ঘটনা ১:
অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করে, পরের দিনের কাজ তৈরি করে, ঘুমাতে গেলেন, আর সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন মাথার কাছে মোবাইলে নেই,বাসার ক্যামেরাটা নেই, দৌড় দিয়ে রাতে ল্যাপটপটা যেখানে রেখে এসেছিলেন সেখানে যেয়ে দেখলেন ল্যাপটপটাও নেই……
ঘটনা ২:
:কিরে দোস্ত, নতুন মোবাইল?
:হুম।
:কিছুদিন আগে না নতুন মোবাইল কিনেছিলি?
:হুম, কিনেছিলাম, কিন্তু এখন আর ভালো লাগছিল না ওটা ব্যবহার করতে, কিনলাম আরেকটা নতুন…
কিছুদিন পরঃ
:কিরে দোস্ত, তোর হাতে ওটা কী?
:ট্যাব।
:তোর না ল্যাপটপ আছে, তোর ট্যাবের কী দরকার?
:কিনলাম।
…………
আরো কিছুদিন পরঃ
:কিরে কী করিস? কার ল্যাপটপ ঠিক করে দিচ্ছিস?
:কারো না।
:তাহলে সামনে এটা কার ল্যাপটপ?
:আমার।
:তোর?????? আগেরটা কই?
:হুম আমার, কিনলাম, আগেরটা দিলাম বেচে…
:কয় নম্বর?
:এটা???হুমমমমম…… :thinking:
………
আমাদের দেশে একটা জমজমাট ব্যবসা আছে- সেকেন্ড হ্যান্ড অথবা চোরাই ইলেকট্রনিক জিনিস বেচাকেনার ব্যবসা।
‘ঘটনা ১’ থেকে আসি। ল্যাপটপ অবশ্যই এমন কেউ চুরি করেবে (৯০ ভাগ সম্ভাবনা) যার ল্যাপটপের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন টাকার। কারণ যার ল্যাপটপের দরকার তাঁর একটা নুন্যতম অবস্থান আছে। আশা করা যায় সে শিক্ষিত। তাহলে অবশ্যই একজন মানুষ তাঁর নিজের ব্যবহারের প্রয়োজনের জন্য অন্য কারো ল্যাপটপ চুরি করবে না। তাহলে যে চুরি করল সে কেন করল? করল কারণ সে সেটা বিক্রি করে টাকা পাবে। একই কথা আবার। বিক্রিটা সে কার কাছে করবে? তাঁর কাছেই করবে যার ল্যাপটপ প্রয়োজন, মানে যে শিক্ষিত।
বিক্রিটা বিভিন্ন ভাবে/ ধাপে হয়।
যেমন-ল্যাপটপ যদি বাসার কাজের বুয়া দ্বারা হয়, তাহলে সে তার এলাকাস্থ নেতার কাছে বিক্রি করবে, সেখান থেকে বহু হাত ঘুরে একটা দোকানে পৌঁছাবে যেখানে চোরাই পণ্য বেচাকেনা হয় এবং দোকানটি সর্বজন পরিচিত ও ব্যবসাটি সর্বজন স্বীকৃত।
অথবা যদি রাস্তা থেকে ছিনতাই হয় তাহলেও সেটা কোনো না কোনো ভাবে ওই দোকানে পৌঁছাবে।
এখন আবার আরেক নতুন ব্যবসা শুরু হয়েছে। বিদেশ থেকে কর ফাঁকি দিয়ে কীভাবে কীভাবে যেন দেশে মোটামুটি নতুন কিছু মোবাইলে,ট্যাব,ল্যাপটপ ঢুকে পরে। তারপর হয়ত কেউ ব্যক্তিগত ভাবে বিক্রি করে অথবা ওইসব দোকান থেকে এসব জিনিস বিক্রি হয়। দাম-অবিশ্বাস্য কম।
দোকানগুলো কেন চলছে?-কারণ চাহিদা আছে।
ব্যবসাটিকে কারা সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে?-যারা কিনছে।
কারা কিনছে?
