অ্যাকশন সিনেমা আমার আম্মুর দুই চোখের বিষ। ‘পয়সা খরচ করে মারামারি দেখার কোন মানে নাই!’ আমাদের আবদারে আম্মুর স্ট্রেইটকাট জবাব। তবুও শেষমেশ Avengers দেখতে যেতে রাজি করাতে পারলাম, উপলক্ষ “থ্রিডি সিনেমা” নামক অত্যাধুনিক এক প্রযুক্তির বঙ্গে আগমন!
গতানুগতিক সিনেমার সাথে এর মূল পার্থক্য হল, এতে স্ক্রিনের কোন্ বস্তুটি সামনে আর কোনটি পিছনে এই আন্দাজ পাওয়া যায়, ঠিক বাস্তব জীবনের মত! মুভি চলার সময় একটি নিরীহদর্শন চশমা পরতে হয়, ব্যস। বস্তু বা মানুষের পারস্পরিক দূরত্বের এই নতুন অনুভূতির জন্যই Avengers এর কাহিনী নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলেও আম্মু মুভি দেখে ব্যাপক খুশি! :happy:
থ্রিডি প্রযুক্তি কীভাবে কাজ করে সে আলোচনার আগে আমরা দৈনন্দিন জীবনে কীভাবে ত্রিমাত্রিক বস্তু দেখে থাকি তার যৎসামান্য ধারণা প্রয়োজন।
নিজে করুন (!):
নাকের সামনে একটি আঙুল ধরুন। এবার বাম চোখ বন্ধ করে আঙুলের দিকে একবার তাকান, তারপর ডান চোখ বন্ধ করে আরেকবার। কী বুঝলেন? একই আঙুল দেখছেন, অথচ দুটি ভিন্ন দিক থেকে! দুটি ভিন্ন ছবি!
আমরা যেই বস্তুর দিকেই তাকাই না কেন, বাম চোখ এবং ডান চোখ একই জিনিসের দুরকম ছবি দেখতে পায়, যেগুলো একটি আরেকটির চেয়ে খুব সামান্য
হলেও আলাদা। এই দুটি সিগনাল মস্তিষ্কে পাঠানো হয়, মস্তিষ্ক কিছু অছাম জ্যামিতি কষে নেয় নিমেষেই, আর দুটি ছবির সমন্বয়ে আমরা বস্তুটির একটি ত্রিমাত্রিক ধারণা পাই। একে বলা হয় দ্বিনেত্র দৃষ্টি বা বাইনোকুলার ভিশন। উচ্চ মাধ্যমিক প্রাণিবিজ্ঞানে এটি আলোচনা করা হয়।
অতএব,
থ্রিডি ধারণা পেতে হলে আমাদের একই বস্তুর দুটি ভিন্ন ছবি দরকার, যেগুলো সামান্য আলাদা অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা। এই দুটি ছবি একত্রে দেখলেই বাকি দায়িত্ব ব্রেন বাবাজির! 😀 আপনার চোখের এই বৈশিষ্ট্য ঠিকমত কাজ করছে কিনা এখানে টেস্ট করিয়ে নিতে পারেন লাইক আ বস।
যাইহোক, ঠিক এই মূলনীতিই কাজ করে থ্রিডি সিনেমার ক্ষেত্রে।
এবারে আসি মূল প্রসঙ্গে
চালু বাঙালী এরই মধ্যে বুঝে গিয়েছেন জল কোনদিকে গড়াচ্ছে। সিনেপ্লেক্সে আপনি যেই নিরীহদর্শন ‘সানগ্লাস’টা দিয়ে মুভি দেখছেন, সেটাই সত্যিকার অর্থে আপনার মস্তিষ্ককে ঘোলাজল খাইয়ে ছাড়ছে। সোজা বাংলায় বলতে গেলে, সানগ্লাসটির দুটি কাঁচে প্রত্যেকটি দৃশ্যের দুটি ভিন্ন ছবি দেখা যায়, যেগুলো সামান্য আলাদা অ্যাঙ্গেলে তোলা!
আর যায় কই। আপনার ব্রেন এই দুটি ছবিকে একত্র করে নেয়, আর আপনি ত্রিমাত্রিক অভিজ্ঞতা লাভ করে আহা উঁহু করেন! 😀
এখন কথা হল, সিনেমার পর্দা তো একটাই। তাহলে সানগ্লাসের দুই চোখে আলাদা ছবি আসবে কীভাবে? যাঁরা ইতোমধ্যে থ্রিডি মুভি দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই প্রথম প্রথম নানা রকম এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। চশমা পরে দেখতে কেমন লাগে, আর চশমা খুলে কেমন লাগে সব বাজিয়ে দেখেছেন। আর আমার মত প্রফেশনাল বান্দর টাইপ পাবলিকেরা উলটা করে চশমা পরে দেখেছেন, চশমার পিছন দিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন, এক চোখ বন্ধ করলে কেমন দেখা যায় সেটাও চেখে দেখেছেন। আর ডাকফেইস আপাদের কথা বাদ দিলাম, উনারা তো এই চশমা পরা ডাকফেইস ছবি ইতোমধ্যে আপ্লোডায়েও ফেলেচেন।
যাইহোক, এই এক্সপেরিমেন্ট করার সময় খেয়াল করে দেখবেন, খালি চোখে স্ক্রিনের ছবি বরং ঘোলা দেখায়! মনে হয় দুটি ছবি একটু যেন পাশাপাশি আছে, অনেক সময় নষ্ট টিভিতে যেমনটা দেখা যায়!
