স্কিল ডেভেলপমেন্ট সিরিজ: মোটিভেশন

আদিবার সবটাতেই আলসেমি। অ্যাই! ভার্সিটিতে ফটোগ্রাফি ক্লাব খুলেছে, যাবি? হ্যা.. যাব? কী হবে গিয়ে? মা বলেন, পড়াশুনা কর্, শুনলে ওর গা ঝিমঝিম করে। এত পড়ে কী হবে? এমন না যে ও বিষণ্নতার রোগী, বা খুব দুঃখী, এমনিই ভালো লাগেনা।

আমরা সোজা ভাষায় যাকে বলি সুখের অসুখ – তাই নিয়েই আজকের লেখা। মোটিভেশন বা উৎসাহ যে কোন কাজের আন্তরিকতার প্রধান নিয়ামক। ওটা না থাকলে কাজে এগোন সম্ভব না। মোটিভেশন না পাওয়াটা কিন্তু কোন অসুখ না, প্রত্যেকটা মানুষই এই অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। কেউ কেউ খুব বেশি যায়, এই আর কী!

মোটিভেশন নিয়ে কথা বলার আগে এমন একটা ঘটনার কথা মনে করুন ত, যেখানে খুব উৎসাহ নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন? সেটা হতে পারে কোন একটা প্রজেক্ট ওয়ার্ক, পিকনিকের আয়োজন, রান্না শেখা, বিয়ের প্রোগ্রামের আয়োজন করা, পড়াশুনার কোন একটা টপিক – যে কোন কিছুই! এমন একটা ঘটনা ভাবুন, যেটা সমাধা করার জন্য কারো চোখ রাঙাতে হয়নি, তিন বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়নি, একশো বার ফেসবুকে আসতে হয়নি। এবার মনে মনে ভাবুন ত, কী এমন ছিল সে কাজটায়, যেটা আপনাকে এত উৎসাহ দিয়েছিল?

ভাল করে ভাবলে দেখবেন, হয়ত কাজটা করার প্রক্রিয়াটা আপনার খুউব প্রিয় (চশমা আঁটা আঁতেলদের জন্য সুডোকু গেম যেমন), অথবা কাজ শেষ হলে কী দারুণই না হবে, এ কথা ভাবতে ভাবতেই অনায়াসে কাজটা করে ফেলা। এখানে দু’ধরণের প্রেরণার উৎস পাওয়া যাচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ: কাজটা ভীষণ আনন্দের। তাই করা। “আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।”

বাহ্যিক: পথের শেষটা খুব সুন্দর, তাই কষ্ট টা গায়েই লাগছে না।

বলা হয় অনুপ্রেরণাটা বাহ্যিক এর বদলে অভ্যন্তরীণ করে নিলে পুরো কাজটাই আনন্দময় হয়ে যায়, তাছাড়া প্রচেষ্টা শেষে সফলতা না আসলেও এতটা কষ্ট লাগে না। কারণ এখানে শেখাটাই ত আনন্দময় ছিল!

মোটিভেশন কেন থাকেনা আমাদের? আমরা কি মানুষ হিসেবে এতই খারাপ যে কেবল অলসতা করতেই ভালবাসি? না! আমার মনে হয়, উৎসাহিত হওয়ার মত উপযুক্ত কারণ আমাদের সামনে থাকেনা দেখেই ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে যাই। বাবা বললেন মেডিকেলে পড়তেই হবে, তাই পাগলের মত ভর্তি পরীক্ষার জন্য পড়ছি – এভাবে কিন্তু আগ্রহটা থাকবে না। কারণ বাবা ডাক্তার হওয়ার উপযুক্ত কারণটাও দেখান নি, ডাক্তারি পড়ার মজাটাও দেখিয়ে দেন নি।

