্তু তার জন্য কিছুটা প্রাথমিক প্রস্তুতি তো দরকার। আশা করি সেই মকসুদ এলাহি পূরণ করবেন।
ভবিষ্যত কর্মপন্থা থেকে বর্তমানে ফিরে আসা যাক। এইসব কিছু আমাদের যেভাবে স্পর্শ করে- তাকে আমরা নিশ্চয় কোন নাম দিয়ে ডাকব। নিজেদের ভেতর অন্বেষন বলে কোন মূল্য চাইব। সচরাচর যাই হয় আর কি- তারপর কথা তুলব আসুন উকিল মুন্সীর মূল্যায়ন করি। কিন্তু যে স্পর্শের কথা বলছি আসলেই সেখানে কি কোন ঋণশোধ বা তাকে মূল্যায়নের কথা তোলা যায়! সে স্পর্শ তো মানব স্বভাবের চিরন্তনতাকে বুঝাপড়ার মামলা। সেখানে উকিলের মূল্যায়ন- এমন গালভরা কথার কোন মানে হয় না। বেকুবী মাত্র। উকিল যা ছিলেন তা তো হয়েও আছেন। তাকে নতুন করে কিছু বানানোর নাই। সেটা করতে গেলে নিজেদের প্রতি বেইনসাফ হবে। আমরা শুধুমাত্র ইনসাফী চাইতে পারি। এর সাথে যোগ আছে-জানতে পারার, বুঝতে পারার, স্পর্শ করতে পারার।
মানব জীবন যাপনের ভেতর নিরন্তন যে সাধনার ধারায় মানুষ বৈচিত্র্যভাবে জগতকে প্লাবিত করছে সেটা আমরা উপলব্দি করতে চাই। সেই উপলব্দি থেকে আজ শুধু এইটুকুই বলা যায়- বেতাই কূলে বসে উকিলের মুখে আমরা গান শুনতে চাই।
সোনা বন্ধুয়ারে, এতো দুঃখ দিলি তুই আমারে, তোর কারণে লোকের নিন্দন, করেছি অঙ্গের বসনরে। কুমারিয়ার ঘটিবাটি, কুমার করে পরিপাটি, মাটি দিয়া লেপ দেয় উপরে। ভিতরে আগুন দিয়া কুমার থাকে লুকাইয়া, তেমনি দশা করলি তুই আমারে।
সংযুক্তি :
নেত্রকোণা থেকে আসার দুই মাস পর দুটি বইয়ের খোঁজ পাই, যেখানে উকিল মুন্সীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেয়া আছে। বই দুটি হলো- নেত্রকোণা মুখশ্রী এবং নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি। রইস মনরমের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে বই দুটির উকিল মুন্সীর জীবনী অংশটির বৈদ্যুতিক অনুলিপি পাঠিয়েছেন মিজান। তার থেকে নেত্রকোণা মুখশ্রীতে অন্তর্ভুক্ত পরিচিতি এখানে সরাসরি তুলে দেয়া হলো। উল্লেখ যে, আমরা উকিল মুন্সী লিখলেও এই দুই বই মতে উকিল মুনশি, লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আমরা উকিল মুন্সীই বহাল রাখলাম। এছাড়া পরবর্তীতে উপরের আলোচনায় কিছু তথ্যগত ভুল চোখে পড়েছে। যেমন- উকিলের জম্ম-মৃত্যুর সন তারিখ। এছাড়া আমাদের লেখায় বাউল শব্দটি সচেতনেই পরিহার করা হলো। যেহেতু আমাদের যাত্রা অচীন থেকে চিন পরিচয়ের দিকে, তাই কোন তথ্য সংশোধন করা হলো না।
… … … … …
এক. উকিল মুন্সী, বিরহী বাউল (১৮৮৫-১৯৭৮)
মোহনগঞ্জ, জালালপুর গ্রাম। প্রখ্যাত বাউল সাধক। বিরহী উকিল নামে পরিচিত। প্রকৃত নাম আবদুল হক আকন্দ। ডাক নাম উকিল। বাউল গানের পাশাপাশি দীর্ঘকাল মসজিদে ইমামতিও করেন। সে সময় গ্রামের মসজিদের ইমামদের সাধারণত ‘মুন্সী সাহেব’ বলে ডাকা হত। আর এ কারণেই ‘উকিল মুন্সী’ হিসেবে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে, ঢাকা পড়ে যায় যায় প্রকৃত নাম। জম্ম ১১ জুন ১৮৮৫ খ্রিঃ। পিতা- গোলাম রসূল আকন্দ। পিতার বাড়ি খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে। পূর্ব-আত্মীয়তা এবং বৈবাহিকতা সূত্রে তিনি জালালপুর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতৃবিয়োগ ঘটে। এক সময় পিতৃহারা এই ববঘুরে তরুণ আসেন মোহনগঞ্জ থানার জালালপুর গ্রামে তার চাচা কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়িতে। উকিল মুন্সীর বাবা বোয়ালীর গোলাম রসূল আকন্দ এবং জালালপুরের কাজী আলিম উদ্দিন পরস্পর মামাত-ফুফাত ভাই। জালালপুরে এসেই তিনি গ্রামের এক সাধারণ কৃষক লবু হোসেনের অপরূপা সুন্দরী কন্যা ষোড়শী ‘লাবুশের মা’ এর প্রেমে পড়েন এবং এই প্রেম নিয়ে একটি গান রচনা করেন-
ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে, সোনার জালালপুর। সেখানেতে বসত করে, উকিলের মনচোর।
পরবর্তীকালে এই গানটি উকিলের কন্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। গান রচনার মাধ্যমে উকিল মুন্সীর এই প্রেমের কথা জানাজানি হলে আভিজাত্যের প্রশ্ন তুলে কাজী বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়। কারণ লবু হোসেন গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। আর উকিল মুন্সী কাজী বাড়ির ঘনিআত্মীয়। আর তাই এ অসম বিয়ে ছিল কাজী বাড়ির জন্য অপমানজনক। ফলে জালালপুর গ্রামে উকিল মুন্সীর থাকা বা যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। প্রেমে বাধা পেয়ে হতাশায় নিমজ্জিত উকিল কিছুদিন জালালপুরের আশেপাশে শ্যামপুর, পাগলাজোড়, জৈনপুর গ্রামে পাগলের মত ঘুরাঘুরি করেন। অবশেষে তিনি জালালপুর থেকে কয়েক মাইল দূরে বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। এ সময় তিনি ইমামতির পাশাপাশি সারারাত স্বরচিত গজল গেয়ে সময় কাটান। অবশেষে ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে লাবুশের মা-এর একান্ত ইচ্ছায় এবং তাঁর পিতা লবু হোসের তত্ত্বাবধানে খুব গোপনে কাজী বাড়ির মানুষের অগোচরে উকিল মুন্সীর বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়েতে লবু হোসনে উকিল মুন্সীকে একটি বসতবাড়ি সহ তিন একর জমি দান করেন। কাজী বাড়ির মুরুব্বীরা শেষ পর্যন্ত এই বিয়ে মেনে নেন। আর তখন থেকেই তিনি জালালপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বিয়ের পর উকিল মুন্সী গজল রচনায় নিমগ্ন হয়ে উঠেন। ধীরে ধীরে তাঁর গানের প্রশংসা ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কিছুকাল পর তিনি হবিগঞ্জের প্রখ্যাত পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তারপর থেকেই একতারা বাজিয়ে গান করতে শুরু করেন। একদিকে গ্রামের মুসল্লিদের পছন্দের ইমাম, অন্যদিকে একতারা হাতে মানুষের প্রিয় বিরহী বাউল ভাটি বাংলার গ্রামীণ সমাজে এ রকমটি ছিল এক অচিন্তনীয় ও অস্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু উকিল মুন্সী তার বিনয়গুণ, চরিত্র মাধুর্য, মানবপ্রেমী হৃদয়, দরাজ গলা, ভরাট ও মিষ্টি কন্ঠস্বর, সবোর্পরি তাঁর সৌম্যকান্তি অবয়ব, সঙ্গীত ও ধর্ম প্রতিভার অপূর্ব সমন্বয়ের কারণেই তাঁর জীবনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছিল। নামাজ বা মিলাদ মাহফিল বা অন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তাঁর মোনাজাত শুনে ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন কেঁদেছেন- ঠিক তেমনি ভাটিয়ালি সুরে একতারাতে তাঁর বিরহ বিচ্ছেদের আর্তনাদে মুখর মরমি গান শুনেও কেঁদেছন সঙ্গীত পিয়াসী সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ। তাঁর একটি বিখ্যাত গান হচ্ছে-
পিরীত ও মধুর পিরীত, পিরীত করা কি সহজ ব্যাপর। তুমি ধর গুরুর সঙ্গ, তোমার পাপে ভরা অঙ্গ, ভিতর বাহির কর পরিষ্কার।
