খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে রাতের হাওয়া ঢুকছে । একটু শীত শীত করছে । কিন্তু জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে করছে না । এই হাওয়ার এমনই বৈশিষ্ট্য যে একে ঠিক ঘরের ভেতর ঢুকতে দেওয়া উচিৎ নয়,আবার ভাল লাগার কারনে মুখের উপর কপাট লাগিয়ে দেওয়া ও উচিৎ নয় । বিষয়টি এমন,আসছে আসুক!আমি তো তাকে ডেকে আনি নি ! থেমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে নিজেই থেমে যাবে । তার উপস্থিতি আমায় ভাল লাগার মৃদু অনুভূতি দিয়ে যায়,তবে তার
অনুপস্থিতি মনের মাঝে বিষাদের ছাঁয়া ফেলতে পারে না ।
ঘরের আলোটা নেভানো দরকার । আলোটা খুব চোখে লাগছে । বিরক্ত লাগছে স্যতস্যতে সাদা আলোটা । শুধু যে ঘরের আলোর উপরই বিরক্তিভাব এসেছে,বিষয়টা এমন নয় । বিরক্তিভাবটা আশেপাশের সব কিছুর উপরই সমান ভাবে বিচরণ করছে।
বেশী বিরক্ত লাগছে নিজেকে । নিজেকে বিরক্ত লাগার যথেষ্ট কারন আছে । অনেক দিন ধরে কিছুই লিখতে পারছি না । এমন না যে আমার মাথার ভেতরটা মরুভূমি হয়ে আছে ! মাথার ভেতর সবুজ গাছপালা আছে,নিয়মিত তারা ফল দিচ্ছে । কিন্তু কোন এক অজানা কারনে সেই ফল আমি এক্সপোর্ট করতে পারছি না । ফল পঁচে যাচ্ছে । ফলের পঁচে যাওয়া গন্ধ প্রতিনিয়ত পাচ্ছি আমি । খুব বিশ্রী গন্ধ !
আমি এখন যে সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি,এটাকে বলা হয় “রাইটার্স ব্লক” । ভীষন যন্ত্রনাদায়ক একটি বিষয় । এই যন্ত্রনাদায়ক বিষয়ের মুখোমুখি যে এবারই প্রথম তা কিন্তু নয় ! আগে ও অসংখ্যবার যন্ত্রনাদায়ক এই বিষয়টির মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে । প্রতিবারই মনে হয়েছে,সময় নিয়ে লিখতে বসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । প্রতিবারই ঠিক হয়ে গেছে । কিন্তু এবারের বিষয়টি ভিন্ন । যতবারই চিন্তা করছি,সময় নিয়ে লিখতে বসলেই
সব ঠিক হয়ে যাবে,ততবারই ভেতর থেকে কেউ একজন মাথা নেড়ে বলছে,”উহু” !
লেখালেখি করার যন্ত্রনা অনেক । যারা নতুন লেখালেখি শুরু করে,এরা নিতান্তই ভাল লাগে বিধায় লিখে থাকে । কিন্তু লেখালেখি যাদের কাছে নেশার মত,তাদের বিষয়টি ভিন্ন । অল্প কিছুদিন লিখতে না পারলেই কেমন যেন একটা চাপা কষ্ট হয় । এই চাপা কষ্টটা যখন চারা গাছ থেকে বড় গাছে পরিনত হয়ে যায়,তখন পৃথিবীটা অর্থহীন মনে হয় । এমন লেখক ও আছেন,যারা আত্মহত্যা করেছেন কিছু লিখতে না পারার হতাশায় । এসব বিষয়ে
সাফায়াত ভাই খুব ভাল বলতেন । মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিতে দিতে বলতেন,“ইতিহাসে এমন অনেক লেখকের নাম পাবি,যারা “রাইটার্স ব্লক” সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেছে । আমার আফসোস লাগে ঐসব লেখকদের জন্য,যারা বোকার মত সুইসাইড করেছে । আরে ! লেখালেখিই কি সব নাকি যে জীবনটাই দিয়ে দিতে হবে ? জীবনটা মুদির দোকানের কোন এক কোণে পড়ে থেকে গলে যাওয়া চিনির প্যাকেট নয় যে ধরে নিয়ে পাশের ডোবায় ফেলে দিয়ে ঝামেলা
মুক্ত হয়ে গেলাম।”
আমি যে সময়ে নিজের লেখা কবিতা বন্ধু-বান্ধবদের শোনানো বাদ দিয়ে,রাত জেগে ছোট গল্প লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি,সে সময়ে সাফায়াত ভাই ছিলেন এদেশের সাহিত্যাঙ্গনে মোটামুটি পরিচিত একটি মুখ । কয়েকটি উপন্যাস লিখে তিনি সাড়া ফেলে দিয়েছেন ততদিনে । সেই সাফায়াত ভাই যখন নির্জন এক দুপুরে,নিজের ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লেন,সেদিন খুব বেশী অবাক হয়েছিলাম আমি । যে মানুষটা একের পর এক ভাল লিখে সাফল্য
পেয়ে চলেছেন,তার এভাবে ঝুলে পড়াটা স্বাভাবিক ভাবেই অস্বাভাবিক হিসেবে বিবেচিত হওয়াটা খুব দোষের কিছু নয় ।
হয়েছিল ও তাই । সাফায়াত ভাইয়ের পরিচিত মানুষেরা বললেন,মৃত্যুর আগের কয়েকদিন তিনি পাগলের মত আচরন করতেন । চোখ লাল থাকতো বেশীর ভাগ সময় । উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন একেবারেই !
