আমার জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায় । এক চিলতে আকাশ । মাঝে মাঝে মনে হয়,আকাশটা অনেক নিচে নেমে আসে । চুপি চুপি যেন বলে যায়,পারলে ছুঁয়ে দাও তো আমায় ! মাঝে মাঝে চাঁদের আলোর অনধিকার প্রবেশে ভেসে যায় আমার ঘর । আমার চোখ রাঙ্গানিকে উপেক্ষা করে আমার ঘর জুড়ে খেলা করে চাঁদের আলো । মৃদু স্বরে আকাশকে বলি,আরো একটু নিচে নেমে আসো, বিরক্তিকর চাঁদটাকে খুলে ফেলে দিই…….
ছোটবেলায় আকাশ ছোঁয়ার খুব ইচ্ছে ছিল আমার । বাবা বলতেন,আমার না কি অদ্ভুত স্বভাব ছিল ছোটবেলায় । হাত বাড়িয়ে আকাশ ছুঁতে চাইতাম আমি । বাবা হেসে বলতেন,”আকাশ তো মরিচীকারে বোকা ! যতই হাত বাড়িয়ে দিবি,ততই দূরে সরে যাবে ! আকাশ কখনো ছোঁয়া যায় না । দূর থেকেই দেখে যেতে হয় রহস্যময় আকাশটা কে”।
ছোট্ট আমি এতকিছু বুঝতাম না । রাতের আকাশে অজস্র তাঁরা দেখে হাত বাড়িয়ে ডাকতাম,”আয়,আয়”।
আমার ডাক বোধহয় কখনো শুনতে পায় নি রাতের আকাশের অতন্দ্র প্রহরীরা । তবু আমি আশায় থাকতাম,কোন এক রাতে আকাশ থেকে নেমে আসবে দু একটি তাঁরা । আমি তাদেরকে বসতে দেবো আমার ছোট্ট টেবিলে । রাত জেগে গল্প করবো ওদের সাথে । গল্প করতে করতেই একসময় জানতে চাইবো,”রাতের বেলা তোমরা আকাশে ঘুরে বেড়াও কেন ? তোমাদের ভয় করে না ? রাতের বেলা তো আমার ভীষন ভয় করে !”
মা’কে খুব বেশীদিন কাছে পাই নি আমি । কোন এক ঝুম বর্ষার রাতে না কি ঘর ছেড়ে কোথায় চলে গিয়েছেন তিনি । মায়ের উপর অনেক অভিমান জমে ছিল ছোটবেলা থেকেই । আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম,মা যেদিন ফিরে আসবেন,সেদিন আমি তাকে না চেনার ভান করে বসে থাকবো । যে হঠাত্ করেই,কাউকে কিছু না বলে হারিয়ে গেছে,তাকে চেনার কি দরকার আমার ? অবশ্য তাকে আমি এমনিতেই চিনতে পারতাম না । তার মুখটা যে ততদিনে ঝাপসা হতে হতে মুমূর্ষ এক ছাঁয়া হয়ে,আমার স্মৃতির ভান্ডারে মাকড়সার অবাধ বিচরনরত অব্যবহৃত এক স্টোর রূমে স্থান পেয়েছে ! যে ছাঁয়া আলোর মাঝে দেখা যায় না,ঝাপসা আলোয় মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে আবার হারিয়ে যায় গাঢ় আধারের মাঝে !
মায়ের ছবি দেখার জন্য বাবার কানের কাছে ঘ্যনঘ্যন করেছি অনেক দিন । বাবা প্রতিবারই অসহায় মুখে বলতেন,”বিপদে ফেলে দিলি রে বাপ ! তোর মায়ের ছবি এখন কোথায় পাই ! বিয়ের সময় তোলা একটা ছবি আছে । সেই ছবি ছত্রাক আর ব্যক্টেরিয়া দখল করে নিয়েছে ।দেখি,ছবিটা স্টুডিও থেকে ঘষে মেজে আনতে পারি কি না…….”
