ছোটবেলায় একবার পাশের বাসায় গিয়ে দেখি বসার ঘরের ছোট্ট সাদা বিছানাটার ওপর একদম ঝুঁকে বসে খুব মনোযোগে কি একটা বই পড়ছে শায়লা আর বিভা। আমাকে দেখে চমকে একবার ফিরে চাইলো, তারপর কিছুই না বলে আবার পড়তে শুরু করে দিল। পাড়ার বন্ধুদের কাছে আমি ছিলাম এক্কেবারে দুধভাত। আমাকে কেউ খেলায় নিতে চাইতো না, ডাকতেও আসতোনা। নিতান্ত কোনদিন দলে লোক কম পড়লে আমি সুযোগ পেয়ে যেতাম। পাত্তা না পেতে পেতে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাই। আমি ওদের দুইজনের চুলের আড়াল ভেদ করে খুব উঁকিঝুঁকি দিয়ে বুঝতে চাইছিলাম কি এমন মহা গোপনীয় বই ওদের কাছে যা পড়তে গেলে হালকা একটু শব্দেই চমকে চমকে উঠতে হয়! অনেক ধাক্কাধাক্কির পরে দেখলাম বইয়ের নাম ‘ভালোবাসার পাশেই’, লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
সেদিন প্রথম তোমার নাম শুনলাম । সেই বইটার ভিতর কি ছিল আজও জানা হলো না, কিন্তু তুমি তো আমার বড় হতে থাকার সঙ্গী হয়ে গেলে। মেলবোর্নে আমাদের ক্লডেল স্ট্রিটের বাড়িতে গরমকালের দুপুরগুলোতে স্কুল থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে পিছনের বারান্দাটায় বসতাম। ঝাঁঝালো রোদের গন্ধে অনেক দূরে ফেলে আসা ঢাকার একলা দুপুর মনে পড়তো। আমি দেখতাম রোদের স্বচ্ছ পর্দা গ্যারেজের পাশের বেড়া বেয়ে লতিয়ে ওঠা প্যাশন ফলের গাছ পার হয়ে যাচ্ছে দুলে দুলে। হোলি-ট্রির পাতা চিকমিক করতো। তোমার কবিতার শব্দগুলো আমাকে ঘিরে ঘুরতে ঘুরতে আপেল গাছের পাতায় মিলাতো –
‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভূবনডাঙার মেঘলা আকাশ
তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট আর
ফুসফুস-ভরা হাসি
দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা, রাত্রির মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা
এসব এখন তোমারই, তোমার হাত ভরে নাও আমার অবেলা…
তোমাকে আমার তোমার বয়সী সবকিছু দিতে বড় সাধ হয়’
মা-বাবার উপর অভিমান করে আবৃত্তি করতাম
‘ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায়
বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাঁচের চুড়ি দেখলে ভাঙি
ইচ্ছে করে লন্ডভন্ড করি এবার পৃথিবীটাকে
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমার কিছু ভাল্লাগে না’।
কোথায় মনুমেন্ট তা কি আর জানতাম তখন? তুমিই চেনালে দমদম, হাওড়া ব্রীজ, কফি হাউজ, রবীন্দ্র-সরণী, উত্তর কোলকাতার ঘিঞ্জি পাড়া, ট্রাম, মেট্রো-রেল, বাসস্টপ, তাজমহল হোটেল, সোনাগাছির চাপা গলি, সল্টলেকের স্বপ্নপুরী। তোমার হাত ধরেই অদেখা শহরটা কি সহজে আমার দুপুরগুলোর দখল নিয়ে নিল।
ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার পরে থাকতাম চিজল্ম কলেজে। সেখানে আমার বক্স রুমের ছোট্ট জানালার সামনে ছিল লম্বা ইউক্যালিপটাস। দুপুর বেলায় তোমার কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পরেছিলাম একবার। বিকেলে ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণ বুঝতেই পারছিলাম না সকাল কি বিকেল। চোখের ওপর ভাসছিল এলোমেলো স্বপ্নের ঘোর। আর ঘরের বাতাস ভারী করে ঘুরছিল তোমার মন খারাপ করা শব্দেরা –
