মহাকাশে একদিন

কামরুল সাহেবের আজ বড়ই দুর্দিন ।

এমনিতে তাহার জীবনে কোন কিছুরই অভাব ছিলনা । সুদূর আমেরিকায় তাহার বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ভাল চাকরিও আছে । শুধুই একটা বউ নাই । জীবনের ৩০টা বছর পাড়ি দেয়ার পরেও বিবাহের পিঁড়িতে বসিবার সৌভাগ্য হয়নাই তাহার । তাহার পিতা, পিতামহ, মাতা, মাতামহ, আত্মীয়স্বজন চৌদ্দগোষ্ঠী সকলে মিলিয়াও এতদিনে একটি বউ জোগাড় করিতে পারেন নাই তাহার জন্য । কারণ অবশ্য কামরুল সাহেব নিজেই । তাহার নাকি কনে পছন্দ হয়না ।

এরপর জীবনের ৩০তম বয়সে এসে পড়িলেন এক বঙ্গ ললনার প্রেমে । এক বন্ধুর বিবাহ উৎসবে তাহাদের পরিচয় । কন্যার নাম জাকিয়া । আহা ! কী সুন্দর সেই নাম, আর তার মুখশ্রী ! একেবারে কামরুল সাহেবের অন্তরটা জাঁকিয়া বসিয়াছেন কন্যা । সেই দিন থেকেই কামরুল সাহেবের জীবনের চাওয়া পাওয়া গেল বদলাইয়া । কীভাবে করিয়া অবিবাহিতা, সুন্দরী কন্যা জাকিয়া আফসানার মন জয় করা যায় এইটাই তাহার একমাত্র মাথা ব্যথা হইয়া উঠিল । একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, সবই ।

জাকিয়ার মনটাও তো প্রায় কামরুল সাহেবের দখলেই চলিয়া যাইতেছিল । শুধু আসল কথাটা পাড়াই বোধহয় বাকি ছিল । হায়রে ডিসেম্বরের সেই শীতল সন্ধ্যা ! তোমার কথা কি কামরুল সাহেব পারিবে কোনদিনও ভুলিতে ?  বোধহয় না ।

সেই সন্ধ্যায় কথা ছিল কামরুল সাহেবের বিয়ের কথাটা পাড়ার । কিন্তু জাকিয়াও তো আর কম বুদ্ধিমতী নন ! তিনি কিন্তু ঠিকই কামরুল সাহেবের মনের কথাটা পড়িয়া ফেলিয়াছেন । তাই কিনা সুযোগ বুঝিয়া আগেই কামরুল সাহেবের সত্যবাদিতার স্বরূপখানা যাচাই করিয়া নিতে চাইলেন !

কামরুল সাহেব কি আর বুঝে শুনে চাপাবাজিটা করেছিলেন ! সেইটা তো ছিল কেবল একটা কথার কথা ! এই কথা সত্য যে তাহার শিশুকালে প্রবল ইচ্ছা ছিল মহাকাশে ঘুরিবার, মহাকাশের ভরশুন্য পরিবেশে ওলটপালট নাচ দিবার । আবার এই কথাও সত্য যে বর্তমানের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার কামরুল সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু কিনা মহাকাশচারী । কিন্তু তাই বলিয়া এই কথা মোটেও সত্য ছিলনা যে বন্ধু জাস্টিনকে বলিলেই সে কামরুল সাহেবকে মহাকাশ থেকে ঘুরাইয়া আনিতে পারিবে !

বন্ধু জাস্টিন থাকে কেনেডি স্পেস সেন্টারের ম্যানেজমেন্ট প্রাক্টিস এ । তাই সে একদিন তাহাকে খেলাচ্ছলে বলিয়াছিল যে, সে চাইলেই নাকি তাহাকে পাঠিয়ে দিতে পারিবে মাইক্রোগ্রাভিটি মন্ডলে । কিন্তু কামরুল সাহেব এবং আর্নেস্ট জাস্টিন উভয়েই জানিত, তাহা দুষ্টুমি বৈকি আর কিছুই ছিলনা ।

এমনি বিপদে পড়িয়া কামরুল সাহেব পড়িলেন জাস্টিন এর পায়ে । তিনি জীবনে কোনদিন কাঁদিয়াছেন কিনা, দাদী মারা যাবার সময় বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়া পড়িয়াছিল কি পড়েনাই, তাহার মনে পড়েনা । তবে এই যাত্রায় কল্পনার রানী জাকিয়াকে না পাওয়ার কথা যতবারই তাহার মাথায় আসিতেছে, বারে বারেই গলায় কিছু একটা দলা পাকাইয়া উঠিতেছে । এমন দুঃখও বুঝি মানুষের জীবনে আসে ! বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম ৫০জন এর মাঝে থাকতে না পারার দুঃখও বুঝি এর কাছে কিছুই ছিলনা !

