একটা ‘হয়ত’ উপন্যাসের প্রথম অংশ

ভাবছি গল্প লিখবো…অথবা টানতে টানতে যতদূর যায়। শুরুটা এইরকম। কিছু হচ্ছে কিনা বুঝতে পারছিনা। এই স্বরটা কি টানছে আপনাদের? এর বাকিটুকু পড়তে ইচ্ছা হয়?…

‘চোখ পর্যন্ত পৌঁছায় না তোমার হাসি…’

আর কি যেন বলছিল? একটুখানি চোখ খুলেই বন্ধ করে ফেললাম। আমি তো ঘুমাচ্ছি। নাকি? স্বপ্ন, হ্যাঁ তাই হবে। বাকি কথাটা শোনা হলোনাতো। এরকমই আমি, অর্ধেক মানুষ। আজকাল একটা বইও পড়ে শেষ করি না…আধাআধি গল্পগুলো ঘুরপাক খায় মাথার ভেতর, মেঘের মতোন। নাকি গাভী? কি যেন কবিতাটা ছিল না? ‘কোথায় যেন বাজছে বেনু, মেঘের মতন চড়ছে ধেনু…’ ধুত্তোরি! এটা তো আমি বানালাম। ওইটা মনে হয় শক্তির কবিতা, কেমন দুঃখী দুঃখী, শান্ত কুয়াশা মোড়ানো… ‘যেখানে মেঘ…যেখানে মেঘ…’।

এদের কি কোনদিন চিল্লাচিল্লি থামবে না? কি হয়েছে মানুষের আজকাল? প্রচন্ড শব্দে ফেটে না পড়লে বুঝি নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়া যায় না? যত জোরে তুমি চিৎকার করবে, ততটাই বেঁচে আছ! ল্যাপটপটা অন করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এখন অন্ধকার ঘরে মনিটরের নীল আলো কেমন অতিপ্রাকৃত মনে হয়। এখানে সেখানে জমাট বাঁধা অন্ধকার। ওই কোনার দিকে বড় চারকোনা অন্ধকারটা আমার স্যুটকেস। ডালা খুলে পড়ে আছে দুইদিন ধরে। ভিতরে কাপড়-চোপড়, বই, চিরুণী, ক্যামেরা, ভাংতি পয়সা সব মিলেমিশে সরগরম অবস্থা। আমার কিছুই গোছাতে ইচ্ছা করে না, খালি ঘুমাই আমি, আর মাঝে মাঝে জাগি।

বাথরুমের ট্যাপটা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে। শুনতে পাই। বাইরে কেউ একজন কন্ঠনালীর সীমার বাইরে গিয়ে চিৎকার করলো মনে হয়। কিম্ভুত এক শব্দে বাতাস ভারী হয়ে গেল – কে বলবে এই শব্দ মানুষের কন্ঠ নিঃসৃত? কেউ কোথাও কোন আলাপ করছে না, হাসছে না, এমনকি গানও শুনছে না। শুধু ওই প্রাচীন কোন প্রাণীর আর্তনাদের মতন চিৎকারের সাথে মিশে যাচ্ছে রাস্তায় গাড়ি চলাচলের হুশ হুশ শব্দ। শনিবার রাতে বেড়িয়েছে মানুষ। কেউ না কেউ সবসময়েই কোথাও না কোথাও যাচ্ছে।