আমার আর বাবার যৌথ পৃথিবীটা ছিল খুবই ছোট । কোন অনাবশ্যক অতিথির অত্যাচার নেই,অচেনা মানুষদের অনধিকার চর্চা নেই ।
শিক্ষক বাবার ছেলে হওয়ায়,বাবার সাথে তার স্কুলে যেতে যেতেই একসময় আবিস্কার করি,আমি স্কুল ড্রেস পরে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছি !
স্কুল আমাকে একদমই টানতো না । তবু যেতাম । স্কুলে যাওয়া আসার পথে,বাবার সাইকেলের বেলের টুংটাং আওয়াজের সাথে সুর সৃষ্টি করা তার কথাগুলো শুনতে খুব ভাল লাগতো আমার । যদিও সেই কথাগুলো আমার ছোট মাথায় খুব সহজে প্রবেশ করতে পারতো না…….
-“মানুষ চেনার সব চেয়ে সহজ উপায় কি জানিস ? মানুষের কাছে নিজেকে সহজলভ্য করে দেওয়া । সহজলভ্য পেয়ে যারা তোকে নিজেদের ইচ্ছে মত মুচড়ে মুচড়ে ব্যবহার করবে,বুঝে নিবি,এদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে । আর যারা তোকে সহজলভ্য হিসেবে পাওয়ার পরে ও,বিপদে ছাড়া ব্যবহার করবে না,বুঝে নিবি,এরাই এ যুগের ভাল মানুষ । এদের কাছাকাছি থাকা যায়”।
আবার কখনো কখনো বলতেন,
-“মানুষ খুব অদ্ভুত জীব,বুঝলি ? অনেকগুলো খোলস দ্বারা আবৃত হয়ে থাকে এক একটি মানুষ । যখন যে খোলসের প্রয়োজন পড়ে,তখন বাকী সব খোলস লুকিয়ে রেখে,প্রয়োজনীয় খোলসটা গায়ে চড়িয়ে বসে । প্রয়োজন শেষে আবার খোলসের পরিবর্তন ঘটে…….”
বাবার এসব কথা মনযোগী ছাত্রের মত মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শোনার মত সময় আমার তখন ছিল না । বাবার কথা শোনার চেয়ে,রাস্তার পাশের গাছ থেকে কয়টা পাখি উড়ে গেল,তা লক্ষ্য করাই ছিল আমার প্রধান কাজ । মানুষের চরিত্র নিয়ে কাটা ছেঁড়া করার চেয়ে পাখির চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামানোটাই আমার কাছে যৌক্তিক মনে হত তখন । বয়সের পার্থক্যের কারনে,বাবা আর আমার চিন্তা চেতনার জগৎ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা…….
বর্ষার সময়,আমাদের টিনের চালে অদ্ভুত আওয়াজ হত । বৃষ্টির ফোটা আর টিনের চালের অনেক দূরত্ব অতিক্রম করে মিলিত হওয়ার শব্দটা অদ্ভুত রকম ভয়ংকর মনে হত আমার কাছে । মাঝে মাঝে আশেপাশের কোন এক জায়গা থেকে ভেসে আসতো বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাওয়া আশ্রয়হীন কোন কুকুরের আর্তনাদের সুর । টিনের চালে ঝরে পড়া বৃষ্টির সুরের সাথে সুর মেলাতো আশ্রয়হীন কুকুরটা । প্রচন্ড ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতাম আমি । কাঁথার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে নীরবে কেঁদে যেতাম । কোন এক সময়,খুব আলতো একটা ছোঁয়া পেতাম মাথায় । অশরিরী কোন কিছুর ভয়ে আরো কুকড়ে যেতাম আমি । আর তখনই কাছ থেকে শুনতে পেতাম,
-“ভয় করছে না কি তোর ? ভয়ের কি আছে রে বোকা ! ঘরের ভেতর বিছানায় শুয়ে থেকে কি কেউ ভয় পায় ?”
আমি বাবার হাত জড়িয়ে ধরে বলতাম,
-“বাবা,কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেন । আমার ভয় করছে…….”
বাবা খুব শক্ত করে আমার হাতটা ধরে বলতেন,
-“ছেলেদের ভয় পেতে নেই…….”
