ক্লাস থ্রি তে পড়ি তখন। হঠাৎ বাসায় সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমার জন্মদিন পালন করা হবে। প্রচণ্ড রকম উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম দিনটার জন্য। বড় কেক কাটা হবে, মানুষ গিফট দিবে-ঘুমের মধ্যেও যেন আনন্দে মাঝে মাঝে দাঁত বের হয়ে যায়।
অবশেষে সেই বহু প্রতীক্ষিত দিন এলো। টেবিলের ওপর জমা হওয়া র্যাপিং করা গিফটের প্যাকেটগুলো যেন হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ঘরের সব মেহমান বের হবার পরই র্যাটপিং খোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লাম। একটা র্যাপিং খোলার পর বের হয়ে এলো একটা কবিতার বই। প্রতিটা কবিতার পাশে সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকা। বিস্মিত ক্লাস থ্রি এর একটা বাচ্চার জন্য যেন খুলে গেলো স্বপ্নলোকের দরজা।
বইয়ের উপর বড় করে লেখা ‘আবোল তাবোল’।
এরপর আমার দিন কাটতে লাগলো ঘোরের জগতে। যখনই সময় পাই বসে থাকি বই নিয়ে। অদ্ভুত কবিতাগুলো মাথার ভিতরে ঘুরপাক খেতে থাকে না বোঝা কথা হয়ে, কিন্তু, হৃদয়টা ছন্দগুলোকে বড় আপন করে নেয়।
“হুঁকো মুখো হ্যাংলা বাড়ী তার বাংলা
মুখে তার হাসি নাই দেখেছ?
নাই তার মানে কি? কেউ তাহা জানে কি?
কেউ কভু তার কাছে থেকেছ?
………………………………………..
ভেবে দেখ এ কি দায় কোন্ ল্যাজে মারি তায়,
দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে!”
দু’লেজওয়ালা হুঁকোমুখো হ্যাংলাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে যাই। পেয়ারা গাছে, উঠানের ওপাশে নারকেলের পাতার ফাঁকে, এমনকি স্কুলের পিছনের ঘন ঘাসের মাঝেও খুঁজে পাই না তাকে।
“যে সাপের চোখ্ নেই, শিং নেই, নোখ্ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না, কাউকে যে কাটে না,
করে নাকো ফোঁস্ফাঁস্, মারে নাকো ঢুঁশ্ঢাঁশ,
নেই কোনো উত্পাত, খায় শুধু দুধ ভাত—
সেই সাপ জ্যান্ত গোটা দুই আন্ তো!
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা ক’রে দিই ঠাণ্ডা।”
নিরীহ সাপটার জন্য খুব মায়া হয়। কী দরকার ওকে মারার। কোন উৎপাত করে না, শুধু দুধভাত খায়-সাপটাকে বড্ড নিজের মতো লাগে। কবির উপর বড্ড রাগ হয় আমার।
“আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!
………………………………………
এই না বলে কুটুত্ ক’রে চিম্টি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।”
এমনিতেই আমার বড্ড কাতুকুতু। তার উপর যদি কাতুকুতু বুড়োর হাতে পড়ি! নির্ঘাত হাসাতে হাসাতে আমার পেট ফাটিয়ে ফেলবে। স্কুল থেকে ফেরার পথে অচেনা পথে বুড়োদের দেখলেই মা-র কাছে চেপে বসি আরও।
“রামগরুড়ের ছানা হাসতে তাদের মানা,
হাসির কথা শুনলে বলে,
“হাসব না-না, না-না!”
সদাই মরে ত্রাসে— ওই বুঝি কেউ হাসে!”
রামগরুড়ের ছানা কী-কেউ বলতে পারে না। আব্বু, আম্মু এতো কিছু জানে, তবুও রামগরুড়ের ছানা চেনে না। এমন মজার দেখতে একটা জিনিস কেন চিড়িয়াখানায় নেই-ভেবেই কত সময় কেটে যায়!
“ট্যাঁশ্ গরু গরু নয় আসলেতে পাখি সে;
যার খুশি দেখে এস হারুদের আফিসে।
চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু, মুখখানা মস্ত,
ফিট্ফাট্ কালোচুলে টেরিকাটা চোস্ত।
তিন-বাঁকা শিং তার। ল্যাজখানি প্যাঁচান—
একটুকু ছোঁও যদি, বাপ্ রে কি চ্যাঁচান!”
