ফিলিস্তিনের ঘটনায় হতবিহ্বল কতিপয় মুসলিম

ফেসবুকে, ব্লগে ঝলসানো পোড়া, বিধ্বস্ত শহর আর মানুষদের ছবি দেখে দেখে মনটা এতটুকু ছোট হয়ে গেছে। বারবার কিছু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল মনে। ছুটির দিনে স্বামীর সাথে ঘর গোছানোর ফাঁকে প্রশ্নটা করেই ফেললাম।

– আচ্ছা, ফিলিস্তিনিদের এত কষ্ট দেখে কি তোমার মনে হয়না, আল্লাহ্‌ কিছু করছেন না কেন? বা আল্লাহ্‌ কী করে মুসলিমদের এত দুর্দশা চুপচাপ দেখে যান?

আমার স্বামীর ঝটপট উত্তর – নাহ!

– কেন?

– (ড্রয়িংরুমে মুখোমুখি সোফায় বসতে বসতে), তুমি আজিমভের ‘ফাউন্ডেশন সিরিজ’ টা পড়েছ না? হ্যারি শেল্ডন যে বিশ্বকোষ তৈরির নাম করে একটা গ্রুপকে টার্মিনাস থেকে অনেক দূরে পাঠিয়ে দেয়, ওর আসল উদ্দেশ্য তো বিশ্বকোষ তৈরি ছিলনা। কিন্তু সেটা প্রথমেই বলে দিলে উদ্দেশ্যটা পূরণ হত না।

– হুম

– এবার দেখ, শেল্ডনের গাণিতিক মডেলগুলিতে কোথাও কিন্তু কোন মিরাকল ঘটার জায়গা ছিল না। ছিল কিছু গণনা, কীভাবে মানুষ বিভিন্ন ধীর সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করবে।

– হুম

– আল্লাহ্‌ কিন্তু যখন তখন মিরাকলের বৃষ্টি নামিয়ে দেন নি। তোমার অসুখ হল, তুমি আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাইলে আর উনি তোমাকে রাতারাতি ভালো করে দিলেন – ঘটনাগুলি কিন্তু এভাবে হয়না। আল্লাহ্‌ চাইলেই পারেন, কিন্তু আমরা আমাদের বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবনা, এমনভাবে উনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে হস্তক্ষেপ করবেন না।

– কিন্তু আল্লাহ্‌ তো প্রথম থেকেই জানেন ইসরায়েল এই জায়গায় গেঁড়ে বসলে এত এত প্রাণহানি হবে!

– অবশ্যই জানেন। উনার উদ্দেশ্য ত আর আমরা জানিনা, তবে ভাবতে দোষ কি, এই ধরণের পরিস্থিতি তে মুসলিম উম্মাহ হয়ত এক হবে, তারা ইহুদিদের পরাস্ত করার জন্য জ্ঞানবুদ্ধি, অর্থনৈতিক সামর্থ্য বাড়ানোর দিকে মন দেবে। শক্তিমত্তায় যে হবে না সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে।

– বোধহয় তুমিই ঠিক বলেছ। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিতে এমন কোন পন্থা গ্রহণ করতে মন চায়না, যেখানে নিরীহ মানুষের জীবনের বিনিময়ে সুদূরপ্রসারী লাভ হবে।

– হ্যাঁ, আমাদের জন্য এমন পন্থা গ্রহণযোগ্য না। আমরা চাইলেই বলতে পারিনা, ইসরায়েল এমন, চল সব ইহুদিদের বোমা মেরে উড়িয়ে দেই।

– কিন্তু আল্লাহ্‌ পারেন?

– অবশ্যই! কারণ উনার প্রজ্ঞা ত আর আমরা আমাদের স্ট্যান্ডার্ডে মাপতে পারব না!

– অর্থাৎ আমরা আমাদের বোধ বুদ্ধি দিয়ে আল্লাহ্‌র সিদ্ধান্ত বুঝতে যাওয়ার চেষ্টা করব না?

– অবশ্যই না!

– কিন্তু তাহলে গাজার এই ঘটনায় আমি একজন মুসলিম হিসেবে কী ভাবব?

– আমরা চিন্তা করব আমরা কী করতে পারি! আল্লাহ্‌ এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আমাদের পার করছেন এটা দেখার জন্যই তো, আমরা কীভাবে এর সমাধান করি, তাই না?

– হু!

