চায়ের কাপে প্রথম চুমুক দিল ইরিত্রা। সবসময়ের মতই ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভীষণ রকমের চা-পাগল ইরিত্রার কাছে মনে হয়, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়ার চিন্তা করার মধ্যে একটা অন্যরকম আনন্দ আছে। প্রথম চুমুকের সাথে সাথেই সেটা অনেকাংশেই ম্লান হয়ে যায়। তাই সে সবসময় প্রথম চুমুকের আগের সময়টাকে দীর্ঘায়িত করে। ফলাফল: ঠান্ডা চা খাওয়া। অবশ্য, সেটা নিয়ে তেমন আক্ষেপ নেই তার।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। অনেকদিন পর বিকেলে বারান্দায় চা খেতে বসেছে। শহরের যান্ত্রিক জীবনের প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝে, ভোরের সূর্যোদয়ের মুহূর্তগুলো, বিকেল, গোধূলী, সূর্যাস্ত- এ সময়গুলো ক্রমশই কেমন যেন বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলছে। সময় এখন শুধু ঘড়ির কাঁটা দিয়েই যেন বিচার করা হয়। তাই আজ সে বেশ পরিকল্পনা করেই বিকেলটা বারান্দায় বসে কাটাবে বলে ঠিক করেছে।
“আল্লার কত কত টাকা-পয়সা…” হঠাৎ চমকে উঠে নিচে তাকাল ইরিত্রা। রাস্তায় এক বৃদ্ধ ভিখারী গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করছে। পরিচিত এই সুরটা এক লাফে তাকে পাঁচ বছর পেছনে নিয়ে গেল। পাঁচ বছর আগের এক সন্ধ্যায় এই একই ব্যক্তি ঠিক একই সুরে গান গেয়ে গেয়ে ভিক্ষা করছিল। অন্যান্য আরও কিছু লাইনের মধ্যে সে কেবল এই লাইনটাই সে বুঝতে পারে। বাকিগুলো অস্পষ্ট হওয়ায় বোঝা যায় না।
তখন ইরিত্রা কেবল এস.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছে। রাতের ট্রেনে গ্রামের বাড়ি যাবে বলে সেই সন্ধ্যায় ব্যাগ গোছগাছ করছিল। সারাটা সন্ধ্যা জুড়ে এই গানটা শোনার ফলে তা মাথার ভেতর ঢুকে যায়। রাতে ট্রেনে ঘোরের মধ্যে পুরোটা সময় বৃদ্ধের গাওয়া গানের সুরটাই কেবল মাথায় বাজছিল। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
এসব কারণেই মিউজিকের প্রতি তার এক প্রকা ভীতি কাজ করে। কোনটা হুট করে মাথায় ঢুকে গেলেই হল! কয়েকটা দিন ওলট-পালট হয়ে যায়।
সেবার সে গ্রামের বাড়িতে থাকা কালে তার এক দূর সম্পর্কের ফুপাতো বোনের বিয়ে হয়ে যায়। তার সমবয়সী ছিল সীমা। এত কমবয়সী একটা মেয়ের বিয়ে হতে দেখে সে খুব অবাক হয়েছিল। প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। কিন্তু শহরে বেড়ে ওঠা এক অপরিণত মেয়ের কথা ভেবে সবাই হেসেই উড়িয়ে দেয়।
বিয়েতে সীমারও মোটেই মত ছিল না। গ্রামেই তার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা হলেও, গ্রামের আর দশটা সাধারণ মেয়ের চেয়ে সে ছিল অনেক আলাদা। পড়াশুনায়ও বেশ ভাল ছিল। আর বই পড়তে সে ভীষণ ভালবাসত। ইরিত্রা সহজে কারও সাথে তেমন একটা মিশতে না পারলেও, খুব সম্ভবত, এই একটা কারণেই তার সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল ইরিত্রার। সে যখনই গ্রামে যেত, সীমার জন্য বই নিয়ে যেত বিভিন্ন রকম।
