“ধানমন্ডি ৮ এ চল।”, বলেই রিক্সায় উঠে গেল অলি। রাত এখন ১২টা।
অলি, পুরো নাম মাশরুর হাসান অলি। মাশরুর নামটাই অলির বেশি পছন্দের কিন্তু অলি নামটা আব্বার দেওয়া বলে আম্মা সবসময় সবার কাছে অলিকে অলি বলেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। অলির বয়স যখন তিন অলির বাবা মারা যায়। এরপর মাকে নিয়ে অলির ধানমন্ডি ৮ এর ওদের পাঁচ তলা বিল্ডিংটাতেই বেড়ে ওঠা। আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেউ নেই ওদের। এক বড় চাচা, তিনিও আবার বিদেশে থাকেন। অলির ছোট বেলাটা খুব একাকী কাটে, পাশের বাসার ছেলেদের সাথে আম্মা খুব একটা বেশি মিশতে দিতেন না, খেলা তো দূরের কথা। অলির নিজের ছোট্ট রুমটা ছিল ওর দুনিয়া। রাতের বেলা মায়ের সাথেই ঘুমাতো ও। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখত আম্মা বারান্দার গ্রিল ধরে বাহিরে তাকিয়ে আছে, হয়ত আব্বাকেই খুজত। অলিও সময় পেলে একা একা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মার মতই আব্বাকে খুঁজত। কত ছোট্ট বেলায়ই জীবন। কিন্তু এক আম্মা ছিল বলেই অলি কখনও কষ্টটাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারে নি তার আগে তার আম্মাই কষ্টটাকে নিজের করে নিত। এখন কি অলির কষ্টের দিনগুলো শুরু হল?
“ভাই রাইতের বেলা, ভাড়া কিন্তু বাড়াইয়া দিতে হইব”, রিক্সাওয়ালার ডাকে হুশ ফেরে অলির। আস্তে করে বলে “হুম।”
“ভাই জীবনডা বড়ই কষ্টের, হায়রে জীবন! সারাডা দিন রিক্সা চালাইয়া পাইলাম ছয়শ ট্যাহা, মাহাজনরে একশ ট্যাহা দেওয়ার পর আর থাকে পাঁচশ, ঘর ভাড়া প্রতিদিন পঞ্চাশ ট্যাহা, ঘরে মা, বউ আর দুইডা পোলাপান। মায়ের বয়সটা দিন দিন বাড়তাছে তাও বুড়িডা মরে না। হের লাইগ্যা ওষুধ কিন, আবার খাওন দেও। বউও পাইছি একটা। হারাডা দিন খালি যাইগা যাইগা করে, কয় কাপড় নাকি দেই না! আরে এত ট্যাহা কই পামু যে তরে নতুন শাড়ী কিন্না দিমু? পোলাপাইন দুইডা খালি কয় আব্বা নতুন জামা কিন্না দেও, পড়ালেহা করুম, স্কুলে ভর্তি কইরা দেও ! হালার পোলাপাইনের জ্বালায়ও বাঁচি না। এই লাইগ্যাই রাইতের বেলায়ও বাড়িত থাকি না, রিক্সা লইয়া বাইর হইয়া পড়ি, ট্যাহা কামাই, নিজে খাই, আর যা থাহে ঘরে দিয়া আহি ওরা খায়। ও ভাই শুনেন নি।”
“হুম শুনি,বল”, অলি বলে।
“ভাই আমি জহিরুল, জহির ডাক নাম। ভাই জীবনের বড়ই শখ আছিল পাঁচ তলা একডা বাড়িত মা, বউ, পোলাপাইন লইয়া থাকুম, হইল না। এই যে দেহেন এই বাড়িগুলার মানুষ কত আরামে ঘুমাইতাছে, পাশে বউ পোলাপাইন শোয়া, পাশের ঘরে মা-বাপ, আহ কি সুখ! আল্লাহয় আমার জীবনে ঐ সুখডা দিল না, ভাই শুনেন নি? কিছু কন না যে? ভাই গরিব মানুষ রিক্সা ওয়ালা বইলা আমাগো লগে কথাও কন না? হায় কি কপাল লইয়া জন্মাইলাম!”
