সেন্টমার্টিন ছেড়ে আসার পর প্রায় ঘন্টা খানেক পার হয়ে গেছে, উপকূলে নোঙ্গর করা নৌবাহিনীর টহল জাহাজটাও ঝাপসা হয়ে গেছে খানিকক্ষন আগে। ট্রলারের ইঞ্জিন বন্ধ করে এখন সেটা ঢেউয়ের তালে ভেসে চলেছে। আরেকটি ট্রলার আসবে তার জন্য অপেক্ষা । জনা পঞ্চাশেক লোক শুকনা মুখে বসে আছে, অজানা ভয় তাদের চোখে মুখে ভীত সন্ত্রস্ত অবস্হা দেখলেই টের পাওয়া যায়। সামনে শুধু জল আর জল, গন্তব্য জানা আছে তবে পথ অচেনা ।
মালেক টের পাচ্ছে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে, পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা ব্যাগ, তাতে শুকনা চিড়া আর গুড়, যে পরিমান আছে তা দিয়ে এক সপ্তাহ চলতে হবে পরিকল্পনা মত, দুটা প্যান্ট আর দুটা শার্ট ও আছে। দুই লিটারের একটা পানির বোতল ও আছে, অবশ্য পানি নিয়ে তেমন চিন্তা নেই, ট্রলারের ড্রামে ভাল পরিমান পানিই আছে। আর আছে দুসপ্তাহ চলার মত তেল। মাঝি মোস্তাক মিয়া নির্বিকার, সাগর জলের সাথে তার আজন্ম সখ্য । সে কিছুটা বিরক্ত, আরো জনা বিশেক লোক নিয়ে একটা ট্রলার আসবে, সেটা কখন এসে পৌঁছাবে তার কোন ঠিক নেই, কারো যাতে চোখে না পড়ে, নৌবাহিনী আর কোস্ট গার্ডের উটকো ঝামেলা এড়ানোর জন্য সে অনেকটা পথ এগিয়ে এসে বসে আছে। আজকাল টাকা দিয়েও ঐ লোকগুলারে বিশ্বাস নেই, টাকাও নিবে পড়ে আবার জেলেও ঢুকিয়ে দিবে।
মালেকের আর ভাল লাগছেনা, অজানা ভয় তার মনে চেপে বসছে, মা আর বোনটার কথা বারবার মনে পড়ছে । তাদের সে কি কান্না, কতবার মানা করেছে তাকে না যেতে। অর্থ বিত্তের চেয়ে তার বেঁচে থাকা তাদের কাছে অনেক বড় বিষয়, সেই ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে তাও এই সাগর জলেই, তারপর থেকে সেই মায়ের একমাত্র অবলম্বন। পানিকে তার মায়ের এতই ভয় যে পারিবারিক পেশা সাগরে মাছে ধরতে কখনো তাকে যেতে দেয়নি তার মা । আর আজকে সে এই পানিতে ভেসে ভেসে ছুটে যেতে চায় মালয়েশিয়ায়, অর্থ আর বিত্তের অফুরান আগমনের আশায়।
গ্রামের সমবয়সী অনেকেই এই পথে যেয়ে আজ বিত্তশালী, নিয়মিত টাকা পাঠায় তারা, দেশে জায়গা জমি কিনে আশায় আছে কোন একদিন ফিরে আসবে নিজ ভূমে , মালেক ও সে স্বপ্নই দেখে চলেছে ।দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি মালেকের ভাবনাই ছেদ ফেলছে বারবার, অর্থ বিত্তের নেশা ফিকে হয়ে আসছে, বেঁচে থাকার আকুতিই প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে । মালেক ডিসিশান নিয়ে ফেলেছে লোক নিয়ে যে ট্রলারটি আসবে তাতে করে সে ফিরে যাবে। খানিক বাদেই মাঝি হাক দিলেন ঐ যে দেখা যাচ্ছে ট্রলার। সেটি এটির সাথে ভীড়তে না ভীড়তেই মালেক ঘোষনা দিল সে যাচ্ছেনা, কান্না কাটিও শুরু করে দিল। অগত্যা দালাল চক্র তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হল, মালেকের দেখা দেখি আরো দুজন ফিরতি পথ ধরল ।
এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে চলে মালেক। ডাইনিং টেবিলে আমি আর সে বসে আছি, তার কথা শুনতে শুনতে আমি লাঞ্চ করছি। মালেকের সাথে পরিচয় আজ থেকে পাঁচ বছর আগে হয়েছিল। সেন্টমার্টিন যাবার প্রত্যাশায় এক সন্ধ্যায় হাজির হয়েছিলাম টেকনাফে। হোটেলে ব্যাগ রেখে রাস্তায় নেমে পেয়েছিলাম মালেকের রিক্সা । সে আমাদের টেকনাফ শহর ঘুরিয়ে দেখাবে সন্ধ্যার আলো আঁধারিতে। টেকনাফ বীচ কখনো দেখা হয়নি বলার পর সে প্রস্তাব দিল চলেন দেখাইয়া নিয়া আসি, এখন মাঝিরা বীচে সাগরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুটা ভয়ে ভয়ে রাজি হলাম। চিনিনা জানিনা, তার উপর ক্যামেরা টাকা পয়সা সাথে। সাহস করে চলে গেলাম তার সাথে। অলি গলি ঘুরে রিক্সা নিয়ে সে হাজির হল বীচে। অমাবস্যায় প্রথম বীচ দেখা হল,দূরে মাছের নৌকার মিটি মিটি আলো জ্বলছে । ফেরার পথে মালেক প্রস্তাব করল তার বাড়িতে যাবার, আমি কোন কারন না পেলেও সে বলল আমাকে তার খুব ভাল লেগেছে, তাই বাড়ি নিতে চায়। অজানা ভয়ে আমি রাজি না হলেও সে রিক্সা তার বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুড়িয়ে এনেছিল ।
আমাকে হোটেলের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল ভাই আপনের একটা কার্ড দেন, মাঝে মাঝে ফোন করব । আমিও কোন কিছু না ভেবে তাকে একটা কার্ড দিয়ে এসেছিলাম। নিজের ব্যস্ত জীবনে মালেককে নিয়ে ভাবার খুব একটা অবকাশ ছিলনা , কিংবা বলা চলে দরকার ও নেই । কিন্তু মালেক তার নিত্যজীবনাচরনের জীবনে আমাকে ভুলে যায়নি । মাঝে মাঝেই ফোন করে ।
প্রথম প্রথম তার এই পয়সা খরচ করে ফোন করার কোন কারন খুজে পেতামনা, এক মিনিটের কথা বার্তা, ভাইয়া কেমন আছেন, বাসার সবাই কেমন আছে, টেকনাফে আবার কবে আসবেন । ভেবছিলাম আমি খুব একটা আগ্রহ না দেখালে সে হয়ত আর ফোন করার উতসাহ পাবেনা। তা হলনা, আমার অনাগ্রহ সে টের পেয়েছিল কিনা জানিনা, তার নিয়মিত ফোন করাতে সে কখনো ক্লান্ত হয়নি। একসময় আমার ও অভ্যাসে পরিনত হল, ফোন দিলে কেটে দিয়ে নিজেই কল করতাম। এভাবেই চলছিল ।
মালেক একসময় রিক্সা চালানো ছেড়ে দিয়ে ব্যবসা শুরু করল, বার্মা থেকে আচাড় এনে বিক্রি করে, ধীরে ধীরে চিটাগং শহরেও মাল সাপ্লাই দেয়া শুরু করল, মৌসুমে আমও এমে বিক্রি করে। মাঝে মাঝে বলে ভাইয়া ঢাকায় বেড়াতে আসব, আমি ভাবি এ আবার কি উটকো ঝামেলা, তবুও অনিচ্ছা স্বত্বেও বলতাম আসো। কিছুদিন আগে ফোন করে বলল আমি আগামী সপ্তাহে ঢাকা আসছি, তার এলাকার কে যেন আছে, সেখানে আসবে, তারপর আমার বাসায় আসবে । আমিও বললাম আস, কি আর করা মনে মনে ভাবলাম। গত কয়বছরে সে আমাকে যতবার ফোন করে খবর নিয়েছে তাতে তার এই আব্দার না মেনে উপায় নেই । শুক্রবার, মালেকের জন্য মোটামুটি ভাল খাবারের ব্যবস্হাও করা হল।