আমরাও যেতাম অকল্যান্ডে – শুক্রবার আর শনিবারের রাতগুলো বিশেষ করে। আর কি আজব আজব কাজ যে করতাম! ‘পরিণীতা’ দেখতে গিয়েছিলাম কোন হলে যেন। আমি আর রাসেল নিজেরাই এত বকবক করতে করতে সিট খুঁজছিলাম যে সামনের সারির লাইনধরা মাথাগুলো যে জ্যন্ত মানুষের শরীরের সাথেই জোড়া দেয়া আছে, খেয়ালই করিনি। আমার ঠিক সামনেই কালো মাশরুমের মতন দেখতে কোঁকড়াচুলের এক লোকের মাথায় পপকর্নের প্যাকেট রেখে দিয়েছিলাম। মাথায় গরম লেগে লোকটা চোখ ছানাবড়া করে আমার দিকে যখন তাকাচ্ছিল, আমি হাসির চোটে আর কিছুতেই ‘সরি’ বলতে পারছিলাম না। এই সিনেমারই শেষের দিকে মারাত্মক সীন ছিল! পাশের বাড়ির নায়িকা সাইফ আলী খানকে বাড়িঘর সব দান খয়রাত করে চলে যাচ্ছে আর সেইদিনই আবার নায়কের বিয়ে হচ্ছে। ওদের দুই বাড়ির মাঝে ইটের দেয়াল উঠে গেছে ততদিনে। বিদ্যা বালানের বোন জামাই সঞ্জয় দত্ত নায়ককে বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠিয়ে এনে বাড়ির দলিলের সাথে সাথে এতদিনের সঠিক ইতিহাস পেশ করল তার কাছে। তাইতেই নায়ক প্রবল বিক্রমে ফুঁসতে ফুঁসতে মাঝখানের ইঁটের দেয়ালের দিকে ছুটে গেল। আশেপাশে মুগুর না থাকায় টিউবওয়েল না কি একটা যেন কয়েক টান মেরে উপড়ে ফেললো আর সেইটাই গদার মতন ধরে সমানে বাড়ি দেয়া শুরু করলো ইঁটের দেয়ালে। বিয়েবাড়ির দাওয়াতীরা সব ‘তোড় শেখর, তোড় শেখর’ বলে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে। দোতলার বারান্দায় দাঁত কিড়মিড় করছেন নায়কের ভিলেন বাবা সব্যসাচী চক্রবর্তী আর দেয়ালের ওইপাশে সপরিবার নায়িকা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। নায়ক দেয়াল ফুটা করার আগ পর্যন্ত এই অনন্ত গৃহত্যাগ। দর্শকরা সব উত্তেজিত, শোকে বিহ্বল। মাঝখানে আমি আর রাসেল হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। রাসেল বলছিল ‘হারামজাদা দেয়াল পরে ভাঙ্গিস, গেট দিয়া বাইর হ, গেলগা কিন্তু!’ আমার হেঁচকি উঠে যাচ্ছিল আর চোখে পানি।

বোটানী শপিং সেন্টার খুব প্রিয় ছিল আমাদের। গ্লেন ইডেন থেকে এক ঘন্টার ড্রাইভ। প্রায় প্রতি শনিবার সকালে যেতাম। সেই সুশির দোকানটার জানালার পাশের টেবিলটা কি আরামের ছিল। দোকানের নামটা কখনো ভালো করে দেখিনি, সবসময় বলতাম ‘আমাদের সুশি-শপ’। দোকানের সবাই চিনতো আমাদের। মাঝেমাঝেই মিসো স্যুপটা ফ্রি পেয়ে যেতাম। কাঠের চারকোনা ভারী অথচ ছোট টেবিলের দুইপাশে মানানসই কাঠের চেয়ার। জানালার ওপাশে দোকানের বাইরে আরো কিছু চেয়ার টেবিল, ছড়ানো ছিটানো দোকান। রাসেল সবসময় নিতো ভাতের ওপরে স্যামন ভাজির সাথে টেরিয়াকি সস আর আমি টুনা-অ্যাভোকাডো রোল আর মিসো স্যুপ। ছোট্ট কাঠের টেবিলের দুইপাশে কত কাছাকাছি ছিলাম আমরা। আমি ওর দু-তিনদিনের না কামানো গালে হঠাৎ দুইএকটা সুক্ষ্ণ শাদা বিন্দু দেখতে দেখতে বলতাম – ‘আহারে জামাইটা বড় হয়ে গেছে, বিয়া দিতে হবে’। রাসেল পরম আপ্লুত মুখে বলতো ‘দিবি? দে না! ওই যে কমলা রঙের জামা পড়াটার সাথে’। তারপর আমরা কিছুক্ষন মেয়ে দেখতাম, ছেলে দেখতাম, অনেক কথা বলতাম অথবা কিছুই বলতাম না। মাঝে মাঝে বৃষ্টি ছিল আর মাঝে মাঝে রোদ। মাঝে মাঝে রাসেল সারাটা সময় পার করতো সেলফোনে গেইম খেলে। আমি তখন জানালায় দেখতাম হাসি-খুশি কিংবা বিষন্ন মানুষ, দেখতাম রঙ, কিংবা মেঘ আর বাচ্চাদের দৌড়ঝাঁপ। কখনো ঝাঁঝাঁলো ওয়াসাবির সাথে মিশে যেত আসন্ন ঝড়ের গন্ধ আর মাঝে মাঝে রোদ ও ধুলার গন্ধ মিলেমিশে আরেকটু তাতিয়ে তুলতো চারপাশ।

