(একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা )
তারিখ : ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর
স্থান : পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় কারাগার
জেলের এককোণায় ২৪ বছরের একটি যুবক উদাস মনে বসে আছে। এই উদাসীনতার সঠিক কারণ বোঝা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ধরে বেশ কোলাহোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। জেলের ভেতর সবসময় কিছু শব্দের আনাগোনা শোনা যায়, তবে মানুষের আহাজারি আর চিৎকারের… কিন্তু আজকের শব্দগুলো কানে অন্য রকম অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। সে জানে আজকে বাংলাদেশ নামে একটা সুন্দর দেশের জন্ম হবে। হয়তো হয়ে গ্যাছে ইতিমধ্যে।
গত নয় মাস ধরে যুবকটি জেলবন্ধী, তার সাথে বন্ধী বংলাদেশী আরো অনেকে। যুবকের নাম শেখ আশরাফ উদ্দিন। খুলনার রাড়ীপাড়া গ্রামে তার জন্ম। খুলনা বি.এল কলেজে কমার্স নিয়ে পড়ার সময় পাকিস্তান আর্মিতে সে চাকুরী পায়। একদিন ট্রেনিং এবং কোর্সের জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয় তাকে। এরপর কেটে যায় দীর্ঘ তিন বছর..করাচি, ইসলামাবাদ আর রাওআলপিণ্ডির ক্যান্টনমেন্টে সুন্দর সময় কাটতে থাকে আশরাফের। কিন্তু ১৯৭১ এসে ক্যামন যেন সব পাল্টাতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তানের আর্মিতে কর্মরত সকল বাংলাদেশীদের আটক করা হয়েছে, এরা যেকোন মুহূর্তে বিপদজনক হতে পারে।
আশরাফের অনেকবার মনে হয়েছে, দেশে ফেরার কোন আশাই নেই। যে কোন সময় ডেকে ফায়ার করতে পারে। এই কারাগারের জীবনটা অনেক বেশী কষ্টের এবং অপমানের,দেশের জন্য যেখানে সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করছে সেখানে একজন ট্রেনিং প্রাপ্ত যুবক কারাগারে বন্ধী !!
ঘটনা আসলেই সত্যি, বাংলদেশ এখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই মুহূর্তের জন্য শুধু আশরাফই নয়, প্রতিটা বাংলাদেশীর অপেক্ষা… দীর্ঘ অপেক্ষা। এখন মরণ হলেও মনে আনন্দ নিয়ে ফিরে যেতে পারবে। এই দিনটার বড় বেশী অপেক্ষা ছিল।
অনেকদিন পরের ঘটনা, আশরাফকে জেলের প্রধান ডেকে পাঠিয়েছেন। অনেকেই বলছিল দোয়া পড়তে পড়তে যা… আর যাকেই বিশ্বাস করিস এদেরকে না। আশরাফের দৃষ্টি স্থির। কেন তাকে এই রাতে ডেকে নেয়া হচ্ছে কেউ জানে না !! আশরাফের কেন যেন মায়ের মুখটা মনে পড়ছে, এখনো বেঁচে আছে কিনা কে জানে…
কথাগুলো উর্দুতে হয়েছে এখানে বাংলায় দেয়া হল :
– কি ব্যাপার ক্যামন আছ ?
– উত্তর নেই
– তোমার তো ফাইলপত্র বেশ ভাল, তোমার জন্য সুখবর আছে পাকিস্তান আর্মি থেকে। কি ভয় পাচ্ছ ??
– কোন উত্তর নেই
– হুম… আচ্ছা, তোমাকে পাকিস্তান আর্মিতে অফিসার পদে রাখা হবে, তুমি চাইলে এদেশে বিয়ে করতে পার। তোমাকে সকল নিরাপত্তা আর সুবিধা দেয়া হবে। ভেবে দেখ.. কি করবে এই সুযোগ কিন্তু বার বার আসবে না। এত মানুষকে ডেকে জিজ্ঞাস করা সম্ভবও না। আর ওই ভাঙ্গা আর অচল দেশে ফিরে যেয়ে কি করবে ?? দেখ.. আশরাফ; চুপ করে থাকবে না কি করবে ?
– আশরাফ শুধু একটা কথাই বলল.. “আমার কোন কিছুরই দরকার নেই। আমাকে আমার দেশে ফিরে যেতে দিন। আমি আমার বাংলাদেশে ফিরে যেতে চাই।”
জেল প্রধান ২৪ বছরের যুবকটির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কোথায় এরা এত সাহস পেয়েছে কে জানে.. কি অদ্ভুত ! কি অদ্ভুত !
[এই যুবকটি আমার বাবা। আজকে আমার বাবার প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা জানিয়ে উৎসর্গ করছি। বাংলাদেশের বিজয় দিবসে বাবার হাত ধরে ঘুরতে ইচ্ছে করছে। শেষ কোন এক বিজয় দিবসে একসাথে আমরা রাস্তায় হেঁটেছি.. খুব সেই সময়টায় ফিরে যেতে মন চাইছে ]
আমরাও গর্বিত আপনার বাবাকে নিয়ে…. দোয়া করি- তিনি শান্তিতে থাকুন…
আব্বা আপনাদের দোয়াতে ভাল আছেন। ধন্যবাদ
উনার প্রতি শ্রদ্ধা।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি যদি আমরা বুঝতাম সেই সময়ে কত্ত বড় ত্যাগ স্বীকারে তারা প্রস্তুত ছিলেন! করেছেন!
আমরা তার সামান্য কিছু করলেও বদলে যাবে বাংলাদেশ
আজকাল আমাদের মধ্যে আবার সেই পুরানো দিনের সাহস ফিরে আসুক সেই কামনায়। বদলে যাক বাংলাদেশ।
সত্যি বলছি, আপনার লেখাটা পড়ে চোখ ২ টা জলে ভিজে গেছে। কিন্তু ভেবে খুব খারাফ লাগছে, এতো ত্যাগ করে কি আমরা সত্যি স্বাধীনতা পেয়েছি? কোথায় গেলো আমাদের সেই দেশপ্রেম? কেন আমরা এমন হয়ে গেছি? 🙁
কেন এমন হল সেই উত্তর জানা নেই আমার। তবে আমারা কি পারি না নতুন করে শুরু করতে ? ধন্যবাদ আপনাকে
আপনার বাবার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।
এই দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটা এখনকার প্রজন্মের মাঝে থাকলে হত! 🙁
অনেক ধন্যবাদ। আব্বাকে সালাম পৌঁছে দিসি। আমাদের প্রজন্ম আবার ফিরে আসুক এই কামনাই করি।
আপনার বাবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা আর প্রার্থনা।
তাঁর মত মানুষ এদেশের হাওয়া-জলে আরও আরও বেড়ে উঠুক। দেশটা এমন ভালো মানুষে ভরে যাক, এটাই কামনা।
আপনার কথা আব্বাকে জানিয়ে দিয়েছি। আমার নিজের বাবা বলে বলছি না, তাঁকে দেখে আমিও অবাক হই