‘বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাই নি…’
আমার সেদিন মনে হয়েছিল আমি একটা সূতা কাটা ঘুড়ি বাতাসের সাথে কই কই ভাসতে থাকছি, আর নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও।
বরুনাকে একটুও ভাল লাগে নাই আমার, আমি তো ‘যে কোন নারী’ হতে চাই নাই। আয়নায় নীরাকে খুঁজতাম। বাসস্টপে দাঁড়ালে আশেপাশে তাকাতে তাকাতে ভাবতাম কে এখন আমাকে নিয়েও লিখবে তোমার মতন করে – ‘বাসস্টপে তিন মিনিট অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ…’। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে বসার প্র্যাক্টিস করতে করতে ভাবতাম কোথাও না কোথাও তুমি তো আমার জন্যই লিখছো কবিতার ভূমিকা।
ইউনিভার্সিটির সেই ঝিলটার সামনে বসে একদিন শেষ করলাম ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’। দেখছিলাম সাদা মেঘ আকাশে আর হাঁসেরা ভাসছিল পানিতে। উল্টাপাশের ব্রীজটার উপর দিয়ে এক জোড়া ছেলেমেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল হাত ধরে, মেয়েটার এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল বাতাসের ঝাপটায় মুখের উপর এসে পড়ছিল আর ফুটপাথে কিচির মিচির করতে থাকা চড়ুই পাখির দল ওদের দেখে ভয় পেয়ে উড়ে গিয়েছিল কোন এক গাছের মাথায়। আমি ভাবছিলাম ওই মেয়েটা একটু একটু মার্গারেটএর মতন দেখতে। মার্গারেট একদিন ভোরে একটা পাখিকে কবর দিয়েছিল, আমি ওকে ভালোবেসেছিলাম। এখনো কোন কোন বিকালে ঠিক সেইদিনের মতন রোদ উঠলে সেই ঝিলটার পাশেই বসে আছি আমার মনে হয়। ঝিলের পাশের মূহুর্তটুকু দিকশূন্যপুর। এই রকম কত কত দিকশূন্যপুর জমে উঠছে দিনকে দিন – যেখানে মনে মনেই যাওয়া যায় শুধু।
কাগজে পড়লাম মৃত্যুর খবর শুনে তোমার ছেলে ছুটে এসেছে আমেরিকা থেকে। খুব তাড়াহুড়ায় স্ত্রী-ছেলে কাউকেই সাথে আনতে পারে নাই। আমার মনে পড়লো পূর্ব-পশ্চিমে প্রতাপের মৃত্যুর সময়টা। মমতাকে ট্রেনে তুলে দিতে দিতে কেন যেন তাঁর মনে হচ্ছিল আর হয়তো দেখা হবে না। যখন তিনি মৃত্যুশয্যায়, তাঁর ছেলে বাবলু বিদেশের এক এয়ারপোর্টে গভীর অস্থিরতা আর অসহায়তা নিয়ে আটকে আছে। প্রতাপের সাথে ছিল শুধু অলি, যে বাবলুকে ভালোবেসে একাই থেকে গেল আজীবন।
কি আকুল কেঁদেছিলাম অলির জন্য! অলি যখন তার সমস্ত আশা, ভালোবাসা আর অপেক্ষা সমেত আমেরিকাগামী প্লেনে বসে ভাবছিল কি ভাবে এত বছর পর বাবলুদা’কে দেখে প্রথমেই বলবে ‘আমি নিঃস্ব হয়ে তোমার কাছে এসেছি’…অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসছিল, আমি তো জানতাম বাবলুর সাথে থাকবে শর্মিলা। ঘুমন্ত শর্মিলার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে অলি নিজেকেই বলতে থাকে সে কখনো এই মেয়েটার কাছে হেরে যাবে না। বাবলুকে শোনায় নিজের মনগড়া প্রেমিকের গল্প – যার নাম শৌনক। সেই প্রথম আমি জেনেছিলাম ভালোবাসলে এভাবেই জিততে হয়, সমস্ত অধিকার ছেড়ে দিয়ে, হাসিমুখে…
‘অভিমান আমার ওষ্ঠে এনে দেয় স্মিত হাস্য
আমি এমন ভাবে পা ফেলি যেন মাটির বুকেও
আঘাত না লাগে
আমার তো কারুকে দুঃখ দেবার কথা নয়’
একদিন ‘আত্মপ্রকাশ’ পড়ছিলাম। একটা কথায় চোখ আটকে গেল। ‘আজকাল কেউ জানতে চায় না কেমন আছি’। আমি সেদিন প্রথম চিঠিটা লিখলাম তোমাকে –