এখানেই আসল জিনিয়াস কারবার। খালি চোখে যেই দুটো ছবি আপনি পর্দায় একত্রে দেখতে পাচ্ছেন, চশমার কাঁচ এদেরকে পৃথক করতে পারে– প্রতি চোখের গ্লাস সেই দুটি ছবির মধ্যে মাত্র একটিকে যেতে দেয়, আরেকটি আটকে দেয়! ফলাফল স্বরূপ, দুই চোখে দুরকম ইমেজ আপনি দেখতে পান, যেগুলো কিঞ্চিত আলাদা অ্যাঙ্গেলের! বাকি কাজ ব্রেনের।
তা না হয় হল। কিন্তু চশমার প্লাস্টিক একই স্ক্রিন থেকে আসা ছবি দুটোকে পৃথক করল কীভাবে?
উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থবিজ্ঞানে আলোর পোলারায়নের [Polarization] নাম শুনেছিলেন, মনে পড়ে? সেটাই ব্যবহৃত হয় এখানে! ব্লগে টেকনিক্যাল ক্যাচাল পাড়লে পোলাপান পচা টমেটো ছুঁড়বে, তাই পোলারায়নের ফিরিস্তি এড়িয়ে যাচ্ছি। খুব সহজ ভাষায় বললে, খালি চোখে স্ক্রিনে যেই দুটো ছবি দেখা যায়, তাদের আলোকীয় বৈশিষ্ট্য আলাদা, দুটি আলাদাভাবে পোলারাইজড। চশমার কাঁচ দুটিও ঠিক সেভাবেই পোলারাইজড থাকে, তাই দুটি কাঁচের রেসপন্স আলাদা হয়, দুটিই শুধু তাদের পছন্দের একটি করে ছবিকে যেতে দেয়, আর আমরা দুই চোখে দুই রকম দেখি। ব্রেন দুরকম ছবি থেকে ত্রিমাত্রিক ধারণা বুঝে নেয়।
[জ্ঞানীয়াস পাঠকরা এখানে আরেকটু জেনে নিতে পারেন, আমাদের পরিচিত লিনিয়ার পোলারাইজেশন এখানে ব্যবহৃত হয় না, বরং সার্কুলার পোলারাইজেশন ব্যবহৃত হয়। তা না হলে, মাথা পুরো সময় কাঠের মত সোজা করে বসে থাকতে হত! কপাল ভালো সার্কুলার পোলারায়ন বলে কিছু আছে, নাহলে আপনি প্রিয় মানুষটির কাঁধে মাথা রেখে মুভি দেখতে গেলেই বারোটা বাজত!]
সিনেমা তৈরি পদ্ধতি
পর্দায় দুই চোখের উপযোগী ছবি ফেলার জন্য মুভি শুটিংও করতে হয় থ্রিডি ক্যামেরায়।
থ্রিডি ক্যামেরায় দুটি লেন্স থাকে, মানুষের চোখের মতই একটু দূরত্বে আর নির্দিষ্ট কোণে। ফলে, আমরা বাস্তব জীবনে দুই চোখে যেই দুটি ছবি দেখতাম, ঠিক সে দুটোই সংরক্ষিত হয়, পরবর্তীতে দুটোই একত্রে সিনেমা হলের পর্দায় ফেলা হয়!
থ্রিডি অ্যানিমেশন কার্টুনের ক্ষেত্রে কাজটা তুলনামূলক সহজ। এখানেও প্রতিটি দৃশ্যের দুটি করে ইমেজ সেইভ করা হয় আমাদের চোখের মানদণ্ডে, আর প্রদর্শনীর সময় দুটো ছবিই একত্রে দেখানো হয়।
থ্রিডি মুভি প্রদর্শনের আরও অনেকগুলো উপায় আছে। এই লেখায় মাত্র একটি আলোচনা করেছি, বাকিগুলো দেখে নিতে পারেন এখানে। লেখার ভুল চোখে পড়লে ধরিয়ে দেয়ার অনুরোধ থাকল, ঠিক করে নেব!