তিন-বাঁকা শিং আর প্যাচানো লেজ যে আকর্ষণ এনে দিয়েছিলো ট্যাঁশ গরুতে তা একেবারেই ভোলার মতো নয়। হারুদের অফিস যেন হাত বাড়িয়ে ডাকতো ট্যাঁশ গরুকে কাছে গিয়ে দেখে আসার জন্য।
যা-ই করি না কেন, কখনোই বইয়ের ৪০পৃষ্ঠা খুলতাম না। খুললেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়:
“পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছ্নাতে।”
এমনিতেই ভুতের ভয়ে বাঁচি না, তার উপর ‘পান্তভুত’! ছবি দেখেই একবারে জান বের হয়ে যেতে চায়, সেই ভয়েই চল্লিশ পৃষ্ঠার প্রতি নিষেধাজ্ঞা।
“ (যদি) কুম্ড়োপটাশ নাচে—
খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!”
গোলগাল দেখতে কুমড়োপটাশ এতো ভয়ংকর যে কেন হলো! কেনই বা সে এতো রেগে যায় ! বালক মন উত্তর খুঁজতে যেয়ে খুব হয়রান হয়ে যায়।
হাঁসজারু, বকচ্ছপ, হাতিমি-এমন অদ্ভুতুড়ে শব্দ খুব মনে ধরে যায় আমার। কিন্তু, কত্ত ভেবেও এমন কোন নতুন শব্দ বানাতে পারি না। তাই মন খারাপ করি, আর, বারবার পড়ে যাই:
“হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল `হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে— “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা—
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি!
জিরাফের সাধ নাই মাঠে-ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢঙ ধরি সেও চায় উড়িতে।
গরু বলে, “আমারেও ধরিল কি ও রোগে?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে?”
হাতিমির দশা দেখ— তিমি ভাবে জলে যাই,
হাতি বলে, “এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই।”
সিংহের শিং নেই, এই তার কষ্ট—
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট। ”
পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে যায় ‘সৎ পাত্র’। মাথায় মধ্যে এখনও অবসরে রিনরিনে কণ্ঠে কেউ গুণগুণ করে:
“শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে—
তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে?
গঙ্গারামকে পাত্র পেলে?
জানতে চাও সে কেমন ছেলে?
…………………………”
একটা মানুষ তার লেখনী, তার আঁকায় একটা বালকের ছেলেবেলার দিনগুলোতে অবারিত রঙিন ভাবনার দোর খুলে দিয়েছিলেন। আনন্দ, উচ্ছাস, বিস্ময়, ভয়, অদ্ভুত লাগা-সবগুলো অনুভূতিকে যেন নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছিলেন।
‘আবোল তাবোল’ যেন একটা কবিতার বই নয়, স্বপ্নলোকের চাবি।
আর, কবি সে স্বপ্নলোকের স্রষ্টা।
শুভ জন্মদিন, সুকুমার রায়। বেঁচে থাকুন সব বালকের বিস্ময়ে-আনন্দে-ভালোলাগায়।
“হেথায় নিষেধ নাই রে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন আকাশতলে
স্বপন-দোলা হাওয়ায় দোলে
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশকুসুম আপনি ফোটে
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ!”
শুভ জন্মদিন সুকুমার রায়।
🙂
অসাধারণ একজন কবি!
পুরা গুষ্ঠিটাই প্রতিভাধর!
পোস্টের ছবি গুলো দেওয়াতে ভালো হয়েছে। দারুণ লাগলো। 😀
আর জন্মদিনে বই উপহার হিসেবে সেরা!
উপহার হিসেবে আসলে বইয়ের এর তুলনা হয় না! (বিয়েতে না আবার ) 😀
ধন্যবাদ! 😀
তোমার বিয়েতে বই উপহার দিতে হবে 😛
😳 :crying:
😛
সুকুমার… <3
😀
শুভ জন্মদিন সুকুমার রায় :happybirthday:
ভালো লেগেছে 😀
অনেক ধন্যবাদ! 😀
কী সুন্দর লেখা!