লেখক ও চিত্রপরিচালক হুমায়ুন আহমদ এর ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ সিনেমায় উকিল মুন্সীর বিরহ ব্যথিত বাণী সমৃদ্ধ নিচের গানটি ব্যবহার করা হয়েছে-
আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি, পূবালী বাতাসে বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি, আমার নি কেউ আসে রে…..।
শরিয়তপন্থী এই মরমি সাধক তাঁর বাউল গানে শুধু একতারা ও চেটিয়া ব্যতীত অন্য কোন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করেননি। পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর জলসায় নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও বারহাট্টার চন্দ্রপুরের পীর মোফাজল হক চিশতী, ঝিমটির চান মিয়া শাহ ফকির, পূর্বধলার লেটিরকান্দা পাগলা বাড়িসহ অত্র এলাকার বিশিষ্ট পীর-ফকিরগণ তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। উকিল মুন্সীও তাঁদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন। বিরহ-বেদনায় হাহাকারে ভরা তার একটি গান-
বন্ধু আমার নিঃদুনিয়ার ধনরে… তোরে দেখলে জুড়ায় জীবন আমার, না দেখলে মরণ রে…।
ব্যর্থ হৃদয়ের সকরুণ আর্তনাদে ক্রন্দসিত এই গানের একটি অপূর্ব উপমা হচ্ছে, ‘চিতার অনল জ্বলে চিত্তে’। হৃদয়তন্ত্রী ছেঁড়া বিরহী উকিলের গানে এ জাতীয় অপূর্ব উপমা বাংলার লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। বিরহী উকিল তার মোনাজাতে ও গানে উপস্থিত মুসল্লি ও দর্শক-শ্রোতদের যেমন নয়ন জলে ভাসিয়েছেন- তেমনি এক অন্তর্লীন প্রার্থনায় নিজেও কেঁদেছেন অঝোর ধারায়। উকিল মুন্সী কুলিয়াটি, পালগাঁও, বরান্তর গ্রামের মসজিদে ইমামতি করেও যখনই নিজ গ্রাম জালালপুর আসতেন তখন গ্রামের মুসল্লিদের অনুরোধে এখানেও তিনি ইমামতি করতেন। কেউ মারা গেলে মৃত ব্যক্তির আত্মীয় স্বজনরা জানাজার নামাযে ইমামতি করার জন্য উকিল মুন্সীকে মনে প্রাণে চাইতেন। এমনও হয়েছে যে, বাউল গানের আসরে বিরতি দিয়ে তাঁকে জানাজার নামাজে ইমামতি করতে হয়েছে।
বাউল গানের এই তাপস পুরুষ সহস্রাধিক গান রচনা করেছেন। তাঁর গানের একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে তাঁর বই ও গানের বেশিরভাগেরই কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। ১৯৭৮ সালে তাঁর ছেলে বিখ্যাত বাউল আবদুস সাত্তার এর মৃত্যুর কিছুকাল পর পুত্রশোকে মুহ্যমান বিরহী উকিল মুন্সী নিজেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দুই. এমদাদ সম্পাদিত নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি
নতুন কোন তথ্য নাই। উকিল মুন্সী সম্পর্কে এই বইয়ের মূল্যায়ন হল-
উকিল মুন্সী নিজে ছিলেন শরীয়তপন্থী এবং নেত্রকোণার অন্যান্য বাউলদের থেকে ব্যতিক্রমধর্মী। তিনি মারেফাত এবং শরীয়ত বিষয়ে অনেক গান রচনা করেছেন। নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলের মনোরম প্রকৃতি ও জলাবায়ুর প্রভাব ছিল তার গানে ও সুরে। হৃদয়ের পরশ দিয়ে ভাটিয়ালি সুরে অসংখ্য বাউলগান রচনা করে তিনি বাংলা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমুদ্ধ করে গেছেন।
………………………………………………………………………………………