‘সুনীল বাবু, তুমি কেমন আছ? আমি সত্যিই জানতে চাই’।
সেই ১৯৯৩/৯৪ তে কারো ঠিকানা বের করা এখনকার মতন সহজ ছিল না। আমি প্রকাশকের ঠিকানায় চিঠি পাঠালাম। সে চিঠির জবাব দেবে তুমি সেরকম আশা না থাকলেও অনেক রকম কল্পনা করতাম। যেদিন সত্যি সত্যি তোমার চিঠিটা এল কি করবো বুঝতে পারছিলাম না! আনন্দবাজার পত্রিকার খাম। তুমি তার উপর আমার নাম ঠিকানা লিখেছ টানাটানা ছোট অক্ষরে। আমি খামটা হাতে নিয়ে বসে থাকলাম, মনে হচ্ছিল একটা মাইক ভাড়া করে রাস্তায় রাস্তায় সবাইকে বলে বেড়াই। চিঠিটা খুলতে ইচ্ছা হচ্ছিল না, পড়ে ফেললেই তো ফুরিয়ে যাবে।
কি সুন্দর গুটিগুটি অক্ষরে আমার এক লাইনের চিঠির জবাবে প্রায় একপাতা চিঠি তোমার। লিখেছিলে ‘আজ সকাল থেকে চমৎকার আছি, আজকে ভাল থাকাটাই তো বড় কথা…’ গাড়িতে অফিস যাবার সময় কলকাতার রাস্তার কথা বলেছিলে…আরো কত কিছু! মুখস্থ করে ফেলেছিলাম চিঠিটা। যার সাথেই দেখা হতো গড়গড় করে বলে যেতে পারতাম। এরপর তোমার চিঠির জন্য অপেক্ষা শুরু হলো। আমি কখনো এক বা দুই লাইনের বেশি লিখতাম না ইচ্ছা করেই, ভাবতাম তুমি ব্যস্ত মানুষ, লম্বা চিঠি যদি না পড়ো? কতো কতো কথা হলো আমাদের – আমি লিখলাম ‘আমি রোজ তোমার চিঠির জন্য ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি’। তুমি লিখলে ‘আমি চেয়েছিলাম সারাজীবন শুধু কবিতা পড়ে আর লিখে কাটিয়ে দেব, আর কিচ্ছু করবো না’!
আমার প্রথম কবিতাটার কথা মনে আছে তোমার? জীবনে প্রথম বারের মত নিজের নাম দেখলাম ছাপানো অক্ষরে, তাও ‘দেশ’ এর পাতায়। কবিতাতেও ঢুকে গিয়েছিলে তুমি –
‘সুনীল বাবু বলে কেউ কথা রাখে না
তুমি কি কথা রেখেছিলে সুনীল বাবু?’
কি যে অদ্ভুত অনুভুতি। মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলে নিজের নামের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমার আব্বা কয়েক দিস্তা ফটোকপি করে ফেললো কবিতার, আমাদের বাড়িতে কেউ এলে সেই কবিতা পড়ার আগে রেহাই নাই, কি মুশকিল!
এর কিছুদিন পর তোমার একটা কবিতা দেখে আমার বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেল যে কবিতায় আমার কথা আছে – ‘একটি পাখির শিষ মাঝে মাঝে শুনি, কোনদিন দেখাও হবে না’। আমার বোনদের সাথে কত ঝগড়া হতো এই নিয়ে। ওরা বলতো ‘ওই বুইড়ার আর খাইয়া দাইয়া কাজ নাই না? তোমারে নিয়া কবিতা লিখবে?’ আমি কিছুতেই ওদের বোঝাতে পারতাম না যে সুনীল কোনদিন ‘বুইড়া’ হয় না।
তুমি একবার লিখেছিলে আমার চিঠি পড়লে তোমার চোখে ভাসে প্রায় কিশোরী একটা মুখ। আমার জানো খুব দুঃখ হয়েছিল সেদিন, কেন তোমার মনে হয় না যে আমি আরেকটু বড়?
অথচ এখন আমি সত্যি বড় হয়ে গেছি সুনীল বাবু। আমার কৈশোরেই থেকে গেছ তুমি আর আমি সরতে সরতে কতদূর এসে গেছি। তোমার…তোমাদের সাথে সাথে মুছে যাচ্ছে একটু একটু আমার ছোটবেলা। মৃত্যুর মত অমোঘ আর কি কোন ইরেজার আছে? তবুও তো ছাপ থেকে যায়, বিকালের শুকিয়ে যাওয়া শিউলি ফুলও যেমন বয়ে বেড়ায় সকালবেলার শিশিরের স্মৃতি।
তোমাকে একটা বড় চিঠি লিখতে বলেছিলে কতবার। লেখা হয় নাই। আজ লিখছি সারা রাত জেগে, সারাদিন ধরে…তুমি পড়বে না?