নামাজের আগে আগে মালেক এসে হাজির, প্রথম বার ঢাকা এসেই সে আমার বাসা খুজে বের করে ফেলেছে । নামাজ পড়ে আসার পর, সে তার ব্যাগ খুলে আমাকে ভড়কে দিল।দুটা বড় বড় বয়ামে ভর্তি আচার, একটা আমের একটা বড়ই এর, তার মা আর বোন বানিয়ে দিয়েছে আমাদের জন্য, সাথে নানা রকম বার্মিজ আচার তো আছেই । তাকে বকাঝকা করলাম এসব কেন এনেছে, সে হাসে আর বলে মা আর বুবু বানিয়ে দিয়েছে । মালেকের অনুভূতির কাছে আমাকে হার মানতে হল, নিজের ভাবলেশহীন অনুভূতির জন্য হালকা লজ্জাও লাগল নিজের মনে।
খেতে খেতে মালকে বলে চলেভাইয়া টেকনাফে একটা জায়গা কিনেন, আপনাদের ঢাকার লোকজন এখন ঐ এলাকার সব জায়গা কিনে ফেলছে, এখন ও দাম কম আছে, আপনি চাইলে আমি ভাল জায়গা খুজে দিব। মালেকের কথায় নিখাদ সরলতা আর আব্দার টের পায়, অন্য কোন ভাবনা তার এই প্রস্তাবে ছিলনা । ভাবী আর বাচ্চাকে নিয়ে একবার বেড়াতে আসেননা তার আব্দার। কথায় কথায় উঠে আসে সাগরে ভেসে মালয়েশিয়া যাবার কথা, আর তখন ই জানলাম তার গল্প।
প্রায়ই সপ্তাহখানেক লাগে মালয়েশিয়া যেতে, এলাকার দালালেরা লোক জোগাড় করে, শুরুতে বিশ হাজার টাকা দিতে হয়, আর পৌঁছানোর পর আরো একলাখ টাকা । ট্রলার তাদের নামিয়ে দেবে মালয়েশিয়ার জঙ্গলে, সেখান থেকে দালাদেরই লোকজন তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেয়, বেশীরভাগ লোকজনই বাগানে কাজ করে। দেশে বেকারজীবন কিংবা সাগরে মাছ ধরার চেয়ে এটাই ভাল তাদের কাছে। এই মানুষ পাচারে জড়িত এলাকার ক্ষমতাসীনরা, লাভের টাকা তাদের পকেটেও যায়, তারাই অনেক কিছু ম্যানেজ করে দেয়। কেবল ট্রলার ডুবি হলেই সেটা খবরের কাগজে আসে এই আর কি । জীবন মৃত্যু যুদ্ধে যারা জয়ী হয় দেশে তাদের সংসারে হাসি ফুটে, নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ করে তারা, আর পরাজিত পরিবারে নেমে আসে অপূরনীয় শূন্যতা । এটাই নিয়তি, এভাবেই বয়ে চলে জীবনের স্রোত ।
মালেককে এসব ভাবনা বাদ দিয়ে দেশে মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা করে যেতে বলি, সে জানায় তাতে ও নানা সমস্যা, চাঁদা আর ঘুষে লাভের বড় অংশই চলে যায়। ফেরার সময় মালেকের হাতে কিছু টাকা গুজে ডিতে চাওয়াই তার সে কি আপত্তি, শেষমেষ তার বোনের বাচ্চাদেরকে কিছু কিনে দেবার কথা বলে সেটা তার পকেটে গুজে দিয়েছিলাম। বাড়ি পৌঁছে সে জানায় ঠিকঠাক ফিরে যাবার কথা, সামনে ব্যবসা আরো বড় করার আশাবাদ ।