বন্ধু জাস্টিন আমেরিকার মানুষ, বোকা বাঙ্গালীদের ভালবাসার জন্য এমন পাগলামী বুঝিবা দেখিবার সৌভাগ্য তাহার হয়নাই । যাহাই হউক, জাস্টিন এর মন গলিল । সে আশ্বাস দিল, উপায় একটা হইতে পারে । তাহার এক পাড়াতো ভাতিজা হেনরির নাকি জনসন স্পেস সেন্টারে প্রি ফ্লাইট ট্রেইনিং নিতে যাওয়ার কথা এইবারে, তাহার নাকি গতবারের ট্রেইনিং এ পাশ হয়নাই । সে দ্বিতীয়বার ট্রেইনিং নিতে প্রবলভাবে অনিচ্ছুক, তাহার স্থানেই যাইবে কামরুল । শুনিয়া তো কামরুল সাহেব এর আনন্দে চোখ দিয়ে টপ টপ করিয়া পানি গড়াইয়া পড়িল !

সে ও এক সময় ছিল বৈকি । কী এক বিচিত্র অনুভূতি ! তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিবেননা কোনদিনই কামরুল সাহেব । আর আমার পক্ষে তাহার অনুভূতি প্রকাশ করতে যাওয়া তো রীতিমত দুঃসাহস এর শামিল ! একদিকে মহাকাশে প্রথম বাঙ্গালী হয়ে উড়তে যাওয়া, আরেকদিকে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকা, কখন আরেকজন এর জায়গায় লুকিয়ে ট্রেইনিং করতে গিয়া  ধরা খাইয়া যান পে লোড স্পেশালিস্টদের কাছে ! যাহাই হউক, জাকিয়া তো খুশি ! বলা যায় আনন্দে আটখানা । তাহার ট্রেইনিং নেয়ার দিন থেকে শুরু করিয়া মহা আগ্রহে দিন গুনিতেছিল কবে আসিবে সেই প্রতীক্ষিত দিন !

কামরুল সাহেবের মনের অবস্থা অবশ্য জাকিয়ার কোনদিনই বুঝার কথা ছিলনা । দিন যতই যাইতেছিল, তাহার রাতের ঘুম ততই হারাম হইয়া যাইতেছিল । চাকরির কারণে কিংবা অন্যের স্থানে বসিয়া খুব বেশী ট্রেইনিং নেয়া তাহার পক্ষে সম্ভব হয়নাই । ট্রেইনিং এ বারে বারেই বলিয়া দেয়া হইয়াছে পৃথিবীর মাটি আর মহাকাশ কখনোই এক নয়, যতই ট্রেইনিং নেয়া হউক না কেন ! শুন্য গ্রাভিটির কথা ভাবলেই তাহার পেট মোচড় দিয়া উঠে, ঘুমের মাঝে ছোটবেলার কাঙ্খিত ওলট পালট নৃত্য করিতে থাকেন তিনি । তবে এক্ষেত্রে সেই নৃত্য হয়ে যায় একটি অতিপ্রাকৃত এবং ভয়ংকর স্বপ্ন । আগে সুন্দরী জাকিয়াকে নিয়া ঘুরিতে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিতেন মাঝে মাঝে, দেখতেন দেশ ও দশের স্বপ্ন, কিন্তু এইগুলা বর্তমানে তাহার কাছে অতি সুখকর স্মৃতি মাত্র ।

যাহাই হউক, সময় তো বহিয়া যায় । অবশেষে সেই কাংখিত দুর্দিন আসিয়াই পড়িল । কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে অরবিটাল টেস্ট ফ্লাইটে নকল হেনরি অর্থাৎ কামরুল সাহেবের নাম উঠিল । লো আর্থ অরবিটাল স্পেস ক্রাফটে পা দিলেন কামরুল সাহেব ।

