কিছুই ভাল লাগছেনা তাতিনের । অন্যদিন হলে এই সময়ে আম্মুর সাথে গল্প করত সে । আজ মা’র চোখের দিকে তাকাতেই কষ্ট লাগছিল খুব । দিনটা নিয়ে কতই না প্লান ছিল তার । আজ বিকালে ভাইয়ার বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা নদীর পাড়ে । সেখানে শীতকালীন পিঠা উৎসব চলছে । কতই না মজা হত । সব ভেস্তে গেল ।
আজ সকালেও সবকিছু এমন ছিল না । একসাথে বসে ঠিক করছিল ওরা কয়জন, কোথায় পিকনিকে যাবে সামনের বছর । আরো কত্ত কী । এরপর মিস ক্লাসে আসলেন । প্রিন্সিপাল স্যার ও আসলেন । বরাবরের মতই এবারও রেজাল্ট ঘোষণা দিলেন স্যার ।
তাতিনের একবারও মনে হয়নি তার রেজাল্ট এত খারাপ হতে পারে ! এতই খারাপ হল যে একেবারে অন্য সেকশনে চলে যেতে হবে ! কান্না পাচ্ছিল ক্লাসেই । অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকানো গেল । বাসায় এসেই দরজা বন্ধ করে কেঁদে দিল তাতিন । বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে তার এত প্রিয় বন্ধু টুম্পা আর রিনিকে ছেড়ে অন্য সেকশনের অচেনা মেয়েদের সাথে ক্লাস করতে হবে ! বাবা মাকে রেজাল্ট বলতেও লজ্জা লাগবে তার । ভাইয়া বরাবরের মতই এবারো ভাল রেজাল্ট করেছে । বাসায় এসেই মা’র মুখে শুনেছে তাতিন । এরপর কারো সাথেই কোন কথা বলেনি সে আর । মানতে পারছেনা কিছুতেই । আরেকবার ডুকরে কেঁদে ওঠে সে ।
–“আহারে বাচ্চা মেয়েটা !”
–“কে ? কে কথা বলে ?” ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে তাতিন । ঘরে তো সে ছাড়া আর কেউ নেই ! তাহলে ?
আরেকবার চারপাশে তাকায় সে । পুরো ঘর নিশ্চুপ । পিনপতন নিরবতা । এতক্ষণ তার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছিল । এখন তাও নেই । শুধুই নিজের নিঃশ্বাস এর শব্দ । জানালাগুলো সব বন্ধ । বাইরে ডিসেম্বরের ঠান্ডা বাতাস । তাতিনদের বাসাটা শহর থেকে একটু দূরে । এখানে রাস্তার গাড়ি আর মানুষের হইচই আসার কথা না । এই ভরদুপুরে সবকিছু আরো বেশী নিশ্চুপ ।
আরেকটা শব্দ থাকার কথা অবশ্য । তার ঘরের টেবিল ঘড়িটার টিক টিক শব্দ । কান পাতল তাতিন ।
না । কোন শব্দ নেই । অবাক লাগছে তাতিন এর । বালিশ থেকে মাথা তুলে অবাক হয়ে ঘড়িটার দিকে তাকালো সে । চলছে তো । শব্দ পাচ্ছেনা কেন সে ? দম বন্ধ করে ফেলল এইবার । আগের মতই নিশ্চুপ । কোন কারণ ছাড়াই ভয় পেতে লাগল ও ।
একটা বুদ্ধি করল সে । আবার বিছানায় গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে রইল । কারও কথা শোনা যায় কিনা এইবার !
না । কোন কথাই আর শোনা গেল না । তবে অনেকক্ষণ পরে আবার ঘড়ির টিক টিক শব্দটা শোনা যেতে লাগল । তাহলে কি এতক্ষণ যা ঘটেছে সব তার মনের ভুল ? হতে পারে । ঘর থেকে বের হওয়ার পরেই পুরো ব্যাপারটাকে তার নিজের কল্পনা মনে হতে লাগল ।
দুপুরে ভাইয়া আর মা’র সাথে খাওয়ার সময় রেজাল্ট জানালো সে । মা একটু কষ্ট পেলেন পেলেন বলে মনে হল ! কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না । পরের বার আরও মনোযোগ দিয়ে পড়তে বললেন । আর বন্ধুদের কথা ভেবে সান্ত্বনা দিলেন ওকে । ভাইয়াও তাই করল ।
ইশ, মা আর ভাইয়াটা এত্ত ভাল কেন ? একটু বকা দিলেও তো পারত ! তাহলে তো তাতিনের দুঃখ একটু হলেও কমত । ওর আবার মন খারাপ লাগা শুরু করল । আগের কত কথা মনে হতে লাগল তার ! বন্ধুদের সাথে একসাথে ক্লাসে বসে কত দুষ্টুমিই না করত ও । এইজন্যেই তো এই অবস্থা ! ইশ, ক্লাসগুলো যদি আরেকটু মন দিয়ে করত !
