মাসটা ডিসেম্বর। ভেবেছিলাম বছরের শেষ সময়টাতে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবো। ছাপানো মলিন হওয়া কাগজের স্তূপ ছেড়ে তাকাবো দিগন্তে, যতদূর চোখ যায়……। কিন্তু
জানালাটা খুলে দেখি, বাইরে কেবল কুয়াশা।
হঠাৎ জোর ঠাণ্ডা বাতাস আসে। দাঁত কিড়মিড় করতে শুরু করে।
তড়িঘড়ি করে জানালা আটকে দেই।
এখনকার দিনগুলোও চলছে আকাশের মত। একটু আলো দেখে বুঝি সকাল হল। ব্যস, সারাদিন আর সূর্যের মুখ দেখার অপেক্ষা শেষ হয় না। আর যদি একবার সূর্যটা উঠে যায়! শুরু করে দেই আমার রৌদ্রস্নান। শীতের দিনে সে আনন্দ আর বাংলার বাইরে পাওয়া যায় না।
কিন্তু মেঘগুলো বড় নির্বোধ। সময় অসময় কিছু বোঝে না। বারবার আলোটাকে আড়াল করে দিতে চায়। আমি আবার জানালা আটকে দেই।
সকালে ঘুম ঘুম চোখে উঠি। বাইরে কিচিরমিচির। একদল লোক জড় হয়ে আছে। দাঙ্গার মত। কোনো যান বাহন নেই। পাশে বাচ্চারা ক্রিকেট খেলছে, কেউ ধুম করে লাথি বসাচ্ছে ফুটবলে। রাস্তাগুলো যেন এক প্রহরের জন্য জন্য হয়ে উঠেছে খেলার মাঠ। সে কী হাসিখুশি ওরা।
আর খেলবে নাই বা কেন? আগের রাতেই যে দেশের জয় হয়েছে। ষোলো কোটি মানুষ গর্জে উঠেছে একসাথে। কুয়াশা উপেক্ষা করে নেমে পড়েছে রাজপথে। সবার মুখে একসুর, “বাংলাদেশ”, “বাংলাদেশ”।
চিৎকার করেছি ওদের সাথে। সে খুশিতেই খেলছে ওরা।
ঘণ্টা সাতেকের পার্থক্য। দুবার আগুন জলে উঠলো সারা দেশে। একবার আনন্দের আগুন। বন্যা বললেও ভুল হবে না। আর একবার সকালে। পুরো দেশ বদলে গেছে। সবাই না বের হলেও অবরোধ হচ্ছে রাজপথে। আগুনে পুড়ে যাচ্ছে বাস, গাছের গুঁড়িগুলো তাদের দেহের বিনিময়ে আটকে দিচ্ছে গাড়ির গতিবিধি।
সংবাদ দেখছি । আজকে নাকি আনন্দ মিছিল। মহাসাগরের অপরপাড়ের অতিকায় লোকগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের পুচকে কিন্তু ক্ষিপ্র বাঘগুলোর জয় ছিনিয়ে আনবার মিছিল। আগে সংসদনেত্রী কখনো বিজয়ে আনন্দমিছিল দিয়েছিলেন কিনা জানি না। আজ দিলেন। সেই আনন্দমিছিলে একটু বাড়তি আনন্দ দান করলো একজন সাধারণ পথিক। আনন্দের জন্য দিয়ে দিলেন নিজের জীবন।
পৈশাচিক আনন্দের প্রেরণার জিনটুকু মানুষের দেহে পরিবর্তিত হয়নি। হোক না সে ছাত্র, তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের, তাই বলে আনন্দের এ মসলাটুকু তো আর ছেড়ে দেয়া যায় না। চাপাতি রডের নৃশংস ব্যবহার আর পথিকের বাঁচার আর্তনাদ আনন্দমিছিলের আনন্দ পরিপূর্ণ করে দিলো। পাশবিক মনে এনেদিলো এক অভূতপূর্ব প্রশান্তি।
আমার এক বন্ধু নাকি চোখের সামনে খুন হতে দেখেছিলো। প্রায়ই বলতো সে কথা। ভাবতাম, যদি এমন দেখতে পেতাম! পেয়েছি, গণমাধ্যমের কল্যাণে। মাসকতক আগে দেখেছিলাম একবার। জায়গার নাম কোম্পানীগঞ্জ, কিশোরের নাম মিলন। পুলিশ ওকে ডাকাত ঘোষণা করে তুলে দিয়ে দিলো মানুষের হাতে। ভুল বললাম, কতগুলো পৈশাচিক মানুষ নামের প্রাণীর হাতে। তারপর? দুঃখিত …… মনে করার সাহস পাচ্ছি না।
আজ আবারো দেখলাম।
আমি একা নই, হাজারো মানুষ, হাজারো জনগণ। কেবল দেখতে পেলো না সরকার, দেখতে পেলো না বিরোধী দল, দেখতে পেলো না কোনো মানবতাবাদী সংগঠন।
আমি জানি, দেখতে পাবে। দেখতে হবেই একদিন। তারপর সবাই মৃতদেহ নিজদিকে টানবে। আবারো পুড়বে চারদিক। ডাবল ডেকার বাস তুলে দেবে গায়ে। একে একে সবাইকে পিষে দেবে। বাকিরা মৃতদেহ দেখে প্রস্তুত হবে নিজেদের রক্তে বাসের চাকা রঙিন করবার জন্য। আবার সেই দোষ দেবে অন্য কোনো বাসের ওপর, পুড়িয়ে দেবে কোনো নিরীহ ঘুমন্ত বাসচালককে।