*পড়ার সুবিধার্থে ও প্রামান্য সুত্রের অভাবে ব্যবহৃত গানের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র টেক্সট দেয়া হলো। এই ক্ষেত্রে গানের গায়কীর সংগতি রক্ষা হয় নাই। আশা করছি ভবিষ্যতে উকিল মুন্সীর গানের সংকলনে এটি যথাযথভাবে রক্ষিত হবে।
কৃতজ্ঞতা:
১. রহিমা খাতুন (উকিল মুন্সীর ছেলে আবদুস সাত্তারের বউ), রাজিয়া খাতুন (উকিল মুন্সীর মেয়ে), মতিউর রহমান (কলম মেম্বার, উকিল মুন্সীর নাতনী জামাই)।
২. দুলাল কমান্ডার (উকিল মুন্সীর ভক্ত ও উকিল মুন্সী স্মৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা।
৩. সৈয়দ মিজানুর রহমান, মোহনগঞ্জ কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া উকিল মুন্সীর বাড়ির হদিস জানার আপাতত কোন পথ দেখছি না। পরবর্তীতে নেত্রকোনার লেখক পরিচিতি পাঠিয়ে সাহায্য করেছে।
৪. রইস মনরম, কবি, গীতিকার ও মোহনগঞ্জের সংস্কৃতিক সংগঠক ।
৫. হুমায়ুন আহমেদ, শ্রাবন মেঘের দিন চলচ্চিত্র ও মধ্যাহ্ন উপন্যাসের মাধ্যমে উকিল মুন্সীর নাম ও গান ছড়িয়ে দিয়েছেন।
৬. বারী সিদ্দীকী, তার গায়কীতে উকিল মুন্সীর গানের সাথে নেত্রকোনার বাইরে সাধারণ মানুষে পরিচয় ঘটিয়েছেন।
৭. তুহিন ও কামাল, হবিগঞ্জ- রিচি-র মোজাফফর আহমেদ (রঃ)-র দরবারের তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন।
তথ্যসুত্র
মৈমনসিংহ বা ময়মনসিংহ গীতিকা এবং উকিল মুন্সী সময়কার গীতি কবিদের প্রসঙ্গে:
১. টি এম আহমেদ কায়সার, শাহ আবদুল করিমের সাক্ষাৎকার, ছোট কাগজ খোয়াব, সেপ্টেম্বর ১৯৯৭।
২. রশিদ উদ্দিন ও শাহ আবদুল করিমের উইকিপিডিয়া পাতা।
৩. মোজাম্মেল হক তুহিন, মুক্তচিন্তার বাউল সাধক জালাল খাঁ, দৈনিক সকালের খবর। অনলাইন লিংক: (http://www.shokalerkhabor.com/online/details_news.php?id=20568&&%20page_id=%2015)
৪. মোহাম্মদ নুরুল হুদা, মৈমনসিংহ গীতিকা প্রসঙ্গে, বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য (দ্বিতীয় খন্ড), বাংলা একাডেমী, ২০০৭, ঢাকা, পৃষ্টা ৮০।
৫. যতীন সরকার, জালাল উদ্দীন খাঁ ও তার সঙ্গীত, দৈনিক ইত্তেফাক, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯।
৬. আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, নেত্রকোনা জেলার ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১৯৯, ২০৬।
৭. নেত্রকোণা মুখশ্রী, প্রকাশক- নেত্রকোণা জেলা সমস্বয় পরিষদ ঢাকা, ঢাকা, ২০০৫, পৃষ্টা ৯৪-৯৫।
৮. এমদাদ খান সম্পা., নেত্রকোণার লেখক পরিচিতি, পলল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০০৬, পৃষ্টা ৯৪-৯৫।
> আমার লেখার খাতা: ইচ্ছেশূন্য মানুষ ।
উকিল মুন্সীর গানের জায়গাগুলো ইটালিক/ কোট এর মধ্যে দিলে ভালো হত
ঠিক বলেছেন। আলসেমী করে দিই নাই।
এ্খানে কালার চেঞ্জ করে দেয়া হয়েছে।
http://www.chintaa.com/index.php/networkdetails/showAerticle/4/31/bangla
খুব দেরি করে পড়লাম যদিও।
তবু অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়েছি।
দুলাল কমান্ডারের আবেগগুলো ছুঁয়ে গেছে আমাকেও।
কেমন একটা আচ্ছন্নতা নিয়ে পড়া শেষ করলাম।
এই মরমি সাধকের আত্মা শান্তি লাভ করুক- প্রার্থনা করি।
অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা ভাইয়া (ধন্যবাদ না কিন্তু) এমন একটা পোস্ট দেয়ার জন্য।
আমার কৃতঞ্জতা জানুন।
আপনার আগ্রহ আমাকে ছুয়ে গেলো। ভালো থাকুন।