কিছু ব্যাপার থাকে একদম নিজের , একটু বেশিই নিজের । সেটা আর যাই হোক কারো সাথেই ভাগাভাগি করা যায়না । যাওয়ার আসলে কথাও না । কারন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে একান্ত কথা হয় খুব বেশি ছেলেমানুষি । আমি প্রায় উনিশ বছরের তরুণ । ছেলেমানুষি করা নাকি আমার সাজেনা , এটা আমার বাবা প্রায়ই আমাকে বলেন । আমি চুপ চাপ শুনি । মাঝে মাঝে যে রাগ উঠে না , তা না , কিন্তু আমি কখনই সেই কথার উত্তরে মাথা তুলে পর্যন্ত তাকাইনা , বাবা বিরক্ত হয়ে মাঝে সাঝে জানতে চান ,
“ নিচে তাকাইয়া মাটি গুনো নাকি !”
আমি জবাব দেইনা , দিতে ভাল লাগেনা ।
আমার আজ ঘুম থেকে উঠার পর বেশ মন খারাপ হয়েছিল । আমরা আর মাত্র এক মাস এই বাসায় থাকব এটা মনে করে । এই বাসাটায় আমরা প্রায় এগারো বছর ছিলাম । সেই এগারো বছরের জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় এবং সবচেয়ে দুঃখী দিন গুলি আমরা এই বাসায় কাটিয়েছি । আমার এই বাসায় শেষ আমার দাদী দেখে গিয়েছেন । এই বাসার প্রতিটা ইট এ দাদীর স্মৃতি মিশে আছে । এই কথাটা আমি যখন ই আমি বলি , বাসার সবাই বেশ বিরক্ত হয় । আমাকে আসলে আমার দাদি ছাড়া তেমন কেউ খুব একটা বুঝেনা । বোঝার কথাও না । আমি খুব পিচ্চিকাল থেকেই দাদীর কাছের মানুষ । এই মহিলা তার জীবনের সমস্ত ভালবাসা আমাকে আমার জীবনের প্রথম পনের বছর দিয়েছেন এবং আমার জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষার ঠিক আগের দিন আমাকে রেখে চলে গেছেন । আমি এখন ও মাঝে মাঝে তার শাড়ী তে নাক ডুবিয়ে বসে থাকি । শ্যাওলা শ্যাওলা গন্ধ টা আর পাইনা , কেউ চলে গেলে মনে হয় তার সব কিছুই সাথে করে নিয়ে যায় ।
এই বাসা ছেড়ে যাওয়ার পিছনে খারাপ লাগার আরেকটা কারণ আছে । কারন টা হল দ্রিতা ।
***
দ্রিতা আমাদের ঠিক সামনের বাসাটায় থাকে । দ্রিতা কে আমি যে ঠিক কখন থেকে চিনি নিজেও জানিনা । আমি প্রায় বারান্দায় বসে গান শুনি , বলা ভাল শুনতাম । কোন একদিন ধুপছায়াময় বিকালে হঠা ৎ ই খেয়াল করলাম সামনের বাড়ির তিনতলার বারান্দা থেকে একজন গান শুনছে । চোখে চোখ পড়তেই ছুটে পালিয়ে গেল । পাঁচতলায় দাঁড়ানো তখন হতভম্ব আমি । ভাবছি, এটা কি হল !
তারপর প্রায়ই এরকম হতে লাগল । চোখ এ কখনো চোখ পড়ত , কখনো পড়তনা । কখন হয়ত একটু মৃদু হাসি । আশ্চর্য ছিল এই ব্যপার টা । এই মেয়েই আমূল বদলে যেত যখন দেখা হত নীচে , রাস্তায় । যেন চিনতেই পারত না । না তার সাথে আমার মুখোমুখি কখনোই কথা হয়নি , বিধাতা সেই মাত্রার সাহস দেন নাই । আমি খুব মুখচোরা মানুষ , তবুও কেমন করে সাহস করে একদিন তার টি এন্ড টি নাম্বারে ফোন দিয়ে বসলাম ।
ও পাশ এর রিনিঝিনি কাঁচ ভাঙ্গা কণ্ঠে যখন বলল ,
” দিত্রা বলছি…..”