(হয়তো চলবে…)

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, পাগলামি-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

12 Responses to একটা ‘হয়ত’ উপন্যাসের প্রথম অংশ

  1. শামসীর বলেছেনঃ

    চলুক- দেখি কই যায় 🙂

  2. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ‘হয়ত’ শব্দটা গল্পের শিরোনামেই ঠিক আছে।
    শেষের ‘চলবে’ শব্দটার আগে জোড়া না দিলেই কি হত না আপু?

    আমি কিন্তু বসে থাকব ‘হয়ত’ উপন্যাসের আরও আরও অনেকটুকুনি পড়ার জন্য।

    লুনাপুর লেখনী নিয়ে কিছু বলার ক্ষমতা তো আমার মত ছোটকু পিচ্চির নেই। তাই শুধু অপেক্ষাতে চুপচাপ মেঘ গুনে গুনে সময় কাটানোর প্রত্যয়ে রইলাম।

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    আবার একই কথা বলতে আসিলাম আপু !

    তৃষ্ণা পেয়েছে খুব !! ইশ প্রতিদিন যদি এমন একেকটা গল্প পেতাম। গল্প নয় উপন্যাস হয়ে গেলেও ক্ষতি কী ?? আমি খুব চাই আপু, আপনি নিয়মিত লেখেন, প্রতি বইমেলায় আপনার লেখা বের হোক, আমি ঘ্রাণ নিয়ে নিয়ে নতুন মোড়কের সেই উপন্যাস/গল্পগুলো পড়ি …

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    আপনার সব লেখাই তো পড়তে ইচ্ছা হয়। 😀
    ছাইপাশ লিখে উপন্যাস বলে চালিয়ে দিলেও দেখবেন যে আমরা গোগ্রাসে গিলছি। :love:

    পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, আপনার ব্যক্তিগত রচনাগুলির স্বর আর এই ‘হয়ত’ উপন্যাসের স্বর অনেকটাই একরকম। এখানে বলে না দিলে হয়তো আমি সত্যি ঘটনা ভেবেই পড়তাম। আবার আপনার দিনলিপির মত লেখাগুলোকেও বলে না দিলে হয়তো গল্প ভাবতাম। যাই হোক, গল্প লেখার বুদ্ধি পেয়েছি এটা থেকে। 😛 নিজের জীবনটাকেই গল্প বলে চালিয়ে দেব হয়তো কোন একদিন। :angel_not:

    • লুনা রুশদী বলেছেনঃ

      এইটাই আমারো একটু ইসস্তত করার কারণ। আসলে ফার্স্ট পারসনে লিখছি বলেই মনে হয়। আর খুব কাঁচা লেখক এখনো, নিজের স্বরের বাইরে অন্য স্বর নিয়ে কাজ করতে শিখিনাই। গল্পের মেয়েটাও আমার মতোন!

      • মাধবীলতা বলেছেনঃ

        সব লেখনীতেই আমার মনে হয় লেখকের নিজের সত্ত্বাটা একটু হলেও ছেয়ে থাকে। এতে সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। আর আমার মতে বেশি ইতস্তত লাগলে, শুরু বা শেষে চরিত্র কাল্পনিক বলে দিলেই হয়ে যায়। ঐ যে টিভি নাটকে যেমন করে বলে, বাস্তবের সাথে মিলে গেলে নিতান্তই কাকতালীয়… 😀

  5. শামসীর বলেছেনঃ

    বিসমিল্লাহ……….

  6. এহসানুল কবির বলেছেনঃ

    টানতে টানতে কতদূর গেছে শেষমেষ? বাকি’টুকু’ পড়তে ইচ্ছে হল গো!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।