খুব আগ্রহ নিয়ে একটা গ্রুপে ঢুকলেন, কিন্তু যেখানেই যাই করতে যান, কেমন যেন শুধু আড়ি আড়ি ভাব, আপনি বুঝতে পারছেন না, ঠিক কী করা উচিৎ, কেউ বলেও দিচ্ছেনা – আস্তে আস্তে মোটিভেশন টা হারিয়ে যাবে।

অঙ্ক পারিনা, বায়োলজি কঠিন লাগে – এ ধরণের কথা বাবা মায়েরা শুনতে একেবারেই রাজি নন। জোর করে সে বিষয়ে পড়তে পাঠিয়ে দেন। ফলস্বরূপ, চরম নিরাসক্তি। একইভাবে, হেরে যাওয়ার ভয়, ভালো করতে না পারার ভয়, অন্যরা কী ভাবছে সেই ভয় – সবকিছু মিলে গুটিয়ে যাওয়ার সহজতম অস্ত্র – মোটিভেশন হারিয়ে ফেলা।

একই ধরণের সোশ্যাল ফোবিয়া দেখা যায় নতুন কোন চ্যালেঞ্জ নিতে গিয়ে। যে পরিবারের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বড় হয়, ঝুঁকি নিতে উৎসাহ দেয়া হয়না, বা ব্যর্থতাকে কঠোর সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখা হয়, সে পরিবারের ছেলেমেয়েদের নতুন কোন দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে অনাকাঙ্ক্ষা দেখা যায়।

মোটিভেশন না থাকলে মানুষ কাজটা ফেলে রাখে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না হলেই নয়। অথবা আরেকটা কাজ (এমনকি যদি হয় ঘর গুছানোও) মোটামুটি জরুরি হলে ওটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে লেখার পর অনেকেই অনুরোধ করেছেন প্রোক্র্যাস্টিনেশন বা শেষ মুহূর্তে কাজ করার বাতিক নিয়ে লিখতে। আমি মনে করি প্রোক্র্যাস্টিনেশন কে দূর করার মূল দাওয়াই হচ্ছে মোটিভেশন বাড়ানো।

কিছু সহজ টিপ দেয়া হল –

১. চাপিয়ে দেয়া লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইঁদুর দৌড় করতে হচ্ছে এমন বোধ হলে খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন অন্যরা কেন এই কাজে মোটিভেটেড হয়। কেউ হয়ত বলবে এই পেশা মহৎ, এই পেশায় টাকাপয়সা বেশি, সম্মান বেশি, কেউ বলবে বাবা মা কে খুশি করার জন্য, কেউ হয়ত নেহাৎ পড়াটার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পায়। তাদের সাথে কথা বলুন, দেখুন আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটাকেও একটু বদলানো যায় কি না! হ্যাঁ, শুরুতে হয়ত নিজের ইচ্ছায় আসা হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা বলে, আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও এতদূর উৎরে গেছেন, তার মানে আপনার সত্যিই যোগ্যতা আছে এই কাজটা করার। শুধু দরকার একটু মোটিভেশন।

২. যে কাজটা করছেন, তা খুবই বোরিং হলে একটা প্রিয় কাজের সাথে জোড়া লাগিয়ে করতে পারেন। যেমন টেবিলের পর্বতসম নোট গুছিয়ে রাখলে মজার একটা আইসক্রিম খাব। বা, দুই পৃষ্ঠা মন দিয়ে পড়া হলে দশ মিনিট ব্রাউজিং করব।

৩. বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে থাকুন কাজটা করার পেছনে লক্ষ্যটা কী? যখনই কাজটা করে একটু ভালো লাগবে, সময়টাকে মনে রাখুন, সেলিব্রেট করুন। পরবর্তীতে যেন এখান থেকে অনুপ্রেরণা পান।

৪. বিরাট বড় একটা কাজ করতে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। কাজটাকে ভেঙে ছোট্ট ছোট্ট করে নিন। নিজে ভেঙে ছোট করতে ভয় লাগলে অন্য কাউকে বলুন ছোট ছোট ভাগ করে দিতে। তারপর একবারে ছোট্ট একটা অংশ করুন। কম্পিউটারের মত!