তাহার পরের ঘটনা অতি দ্রুত । সেই ক্ষণ আসিয়া গেল একসময় । তাহাদের সামনের কম্পিউটারে খুব দ্রুত সময় উঠিতে লাগিল । আর উঠিতে লাগিল আবহাওয়ার অবস্থা । প্রেসিপিটেশন, টেম্পারেচার, উইন্ড, লাইটনিং ফোরকাস্ট, হিউমিডিটি ইত্যাদি সবকিছুই নাকি তাহাদের অনুকূলে । তাহলে আর দেরী কেন ? স্পেসক্রাফট উড়াল দিল তাহাদের নিয়া ।

প্রথম কয়েক মিনিট এর কথা কামরুল সাহেবের মনে নাই । স্পেসক্রাফট এর প্রচণ্ড গতিবেগে যথারীতি অনভিজ্ঞ অ্যাস্টোনট হিসেবে জ্ঞান হারাইলেন তিনি । কয়েক ঘণ্টা পর যখনি তাহার জ্ঞান ফিরিল, তিনি আবিষ্কার করিলেন তাহার মাথা ভার হইয়া আছে, সারা শরীর ব্যথা করিতেছে । কিন্তু তাহার সবচেয়ে বেশী যেই বোধ প্রবল হইয়াছে তাহা হইল, প্রকৃতির ডাক !

মহাকাশে বেশীক্ষণ না, মাত্র বারো ঘণ্টা থাকিতে হইবে তাহাদের । এইটাও ট্রেইনিং এরই অংশ নাকি । তাই বলিয়া বাথরুম এর ট্রেইনিং নিতে যাবার গুরুত্ব বুঝতে পারেন নাই তিনি । এখন সিট থেকে আলগা হওয়ার পর থেকে স্পেসক্রাফটে ভাসিতে ভাসিতে, মহাকাশের দেয়ালে ধাক্কা খাইতে খাইতে, ওলট পালট ডিগবাজী খাইতে খাইতে তিনি বাথরুম ঠিক কতক্ষণ এইভাবে চাপিয়া রাখিতে পারিবেন, আন্দাজ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন । অবশেষে সেই হিসাব করিতে ব্যর্থ হইয়া অন্যান্য ক্রুদের সাথে কথাবার্তা বলিয়া আর নীল রঙের পৃথিবী দেখিয়া উহা ভুলিয়া থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালাইতে লাগিলেন ।

এমনি করিয়া কয়েক ঘণ্টা চলিয়া গেল । সময় যতই যাইতেছে, তিনি ততই অবস্থার ভয়াবহতা উপলব্ধি করিতে পারিতেছিলেন । তাইত আর দেরী না করিয়া অনভ্যস্ত শরীরে তিনি খুঁজিয়া বাইর করিলেন বাথরুম খানা ।

বাথরুম ট্রেইনিং এর উপর নাসা বেশ জোর দেয় । কামরুল সাহেব হেসেই খুন হয়েছিলেন একদা সেই কথা শুনে । সেই সময়কার হেলায় হারানো সুযোগ এর কথা মনে করিয়া তাহার কান্না আসিতে লাগিল ক্ষণে ক্ষণেই । আর চাহিয়া চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন অত্যধিক অপরিচিত, স্পেস্ক্রাফট এর সবচাইতে বিচিত্র যন্ত্রটাকে, যাহার নাম নাকি ওয়াস্ট কালেকশন সিস্টেম !

কিন্তু সময় যে আর নাই এই যন্ত্রের সৌন্দর্য অবলোকন করার ! কামরুল সাহেব দুই চোখে ঘোলা দেখিতে লাগিলেন । বারে বারে চোখ পিট পিট করিয়া প্রাণপণে ভয়ানক যন্ত্রটা ব্যবহার করার শেষ চেষ্টা করিতে করিতে স্নায়ুর উপর আর চাপ সহ্য করিতে না পারিয়া অবশেষে চোখ মুদিলেন WCS এর উপরেই !