:yahooo: :happy:
:penguindance:
:happy: :happy: :happy:
:thinking:
সার্কুলার পোলারাইজেশন টা জানতাম না… শিখলাম 🙂
হুম, একটা ব্রিলিয়ান্ট সলিউশান! কাষ্ঠ হয়ে মাথা সোজা রাখতে বাধ্য হলে মুভি দেখে শান্তি পাওয়া যেত না! 😛
একটা মজার এক্সপেরিমেন্ট করতে পারেন! পরবর্তীতে কখনও থ্রিডি মুভি দেখার সময় চশমার পিছন দিয়ে দেখার ট্রাই করতে পারেন [অর্থাৎ চশমার কানের সাপোর্টটা পিছনের বদলে সামনের দিকে ধরে]; থ্রিডি ইফেক্ট কাজ করবে না! সার্কুলার পোলারাইজেশনের আবশ্যক ওরিয়েন্টেশন থাকবে না যে! 😛 😛 😛 😀
খুব ভাল লিখছো, দারুণ সুখপাঠ্য। 😀 এটা পড়েই ঠিক করে ফেললাম মুভি দেখতে যাবো। :happy:
অ্যাভেঞ্জার্স বা স্পাইডারম্যান কোনটাই আহামরি কোন মুভি না। এই থ্রিডি অভিজ্ঞতা লাভই আসল উদ্দেশ্য! 😀 😀
কেমন করে এই চশমা বানানো যায়, তা লিখে দিলে ভালো হতো। বাসায় বসে ডাউনলোড করে যদি দেখা যেত…… 😛
উঁহু। থ্রিডি মুভির জন্য হলের পর্দাটাও স্পেশালাইজড। সাধারণ মনিটর পারবে না দুধরণের পোলারায়ন সৃষ্টি করতে, তার জন্য থ্রিডি মনিটর লাগবে! [ঠিক যেমনভাবে হাই ডেফিনিশন ছবি দেখার জন্য এইচডি মনিটর লাগে] থ্রিডি টেলিভিশন/ হোম থিয়েটারে সেই বিশেষ ধরণের স্ক্রিনের ব্যবস্থা থাকে।
আর সেই চশমাটা আর কিছুই নয়, স্রেফ একটা পোলারাইজার! [সমাবর্তক ক্রিস্টালের কথা পড়েছি অনেকেই, এখানে তার সিমপ্লিফাইড কমার্শিয়াল ভার্সন ব্যবহৃত হয়।]
সুতরাং বাসায় বসে দেখতে হলে কিছু দানাপানি খরচ করতে হবে দাদা 😀
দানাপানি নাই কেনু :wallbash:
নিচে সুবর্নরেখার কমেন্টটি দেখুন, দুর্দান্ত আইডিয়া! আমার জানা ছিল না!
:clappinghands:
অনেক কিছুই জানতে পারলাম 😀
😀
থ্রিডি মুভি নিয়ে আসলেই এত কিছু জানতাম না ! মানে আমার কাছে অযথাই মনে হত। তবে এই লেখা পড়ে বিয়াপক আকাংক্ষার উদ্রেক হল এইরকম একখানি মুভি দেখার !! 😀
😛
দারুণ লিখসিশ :clappinghands:
ধন্যযোগ! 😀
km player e dekha jabe na? ami 300 tk die glass kinbo
দেখা যাবে, থ্রিডি আমেজ পাওয়া যাবে না আরকি 😛
লাইক আ বস চাষীর ‘লাইক আ বস’ মার্কা পোস্ট! :clappinghands:
এই লন একটা কোক :beerdrink:
অল হেইল গোজ টু ‘লাইক আ বস’!
চিয়ার্স! :beerdrink:
নতুন অনেক কিছু জানলাম।
ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ! 😀
স্বপ্ন বিলাস বলেছেন :
জানুয়ারি 18, 2013 at 1:13 অপরাহ্ন
কেমন করে এই চশমা বানানো যায়, তা লিখে দিলে ভালো হতো। বাসায় বসে ডাউনলোড করে যদি দেখা যেত……
:happy: :happy: :happy:
অনেক কিছু জানলাম …….. আমি হিন্দী একটি 3d সিনেমা দেখেছিলাম-হরর, বাসার টিভিতে… কিন্তু তা প্রায় সাধারণই মনে হয়েছিল, এখন বুঝত পারছি সিনেমাহলে না দেখলে আসলে 3d দেখা বিফল….
“নতুন অনুভূতির জন্যই Avengers এর কাহিনী নিয়ে কনফিউজড হয়ে গেলেও আম্মু মুভি দেখে ব্যাপক খুশি!”….
যাক এরপরে আর পয়সা খরচ করে মারামারি দেখতে সমস্যা হবে না 🙂 🙂 🙂
হাহা 😀
:yahooo:
😀 😀
আমার মনে হয় যারা শুধুমাত্র 3D দেখার অভিজ্ঞতা লাভের জন্য হলে যেতে চান, তারা চাইলেই মুভি 3D তে কনভার্ট করার জন্য সফটঅয়্যার ডাউনলোড করে নিতে পারেন । আর তারপর খুব সহজেই দুই রঙ্গা চশমা বানিয়ে ঘরে বসেই 3D উপভোগ করতে পারেন । আমরা বাসায় বানাইছিলাম একটা । অইটা ছিল, লাল আর সবুজ । এইরকম আরো বেশ কয়েক রঙেরই বানানো যায় । যে কোন প্লাস্টিক এর কাগজে মার্কার দিয়ে রঙ করে নিলেই হয় । ব্যাপারটা আরো বেশী মজার এবং সস্তা ! 😀
বাহ! 😀