দল ১:
ঘটনা ২ যারা ঘটাচ্ছে। বন্ধু বা পরিচিত মহলে কিছু দিন পরপর নতুন নতুন মোবাইলে, ল্যাপটপ নিয়ে যেয়ে সবার চোখ ট্যারা করে দেয়ার জন্য, গল্প-গুজব করে সময় কাটানোর জন্য ক্যাম্পাসে নতুন কোন একটা বিষয় দেয়ার জন্য…
এই শ্রেনীর মানুষদের বাবার যদি বিশাল টাকা-পয়সা থাকে তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে আমার মনে হয় না এতো ঘনঘন মোবাইল, ল্যাপটপ বদলানো সম্ভব। কারণ এই প্রবণতা ছাত্র বয়সের মাঝে বেশি। ছাত্র অবস্থায় কিছুদিন পরপর মোবাইল, ল্যাপটপ কেনার মত সামর্থ্য থাকা কিছুটা অস্বাভাবিক। (বুয়েট-ভর্তি পরীক্ষার কোচিং,ছাত্রছাত্রী পড়ালে না হয়………)
আর যখন নিজের সামর্থ্য হবে তখন মনে হয় না এতো তেল কারো থাকবে…
যদি নতুন পণ্য এতো ঘনঘন কিনতে না পারে তাহলে নিশ্চয়ই সেকেন্ডহ্যান্ড/ চোরাই মালের দোকান থেকে কম দামে কেনে।
দল ২:
নিতান্ত শখের বশে কিনল। হয়ত দামি, স্টাইলিশ পণ্য একবারই কিনবে, কিছুটা কম দামের জন্য চোরাইপন্যের দোকান থেকে কিনল।
কিন্তু কথা এখানেও এক। যে শখের বশে কিনল সেও কিন্তু শিক্ষিত। হ্যাঁ, শখের তোলা আশি টাকা। কিন্তু আমার মতে যে ২০,০০০টাকায় মোবাইল কিনতে পারে,-
হয় সে বাজার দাম যে মোবাইলের ২০,০০০ টাকা সেটা কিনুক, না হয় প্রয়োজনে আরো কিছুদিন টাকা জমিয়ে বাজার দামেই ২০,০০০+ দামে কিনুক।
মোবাইল বা ল্যাপটপ চুরি হওয়াটা বেড়েই চলছে এবং নিঃসন্দেহে ব্যাপারটা কষ্টকর। প্রয়োজন হোক বা শখেই হোক- বেশির ভাগ মানুষ তাঁর অনেক দিনের সঞ্চয় দিয়ে একটি দামি মোবাইল বা ল্যাপটপ কেনে। সেটি হারালে কেমন লাগে?! হ্যাঁ, হারানোর পেছনে কিছুটা আমাদের অসাবধানতা, অসচেতনতাও হয়ত আছে, কিন্তু শুধুমাত্র ‘সাহারা-তালা’ দিয়ে বন্ধ করে বসে থাকা মানেই তো সচেতনতা না।আমরা শিক্ষিত মানুষেরাই যদি ব্যাপারটাকে পরোক্ষ ভাবে প্রশ্রয় দেই তাহলে কীভাবে হবে?
আমাদেরই পণ্য চুরি হচ্ছে আবার আমরাই তা চোরাইপণ্যের দোকান থেকে কিনছি। চোরাইপণ্যের দোকান থেকে যদি অন্য কিছু বিক্রি হত তাহলে আমি এতো কথা বলতাম না। ফুটপাথে অনেক কিছু বিক্রি হয় যার কিছু অংশ চোরাই হতে পারে, কিন্তু ওগুলো নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।কারণ সেসব পণ্য শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই কেনে। যেহেতু পণ্যটি মোবাইল, ল্যাপটপ সেহেতু তা অবশ্যই শিক্ষিত মানুষেরা কেনে। শিক্ষিত, সামর্থ্যবান মানুষ কেন চোরাই পণ্য কিনবে?
বেচাকেনা হচ্ছে বলেই নিশ্চয়ই ব্যবসাগুলো টিকে আছে। আমরা চোরাই পণ্য কেনার মাধ্যমে আমরা, আমরা শিক্ষিত মানুষেরাই এই ব্যবসা চালিয়ে নিচ্ছি।
আমি একা বা আমরা কয়েকজন চোরাই পণ্য কেনা বন্ধ করে এই ব্যবসা বন্ধ করতে পারব না কিন্তু একটা পদক্ষেপ নিয়ে তো দেখি। কিছু না করে বসে থাকব, আবার আমরাই বলব- আমাদের দুর্নীতি মুক্ত দেশ চাই???
চমৎকার একটা বিষয় তুলে এনেছেন। এভাবে আগে ভেবে দেখি নি।
তবে, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদির উপর ট্যাক্স এর পরিমাণ নিয়ে ভাবার সুযোগ আছে। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এর আমদানিতে কর দিতে হয় ১২%, যেখানে আমেরিকায় আমদানি কর শূন্য। কেউ ২০০০০ টাকার একটা ফোন কিনতে গেলে বিভিন্ন ট্যাক্স যোগ হয়ে এটার দাম হয়ে যাবে ২৫০০০+। এজন্যই মানুষ কম দামে কেনে।
অবশ্যই প্রত্যেকের বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা থাকা উচিত ভালো-খারাপের বিষয়ে, তবে একই সাথে ট্যাক্স এর পরিমাণ নিয়ে এখানে প্রশ্ন তোলারও সুযোগ থাকছে।
প্রথম কথাঃ নিয়ম তো নিয়মই। এখন আমার দেশে যদি কর দিতে হয়, আমার তো নিয়মের বাইরে যাওয়া উচিৎ হবে না।
দ্বিতীয় কথাঃ বিদেশ থেকে এনে ব্যক্তিগত ভাবে কেউ যদি বিক্রি করে তাহলে নাহয় আমি জানব-এটি কর ফাঁকি দেয়া পণ্য, তাই দাম কম। কিন্তু বিক্রি যদি ব্যক্তিগত ভাবে না হয়ে দোকানে হয়, সেখানে তো কোনটা চুরি করা পণ্য আর কোনটা কর ফাঁকি দেয়া পণ্য সেটা আলাদা করা কঠিন। 🙁
আরও ব্যাপার আছে।
চোরাই পণ্যের কর দেয় কি কেউ? এলাকার চাঁদাবাজরা কিছু খাবে, তাহলেই চোরাই পণ্য আবার বৈধ হয়ে যাবে! যিনি কেনেন তিনিও একই সাথে করমুক্ত থাকেন+কম দামে কেনেন আর বিক্রেতার তো পুরোটাই লাভ, আন্ডারডগের আখরায় যাবে, বাকিটা নিজের।
মোবাইল ফোন আমদানীর এই ব্যয়বহুল খরচের আরেকটা সমাধান হতে পারে দেশি পণ্যের প্রচার। দেশি বিক্রেতারা যত মার খাবে, শুল্কও তত বাড়বে। চিকিৎসা, শিক্ষাক্ষেত্রে যেখানে বাৎসরিক বাজেটের হার কম থাকে সেখানে ইলেকট্রনিক্সের সামগ্রীতে ছাড় দেয়াটা বেমানান। যদিও নিয়মটা একইরকম হয় না সবসময়।
আবার এই আমদানি কর বাড়ার কারণেও ল্যাপটপ চুরি, ছিনতাই আর সেকেন্ড হ্যান্ডের ব্যবসা চলতে থাকে। দারিদ্রের দুষ্টচক্রের মত অবস্থা অনেকটা। যাদের জিনিস চুরি হয়, তারা বারবার নতুন পণ্য কিনতে আগ্রহী হন না ধনিক শ্রেণিভুক্ত না হলে।
এই চক্রটা কীভাবে ভাঙা যায় সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
শত হোক, নিজেদের দেশ তো।
দায়টা নিজেদেরই নিতে হবে।
সুন্দর পোস্ট, পাঞ্চলাইনটা দারুণভাবে প্রশ্নবোধক অনুভূতির জন্ম দেয়।
দেশি পণ্যের প্রসার অনেকটাই কমাতে পারে এই দুর্নীতি-সহমত।
ছোট-খাট (মানে বয়সে) পিচ্চি মানুষ, এতো ভারি ভারি কথা একটু কম বুঝি 🙁
পড়ার জন্য ধন্যবাদ 8)
দেখা হলে বুঝিয়ে দিবোনে! 😛
দারুণ লিখেছো তো! আমি পড়া শুরু করার আগে/শিরোনাম দেখে বুঝতেই পারি নাই ভেতরে কী থাকবে।
এসব নিয়ে তেমন ভাবি নাই আগে, তবে তোমার প্রতিটা কথাই যৌক্তিক মনে হল। ভাবনা-জাগানিয়া পোস্টের জন্য ফাইভ-স্টার দিলাম একটা। 😀
এটা তো মনে হয় তোমার ল্যাপটপ হারানোর শোক থেকে আসা পোস্ট। 🙁
ধন্যবাদ 🙂
সেইটা আবার বলতে…… :crying:
ল্যাপটপ হারানোর পর, মানে সেই তিন মাস আগ থেকে ভাবতেসি এটা লিখব লিখব……
অনেক ভাবনা যোগানো……
ভাবনা জাগার জন্য ধন্যবাদ 🙂
কিছুদিন আগে কলকাতার একটা মুভি দেখলাম “ল্যাপটপ”।
মুভির কাহিনী একটা ল্যাপটপ হারানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করী, সেই ল্যাপটপ হাত বদল হতে হতে ঘটনা এগিয়ে যাওয়া। যতদূর মনে পড়ে ঘটনাটা এমন ছিল…একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার ল্যাপটপ চুরি করে, তার স্ত্রী অনেকবার চেষ্টার পর সম্ভবত টেস্টটিউবের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দেবার জন্য হাসপাতালে ভর্তি, কিছু টাকা বাকি থাকার জন্য ডাক্তার অপারেশনে রাজি হচ্ছেন না। সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার ঐ ল্যাপটপ প্রায় অর্ধেক দামে এক অসহায় নিম্ন মধ্যবিত্ত পিতার কাছে বিক্রি করে দেয়, যার ছেলে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে এবং তার একটি ল্যাপটপ কেনা আবশ্যক।
এত ঘটনা বললাম, কারণ এখানে ভেবে দেখার সুযোগ আছে যারা এই চোরাই পণ্য কিনছেন, তারা আসলে কেন কিনছেন? অবশ্য বাংলাদেশে এখন দোয়েল ল্যাপটপ আছে, সেটা দিয়ে কাজ চলার কথা। পোস্ট পড়তে পড়তেই বুঝেছি, লেখিকা মনে অত্যন্ত ক্ষোভ নিয়ে লিখেছেন। এইভাবে চুরি যাওয়া মেনে নেয়া যায় না আসলেই।
সমাধানের জন্য দেশীয় পণ্যের প্রসার দরকার এটা ঠিক। কিন্তু তার আগে মানুষের মানসিকতারও পরিবর্তন দরকার। আজকাল আইফোন, আইপ্যাড, দামী ক্যামেরা, ল্যাপটপের প্রতি তরুণ প্রজন্মের ক্রমবর্ধমান Crazyness কমানো দরকার। সবার সামর্থ্য থাকে না, যার সামর্থ্য থাকে এইসব কেনার, তাদের অন্যদের থেকে নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার মানসিকতা /show off tendency থেকে সরে এসে ইতিবাচক কাজে/দেশীয় পণ্যে (হোক তা কমদামি) সম্পদ ব্যয় করা দরকার, যাতে দেশ ও দশের উপকার নিহিত থাকে। তাহলে সত্যিকার অর্থে সরব একটি প্রজন্ম আমরা পাব।
সরি, মনে হয় বেশি দীর্ঘ মন্তব্য করে ফেললাম! আমার নিজেরও মোবাইল চুরির ঘটনা আছে… 🙁