স্বামীর সাথে এটুকুই ছিল কথোপকথন। আলোচনাটা অনেকগুলো চিন্তা নতুন করে শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করল। মোটামুটি নাস্তিকতা কখনও আমার মনে জায়গা পায়নি, কিন্তু এহেন অসহায় অবস্থায় ঠিকই মনে এসেছে, আল্লাহ কি আমাদের দেখেন না? আমরা কি আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্ত দল নই? তখন অল্প বুঝতে পারলাম, কেন ব্যক্তিগত দুঃখ দুর্দশায় ভুগলে অনেকে নাস্তিক হয়ে যায়। ঈমানকে চোখ রাঙানি নয়, বরং বার বার রিমাইন্ডার এর মাধ্যমে পাকাপোক্ত করাই আরেক পরীক্ষা।

আমাদের কাছে সোজা চোখে যে কাজটা অন্যায় মনে হয়, তার সুদূরপ্রসারী ভালো দিক থাকতেও পারে (উদাহরণ সূরা কাহফ), সুতরাং কেন আল্লাহ এসব হতে দিচ্ছেন ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে আল্লাহ আমাদের থেকে কী আশা করছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করাই ভালো।

হ্যা, আমি মুসলিম হিসেবে কী করতে পারি? ফেসবুকে, ব্লগে ছবি শেয়ার করতে পারি, মন খারাপ করে কান্নাকাটি করতে পারি – সেসব ত আছেই, কিন্তু সে ত আজ রাতে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির ঘোষণা হলেই কালকে ভুলে যাব। তারপর? আবারো যে কে সেই?

এর উত্তর খুঁজছিলাম যখন, তখন এক ছোট ভাইয়ের এই চিন্তাটা চোখে পড়ল –

“বাস্তবধর্মী চিন্তা বাস্তববাদী মানুষের থাকবে। কিন্তু তাই বলে আবেগ থাকবে না, তা কিন্তু নয়। গত কয়দিন ধরে গাজার মানুষদের উপর ইসরাইলী সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের জন্য তাই ফেসবুক জুড়ে দেখি আবেগী সংলাপ।

কেউ দুষছে মুসলিম দেশপ্রধানদের। কেউ বলছে পুরো বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অধিকাংশই ভদ্র অভদ্র ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে ইসরাইলীদের প্রতি। কেউ আবার আগ বাড়িয়ে বলছে ইহুদীদের দোষ।
এর মধ্যে সমাধানের চিন্তাও করছেন কেউ কেউ। সেই সমাধানের ব্যাপ্তিটা ব্যপক। স্রেফ ইসরাইলী পণ্য বর্জন থেকে শুরু করে, জগৎজুড়ে মুসলিম খেলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক আছে এতে।জোর দিয়ে প্রকাশ আছে, স্রষ্টার কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি, ধর্মগ্রন্থ আর ধর্মীয় আচারে আরো মনোনিবেশ করে আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা।

কিন্তু, এ সব কিছুই নিছক আবেগের আস্ফালন ছাড়া কিছুই নয় বলে প্রমাণ করা যায়। আজকের ইসরাইল কিন্তু, আগে থেকেই এমন ছিল না। বরং, শত বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে তারা। ইউরোপিয়ান অত্যাচারীদের হাত থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নিয়ে, এখন তারা জ্ঞান বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখায় সর্বাধিক প্রযুক্তিধারী হবার প্রতিযোগীতায় রত। শুধু প্রযুক্তি নয়, রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে তাদের বর্তমান প্রভাব বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত।

আমরা আবেগে অনেক কিছুই করতে পারি। কিন্তু, ধর্মীয়ভাবে মুসলিম হওয়ার দায়িত্ববোধ থেকে জ্ঞানচর্চা আর উন্নয়নের জন্য নিজেদের মিশন নির্দিষ্ট করতে আমরা অক্ষম। কয়টা তরুণ, গাজা হত্যাযজ্ঞের ফলে নিজের মিশনকে জ্ঞানার্জনের দিকে নিয়ে গেছে? কয়জন কিশোর, যুবা, বলেছে, আজ থেকে আমি পড়াশোনায় দুই ঘন্টা করে বেশী সময় দেবো? কতজন, মুসলমান বলেছে, ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছরের মাঝে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আর গবেষণা প্রতিষ্ঠানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবো?