“জহিরুল, রিক্সাওয়ালা বলে কথা বলব না কেন? আচ্ছা আজ এই রাতে আমাকে যে এতটা পথ কষ্ট করে বয়ে নিয়ে আসল তাকে কি শুধু টাকা দিয়ে মাপতে পারব? আমাকে হাজার টাকা দিলেও কি আমি এটা করতে পারতাম বা করতাম? নিজেকে এত ছোট ভাববানা বুঝছ।”
ধানমন্ডি ৮ এর অলিদের বাসার সামনে এসে রিক্সা থামল। আম্মার ঘরের লাইটটা জ্বালানো, অলির মনে হল আম্মা মনে হয় ঘুমায় নি এখনও। কিন্তু ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা তো!
“ভাই একডা কথা জিগাই?”
“হুম, বল জহিরুল।”
“এত রাইতে কবর স্থানে কি করলেন?”
“এই বাসাটা দেখতেছ জহিরুল? এইটা আমাদের বাসা, পাঁচ তলা বিল্ডিং। এই বাসার ঐ ওপরের বাসাটায় আমি আর আমার আম্মা থাকতাম। আমার আম্মা ছাড়া আর কেউ নাই, আজ সকালে আম্মা মারা গেছে, তাকে আজিমপুরে রেখে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেল। আম্মা তো, তাই আসতে ইচ্ছা করছিল না। এই বিশাল বাড়িটায় আমি একা কিভাবে থাকব? তারপর ঐখানের হুজুর জোর করে পাঠায় দিল কিন্তু এই বাড়িটায় ঢুকতে ইচ্ছা করতেছে না। এক সাথে ভাত খাবো কার সাথে?”
জহিরুল চলে যায়। সে খুব দ্রুত রিক্সার প্যাডেল চাপছে। তাড়াতাড়ি তার বস্তিটায় ফিরে যেতে হবে। তার বুড়ি মা টা তার জন্য না খেয়ে বসে আছে, ছোট বেলা থেকেই জহিরুল ছাড়া সে খায় না, আজও মনে হয় খায় নাই।
“পোলাপানগুলাও দাদীর মত হইছে।”, ভেবে হাসে জহির।
বউটারেও কতদিন ভালো করে দেখে না, আজকে সবার সাথে এক সাথে খাবে জহিরুল। তারপর বাচ্চা পোলাপান দুইডারে নিয়া বুকে জড়াইয়া একটা ঘুম দিব। পাঁচ তলা না থাকলেও আজ সে সুখী, অনেক না হইলেও অনেকের চেয়ে বেশি।
[আইনস্টাইন সাহেব আপেক্ষিকতা নীতি দিয়েছিলেন। দৈর্ঘ্য, ভর, সময় কত কিছু নিয়েই বলেছেন কিন্তু সুখ জিনিসটা বোধহয় ভুলে বাদ পড়ে গিয়েছে। এটাই যে সবচেয়ে বেশি আপেক্ষিক, সুখ।]
:crying:
🙁
ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেলে অক্ষর! তবে গল্পটা আর সামান্য একটু বড় হলে মনে হয় মন্দ হত না। মনে হল, একটু তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আসলেই সৃষ্টিকর্তা সবাইকেই কিছু না কিছু দেন সুখী হবার মত। সত্যিই আপেক্ষিক…
পরে আর কখনও লিখলে বড় করে লিখব ! থ্যাঙ্কস পড়ার জন্য। 🙂
আমার খুব ভাল লাগলো গল্পটা অক্ষর। শেষটায় কী হবে আগে থেকে বোঝা যায় নাই, এই জন্য বেশি সুন্দর লাগলো। মেসেজটাও দারুণ! 🙂
ধইন্যা আপি ! :happy:
মেসেজটা আসলেই অনেক সুন্দর 😀
সবচেয়ে বেশি আপেক্ষিক সুখ আমারও তাই মনে হয়
আর গল্পের শেষটা অনেক সুন্দর হয়েছে পিচ্চি
ধইন্যা পিচ্চি আপি ! 😛
আগে মন্তব্য গুলো পড়ে গল্পটা পড়লাম। অক্ষরের লেখা এভাবেই পড়ি।
অক্ষর- সুখের আপেক্ষিক মানে খোঁজা শুরু হল কেন ভাই?
আগে মন্তব্য গুলো পড়ে গল্পটা পড়লাম। অক্ষরের লেখা এভাবেই পড়ি।
😯 😯 :thinking:
🙁 🙁
তোর এখন পর্যন্ত লেখা সব গল্পের ভেতর এটা একদম অন্যরকম লাগল।
আগে থেকে ধরতেই পারি নাই কী হবে শেষটা!
লেখালেখি ভালো হচ্ছে দিন দিন।
গুড গুড। 😀
8)