ঘরে গিয়ে প্রচণ্ড মন খারাপ করে বসে থাকল সে । তার প্রিয় কার্টুন দেখানোর কথা এখন । মনেই থাকলো না তার । বার বার চোখে পানি এসে যাচ্ছে । অসময়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে । ঘুমানোর আগে অবশ্য একবার ঘড়িটার দিকে খেয়াল করল । আগের মতই টিক টিক করছে সেটা ।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার ! ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল চারটা বাজে । মাত্র আধা ঘন্টা ঘুমিয়েছে সে ! অথচ মনে হচ্ছে কতক্ষণ !
–“কী ভাবছো এত অবাক হয়ে ?”
স্পষ্ট ঘড়িটা থেকেই শব্দটা আসল । তাতিনের এবার কোন সন্দেহই নেই । আবার ভয় লাগতে লাগলো তার । ঘড়ি কীভাবে কথা বলে ?
–“কে কথা বলে ?”
–“আমি ! তুমি বুঝতে পারছোনা ? সবকিছু ভুলে গেছ এর মাঝেই !”
–“বুঝতে পারছি ! কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব ? ঘড়ি কীভাবে কথা বলে ? আর কী ভুলে গেছি আমি ?”
–“ভুলে গেছ এতক্ষণ ধরে আমার কাছে কী চাইলে তুমি । শেষবারের মত বল, তুমি কি আসলেই একমাস আগে ফিরে যেতে চাও ?”
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে সময় লাগল তাতিন এর । না । সে কল্পনা করছে না । ঘড়িটা আসলেই কথা বলছে । এবং একটা অদ্ভূত কথা বলছে তাকে । ঠিক তার মনের কথাটা । ঘুমানোর আগে ঠিক এই ইচ্ছাটাই হচ্ছিল তার মনে মনে । একমাস আগে ফিরে যেতে পারলে কত ভাল হত ভাবছিল সে । কী কী করত সে তাও ভেবে রেখেছে সে । কিন্তু তাই বলে—
–“কথা বলছো না কেন ?”
–“হ্যাঁ । যেতে চাই আমি ।”
–“ জানতাম । তুমি এটাই বলবে । কিন্তু তাতিন, তুমি কি জানো ? তোমাদের, মানুষের জীবন আসলে এই রকমই । অনেক সময় তোমরা হেরে যাও এখানে । কিন্তু সেই কষ্টকে ভুলে গিয়ে আবার ভবিষ্যতের জন্য প্রস্ততি নাও ঠিকই । তোমরা অতীতে ফিরে যেতে পারোনা বলেই তোমাদের জীবন এত সুন্দর ।”
তাতিনের এত বড় বড় কথা শুনতে ভাল লাগছেনা আপাতত । ফিরে যেতে পারলে আবার যাবে না কেন ? এমন সুযোগ হাতছাড়া করবেনা কেউই ।
–“আমি যাব এক মাস আগে !”
–“যাবে তুমি । আজ থেকে ঠিক একমাস আগের ভোররাতে । তবে তোমাকে আরো একটা কথা বলতে চাই আমি । তা হল, মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটতে পারে একটা নির্দিষ্ট সময়ে । আমরা হয়ত সেটাকে খারাপ ভাবি । কিন্তু হতে পারে সেটা আরো অনেক কিছু থেকেই ভাল ।”
ঘড়িটার এত ভারী ভারী কথা তাতিনের ভাল লাগছেনা শুনতে আর । আপাতত তার রেজাল্টের চেয়ে বড় দুঃখ আর নেই ।
–“তুমি তবে ঘুমিয়ে যাও তাতিন । ঘুম ভাঙলেই ক্যালেন্ডারে তারিখ দেখতে পাবে ।”
উত্তজনায় ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে গেল সে । ঘুম ভেঙ্গে দেখল নভেম্বরের ভোরবেলা । মনটা আনন্দে ভরে গেল তার ।
স্কুল থেকে বাসায় আসার পথে টুম্পা আর রিনিকে তার জমানো টাকা দিয়ে ফুচকা কিনে খাওয়ালো সে । আজ তার মন খুবই ভাল ।
বাসায় গিয়ে মন দিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল সে । এখনও তার কাল বিকেলের ঘটনা মনে পড়ছে । আর বার বার অবাক লাগছে খুব ।
কয়েকদিন পরের কথা । প্রচণ্ড জ্বরে উঠতে পারছেনা তাতিন বিছানা থেকে । মা অনেক কিছু করছেন তার জন্য । জ্বরের ঘোরে তাতিনের একটা কথাই বার বার মনে পড়তে লাগল । কাল তার পরীক্ষা শুরু ।
আজ প্রায় দুই সপ্তাহ হতে চলল । তাতিনের জ্বর একটু কম এখন । বিছানায় একা একা শুয়ে বার বারে সেদিন বিকালের কথাই মনে পড়ছে তার । সবকিছু এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছেনা । একটাও পরীক্ষা দেয়নি সে জ্বরের কারণে । টাইফয়েড হয়েছিল তার। সেদিনের ফুচকা থেকেই হয়ত । ডাক্তার আংকেলও তাই বলছেন । ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বারবার তার মনে হতে লাগল, ইশ্, আবার যদি সেই বিকালে ফিরে যেতে পারতাম । ঘড়িটার উপর প্রচণ্ড রাগ লাগতে লাগলো তার । সব দোষ ঘড়িটার !