আবেগ মিইয়ে যাবে। রক্তের দাগ থেকে যাবে। থেকে যাবে ইসরাইলের আয়রন ডোম, এয়ার ফোর্স, নিউক্লিয়ার বোমা। থেকে যাবে তাদের মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, অর্থনৈতিক প্রভাব আর রাজনৈতিক লবিং।

আ্মাদেরকেই এই অন্ধকার ঘরে আলো আনতে হবে। জ্ঞানের আলো।”

আমি পুরোপুরিভাবে একমত। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি গাজায় ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার খবরে ইহুদিদের উত্তর হচ্ছে, ‘ওরা আমাদের দিকে রকেট হামলার আগে জানতো না এমন হবে?’ শ’য়ে শ’য়ে ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে শুনে তাদের উত্তর হামাসরা সাধারণ মানুষের ঘরের মাঝখানে ঘাঁটি গেড়ে রাখে। যেসব জায়গায় মিসাইল ফেলা হচ্ছে সেখানে হামাসের ঘাঁটি জেনেই করা হচ্ছে।’ এসব যুক্তি ঠিক না বেঠিক সে তর্কে যাবো না। শুধু বলতে চাই, মিডিয়াতে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বলার মত একটা সহানুভূতিশীল চ্যানেলও নেই। ওদের যুক্তির বিপক্ষে যুক্তি দিয়ে উত্তর দেয়ার জন্য আমাদের নোয়াম চমস্কি, ফিঙ্কেলস্টাইনের মত অমুসলিমদের কাছে হাত পাততে হয়। এর থেকে উত্তরণ কবে হবে? আবেগ, আরো একটু বেশি দোয়া, আরো বেশি বেশি কান্নাকাটি – এর পরে কী? কিছুই না?

আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্ত জাতি আমরা। ‘আর রাহীম’ গুণটি – কেবলমাত্র মু’মিন দের জন্য বরাদ্দ। তার মানে মুসলিম জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করব – এই প্রত্যয়ে যে কাজে হাত দেব সেখানেই আল্লাহর অনুগ্রহের বৃষ্টিধারা নামবে। কুরআনে কতবার আছে, ‘তারা কি দেখে না?’ ‘তারা কি আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করে না?’ তারপরেও কেন বিজ্ঞানে আমাদের খুঁজে পাওয়া যায়না? দর্শনে একখান মাত্র স্কলার? মিডিয়া? জার্নালিজম? থাক আর না বলি।

আলো বহন করতে হবে। আলো। এর কোন বিকল্প নেই।

দয়া করে পোস্টে মন্তব্য করলে কেবলমাত্র কী করার চিন্তা করছেন তা জানিয়ে মন্তব্য করবেন।

কোটেশন: সাইফুদ্দিন সাবের

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

3 Responses to ফিলিস্তিনের ঘটনায় হতবিহ্বল কতিপয় মুসলিম

  1. সামিরা বলেছেনঃ

    “কুরআনে কতবার আছে, ‘তারা কি দেখে না?’ ‘তারা কি আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে চিন্তা করে না?’ তারপরেও কেন বিজ্ঞানে আমাদের খুঁজে পাওয়া যায়না? দর্শনে একখান মাত্র স্কলার? মিডিয়া? জার্নালিজম? থাক আর না বলি।”

    পোস্টে তো মন্তব্য করাই কঠিন করে ফেললেন আপু। একদিক থেকে ভাল অবশ্য। সময় নষ্ট করা বন্ধ করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ্‌। এটাই এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা।

    দারুণ লেখা আপু, বিশেষ করে শেষটা।

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    শেষ লাইনটা লিখে বিপদে ফেলে দিলা কিছুটা, আপু।

    তবে আমি আপাতত চিন্তা করছি, মুসলামানদের অদূরদর্শী আচরণে পরিবর্তন আনার উপায় কী হতে পারে। ফিলিস্তিনের ঘটনায় কী কর্তব্য সেটা ভাইয়ার কোটেশনেই দেয়া আছে। কিন্তু এই ঘটনায় আমার চিন্তাধারা ঘুরপাক খাচ্ছে কেবল মানুষের উগ্রবাদী আচরণকে কেন্দ্র করে। সহনশীলতা, যাচাই-বাছাই করার নীতি, গ্রহণীয় আর বর্জনীয় বিষয়বস্তুর তালিকা তৈরি, গঠনমূলক সমাধান নিয়ে চিন্তা করা- আপাতত এই কয়টা জিনিস গত কয়েকদিন ধরে ভাবছি। মানুষের সাইকোলজির বিচিত্রতা দেখলে সত্যিই অবাক লাগে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।