গ্রীষ্মের দুপুরের প্রচণ্ড গরমে সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকত, সেই সময়টাতে বাতাবীলেবু গাছটার নিচটায় খাটলা পেতে বসে তারা কত দিন গল্প করে সময় কাটিয়েছে! সীমার কারণেই তার জানা হয়, দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠে খালি পায়ে দৌড়ে যাওয়াতে কেমন আনন্দ। খুব সকালে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় করে পদ্মা ভ্রমণের সময়, ইঞ্জিন চালু হলেই তার প্রকট শব্দে কোথা থেকে যেন ঝাঁকে ঝাঁকে মাছরাঙ্গা এসে নৌকার চারিদিক ঘিরে উড়তে থাকে, আর টুপ করে পানি থেকে মাছ ধরতে থাকে- এই রকম অপূর্ব সুন্দর, বিহ্বল করে দেয়ার মত একটি দৃশ্যের সাথে সে প্রথম পরিচিত হয় তার সেই বোনটির কল্যাণেই। বিস্ময়ের ব্যাপার হল, নৌকার ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়ার সাথে সাথেই পাখিগুলো যে ম্যাজিকের মত কোথায় গিয়ে লুকায় তা মোটেই টের পাওয়া যায় না।
সীমার দুচোখ জুড়ে ছিল অনেক স্বপ্ন। কিন্তু গ্রামের নিতান্তই দরিদ্র একটি পরিবারের সন্তান হওয়ায়, তার স্বপ্নগুলো স্বপ্নই রয়ে গেছে। বিবাহিত জীবন মোটেই সুখের হয় নি তার লোভী স্বামীর সাথে। বিয়ের সময়ই ‘উপঢৌকন’ হিসেবে একটি মোটর সাইকেল নিয়েছিল। পরবর্তীতেও বিভিন্ন সময়ে চাপ দিয়ে শ্বশুর বাড়ি থেকে টাকা আদায় করত। তা দিতে অস্বীকার করলে কখনও কখনও তার গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত না।
বিয়ের বছর দুই পরে, প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে আনতে গিয়ে সে এই পৃথিবীর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যায়।
এরই মধ্যে পাঁচ বছর কেটে গেছে। অনেক পরিবর্তন এসেছে এই পৃথিবীতে। সীমার কথা কেউ মনে রাখে নি। খুঁজে দেখলে হয়ত এমন আরও অনেক সীমার খোঁজই পাওয়া যাবে। কিছুদিন শোক পালন করার পর ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে যে সীমাদের কথা সবাই ভুলে যায়। অনেক দিন পর আজ সেসব কথা মনে পড়ায় ইরিত্রা একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
সীমার কন্যা সন্তান বেড়ে উঠছে তার নানা-নানুর কাছে। সেও হয়ত তার মায়ের মত স্বপ্ন বুনছে। তার স্বপ্নগুলো পূরণ হবে তো?
“আল্লার কত কত টাকা পয়সা……” একই সুরে গেয়ে চলেছে বৃদ্ধ।
:welcome: স্বাগত জানাই সরব লেখায়! (অবশ্য আমাকেও আপনার স্বাগত জানানো উচিত কমেন্টিং এ) 😛
সুন্দর গল্প!! আরো সুন্দর হবে আগামীতে! :love:
ধন্যবাদ। 🙂
আপনাকে কমেন্টে স্বাগতম। :welcome:
( আরণ্যক আমার লেখায় প্রথম কমেন্ট করেছে! :penguindance: )
ইয়ে…… ব্লগে কি বন্ধুদেরও আপনি বলা নিয়ম?? এত ফর্মালিটি করতে আমার কেমন যেন লাগে…… 🙁
একটু ভাব নেয়ার চেষ্টা করসিলাম! দিলা না… 🙁
হা হা 😛