এই পাশের আমার পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে গিয়ে হয়েছিল , সারা পৃথিবীময় তখন একটাই নাম,
দিত্রা!
দিত্রা!!
দিত্রা!!!
দিত্রা মাঝে মাঝে ছাদে আসতো । আমি আমার রুম থেকেই দেখতাম । সাথে থাকত ওর আম্মার হেল্পার । ছাদে দিত্রা ঘুর ঘুর করত । আশপাশের সব বাসার ছেলেদের অনেক রাত জাগা দীর্ঘশ্বাস এর কারন ছিল দিত্রা তা আমি খুব ভাল করে জানতাম , জানতো দিত্রাও । আমার জন্য দিত্রা কি ছিল তা তখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি । শুধু এইটুকু জানতাম , আমার চারকোণা ছোট্ট রুম টায় দিত্রার ছায়া পড়তেই রুম টা আলোকিত হয়ে যেত । সেই আলোর উৎস অন্য কোন জগতে , এবং সেই আলো টুকু শুধুই আমার জন্য । সেই আলো দেখতে পেতাম একা আমি ।
আস্তে আস্তে দিত্রা সম্পর্কে খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছি । তখন জানতে পারি , দিত্রার বড়বোন আর বড় একটা ভাই আছে । দিত্রা সবার ছোট ।
আরও খোজ লাগালাম , যে মেয়ের ঠোঁটে এক চিলতে প্রস্রয়ের হাসি থাকে বারান্দার রাত্রি গুলোতে ,কিংবা ঝুম বরষার বিকেলে , রাস্তায় নামা মাত্রই সেই হাসি মাখা মুখ কেন বদলে যায় বরফের কাঠিন্যতায় । এবং জানলাম , দিত্রার বড় বোন খুব ভালবেসে একজন কে সঙ্গী করতে চেয়েছিল , সারাজীবনের সঙ্গী । তার মাশুল এখনও গুনে যাচ্ছে দিত্রার পরিবার । আর দিত্রার বড়বোন এখনও সেই মানুষটি কে ভেবে রাত জাগে । ছোট্ট মেয়ে টাকে বুকে ধরে রেখে ।
দিত্রার শীতল কাঠিন্য তার কারন আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো । আমি কখনই দিত্রা কে কিছু বলিনি, সব কিছু জানার পর আর বলতে ইচ্ছা ও হয়নি । আমার অনুভুতি গুলো নিয়ে নিজেই ভীষণ দোটানায় ছিলাম । ওকে আর কি বলব , তা ছাড়া বুঝে গিয়েছিলাম আমি , অনুভুতির প্রকাশ ঘটালে শুধু ঝড় উঠবে আর কিছুনা ।
বাসাটার দিকে তাকাতে আমার বুক টা হাহা করে উঠল । আমি জানি ছেলে মানুষের এত আবেগ থাকলে চলেনা । কিন্তু আমার চোখের মাঝে কি যেন পড়েছে । চোখ কচ কচ করে পানি চলে আসছে বারবার । গলাতেও কি বেঁধেছে মনে হয় , দলা পাকিয়ে উঠছে খানিক পর পর । বাসাটা থেকে সব আসবাব নিয়ে যাওয়া হয়েছে । দেখে মনে হয় , কখন হয়ত ছিলামনা । মা , বাবা , পিচকু সবাই চলে গেছে আমিই সবার শেষে যাচ্ছি । গেট দিয়ে বের হয়ে মোড় এ চলে গেলাম । মনে কেমন একটা খচখচ অনুভুতি হচ্ছে । যেন কিছু ফেলে এসেছি । আমি জানিনা হঠাত আমার কি হল । আমি আগের বাসার রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম । ঝুম করে বৃষ্টি নামল । আমি আমার পুরনো বাসা আর দিত্রার বাসার মাঝে ব্যবধান সৃষ্টি করা রাস্তায় দাড়িয়ে ভিজতে লাগলাম । এসব পাগলামির কোন মানে ছিলনা । কিন্তু আমার পাগলামি করতে ইচ্ছা হচ্ছিলো , জীবনে প্রথম বারের মত ।
প্রায় দুই ঘণ্টা ভিজেছিলাম বৃষ্টিতে । যখন চলে আসবার সময় হয়েছে , আমি অবাক হয়ে দেখলাম দিত্রার বাসার গেট খুলে গেছে । দাড়িয়ে আছে দিত্রা !
