একুশে হলের দোতলা। রুম লাগোয়া বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে নিহান। সামনের বাগানে ফুটে আছে একঝাক রক্তজবা, আর কিছু লালগোলাপ। একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনটা উদাস হয়ে উঠল ওর। ছ’মাস হল নিহান বাড়ি যায় না। গতবার ফেরার আগে মাকে বলে এসেছিল, ঢাকায় গিয়ে দিন পনের’র মাঝে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবে। ফিরে এসে মাকে নিয়ে যাবে ঢাকা দেখাতে। নিহান ভেবে রেখেছিল মাকে টি এস সি, কার্জন হল, কলাভবন আর জাদুঘর ঘুরে দেখাবে। কিন্তু মা শুধু বলছিল চিড়িয়াখানা দেখবে। কেমন ছেলেমানুষি, ভাবতেই হাসি আসে ওর!
ক্যালেন্ডারের পাতাটা তখন ছিল জুলাইতে। ফেরার সময় ছিল প্রবল বৃষ্টি। সকাল,দুপুর রাত, এবছর বৃষ্টি হয়েছে প্রচুর। বৃষ্টির দিনগুলোতে পূরবীর কথা ভীষণ মনে আসছিল ওর। বৃষ্টি-জল-কাদার ফাকেই কদিন ঢের জ্বালিয়ে গেল পোয়াতি নদীর দুকূল ছাপানো জল। কালনীর কূলে নামা গতিময় প্লাবনে হাওরগুলো তখন যৌবনের চাষ করতে ব্যস্ত, কী প্রবল দাপট তার যৌবনবতী স্রোতের! সবকিছু ভেঙেচুরে এগোয়। এর পরে এলো হেমন্ত। গ্রাম থেকে মা খবর পাঠাল, খোকা আয় না তুই, এবার ধান ফলেছে অনেক। দেখে যা ক্ষেত জুড়ে মুঠি মুঠি সোনার ধান, অবুঝ বাতাসে কেমন দোলে সবুজ করুন ধানের শীষগুলো। যাওয়া হয়নি নিহানের, চিঠি লিখে পাঠাল, পরীক্ষার কথা বলে। ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যায় সময়ের সাথে সাথে। এখন দিন পাতা ঝরার, গাছের বাকলগুলো হলুদ হতে শুরু করেছে। কেমন একটা বিষাদী বাতাস বইছে, শিশিরাক্ত সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্ধি।
নিহানের মনে পড়ে যায়, স্টেশনে আসবার সময় বৃষ্টির ছাট থেকে বাচাতে নাদের আলী বর্ষাতিটা ধরেছিল ছোটবাবুর ঠিক মাথার উপরে। যেন ছোটবাবু এখনো ছোট্টই রয়ে গেছে। ফলাফল নাদের আলী ভিজে একশা। এমন দমকা হাওয়া, বর্ষাজলের গর্জন ওকে স্মৃতিকাতর করে। আশৈশব বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধাত নিহান, সেই বর্ষাজলে অবগাহনের সুখ নাদের আলীর জন্য বিসর্জন দিল। দিনটি ছিল পাঁচ মাস আগের। এতটা দিন সে মাকে দেখেনি, পারেনি বোনটাকে কোলে নিতে, তাকে ঢাকাই খেলনা তুলে দিতে। আর অপেক্ষা করে থাকা পূরবী, যার চোখে তাকালেই নিহান খুঁজে পায় নির্ভরতার মহাকাব্যিক আশ্রয়, তার চোখে রাখা হয়নি ক্লান্ত নিহানের চোখ! এতগুলো দিন কাটল, ভেবে অবাক হয় নিহান। আজ সে যাবে পরিবার, আপনজনের কাছে। গিয়ে একটা চমক দেবে সে।
বেলা বারোটায় স্টেশনে পৌঁছল সে, তিনটায় ট্রেন। টিকিট কাটা নেই, বাড়তি দুশ্চিন্তা। হাটতে শুরু করতেই একটা মেয়ে বলল, ভাইজান দুইডা ট্যাহা দেন, ভাত খামু, আইজ শবেবরাত-দেন না দুইডা ট্যাহা। আট ন বছর হবে বয়স, গায়ে শতচ্ছিন্ন জামা। নিহান বলল, দু টাকায় কি আর ভাত পাবি? আমার সাথে আয়, তোকে ভাত খাওয়াব-আয়। মেয়েটাকে নিয়ে হাটতে শুরু করল সে। একটু পরেই ওকে আর দেখতে পেল না সে। কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। অবাক নিহান হাটে, টিকিটের লাইনের দিকে।
স্টেশনটা নতুন রঙ করা হয়েছে। কদিন আগে হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপ, নতুন করে রাঙিয়ে গেছে শহরটাকেই। মুছে দিয়ে গেছে পুরোনো সব ইতিহাস- দেয়াল জুড়ে ভোটের পোস্টার, পানের পিকের শক্ত চিটচিটে দাগ, ময়লার হলদে আভা। ঝাঁ চকচকে ভাব। স্টেশনের নিয়মিত হকার আর ভাসমান লোকেরাই সংখ্যায় কম। নিজের দাগটুকু ঢাকার চেষ্টাটা চলেছে ভালই। ভাবতে ভাবতে লাইন ধরে। আধ ঘন্টায়ও যখন টিকিটের টিকির খোজও পেল না, তখন লাইন ছেড়ে বেরোতেই এক লোক আড়ালে আসবার ইশারা দিল। দ্বিগুণ দাম চাইল, টাকা দিতেই হাত বদলে এলো সোনার হরিণ, বাড়ি যাবার রূপোর সিন্দুকের চাবি।