বাবার জোড়া তালি দেওয়া সাইকেলটার প্রতি আমার কৌতুহল ছিল সীমাহীন । ছোট বেলায় কৌতুহলটা সাইকেলের বেলের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল । একটু বড় হওয়ার পর,কৌতুহলটা ছড়িয়ে পড়ে সাইকেলের চাকা,প্যডেল,ব্রেক আর সিটে ।
কোন এক বিকেল বেলায়,আমাকে সাইকেলের সিটে বসিয়ে,পেছন থেকে সাইকেলটা ধীরে ধীরে সামনে ঠেলে,আমার অনেক দিনের কৌতুহল মেটান বাবা । এক এক বার প্যডেলে চাপ দেওয়ার সাথে সাথেই যেন,রহস্যময় সাইকেল এক এক করে তার সব রহস্যময়তার জট খুলে দিচ্ছিলো আমার সামনে । রহস্য উদঘাটনে ব্যস্ত আমায় একলা ছেড়ে দিয়ে পেছনে দাড়িয়ে থাকেন বাবা । বাবার হাতের পরশ মলিন হতেই যেন সাইকেলটা বুঝে যায়,এত দিন তার ঘাড়ে বসে থাকা ছোট ছেলেটা,তার মাথায় চড়ে বসেছে ! জোড়া তালি দেওয়া বাবার সাইকেলটার আত্মসম্মান অনেক উচু থাকায়,আমাকে মাটিতে ফেলে দিতে খুব একটা কুন্ঠিত হয় না সে ! বারবার পড়ে গিয়ে,ব্যথার পর ব্যথা পেয়ে যখন আমি ডুকরে কেঁদে উঠি,বাবা তখন একহাতে সাইকেল,অন্যহাতে আমায় জড়িয়ে ধরে বাড়ির পথে হাটতে হাটতে বলতেন,
-“ছোট ছোট বাচ্চারা হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন উঠে দাড়ায় । উঠে দাড়ানোর কিছুক্ষন পর সে বুঝতে পারে,সে উঠে দাড়িয়েছে।উঠে দাড়ানোর আনন্দে যখন সে বিভোর,ঠিক তখনই সে মেঝেতে আছড়ে পড়ে । তার প্রথমবার উঠে দাড়ানোর আনন্দটা মিলিয়ে যায় কান্নার শব্দে । মানুষের জীবনটা অনেক কঠিন । বারবার পড়তে হবে,আবার উঠে দাড়াতে হবে । সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েই যদি এত কাঁদিস,পরে কি করবি ? কাঁদলেই কি তোর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ?”
বাবার কথা না বুঝেও,কেন যেন কান্নাটা থামিয়ে দিয়েছিলাম সেদিন ।
এরপর থেকে একা একাই সাইকেলে চড়ে বসতাম । অবাধ্য সাইকেলটাকে শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখার চেষ্টায় মেতে উঠতাম আমি । একদিন বাবা আমায় সাইকেল চালাতে দেখে কিছুটা অবাক হলেন । মুখের ভাব দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে এনে একটু হেসে বললেন,
-“সাইকেল বোধহয় বুঝে গেছে,তার মালিকানা বদল হতে চলেছে !”
আমি কিছু না বুঝে,শুধু হেসেছিলাম সেদিন ।
আমার বাবা মারা যান প্রবল বর্ষার এক রাতে । বর্ষার সময়টাকে কেন যেন খুব অপছন্দ করতেন বাবা । তার অপছন্দের বর্ষাকালেই তার মৃত্যু হয় । হঠাত্ বুকে ব্যথায় কাতরিয়ে ওঠা এবং কিছুক্ষন পরই নিস্তব্ধতায় তলিয়ে যাওয়া ।
বাবাকে কেন যেন কখনো ভয় পেতাম না আমি । তবে ঐ রাতে নিথর হয়ে পড়ে থাকা বাবাকে দেখে কেন যেন ভীষণ ভয় লাগছিল আমার । ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছিল সে রাতে । আশ্রয়হীন কুকুরটা সে রাতে ও করুণ সুরে ডেকে যাচ্ছিল । তবে সে রাতে টিনের চালে ঝরে পড়া বৃষ্টির ফোটা আর আশ্রয়হীন কুকুরটা যেন শব্দ করে নির্ঘুম আমায় বলে যাচ্ছিলো,ভয়ের কিছু নেই । এই তো আর কিছুক্ষন ! সকাল হয়ে এলো বলে…….