দিত্রা আমাকে সেদিন আরও একবার অবাক করে দিয়েছিল। সেদিন বৃষ্টি তে ভিজে ভিজে আমার কাছে এসেছিল ও । খুব আস্তে করে আমাকে বলেছিল,
”আপনি মাঝে মাঝে আসবেন না এখানে? আমি আপনার জন্য বারান্দায় দাড়িয়ে থাকতাম , আপনি জানেন না হয়ত । আমি কিন্তু এখন ও দাঁড়িয়ে থাকব , আসবেন তো?”
আমার কি হল আমি জানিনা , আমি দিত্রার হাত শক্ত করে ধরে বললাম ,
”যতদিন বেঁচে থাকব , আমি আসব , আমি শুধু তোমার জন্য আসব দিত্রা ।“
তারপর আরও অনেক দিন দিত্রার বাসার সামনে যেয়ে দাড়িয়ে থেকেছি । আমাদের দেখা হতো খুব কম । আর কথা হতো না বললেই চলে । আমাদের সবার বুকের বাঁ পাশে একজন মানুষ বাস করে । আমার বুকের ঠিক ঐ জায়গায় বাস করত দিত্রা । আমদের কথা বলতে হতনা । মুহূর্তের দেখায় আমরা বুঝতাম আমরা কে কি বলতে চাই । শুনতে অবাক লাগতে পারে কিন্তু আমার আর দিত্রার ক্ষেত্রে এটা সত্যি ছিল ।
তার বছর তিনেক পর দিত্রার বাসায় বিয়ের সানাই বাজল । হলুদের দিন রাতেও দিত্রা বারান্দায় এসেছিল । দিত্রার চোখে পানি ছিল । আমি মৃদু হেসে আস্তে করে ঠোঁট নেড়ে বলেছিলাম ,
”তুমি চিন্তা করোনা , আমি আমার কথা রাখব । আমি প্রতিদিন তোমার বাড়ির সামনে আসব । দিত্রা , শুধু তোমার জন্য ।“
কি আশ্চর্য এরপর দিত্রা কে কখনই ঐ বারান্দায় আমি আর দেখিনি । এরপর আর কিছু বিবর্ণ শীত কাটিয়েছিলাম আমি , কাটিয়েছিলাম রৌদ্র তপ্ত গ্রীষ্ম , অবশই দিত্রার বাসার সামনে ।
তারপর একদিন দি্ত্রার সাথে আমার দেখ হল । এমন এক ভাবে যেভাবে আমি কখন ওকে দেখতে চাইনি । দিত্রার কোলে সেদিন জুনিয়র দিত্রা বসে ছিল । দিত্রার চেয়েও সৌম্য চেহারা । দিত্রার পরনে একটুকরো সাদা শাড়ি । দিত্রার শুভ্রতায় শাড়ি টা খুব ম্লান লেগেছিল সেদিন । দিত্রা আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । আমি মুখ ফুটে শুধু বলতে পেরেছিলাম,
”এখন আর দিনে সময় পাইনা , তুমি কি রাগ করেছ?”
দিত্রা পাথরের মত মুখ করে বলেছিল ,
”আর কোনদিন দাঁড়াতে হবেনা তোমার , এইসব মিথ্যা দেবদাস গিরির প্রয়োজন নেই কোনও ।“
আমি যখন কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে চলে আসছি , কানে একটা বাক্য এল , “আমি কখনো এত খুশি হইনি এই জীবনে , সত্যি বলছি ।”
আমি শুনলাম ,
জুনিয়র দিত্রা তার মাকে জিজ্ঞেস করছে,
”উনি কে মা?”
আমার দিত্রা উত্তর করেছিল , “ উনি সেই একজন মা , যে আমার বুকের বাঁ পাশে , তোমার সাথে বাস করে।“
আমি বাসায় যখন দিত্রার কথা জানালাম , আমার মা শুধু একটা কথাই বলেছেন ,
”যাকে ভালবাস , তাকে কখন কষ্ট দিও না বাবা । ওই মেয়েটার হয়ত তুমি ছাড়া কেউই নেই ।“
দিত্রার বাসায় মা যখন গেলেন , তাদের নিষেধ করার কোন অবকাশ ছিলোনা । দিত্রা তখন তাদের কাছে বোঝা । সেই বোঝা কে যেভাবেই পারুক বিদায় করা চাই । বাগড়া দিয়েছিল দিত্রা স্বয়ং !
আমাকে ডেকে অদ্ভুত শীতল কণ্ঠে বলল ,
”কারো করুনা জিনিষটা আমার একদম পছন্দ না , আমি আশা করব তুমি বুঝতে পারছ ।“
আমি বুঝতে পারছিলাম না কিছুই , আমার মাথায় তখন ঘুরছে আমি আর কোনভাবেই দিত্রাকে হারাতে পারবোনা , কিছুতেই না ।
আমি পৃথিবীর অন্যতম সৌভাগ্যবান পুরুষ , আমার প্রথম ভালবাসা দিত্রার রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে আমার ঘুম ভাঙ্গে । আমি পৃথিবীর অন্যতম সৌভাগ্যবান বাবা, যার নিধিতার মত একটা কলিজার টুকরা মেয়ে আছে ।
ব্যস্ত অফিস শেষে যখন বাসায় ফিরি , নিধিতা যখন
”বাবাআআ!”
বলে চিৎকার করতে করতে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে । আমার মনে হয় , এক জীবনে এর থেকে বেশি আমি আর কি পেতে পারতাম বিধাতার কাছে ?
বুকের বাম পাশে কে থাকে, কে আছে?!
ভালো লাগছে গল্প।
এত্ত দিন পর কেন?
দ্রিতা/ দিত্রা বানান কয়েক জায়গায় ঠিক আসে নাই। আসল বানান কোনটা?
দিত্রা মানে কী?
(সারা দিনে দেখি কমেন্ট নাই! ঢাবি বুয়েট নর্থ সাউথ সব জায়গায় পরীক্ষা দেখি :P)
দিত্রার সত্যিকারের অর্থ জানা নাই ভাইয়া !!
তবে হিন্দুদের বন্ধুত্বের দেবী দিত্রা মিত্রা নামে পরিচিত ।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ । 🙂
ভালবাসার অনুভূতির সাথে বৃষ্টির একটা সম্পর্ক আছে বোধ হয়। খুবই সুন্দর গল্পটা, সকাল সকাল “ক্ষ” ব্যান্ডের গাওয়া আমাদের জাতীয় সংগীত আর আপনার এই ছোট গল্প , নাহ দিনটা বোধহয় ভালোই যাবে। :happy:
:happy:
সুন্দর একটা গল্প
বিশেষ করে শেষটা
:love:
অনেক ধন্যবাদ আপু !!
😀
দিত্রা নামটা সোন্দর :love: :callme:
বেশি ভাল্লাগসে ভাই ??
:fire: উনি আবার গুলি কইরা দিবেনা তো ?? 😛