বিছানা থেকে উঠে ছুঁড়ে ফেলল সে ওটাকে । বন্ধ হয়ে গেল টিক টিক শব্দ । তাতেও তার মন ভাল হলনা একটুও । শুয়ে শুয়ে নানান কথা ভাবতে লাগল সে । ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল ।
অনেকক্ষণ থেকেই মা ডাকছেন । চোখ খুলল সে । খুলেই দেখতে পেল টেবিলের উপরেই ঘড়িটা রাখা । আবার রাগ লাগতে লাগল তার ।
–“কীরে ? এইভাবে তাকিয়ে আছিস কেন তুই ? আর, এখনও ঘুমিয়ে আছিস কেন ? তোর নাকি নদীর পাড়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা ? সবুজ বসে আছে তোর জন্য ।”
মা’র কথা শোনার সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকালো সে । ডিসেম্বর মাস । তার মানে ? কিছুই বুঝতে পারছেনা সে ! তবে তাতে কিছুই যায় আসেনা তার আর । কী যে ভাল লাগছে তাতিনের ! মনে হচ্ছে আরেকবার কেঁদে ফেলবে সে । মা চলে যাওয়ার পর সত্যি সত্যি চোখের পানি আটকালো না তাতিন । আর মুগ্ধ হয়ে ঘড়িটার টিকটিক শব্দ শুনতে লাগল ।
(Community Action এর “The Bookworm Revolution” Project এর বাচ্চাদের জন্য লেখা একটি ছোটগল্প এটি । সব মানুষের মাঝেই একজন শিশু লুকিয়ে থাকে শুনেছি । প্রিয় পাঠক, আপনাদের মাঝের সেই শিশুটির উদ্দেশ্যেই গল্পটা এখানেও তুলে দিলাম । 🙂 )
আরে দোস্ত তুই! কত্তদিন পর… 😀 😛
অসাধারণ গল্প লিখছিস।
হিংসা হচ্ছিল দেখে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার ছোট ভাই-বোন নাই দেখেই শুধু আমি বাচ্চাদের জন্য এত ভাল গল্প লিখতে পারি না। নাহলে ঠিকই পারতুম।
লেখার মধ্যেই স্পেইস একটু কমায় দিস, প্যারাগুলির মধ্যে আর কি। এত্ত বড় বড় স্পেইস হইছে। 😀
স্লিপিং বিউটিকে ফাইভ স্টার দিলুম। :happy:
অসাধারণ লাগছে নাকি ? 😀
বাচ্চাদের ভালো লাগলেই বেঁচে যাই ! (যদি ছাপে আরকি :p)
হম, অনেকদিন পর । ঘুমকুমারী বলে কথা ! তুই না গুতাইলে এইটাও লিখা হইতো না । তুই বলছিস বলেই লিখছিলাম । 😀
( তোর মধ্যে মনে হয় একজন সত্যিকারের বাচ্চা লুকিয়ে আছে । নাইলে ফাইভ স্টার ? :thinking: )
পিসি থেকে সরাসরি পেইস্ট করে দিছি , স্পেসগুলা একদম খেয়াল করিনাই । ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পোস্ট দিছিলাম মনে হয় । 😛
প্লটটা ভালো লাগছে। গল্পও। লিখতে থাকুন নিয়মিত।
খুব সুন্দর করে জীবনের পথে সময়ের গতিময়তা তুলে ধরেছেন…… 🙂
এমন আরও গল্প চাই, নিয়মিত……… 🙂
ভালো লেগেছে গল্প। আরও গল্প পড়তে চাই 😀
আমারও মাঝে মাঝে ঘড়ি ঘুরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে! 🙁 প্লটটা আসলেই ভালো লেগেছে। আরও গল্প চাই 😀
ভালো লেগেছে আপুনি :love:
পরীক্ষার আগে আমারও ইচ্ছা করে ঘড়ি ঘুরিয়ে দিতে 😛
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ । একেবারে একসাথে আমার সব পছন্দের ব্লগার ভাইয়া আর আপুরা দেখি কমেন্ট নিয়ে হাজির হয়েছেন ! সবার এত ভাল লাগবে বুঝিনাই আগে । :happy:
সবাই দোয়া করবেন যাতে আরেকটু নিয়মিত লিখতে পারি । :love:
দারুণ তো! 🙂