:welcome:
মন খারাপ করা গল্প
এই যৌতুক নামক ব্যাধি যে দেশ থেকে কবে যাবে 🙁
ভালো লেগেছে 😀
আশা করি নিয়মিত লিখবেন
হুম। কবে যে যাবে। এখন অবশ্য নতুন নিয়ম চলছে, কেউ আর ‘যৌতুক’ নামে কোন কিছু দাবী করে না। ইনিয়ে বিনিয়ে বিভিন্ন ভাবে চায়।
খুব চমৎকার!! অত্যন্ত সাবলীলভাবে সুন্দর কিছু বিষয় ফুটিয়ে তুলেছ!! :clappinghands:
লিখতে থাক। তোমার লিখতে থাকা উচিৎ।
:welcome:
মন্তব্যের জন্য ধন্য বাদ। কেবল তো শুরু করলাম। নিয়মিত লেখার চেষ্টা করব। 🙂
:clappinghands:
প্রথম লেখা হিসেবে চমৎকার :beshikhushi:
keep it up 😀
পড়ার জন্য এবং কষ্ট করে কমেন্ট করার জন্য অনেক ধন্যবাদ দোস্ত।
I’m proud of my friends, really! :beshikhushi:
এসব পচা লেখা পড়েও এত প্রশংসা করছে। (আমি হলে এতটা পারতাম না বোধহয় 😛 )
ভালো লেগেছে! :love:
:welcome:
মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ তিষাপু! :love:
এখন গল্প পড়ে মন্তব্য করাটা কেমন যেন একঘেয়ে হয়ে গেছে! খুব সুন্দর, অনেক ভালো লিখছ এগুলো যেন ডাল-ভাত। তবে সত্যিকার অর্থেই গল্পটা খুব সুন্দর হয়েছে। একটু সমালোচনা টাইপ করি, এইটা যেহেতু গল্প তাই ঐ যে উপঢৌকন এর পর ব্রাকেটে যে অংশটা লিখেছ সেটা ঠিক মানানসই লাগে নি। এছাড়া গল্প খুবই সাবলীল তবে সত্য গল্প বলে একটা নির্মমতার ছাপও আছে। চলতে থাকুক।
তুমি তো পুরাতন পাপী আবার স্বাগতম জানাতে হবে নাকি ? 😛
“তুমি তো পুরাতন পাপী আবার স্বাগতম জানাতে হবে নাকি ?” – হা হা হা!! 😀
🙄
আসলেই তো… আমার ভুল হয়ে গেছে, ঠিক হয় নি স্বাগতম জানানো। 😛 😛
সুন্দর সমালোচনার জন্য অনেক ধন্যবাদ । 🙂
ঐ অংশটা নিয়ে আমারও একটু খটকা ছিল। তাই এডিট করে ফেললাম।
niceee…. (y)
:guiter:
স্বাগত ‘সরব’ এর উঠোনে।
চমৎকার একটা বিষয় উঠে এসেছে লেখায়। বাল্যবিবাহ আজকের দিনেও যেভাবে বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে, তা গ্রামের দিকে গেলেই প্রচণ্ডভাবে টের পাওয়া যায়।
আরও গল্প পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম 🙂
সত্যিই ভাইয়া। গ্রামে বাল্যবিবাহ এখনও নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আমরা এটা নিয়ে যতই কথা বলি আর আন্দোলন করি না কেন, সব মনে হয় যেন একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই আবদ্ধ। আসল জায়গায় তেমন একটা প্রভাব ফেলতে পারছে না।
সরব এর চমৎকার উঠোনে আসতে পেরে আমিও আনন্দিত। 🙂
ভাল লাগছে। লেখাটা ‘গল্প’ বিভাগে দিয়ে দিয়ো। 😀
ইরিত্রা নাম দেখে শুরুতে ভাবলাম সায়েন্স ফিকশন। 😛
আপনার ভাল লাগছে জেনে অনেক খুশি হলাম। :penguindance:
যদিও আপনার কাছ থেকে এর সাথে একটু সমালোচনাও আশা করছিলাম আপু। 🙂
এটা কে ঠিক গল্প বলা যায় কি না সেটা নিয়ে আমার খানিকটা সন্দেহ ছিল। তাই ‘বিবিধ’ বিভাগে দেয়া।
হাহা। প্রথম লেখায় সমালোচনা করা কি ঠিক? 😛 এরপর থেকে ইনশাআল্লাহ্!