২৮ অক্টোবর, ২০১২
মেলবোর্ন
কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না…… চোখ দুটো ভিজিয়ে দিলেন একটু………
আমিও খুব মন খারাপ নিয়েই লিখেছিলাম। আমার ছোটবেলার মানুষগুলো সব অতীত হয়ে যাচ্ছেন…
প্রিয় লেখক, প্রিয় মানুষকে নিয়ে এরকম একটা লেখার চাইতে ভাল উপহার আর কী হতে পারে!
সুনীলের ভক্ত হওয়ার মত কোন লেখা পড়া হয় নি, মারা যাওয়ার পর সবার মুখে শুনে শুনে এখন পড়তে ইচ্ছা করছে।
আপনার লেখা কেমন লাগে সেটা নিয়ে আর কিছু বলবো না ঠিক করেছি। 🙂
আপু পূর্ব-পশ্চিম পড়সেন? না পড়লে পারলে অবশ্যই পড়বেন এবং একটা ভালো বুদ্ধি দেই- দ্বিতীয় খণ্ড আগে পড়বেন 🙂
না। বিখ্যাত কোন লেখাই পড়ি নাই। 🙁
না না প্রথম খন্ডই আগে পড়া দরকার! পিকলুর প্রেমে পড়ে এখনো উঠলাম না! তবে ঐতিহাসিক উপন্যাসের দিকে সুনীলের সবচেয়ে ভাল কাজ মনে হয় ‘সেই সময়’। ওঁর আরেকটা ছোট উপন্যাস আমার খুব প্রিয়, নাম হলো ‘স্বর্গের নীচে মানুষ’
এতো দিন ভাবতাম পূর্ব-পশ্চিম দ্বিতীয় খণ্ড আমি নিজে আগে পড়েছি বলে বুঝি আমার দ্বিতীয় খণ্ডের প্রতি আলাদা দুর্বলতা আছে। কিন্তু কিছুদিন আগে আমার এক বান্ধবী (যাকে পূর্ব-পশ্চিম পড়ার জন্য আমি যথেষ্ট জ্বালাইসি)পূর্ব-পশ্চিম পড়তে যেয়ে ধৈর্যের অভাবে পড়া ছেড়ে দিয়েছে, তখন তাকে বললাম আমি দ্বিতীয় খণ্ড আমি আগে পড়েছি। তাই ভাবলাম প্রথম খণ্ড হয়ত একটু অধৈর্যজনক।
আমার অবশ্য দ্বিতীয় খণ্ড ভালো লাগার কারণ আমি বিপ্লব জাতীয় উপন্যাস পছন্দ করি। প্রথম খণ্ডের একদম শেষে বিপ্লব আসে।
আমার মনে হয় সুনীলের লেখায় ডুব দেয়ার জন্য কৈশোর সবচেয়ে ভালো সময়। বিশেষ করে ওঁর কবিতাগুলোর অনুভুতি প্রায় কিশোর বয়সী। আমি সুনীলবাবুর লেখা পড়তে শুরু করার অনেক দিন পরে তাঁর ছবি দেখেছিলাম আর খুব অবাক হয়েছিলাম পাকা চুলওয়ালা একজন মানুষকে দেখে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম ২৪/২৫ এর বেশি বয়স হবে না!
কেন আমার লেখা নিয়ে বলবেন না! বলেন! বলেন! বলেন! বলেন!!! :p
:crying:
আপুনি আপনি এত সুন্দর করে কি ভাবে লিখেন? :love:
আপুনি আপনি এত্ত সুন্দর করে যে ভাবে পড়েন :p
পূর্ব-পশ্চিম এর শেষ অংশের কাহিনী যে এপর্যন্ত কতজনকে বলেছি এবং কতজনকে তার দ্বারা প্রভাবিত করেছি তার হিসেব নাই।
পূর্ব-পশ্চিম আমি পড়ার পরে আমার আব্বার পিছনে অনেক দিন ধরে ঘুরঘুর করলাম যে আব্বার ও এই বই পড়তেই হবে, নইলে জীবন বৃথা। কিছুতেই রাজী হয় না, শেষ পর্যন্ত আমি পড়ে শুনাতে শুরু করলাম। তারপরে এমন এডিক্টেড হয়ে গেছিল! ঘুম থেকে উঠেই বলতো পূর্ব-পশ্চিম পড়ে শোনাতে, আর সারাদিন ম্যারাথন পড়া হয়েছিল তখন।
লুনাপুর মারাত্মক লেখনীর জাদুর কাঠির সন্ধান আমি পেয়েছি! :happy:
আপুর সব বড় বড় লেখকদের সাথে সংস্পর্শ । প্রথমত অন্য অনেকের আগেই মো-ইয়ানকে চিনে ফেলেছেন, এমনকি দেখেও ফেলেছেন সশরীরে! তারপর জানা গেল হুমায়ুন আহমেদ আপনার প্রতিবেশী ছিলেন একসময়। আর এরপর বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ভারতের প্রখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পত্রমিতা!
ইশ! বরং উলটা! দেখ ওদের তিনজনের মধ্যে কমন কি? লুনাপু! তার মানে কোন না কোন ভাবে আমার সংস্পর্শে আসতে পেরেই ব্যাটাদের ভাগ্য খুলে গেছে! তুমিও আশেপাশেই থাকো আমার, বলা যায় না পরের নোবেল টা তোমার ভাগ্যেও জুটতে পারে। :p
আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক আফামণি !!
সুনীলকে নিয়ে যে কত্ত স্মৃতি!
‘সেই সময়’ পড়তে পড়তে এতই বুঁদ হয়ে গিয়েছিলাম যে সেকেন্ড ইয়ারে স্যারের হাতেনাতে ধরা খেতে হয়েছিল। যখন বকাঝকা করে ক্লাস থেকে স্যার বের করে দিলেন তখন একটুও খারাপ লাগল না। কিন্তু আমার বইটা নিয়ে যে তিনি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন বোর্ডের ওপাশে, সেটার কথা ভেবে, বইয়ার আঘাত লাগল ভেবে আমি একা একাই কেঁদে দিলাম! ক্লাসে সারাক্ষণই গল্পের বই পড়ি কিংবা আঁকাআঁকি করি। কখনোই ধরা পড়ি নি ঐ একবার ছাড়া। সেদিন সেই সুনীলের বইটাই কেন ব্যথা পেল তা ভেবে ভেবে অনেক কষ্ট পেয়েছি। স্যার চলে যাবার পর বইটা কুড়িয়ে নিয়ে হাত আর ওড়না দিয়ে ধুলোয় মোড়া মলাটটা মুছেছিলাম, মনে আছে। কী মায়া শুধু একটা বইয়ের জন্য!
পূর্ব-পশ্চিমের পিকলুকে এত ভালো লেগেছিল, যে বলার মত নয়। দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতেও দুরু দুরু বুকে শুধু প্রার্থনা করছিলাম পিকলু যেন ফিরে আসে, যদি আসে! প্রথম খণ্ড পড়ার পর কী কান্না, দ্বিতীয় খণ্ডে চোখের জল প্রার্থনা হয়ে গেল! ঐ পিকলুর জন্য।
‘কেউ কথা রাখে নি’ এর আবৃত্তি শুনে অঝোরে কেঁদেছি টানা এক ঘণ্টা!
শুধু কি সুনীলেরই কষ্টে?
স্মৃতি বলে আর শেষ করা যাবে না।
আপনাকে হিংসে হচ্ছে আপু, আপনি কেন সুনীলকে চিঠি লিখলেন?
অথচ সেই সময় এই চিঠি লেখার কথা একটি বারের জন্যেও আমায় আসে নি!
সুনীলের জন্য ভালোবাসাটা আমার কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ হয়েই রইল, আপনার মত কখনো যদি অন্তত একবার পূর্ণিমার গন্ধটা পেতাম!
চোখের পানি ধরে রাখাটা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো আপু, পারলাম না, ঠিক হাতের তালুর মতো করে চিনে উঠছিলাম কোলকাতা শহরটা, বিষণ্ণ দুপুরের ট্রামের সারিতে বসে থাকা কারো মুখ, কোন অচিন মানুষের জন্য অপেক্ষা, অদ্ভুত ভালোলাগার কিছু শব্দ, এমন করেই চিনেছিলাম বুঝি তাকে…
এই এখানে, এই মুহুর্তে তিনি নেই, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়…
তবু, যেভাবেই থাকুন, ভালো থাকুন সুনীলদা, অনেক ভালো থাকুন…