আজ আকাশ ভরা জোছনা । চাঁদের আলো এসে খেলা করছে আমার জানালায় । বরাবরের মত আমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই,অনেকখানি চাঁদের আলো ঢুকে পড়েছে আমার ঘরে । ঘরের মেঝে জুড়ে চলছে মায়াবী আলোর লুটোপুটি খেলা । আমি ঘর ছেড়ে বাইরে নামি । চাঁদের আলোয় ম্লান হয়ে আছে আকাশের সব তাঁরা । সাদা কিছু মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে যেন অপার বিস্ময় নিয়ে ! আমি হাত বাড়িয়ে চাঁদের আলোয় ম্লান হয়ে থাকা পাশাপাশি দুটি তাঁরা কে ডাকি,”আয়,আয়”।
আমি বাবার জোড়া তালি দেওয়া সাইকেলটা তুলে নিই । টুংটাং বেলের শব্দে বেঁধে নিই নিজেকে । শূন্য বাড়িটাকে পেছনে ফেলে নেমে আসি রাস্তায় । ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসা চাঁদের আলোয় ভিজে এগিয়ে যাই আমি । রাতের আকাশ হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমায় । আজ বড্ড আকাশ ছুঁতে ইচ্ছে করছে…….
মন খারাপ করা গল্প 🙁
ভালো লেগেছে 🙂
বিরামচিহ্নগুলি একটু ঠিক করে নিবেন
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
বিরাম চিহ্ন,স্পেসিং সহ অনেক কিছুই এডিট করা দরকার ছিলো । কিন্তু এডিট করতে পারছি না ।
:welcome:
সরবে স্বাগতম 😀
আশা করি নিয়মিত লিখবেন
আর এডিট অপশনে গিয়ে ঠিক করলেই হবে 🙂
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
এডিট অপশনে গিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঠিক করতে পারিনি।
🙁 🙁
বিষন্ন গল্পকথা……
মানুষ চেনার তত্ত্বটা অনেকাংশে সত্যি…… না চেনার ভান করে বসে থাকার কথা বললেন না, আমি ছোটবেলায় এমনিতেই অনেক দুঃখবিলাসী গল্প বানাতাম বসে বসে, কিংবা এখনো মনে হয়–প্রিয়জনদের যদি রাগ-অভিমান গুলো ঠিক ঠিক বোঝানো যেত!!
প্রথম লিখলেন?? লেখার হাত কিন্তু খুব-ই ভাল আপনার…… সবসময় লিখবেন……
শুভকামনা………
ফেসবুকে একটি পেইজে টুকটাক লিখতাম। এই গল্পটা ও ঐ পেইজে প্রথম দিয়েছিলাম। তবে এখন থেকে সরবে নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছা আছে।
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
:welcome: ভাইয়া!
মানুষ চেনার সব চেয়ে সহজ উপায় মানুষের কাছে নিজেকে সহজলভ্য করে দেওয়া- এইভাবে কখনো ভেবে দেখি নি আগে!
নিয়মিত লিখবেন ভাইয়া। 🙂
নিয়মিত লিখতে পারবো কি না জানি না,তবে অন্যদের লেখা পড়ার জন্য হলে ও নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছে আছে।
ধন্যবাদ আপনাকে 🙂
মন খারাপ করে দেয়া গল্প। :welcome:
মানুষ চেনার ব্যাপারটার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল চমক ভাইয়ার মাধ্যমে। মনে করিয়ে দিলেন… তবে থিওরীটা আসলেই সত্যি!!
:welcome:
এহহে… দু’বার চলে এল কি করে??
মানুষ চেনার বিষয়টা চমক ভাই ও এভাবে বলেছেন? জানতাম না তো!
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ 🙂
সত্যি!!
উনি প্রায়ই বলেন!! এবং ঠিক এইভাবেই বলেন!! 😀
ওয়েল্কাম! 🙂
আসলেই জানতাম না! তবে জানতে পেরে ভালো লাগছে 🙂