মানুষ যে কেমন করে অমর হয় সেই কথা ভাবছি। 🙂
‘আবোল তাবোল’ পড়ি নি ছোটবেলায়। এখানে-ওখানে কবিতা পড়েছি সুকুমারের। আর ‘সৎ পাত্র’ তো ছোটদের সমাজে খুবই বিখ্যাত কবিতা ছিল স্কুলে থাকতে। 😀
এই কবিতাটা নিয়ে মজার স্মৃতি আছে একটা। স্কুলে আমাদের সপ্তাহে একদিন একটা ক্লাস থাকতো – সাংস্কৃতিক ক্লাস। অন্য ক্লাস শেষ করে সেটায় যাওয়ার জন্য দৌড় প্রতিযোগিতা মত হত, কে কার আগে অডিটোরিয়ামে ভাল জায়গায় বসতে পারে সেই জন্য। ঐ ক্লাসে একবার এই কবিতা আবৃত্তি করতে গেলাম, তো, যেখানে দাঁড়িয়ে সবাই আবৃত্তি করে সেই টেবিলে রাখা মাইক্রোফোন পর্যন্ত আমার মুখ না পৌঁছানোর কারণে কেউ শুনতে পাচ্ছিল না আমার কণ্ঠ। তখন স্যার আমাকে ডেকে তার নিচু টেবিলে রাখা মাইক্রোফোনে বলতে বললেন, আমি স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করলাম, “শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে…”। :guiter:
নস্টালজিক হয়ে পড়লুম। এইটার ইমো নাই। 🙁
আমিও একবার একটা অনুষ্ঠানে এটা আবৃত্তি করেছিলাম 8)
বাই দ্য ওয়ে, “কী সুন্দর লেখা!” দিয়ে কি সুকুমার রায় এর কবিতা বোঝানো হয়েছে? :thinking:
হাহা, না আপনার লেখাই। 😛
Feels good! 😛
ইশ কি দারুন সব ছড়া লিখে গিয়েছিলেন বাচ্চাদের জন্য তিনি। 🙂 ছবি গুলো দেখেই মনে হলো, এই বইটা আমার ছিল।
আসলেই দারুন!
সুকুমার ছাড়া শৈশব এর কত আনা বাকি থাকত?
লক্ষণের শক্তিশেলটা ঐ দিন আবার পড়লাম, কে জানি শেয়ার করল সে কী লেখা!
মাঝে মাঝে মনে হয়, এমন দুই-একটা লেখাও যদি লিখতে পারতাম!
সুকুমার নিয়ে আস্ত একটা পোস্ট দিয়েই আমার কাজ অর্ধেক কমিয়ে দিছিস! :happy:
এই মানুষটাকে যে কী শ্রদ্ধা করি! :huzur:
আমার পরের কোন এক লেখায় তোর এই পোস্টের রেফারেন্স দিতে হবে। 😀
অসাধারণ পোস্ট। 😀
নস্টালজিক মুহূর্ত গেল ছড়া পড়ার সময়! :beshikhushi:
এক মাস পর পোস্ট দিয়েছি। কিছুটা ভালো হলেই আমি খুশি! 😀
অনেক ভালো হইছে! :happy:
:penguindance:
এই বইটা আমারও প্রথম বাংলা কবিতার বই। মনে পরে গেলো। 🙂
ভুলে না যাওয়ার মতোই একটা বই 🙂
সত্যিই যেন স্বপ্নলোকের চাবি।
সুকুমার রায়ের লেখা লাল মলাটের বই এখনো আমার মন খারাপের সঙ্গী 🙂
এতো অদ্ভূত ও অসাধারণ চিন্তা করে কিভাবে লিখে গেছেন এতো কবিতা, ভেবে কূল পাই না!
অসাধারণ একটা লেখ 🙂
এত্ত দিন সরব থেকে দূরে ছিলাম, কী চমৎকার কিছু লেখা মিস করেছি- ভাবতেই কষ্ট লাগছে 🙁
অবশ্য উপায়ও ছিল না 🙁
আপনি লেখালেখি কখনো বন্ধ করবেন না, ভাইয়া 🙂
এখনই তো কিছুদিন ধরে ঠিকমতো লিখতে পারছি না 😳
আশা করি আরও ভালো লেখা নিয়ে ফেরত আসতে পারবো 🙂