ইরিত্রা নাম দেখে আমিও ভেবেছি সায়েন্স ফিকশন নাকি!! 🙂
গল্পটা অনেক মেসেজ দিচ্ছে, গল্পতে এই ব্যাপারটা আমার অনেক পছন্দ; পাঠককে চিন্তার কিছু খোরাক দেয়া……
আরও অনেক গল্প আশা করছি, নিয়মিত। একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি আমি–নিয়মিত না লিখলে একটা সময় লেখার স্পৃহাটাই চলে যায়…… 🙁
আকাশ ভেঙ্গে উড়ে যায় এক ঝাঁক গাংচিল– এই লাইনটা আমার অনেক পছন্দ… শুভকামনা অনেক অনেক…… 🙂
ইয়েস আমিও ইরিত্রা দেখে সাইন্স ফিকশন ভাবছিলাম। 😀
সবার দেখি একই কথা মনে হয়েছে! :happy:
অবশ্য, এখন আমারও মনে হচ্ছে নামটা সাইন্স ফিকশনের মতই লাগছে।
এত সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপু।
কেবল তো শুরু করলাম। চেষ্টা করে দেখি, কতটা নিয়মিত থাকতে পারি। 🙂
“আকাশ ভেঙ্গে উড়ে যায় এক ঝাঁক গাংচিল…” :beshikhushi:
অতীব সুপাঠ্য ও সুচিন্তিত। তবে আরেকটু বড় হলে মন্দ হত না। আমি আবার গল্প পড়তে বড়ই ভালোবাসি… 😀
ইয়ে…মানে… আমি তো লেখালেখিতে একদম নতুন। তেমন লেখতেও পারি না। তাই একটু ছোটই হয়ে গেছে। আগামীতে চেষ্টা থাকবে বড় লেখার। 😳
কমেন্টের জন্য অনেক ধন্যবাদ লতা’পু! (মাধবীলতা তো নিজেকে লতা ভাবতেই বেশি ভালবাসে,তাই এই নামটাই ব্যবহার করলাম।) 😀
লুকজন কই কমেন্ট করে, নোটিফিকেশন তো পাই নাই, এমনিই ঘুরতে আসছিলাম। 😀
মাধবীপু বললেও খুশি হব, নো প্রবলেম। আমার একসময়ের নিক হওয়ার কথা ছিল কিনা। :happy:
ঠিক আছে। তাহলে মাধবী’পু। 🙂 :beerdrink:
মেয়েটা যে কেন লেখে না বুঝি না। এতবার বলার পরে মাত্র একবার লিখল!
আর কতবার আপনাকে সাধাসাধি করতে হবে আপামণি? :wallbash:
গল্পের চিন্তাধারা, প্রশ্ন, বোধ, উপলব্ধি প্রথমবারের তুলনায় বেশ ভালো লেগেছে। লিখতে থাক, আরো ভালো হবে, আমি জানি। 🙂
একটা টাইপো আছে-
শশুর> শ্বশুর (বিয়ের আগেই শ্বশুর বানান ঠিকঠাক জেনে রাখা ভালো) 😛
ফিনিক্স পাখি না দেখলে কি আর বানান নিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়? তারপরেও, মাত্র একটা ভুল ধরা পড়ল দেখে বিস্মিত হলাম! 😯
‘শ্বশুর’ বানান ভুল করা তো দণ্ডনীয় অপরাধ হবার কথা! 😛
আমার প্রথম লেখা, ভালো লেগেছে অনেক জেনে খুশি হলাম আপু। :beshikhushi:
সুন্দর একটা গল্প পড়ার জন্য আনন্দিত হব না ইরিত্রার জন্য মন খারাপ করব বুঝতে পারছি না. . . 🙁
একটা জিনিস-ই চাইব- নিয়মিত গল্প, জীবনধর্মী. . .
:welcome:
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। চেষ্টা থাকবে লেখার। 🙂
সুন্দর হয়েছে।
নিয়মিত লেখ। আমার মত অমাবস্যার চাঁদ হয়ে যেওনা। 😀
আগে মাল্টি-টাস্কিং তন্বী আপু হবার চেষ্টা করি……………… তারপর নাহয় অমাবস্যার চাঁদ হওয়া যাবে! 😛
*** দৃষ্টি আকর্ষণীঃ ‘Reply’ তে ক্লিক না করে কমেন্টের উত্তর দিলে কারো কাছে নোটিফিকেশন যায় না। উপরের বেশ কয়টা কমেন্টে তুমি এমন করেছ। কেউ যদি এমনিই ঘুরতে আসে (যেমন এখন আমি আসলাম 😛 ) তবেই শুধু টের পাবে, নচেৎ নয়। বিষয়টা খেয়াল রেখো। 🙂
তাই তো করেছিলাম মনে হয়…… কী জানি! :thinking:
শব্দের বুনোট আগ্রহী করে রাখে শেষটা জানার।
সুখপাঠ্য। আরো পড়তে চাই! 🙂