দুঃখিত বিশ্বজিৎ দাস, দুঃখিত বাসচালক, আমাদের স্মরণশক্তি অত্যন্ত ক্ষীণ। আমরা কালই ভুলে যাবো তোমাদের। এক হত্যাকান্ডের কথা আমাদের মনে পড়েছে চল্লিশ বছর পর, জানি তোমাদের মনে পড়বে না সহস্র বছরেও।
পুনশ্চঃ
এখনও দিগন্ত দেখার বড় ইচ্ছা। কিন্তু জানালা খুলতে সাহস পাচ্ছি না। মনকে একটানা প্রবোধ দিয়ে চলেছি, “বাহিরে কেবলই কুয়াশা…………”
এত সুন্দর করে এত কষ্টের কথা লিখলেন।
আমার এখনও কেন যেন ভাবতে ইচ্ছা করে না যে এই বিশ্বজিৎ দাসের জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। খুব সম্ভব ঘটনাগুলিও কেমন অবাস্তব-অসম্ভব মনে হয়।
মনে হয় ভার্চুয়াল জগতে থাকতে থাকতে আমি, আমরা এখন বাস্তবকেও ভার্চুয়াল মনে করতে শুরু করেছি।
আজ ডিপার্টমেন্টে সবকিছু নিয়ে কথা হচ্ছিল……… মানুষ এতো মতামত দেয়!! শুধু অবাক হয়ে দেখতে হয়…… কারো কথা আর কাজের সাথে যখন কোন মিল থাকে না, তখন সেইসব কথা কতটা হাস্যকর শোনায় মানুষ বোঝে না কেন!!!
বেশিরভাগ বলছিল–এদের ধরে বিচার করলে তারপর থামবে এইসব।
আমার তা মনে হয় না।
যে একটা ছোট অন্যায় করে, এবং করতেই থাকে, সে স্বার্থের জন্য আরও বড় অন্যায় ও করবে অনায়াসে……
ছোট মিথ্যে বলা, কারো রেফারেন্সে জব নেয়া, পরিচয় ব্যবহার করে বাড়তি সুবিধা নেয়া…এসব কে আমরা অন্যায়-ই ভাবি না মোটে……
গাছের গোড়ায় না দেখে শুধু উপরে পানি ঢালার কথা ভাবি আমরা……
এদেশের মাটিতে কিছু অদ্ভুত বৈপরীত্য শিকড় গেড়ে বসে। সেটার মূলে রয়ে গেছে ভয়। আজ কেউ দেশটাকে বদলানোর চেষ্টায় যদি প্রাণও দেয়, তবু এখানে আর “প্রাণের বিসর্জনে হাজার আত্মার উদ্ভোধন” হয়ে ওঠে না। কেন যেন বাঙালির আগে বীর বিশেষণটার বদলে নিরীহ কথাটাই মানিয়ে যাচ্ছে :wallbash:
দেখা যাক, আপনি আমি মিলে যদি কিছু করতে পারি… :thinking:
আমরা কয়েক জন যদি শুরু করে মনে রাখা। না ভুলে যাওয়া কে জানে কিছু হয়েও যেতে পারে।
লেখাটা খুব ভালো লাগল।
ভাইয়া, একটা সময় রাজাকার ইস্যুতে মানুষ কখনো কথা বলতো না, সবাই চেষ্টা করতো ভুলে যেতে, অথবা কেউ কখনো যদি কিছু বলেই ফেলতো, তাও মিলিয়ে যেত ক্ষনিকের মাঝে। কিন্তু কিছু মানুষ ভুলে যায়নি। ভুলে যায়নি এদেশের জন্মের আগে আর জন্মের পরে কিভাবে তারা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে জীবিকা আহরণ করেছে, কিভাবে ক্ষমতায় এসেছে…… সে কারণেই মানুষ আবারও মনে করতে পেরেছে, বিচার চাইতে পেরেছে……
হ্যাঁ ভাইয়া, আজ আমরা কিছু না করতে পারি, আমাদের অন্তত কথাগুলো মনে রাখতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। বুয়াজিজির আত্মাহুতিতে যদি এই বিশ্বের তাবৎ একনায়কদের আসন নড়ে যেতে পারে, বিশ্বজিতের রক্তের বিনিময়ে এই বাংলার জানোয়ারগুলোকে আমরা বলি দিতে পারবো না?
ঐখানে ভাইয়া অর্থনৈতিক একটা ইস্যু ছিল। প্রচুর বেকার ছিল আমাদের তো বেকার থাকলেও কীভাবে কীভাবে জীবন চালিয়ে নিচ্ছে!
তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না! অযোগ্যতার কারণে তরুণদের হাল ধরতে হবে বলেই মনে করি
Brother এমন দৃপ্ত লেখনি তোমাকে অনেক বড় করবে, আমরা কয়জন এই লেখা বুঝার ক্ষমতা রাখি? অনেক বড় হও তুমি।
খুব ভালো লেগেছে লেখা