টিকিট হাতে পেয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে নিহান। ওয়েটরুমে বসে তাকায় আশে পাশে। অনেকের গায়েই রঙচঙা সোয়েটার। আলমিরা থেকে বের করেই গায়ে দিয়েছে অনেকে- ভাঁজ পরে আছে, সাথে রয়ে গেছে ভ্যাপসা গন্ধটাও। ওদের দেখে নিজেরও শীত লাগছে নিহানের। সাধারণত নভেম্বরে ভরদুপুরে ঢাকায় সোয়েটার গায়েতোলার মত শীত পড়েনা, তবে আজ পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অপেক্ষমাণ যাত্রীদের রুমটা ভরে উঠল হা করা বোয়ালের পেটের মতন। রুমের বাইরেও অনেকে দাড়িয়ে। সদ্য মা হওয়া এক তরুণী বাচ্চা সামলাতে গিয়ে গলদঘর্ম। বাচ্চা কাঁদছে, রীতিমত গগনবিদারী চিৎকার। আশে পাশে বাবাও নেই। কান্না ও ভিড়ে অতিষ্ঠ হয়ে ও হাটা ধরে সামনের দিকে।
দুটো মত বাজে। ট্রেন এসে গেছে স্টেশনে। ঘোষণা শুনেই টিকিটের দিকে চোখ রাখল নিহান। ট্রেনের নাম পূরবী। অবাক হয় ও, কোমল স্নিগ্ধতায় ভরা এই নামটা দেখে। আচ্ছা ট্রেনের এই নামটা কে রেখেছিল? নিশ্চয়ই কবি ছিল সে কিংবা তার ছিল কবিমন। পূরবী কি জানে ওর সাথে দেখা করতে যাবে পূরবী নামের ট্রেনে চড়ে? ভাবতেই লজ্জাও চলে আসে কিছুটা। হেসে ফেলে সে, মুচকি হাসি। এত বড় ছেলেদের লজ্জা পেতে নেই, নিহানের সেটা একদম জানা নেই। তাই এখনো ও লজ্জা পায়। হলে বন্ধুরা ফোন করার সময় ওকে নিয়ে খেলতে বেশ মজা পায়।
ট্রেন প্রায় পূর্ণ। ছাড়বার সময় হয়ে গেছে। বেশ কটা হুইসেল বাজিয়ে ঝাঁকা দিয়ে ট্রেনটা দুলতে শুরু করল সমান্তরাল লোহার দুটো পাতের উপর দিয়ে। নিহানের বুকে পোষা ছোট্ট সুখের ভাবনাগুলো রঙিন হতে থাকে। শাদা ক্যানভাসে আলোছায়া জাগছে ফুটকির মত। বোনের হাতে নতুন পুতুলের সেট, মাকে নিবিড় আলিঙ্গন আর পূরবীর হাতে হাত রেখে কালনীর জলে পা ডুবানো- ওপারের মানুষদের নিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতে ভীষণ ভাল লাগছে এপারের নিহানের। নিহান জানেনা আর কি চাইবার আছে দুদণ্ডের এই শাদামাটা জীবনে, দু চারটে সুখের মুহূর্ত ছাড়া।
ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক, কু ঝিক ঝিক….
ভাল তো! মনে হচ্ছে কোন উপন্যাসের প্রথম দুই-এক পাতা পড়লাম। 😀
উপন্যাস
ভাল বলেছেন।
আমার যদি লেখার মত ধৈর্য্য থাকত উপন্যাস একটা লিখেই ফেলতাম এতদিনে
ধন্যবাদ কমেন্টের জন্য
চারপাশের বর্ণনাগুলো অনেক ভালো লেগেছে
এত ছোট কেন? ভালোই তো লাগছিলো পড়তে 😀
যাতে শেষ হইয়াও হইল না শেষ
এই রেশটা থাকে এজন্যেই ছোট করে রেখেছি
ভালো লাগছে তানিম। দিন কাল কেমন যাচ্ছে?
তোমার তো কোন খোঁজ পাই না। সেলিব্রেটি মানুষ
কই কই যে থাকো।
আমি আছি মাটির কাছাকাছি
ঝরঝরে লাগল ভাইয়া।
কবিতার বাইরেও এরকম দু’একটা লেখেন না কেন?
কবিতার বাইরে ইদানীং গল্পও লিখছি কিন্তু। এ বছরে তিন তিনটা গল্প লিখেছি। 😛
আমার মত অলস মানুষের জন্যে এটা অনেক, অনেক বেশি
হা হা। সম্প্রতি বাংলানিউজ আমার একটা গল্প ছেপেছে। পড়ে দেখতে পারো
http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=5d45fe721ec11b68664e5228c6e85067
ভাইয়া, গল্পটা পড়ে এলাম, ফাটাফাটি বললেও কম বলা হবে! এক টানে পড়েছি।
আপনি আলসেমি ছেড়ে ঝেড়ে কাশুন তো, আমরা পাঠকেরা এমন গল্প মিস করতে চাই না।
কালনী নদী টা কোন জায়গায় ?
হাওড়াঞ্চলে
🙂 গল্প কেমন লাগল ?
কথামালা সারাবেলা
ছুঁয়ে দিল মেঘমালা……
আরও লিখুন এমন……
কষ্ট লাগে বড়, আমি আবার আইলসা মানুষ