৫. পুরোপুরি নিজস্ব টিপস্: মনে মনে একটা কিউট পাঁচ বছরের পাকনা বাচ্চাকে চিন্তা করে নিন, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন আপনি কী কাজ করেন। তার মজা লাগে এমনভাবে বুঝিয়ে বলতে পারলে আপনি আপনার কাজকে ভালবাসতে শুরু করবেন, নিশ্চিত!

যে উৎসাহ হিরককে সিন্দুকে চাপা দিয়ে রেখেছেন বছরের পর বছর, আজকে একটু বের করে দেখুন না, আগের মতই চিকমিক করে কি না! উদাসীনতার ধুলো ঝেড়ে, আশা নামের রোদটির সংস্পর্শে রাখলে হয়ত আজকে তার অন্য রূপ দেখতেও পারেন!

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

12 Responses to স্কিল ডেভেলপমেন্ট সিরিজ: মোটিভেশন

  1. নোঙ্গর ছেঁড়া বলেছেনঃ

    আহ!! এইরকম কিছু কথাবার্তা খুঁজছিলাম অনেকদিন ধরে…
    কিছু আইডিয়া অন্তত পেলাম, ব্যবহার করতে পারব কিনা জানিনা।
    পিচ্চিদেরকে ধরে বুঝানোর আইডিয়াটা পছন্দ হইসে। মনে মনে একটু ট্রাই করে গিয়েই দেখলাম কাজে লাগতে শুরু করেছে।

  2. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ২ আর ৫ আমি ফলো করি! হিহিহি …বাকিগুলোও মাথায় নিলাম। :happy:

  3. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    ৫ নম্বর পয়েন্টটা ব্যাপক কিউট! 😀

    প্রোক্রাস্টিনেশন নিয়ে পেইন অনেকদিন ধরেই। টাইম ম্যানেজমেন্টের বিষয়াদি জীবনে প্রয়োগ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি বেশ কয়েকদিন ধরেই। কিছুটা ফল আসতেও আরম্ভ করেছে। আপনার এই সিরিজের মহাভক্ত আমি! 😀

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    সব দাওয়াই-ই জানি, শুধু অ্যাপ্লাই-টাই করা হয় না।
    কখনও অ্যাপ্লাই করতে পারলে, আপুকে এসে জানিয়ে যাব।
    পোস্ট বরাবরের মতই অতীব সুস্বাদু। 😀

  5. সাবরির অনিক বলেছেনঃ

    একেবারে আমার জন্যে লেখা। :yahooo:

  6. অক্ষর বলেছেনঃ

    “মনে মনে একটা কিউট পাঁচ বছরের পাকনা বাচ্চাকে চিন্তা করে নিন, তাকে বোঝানোর চেষ্টা করুন আপনি কী কাজ করেন। তার মজা লাগে এমনভাবে বুঝিয়ে বলতে পারলে আপনি আপনার কাজকে ভালবাসতে শুরু করবেন, নিশ্চিত!”

    চেষ্টা করে দেখি, অবশ্যই কিছু না কিছু হওয়ার কথা ! খুবই উপকারি পোস্ট।

  7. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    এত্ত ভালো একটা পোস্ট আর আমি এতোদিন পরে দেখলাম ভেবে নিজের উপরেই রাগ হচ্ছে! :wallbash:

    পোস্ট প্রিয়তে নিলাম আপু।
    মাঝে মাঝেই উলটে পালটে দেখতে আসব। :penguindance:

  8. জনৈক বলেছেনঃ

    দারুণ পোস্ট…পড়েছিলাম আগেই, কমেন্ট এখন!

  9. মিসন বলেছেনঃ

    আপু , আমি মোটিভেশন এর ফ৽ান ।।। আপনি কি মোটিভেশন এক্সপারট ।।। আমারও ইচ্ছা মোটিভেশন নিয়ে কাজ করার । 🙁

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।