আমি মানুষের কথায় তেমন একটা গুরুত্ব দিই নি । মানুষের স্বভাবই হচ্ছে না জেনে ও জানার মত করে কথা বলা । আর যে মানুষটার বিষয়ে কথা বলা হবে,সেই মানুষটি যদি একটু পরিচিত মুখ হন,তাহলে গুজব ছড়াবে আরো বেশী । তাই মানুষের কথাই কান দেওয়ার কোন প্রয়োজন অনুভব করিনি আমি ।
আমি একদিন নিশা ভাবীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম । সাফায়াত ভাইয়ের সাথে কয়েকবার তার বাসায় যাওয়ার কারনে,ভাবী আমাকে চিনতেন আগে থেকেই । তবে খুব বেশী কথা হয় নি কোন দিন তার সাথে । নিশ্চুপ থাকা ঐ মানুষটা,আমার সামনে বসে যখন ডুকরে কেঁদে উঠছিলেন সেদিন,আমার খুব অসহায় লাগছিল । নিশা ভাবী কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,“আমাকে শুধু বলতো,”নিশা ! আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছি । সব কিছু অর্থহীন লাগে । আমি লিখতে
পারছি না কেন ?”
মৃত্যুর আগের রাতে আমাকে ডেকে বললো,”আমার মনে হয়,আমার যা লেখার ছিল,তা লিখে ফেলেছি । আমার দ্বারা আর লেখালেখি সম্ভব না । তুমি এক কাজ কর । কিচেন থেকে দেয়াশলাই নিয়ে আসো । লেখার খাতাটা পুড়িয়ে ফেলবো ।”
আমার অপেক্ষা না করে নিজেই কিচেন থেকে দেয়াশলাই নিয়ে এসে লেখার খাতাটা পুড়িয়ে ফেললো ।”
নিশা ভাবী আবার কাঁদতে শুরু করলেন । আমি উঠে চলে আসলাম । সামনা সামনি বসে একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের কান্না দেখার মত শক্ত হতে পারি নি বোধহয় তখনো । রাস্তায় হাটতে হাটতে শুধু সাফায়াত ভাইয়ের বলা কথাগুলোই মনে পড়ছিল,“ইতিহাসে এমন অনেক লেখকের নাম পাবি,যারা “রাইটার্স ব্লক” সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেছে । আমার আফসোস লাগে ঐসব লেখকদের জন্য,যারা বোকার মত সুইসাইড করেছে । আরে ! লেখালেখিই কি সব
নাকি যে জীবনটাই দিয়ে দিতে হবে ?”
জানালা দিয়ে এখনো বাতাস ঢুকছে । জানালার ওপারের আকাশে বড় একটা চাঁদ ঝুলে আছে । জানলা বন্ধ করে ওপাশের চাঁদটাকে আড়াল করি আমি ।
টেবিল ছেড়ে আমার খোলা বারান্দার দিকে এগোই আমি । আমার খোলা বারান্দায় চাঁদের আলো এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে । পাশের উঁচু বিল্ডিঙটা খুব যত্ন করে চাঁদটাকে আড়াল করে রেখেছে কিন্তু চাঁদের আলোকে আড়াল করতে পারে নি । খোলা বারান্দার রেলিঙের উপর দাড়াই আমি । ঘাড় ঘুরিয়ে আলো নেভানো আমার রুমের ভেতরটা দেখি আমি । আমার লেখার খাতায় জ্বলতে থাকা আগুন নিভে এসেছে প্রায় ।
নিচে কোথাও একটা কুকুর ডাকছে । আমি নিচে তাকাই । অনেক নিচের রাস্তার উপর ও চাঁদের আলো লুটিয়ে পড়েছে । কুকুরটাকে কোথাও খুঁজে পাই না । আচ্ছা,বিরক্তিকর চাঁদটা কালো রাস্তার উপর এত মায়া ছড়াচ্ছে কেন আজ ?
– মোস্তাফিজুর রহমান শুভ
লেখাটা সুন্দর, স্মুথ! ভালো লাগলো পড়তে গিয়ে।
শুরুর দিকে একটু হুমায়ূনীয় লেগেছিল, পরে আর না।
😀 :welcome:
লেখাটি দেওয়ার পর থেকে কয়েকবার উঁকি দিয়ে দেখেছি কেউ কোন মন্তব্য করেছে কি না ! প্রথম সব কিছুতেই কৌতূহল একটু বেশি থাকে কি না ! ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
আমি তো এতদিন ধরে লিখেও বার বার উঁকি দেই মন্তব্যের জন্য। 😀
আমি সরবে নতুন তু,এই কারনে কৌতূহলটা একটু বেশি । 🙂
টাইপোর জন্য দুঃখিত ।
সরব এ স্বাগতম।
দাঁড়ি নিয়ে একটা কথা বলি, এইভাবে দিন। এইভাবে নয় ।
বুঝতে পেরেছে স্পেসটা কোথায় দিয়েছি। এতে ভালো লাগবে দেখতে।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজেই এই অবস্থায় আছি…পুরাই ধরার উপর!
বুঝতে পেরেছি।
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
দোয়া করি,খুব তাড়াতাড়ি আপনার বর্তমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটুক 🙂
:welcome:
ভালো লিখা
বিরামচিহ্নগুলি একটু ঠিক করে নিবেন
আশা করি নিয়মিত লিখবেন 🙂
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
বিরাম চিহ্নের বিষয়টি দেখবো 🙂