পত্রপত্রিকায় টেকনাফের কোন খবর দেখলে মালেকের কথা মনে পড়ে, ধীরে ধীরে নিজেকে গড়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত এক যুবকের কথা মনে হয়। পেপারে মাঝে মাঝেই দেখি মালয়েশিয়া যাবার পথে ট্ড়লার ডুবিতে অনেকের প্রানহানি , মনে মনে আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই, মালেকের ফিরে আসার জন্য । যারা হারিয়ে গেছে টাদের কাউকে আমি চিনিনা, তাই সেটা খুব বেশী দাগ ও কাটেনা আমার মনে, মালেক হারিয়ে গেলে কিছু সময়ের জন্য হলেও খারাপ লাগত, জীবনের স্মৃতিময় অংশে মালেকও যে একটা ক্ষুদ্র জায়গা দখল করে আছে ।
অনেকদিন তার খবরাখবর নেই, সপ্তাহ দুয়েক আগে সে ফোন করে বলল, ভাইয়া আগামী সপ্তাহে আমি মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছি। আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমার কি আবার মাথা খারাপ হইছে নাকি, আগেরবার ফিরে আসলা, আর নানারকম দূর্ঘটনাত ঘটছেই। যে টাকা দিয়ে তুমি যাবা সেটা দিয়ে ব্যবসা কর। সে বলল এইবার টাকা দেয়া লাগবেনা, আগেরবারের টাকা দালাল ফেরত দেয় নাই, সেটা দিয়েই যাচ্ছে, আর যাবার পর একলাখ টাকা দিতে হবে। ফোনে তাকে নিরস্ত করার চেস্টা করে বিফল হলাম, দেশে ব্যবসায় খুব বেশী লাভ হবেনা বলে সে রায় দিয়ে ফেলল। যা লাভ হয় তার বড় অংশই চলে যায় ম্যানেজ করার কাজে। আর মালয়েশিয়া একবার যেতে পারলেই সব হয়ে যাবে। তদুপরি এখন শীতকাল, সাগর ঠান্ডা, ট্রলার ডুবির সম্ভাবনা কম, তার গলায় উপকূলের সাহসী তরুণের কন্ঠস্বর !!!
ভাইয়া দোয়া করবেন যেন ঠিকমত যেতে পারি, বাবু কেমন আছে জেনে ফোন রেখে দেয় মালেক । ।
রবিবার চলে গেছে তাও সপ্তাহখানেক হয়ে গেছে । আমি মালেকের নাম্বারে ফোন করার সাহস পাচ্ছিনা । মাসখানেকের মাঝে সে যদি ফোন না দেয় ধরে নিব মালেক মালয়েশিয়ায় পৌঁছে গেছে ।
ভাল থাকুক মালেক, যেখানেই থাকনা কেন , জীবন যুদ্ধে সে জয়ী হবে সবসময় এই কামনায় করি ।
আনিসুল হকের একটা উপন্যাস ছিল না এইভাবে মরক্কো থেকে ইউরোপ যাত্রার কথা?
ইস্তাম্বুল যাবার সময় প্লেনে এক প্রবাসীর সাথে দেখা। খুব কষ্ট করেছেন জীবনে। যখন শুনলেন পুরোটাই কোম্পানির খরচে যাচ্ছি…কেমন যেন লাগল তার। কথায় কথায় অনেক কিছুই বললেন। শুরুটা বিশেষ করে…
লিখতে চেয়েছিলাম। হয় নি 🙁
প্রবাসীরা শুধু রেমিটেন্সের হিসেবেই আছেন আর কিছুতে নয় 🙁
খুব সুন্দর মনখারাপ করা একটা কথা বললেন ভাইয়া 🙁
🙁
এই যোদ্ধাদের জন্য বুক ভরা প্রার্থনা আর শুভকামনা।
কিন্তু এইসব দালালির সমাধান কী আসলে?
:crying: