একটি বিতর্ক প্রতিযোগীতার কথা বলি । একবার স্কুলে একটি বিতর্ক প্রতিযোগীতার জন্য অন্য একটি স্কুলে যাই । যথারীতি আমরা আমাদের গৎবাঁধা বুলি আওড়াতে থাকি , আমাদের প্রতিপক্ষ দলের একজন পুরোটা সময় যারা ডেস্কে উঠে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । একমুহূর্তের জন্য সে তার নোট মুখস্থ করা বা কোন কিছু টুকে নেওয়া এটা নিয়ে তার কোন মাথা ব্যাথা ছিলনা । সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল প্রতিযোগীদের দিকে । আমি যখন ডেস্কে উঠলাম সে আমার দিকে যেভাবে তাকাল তাতে আমি একটু ইতস্তত বোধ করলাম এবং আমি যে পরিকল্পনা করেছিলাম তাতে গোলমাল লেগে গেল । আমার পুরো বক্তৃতাটা অগোছালো হয়ে যায় । তখন আমি চিন্তা করলাম , আমিও প্রতিশোধ নিব । ছেলেটা যখন ডেস্কে উঠল আমিও তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম । কিন্তু তার বৃক্তৃতা শুনে কিছুক্ষনের জন্য আমি কান্ডজ্ঞান শূন্য হয়ে যাই । সে যে কথা গুলো দিয়ে তার বক্তব্যটা শুরু করে তা হল ,
”আমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি আমার আগের জেনারেশনটাকে জেলে ভরতাম” । তার এই কথা শুনে পুরা হল ভর্তি মানুষ চুপ হয়ে গেল । তারপর সে যে কথাগুলো বলল আট বছর পরে কেন জানিনা তা খুব মনে পড়ছে । সে বলেছিল “আমার যদি ক্ষমতা থাকত আমি আমার আগের জেনারেশনটাকে জেলে ভরতাম । আপনারা হয়ত ভাবছেন আমি বেয়াদব হয়ে গিয়েছি । আমি আংগুল উচিয়ে বলব এই সেই জেনারেশন যারা আমাদেরকে ঘৃনা করতে শিখিয়েছে । জন্মের পর থেকে শিখিয়েছে বিএনপি অথবা আওয়ামিলীগ যে কোন একটিকে মনে প্রানে ঘৃনা কর । … ” তার বক্তৃতায় সে যুক্তি দিয়ে প্রমান করেছে এই সে ই প্রজন্ম যারা বাংলাদেশকে দুইভাগ করেছে । আমাদের আজন্ম লালিত কোমল বাঙ্গালিত্বকে হিংস্র করেছে । পরে তারসম্পর্কে জানলাম সে পরে বাম আন্দোলন করেছে এবং এখন দেশের বাইরে ।
কেন জানিনা আজকে সেই ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে । সে সেই অল্প বয়সে যা বুঝেছিল ,আমরা আজীবন পড়ালেখা করে তা বুঝতে পারব কিনা জানিনা । হয়তবা সে বাস্তবতা খুব কাছ থেকে দেখেছে ।
আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছিলাম তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন একটি সময় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন । বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সম্মানের যে পরিবর্তন হয়েছে (আশির দশকের পরে) তার একটি ঘটনার মাধ্যমের প্রকাশ করি । আমি যে কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করি সেই কলেজের বাংলার স্যার তার জীবনের একটি ঘটনা এটি । তার ভাষায় বললে “আমরা যখন আগে গ্রাম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতাম , আমাদেরকে গ্রামের মানুষ অন্যরকম সম্মান করত । যখন বাড়ি যাওয়ার জন্য নৌকায় উঠতাম তখন আমার ভাড়া দেওয়ার জন্য নৌকার অন্যান্য যাত্রীরা রীতিমত ঝগড়া করত । এখন যখন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নৌকায় উঠে তখন মুরব্বীরা এই ভেবে ভয়ে থাকে যে , কখন তার মুখে বিড়ি ফুকে দেয় অথবা তাকে “শালা” বলে গাল দেয় ।”
স্যারের শেষ কথা গুলো শুনে পুরো ক্লাস ভর্তি ছাত্রছাত্রীরা হাসতে লাগল । কত হাসির একটা কথা, তাইনা ?
কিন্তু এর চেয়ে জঘন্য কাজ আমাদের বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা করেছে এবং করছে ।
ইউরোপ গত শতাব্দীতে কয়েকবার ধ্বংস হয়েছে । তারপরও তারা মাথা তুলে দাড়িয়েছে । তার অন্যতম কারণ তারা তাদের প্রতিষ্ঠান(গবেষনা) গুলোকে সচল রেখেছে । আমাদের দেশের বর্তমান অবনতির জন্য কোন ইনডেক্স দেখার দরকার নেই , বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান দেখুন ,বাংলাদেশের অবস্থান জেনে যাবেন । শুনেছি এককালে মালশিয়ানরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার জন্য পাগল ছিল । এখন বাংলাদেশী ছাত্রদের তারা ভিসা দেয়না । বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সামান্য রাজনৈতিক অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি থাকেন ।
একজন শুভাকাঙ্খীর সাথে কথা বলছিলাম । তিনি খুব সুন্দর একটা সমাধানের কথা বললেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য । তার কথামতে একটা আইন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেহারা পাল্টে দেবে । তা হল “ বাংলাদেশে যারা মন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং উচ্চ পর্য়ায়ের সরকারী কর্মচারী আছেন তাদের ছেলে মেয়েদের অবশ্যই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে হবে । দরকার হলে তাদের জন্য “কোটা” খুলে তাদের স্পেশাল ছেলেমেয়েদের পড়ার ব্যাবস্থা করত হবে ।” পরবর্তীতে তিনি আরও অনেক কথা বললেন যার সারমর্ম হল , যদি তাদের ছেলে মেয়েরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত তাহলে বাংলাদেশের অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুব ভাল চলত ।
কিন্তু হতাশ করার কথা হল বাংলাদেশ নাম এই জনাকীর্ণ নৌকার যারা মাঝী তাদের সন্তানদের তারা টাকার(!) বিনিময়ে পড়ান বিদেশে । আর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পরিণত হয়েছি তাদের পৌষ্য পশুতে । তাদের সেই রাজপুত্ররা যখন বিমান বন্দরে আসে তখন আমরা লাল গালিচা সংবর্ধনা দিই । আমরা বড় ব্যানারে লিখি “তুমি এসেছ তাই ধন্য বাংলাদেশ” । তারা ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষন দিবেন আমরা অবাক হয়ে বলব “বাপকা বেটা” । তারা জানেনা পলাশী থেকে শাহবাগের রিকসা ভাড়া কত ।তারা টিভিতে টকশো করবে আর বলবে “Bangladesh is hot, you know” । আমরা তাদের ইংরেজী এক্সেন্ট শুনে মুগ্ধ হয়ে যাব ।
বিশ্ববিদ্যালয় হল সর্বোচ্চ জ্ঞান চর্চার জায়গা । এই জায়গাটা যদি নষ্ট হয়ে যায় বাংলাদেশ তার আমিত্ব হারাবে । এই জায়গায় আসার সুযোগ পেয়ে যখন একজন ছাত্র শুধুমাত্র “আদর্শের” ভিন্নতার জন্য অন্য একজন ছাত্রের গায়ে হাত তুলে তখন চিন্তা করতে হবে আমাদের সমাজের অন্যান্য জায়গার পরিস্থিতি কেমন । সর্বোচ্চ শিক্ষিত এবং আলোকপ্রাপ্ত(!) লোকেরা যখন এই ব্যাবহার করে তখন অর্ধশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত লোকদের কাছথেকে আমরা কি আশা করতে পারি ?
দ্বিমত পোষণ করার কোন প্রশ্নই উঠে না, সমাধানটা দুর্দান্ত ধরণের সত্য বলে মনে হলো, কিন্তু একটাই প্রশ্ন, এই বিলটা পাশ করবে কে বলতে পারেন? কে নিজের ছেলেমেয়ের এমন সোনার ভবিষ্যৎটা আমাদের মতো অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিতে চাইবে??
যে দেশকে তারা তাদের সন্তানদের জন্য নিরাপদ মনে করেনা তারাই এই দেশের রাজা !
অদ্ভুত এই দেশ ।
বিএনপি নাহয় আওয়ামী লীগ যেকোন একটাকে ঘৃণা করতেই হবে– এই কালচার সহ্য হয় না! এই ঘৃণা এখন এতটা তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ইতিহাসের যেকোন গৃহযুদ্ধের সমকক্ষ হবার পথে।
কেন রে ভাই? শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধ হয়েছিল, কারণ তামিল টাইগাররা দেশের উত্তর ও পূর্ব অংশকে স্বাধীন করে ফেলতে চাইছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, অন্যায় শোষণের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বও একটা কারণ ছিল। কিন্তু এখন কিসের দ্বন্দ্ব? ক্ষমতার? স্রেফ অসুস্থতা।
আমরা গণতন্ত্র বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি, গণতন্ত্রের আদর্শ মডেলে সরকার জনগণের জন্য কাজ করে যাবে আর বিরোধী দল জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের গঠনমূলক সমালোচনা করবে, ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দেবে। দিনশেষে সবার কাজের একটাই মোটিভ– জনগণের সেবা। অথচ আমাদের গণতন্ত্র যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
এসব নিয়ে সবচেয়ে সূক্ষ্ম বিবেচনাবোধ থাকার কথা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের। তারা তো আর মূর্খ নন, পড়াশোনা জানা নাগরিক। অথচ তাদেরকেই যখন কুপিয়ে মানুষ হত্যা করতে দেখি তখন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা একটা এপিক বিদ্রূপ বলেই মনে হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোন বিকল্প নেই!
“বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার কোন বিকল্প নেই” একমত