এরপরের কাহিনী সবটা আর কামরুল সাহেবের মনে নাই । শুধু মনে আছে সহযাত্রী ক্রু দুইজন তাহাকে অনেক কষ্টে জ্ঞান ফিরানোর পরে একটা কিছু একটা পানীয় খাওয়ানোর চেষ্টা করিয়াছিলেন । সেই পানীয় তিনি আর মুখে নিতে পারেন নাই, তবে কিনা চোখের সামনে ভাসতে দেখেছিলেন । সেই ভয়ংকর দৃশ্য অবলোকনের পরে কামরুল সাহেব তৃতীয় বারের মত চোখ মুদিলেন ।

এভাবেই কিনা জীবনের অতি প্রতীক্ষিত এবং  বিচিত্রতম ঘটনার সমাপ্তি হইল কামরুল সাহেবের ! অবশ্য এই দুঃখজনক অভিজ্ঞতা পুরোটা একা লাভ করতে পারলেন না কামরুল সাহেব । সহযাত্রীদের অধিকারেই ছিল সিংহভাগ অংশটা ! ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনিং নেয়া সত্ত্বেও তাহারা আর সেই বাথরুম ব্যবহার করিতে পারিবেন কিনা তাহা আমরা না ই ভাবি !  সুন্দরী জাকিয়ার মন লাভ তো করা যাইবে ! পৃথিবীতে অবতরণের পরে কামরুল সাহেবের জন্য এইটা হইতে পারে অন্যতম সুখ ভাবনা । আর ক্রুদের কাছে নকল হেনরির ধরা খাওয়ার পরে বন্ধু জাস্টিন আর আসল হেনরির কী অবস্থা হইতে পারে, তাহাও আমরা আর না ভাবি !

মুনীরা মারদিয়া সম্পর্কে

একজন ঘুমকুমারী ।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, বিবিধ, রম্য-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

14 Responses to মহাকাশে একদিন

  1. হাসান বলেছেনঃ

    মহাশূণ্যে ভাসার যে কিঞ্চিৎ মনের গহীনে ছিল আজ সেটাও লুপ্ত হেইতে চলিল… 🙁

    তবে এমন চমৎকার গল্পের মাধ্যমে সবাইকে সাবধান করে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

  2. শারমিন বলেছেনঃ

    বেশ মজার গল্প তো 😀

  3. অনাবিল বলেছেনঃ

    হাহহাহাহা……
    এমন গল্প আগে পড়া হয়নি…… খুব্বি মজারু…… :beshikhushi: :yahooo:

    [মঙ্গলে যাবার ইচ্ছে আমার ভীষণ…… চিন্তায় পড়ে গেলাম…… 🙁 ]
    কম কম ঘুমান আর বেশি বেশি লিখেন…… :happy: :love:

    • সুবর্ণরেখা বলেছেনঃ

      মজা লাগছে শুনে আনন্দিত হইলাম ! 😀

      মঙ্গলে যাবেন, তাতো বড়ই ভাল কথা । ট্রেইনিং ঠিকমতন নেয়া থাকলেই চলবে ! 😛

      আপনার কম ঘুমানোর পরামর্শের জন্য অসংখ্য :love:
      এই ছুটিতে একদিন একটু কম ঘুমাইছিলাম । (সকাল সাড়ে নয়টায় ঘুম থেকে উঠছিলাম !!) সেইদিন ই গল্পটা লিখে ফেলছি ! কম ঘুমানো আসলেই ভাল !

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    কতদিন ধরে যে মহাকাশে গিয়ে দুইটা ডিগবাজি খাবার ইচ্ছা ছিল, কী আর বলব!
    কিন্তু এখন… :voypaisi:

    • সুবর্ণরেখা বলেছেনঃ

      অবশ্যই ডিগবাজি খাবা আপু ! :happy:
      ট্রেইনিং ঠিকভাবে নিয়ে যাবা । আর আজকাল তো মনে হয় ম্যাগনেটিক সোলের জুতা পড়ে মহাকাশযানে, ডিগবাজি খাওয়ার সুবিধা খুব বেশী নাই মনে হয় । 😛

  5. সাঈদ আনোয়ার অনুজ বলেছেনঃ

    মহাকাশ ভ্রমনের কিঞ্চিৎ অভিলাষ বসতি গড়িয়াছিল হৃদয় গহিনে। কিন্তু… 🙁

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।