গতকাল মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে এক তরুণী ধর্ষিত হয়েছে। তার আগের কয়েকদিনের মাঝেই ধর্ষিত হয়েছে আরও কয়েকজন। তারও আগে আরও অনেকে। শিশু থেকে বয়স্ক, পোষাকশ্রমিক থেকে গৃহবধূ। প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই নিশ্চিতভাবে চোখে পড়ছে একটা খবর-ধর্ষণ।
শরীরে একটা ঘা কে বাড়তে দেয়া হলে সেটা বাড়তেই থাকে। একটা সময় সেটা বাড়তে বাড়তে সীমা ছাড়িয়ে যায়। পচন ধরে সমস্ত শরীরে। বাংলাদেশে ধর্ষকদের অবস্থা ঠিক সেই পচা ঘা এর মতো, যাকে কেটে ফেলতে সবার বড্ড অনীহা।
এক্ষুনি সবাই রেগে উঠবেন। অনেকে বলবেন, “ধর্ষকরা তো খুব খারাপ, আমরা সবাই ধর্ষকদের ঘৃণা করি। তাদের শাস্তি দাবি করি। ভয়ংকর সব শাস্তি দাবি করি।”
আসলেই কি?
আমরা প্রতিদিন নতুন নতুন ধর্ষণের খবর পড়ছি পত্রিকায়। ক’টা ধর্ষকের বিচারের কথা পড়ছেন? প্রতিদিনের কথা ছেড়ে দিন, গত এক মাসেও কি একটা পড়েছেন?
ধর্ষণের বিরুদ্ধেই বা আমরা কতটা সোচ্চার? ফেসবুকে একটা জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস, ব্লগে একটা নোট, শতশত লাইক-ভার্চুয়াল জীবনের মতো আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি ভার্চুয়াল প্রতিবাদে। সেই ভার্চুয়াল প্রতিবাদের মধ্যেও দেখা যায় কিছু অপমানব বলার চেষ্টা চালায়, “ধর্ষণ আসলে মেয়েটারই দোষে হয়েছে।”
প্রতিটা ধর্ষণের দায় যেন মেয়েটার। তাকে সমাজ থেকে নির্বাসিত করা হয়, তাকে সংসার থেকে বিতাড়িত করা হয়, তাকে জীবন থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় এক অর্ধমৃতের জীবনে।
আর ধর্ষক?
প্রথমেই চেষ্টা করা হয় আলোচনা বা শালিসের মাধ্যমে ঘটনা মিটিয়ে ফেলতে। সম্ভব না হয়ে কিছুদিন পর টাকার মাধ্যমে অথবা ভালো উকিল দিয়ে টাকার জোরে বাঁচিয়ে ফেলা হয় তাকে। পশুকে বাঁচিয়ে ফেরত আনা হয় সমাজের মাঝে নতুন কোন মানুষকে শিকার করার জন্য। নতুন একটা জীবনকে ধ্বংস করার জন্য।
গতকাল মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা যেন কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ভারতের দিল্লীর ঘটনার প্রতিচ্ছবি। সেই ঘটনা নিয়ে এতো প্রচার হয়েছে যে, ধর্ষকরাও উৎসাহ পেয়েছে নতুন কিছু করার!
বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আছে ভারতকে অনুসরণ করার অভ্যাস। আমরা হিন্দি চ্যানেল দেখি, হিন্দি গান শুনি, ঈদে ভারতের নায়িকাদের নামের জামা পরি, বাংলাদেশের চ্যানেলে ভারতের মতো সিরিয়াল বানানো শুরু করি, ওদের আইটেম সং দেখে আমরাও সিনেমায় আইটেম সং দেখিয়ে সিনেমাকে আধুনিক করি।
এবং, অবশেষে ভারতের ধর্ষকদের মতো এদেশেও বাসে কিছু পশু চড়াও হয় একটা মেয়ের উপর!
সবকিছুতে ভারতকে অনুসরণ করলেও আমরা যে কথা ভাবতেও পারি না:
- ভারতে ধর্ষিত মেয়েটাকে দেশে সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেয়ার পর এমনকি সিংগাপুরেও চিকিৎসার জয় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। আমাদের দেশে ধর্ষণের পর একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয়, ভয়ংকর সামাজিক অবস্থার সামনে। তাদের বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়া, এমনকি ন্যূনতম চিকিৎসা নিয়ে আমরা ভাবি না।
- ভারতে ধর্ষিত মেয়েটার পক্ষে ধর্ষকদের শাস্তির দাবি পথে নেমে এসেছিলো হাজারো মানুষ। মানুষের দাবির চাপেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুঁজে বের করে না জানা সেই ধর্ষকদের। বাংলাদেশে ক’টা ধর্ষকের শাস্তি হয় বলতে পারেন? অনলাইনে স্ট্যাটাস দেয়া ছাড়া ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে কি কেউ পথে নেমেছে? পথে নামতে বড্ড ভয় আমাদের, যদি পুলিশ মারে! ন্যায্য দাবির পক্ষেও পথে নামতে, এমনকি একটা মানববন্ধনে যেতেও বড্ড অনীহা আমাদের। এমন সময়েই ‘অনেক কাজ’ এর কথা মনে পড়ে যায় আমাদের।
- দিল্লীর মেয়েটা ধর্ষণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিজে ক্ষমা চেয়েছেন, স্বীকার করেছেন নিজের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা হয়তো ভুলে যান তাদের দায়িত্ব কতটুকু। দেশের মানুষের প্রতি তাদের যে দায়িত্ব আছে, তাদের ব্যর্থতায় যে তাদের অনুতপ্ত হওয়া উচিত; সেটা ভুলে বরং কাদা ছোড়াছুড়ি করতেই তারা বেশি পছন্দ করেন।
প্রতিমুহূর্তে আমরা বাংলাদেশের নতুন সুদিনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করি। প্রতিদিন আমরা ভাবি, এই ছোট্ট দেশটা সব বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাবে বহু পথ। সেই পথ পেরুতে হলে এই দেশের এই পশুগুলোকে আগে দূর করতে হবে।
- ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে, যেন কেউ ধর্ষণের কথা চিন্তাও না করে।
- শুধুমাত্র অনলাইনে না, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে কম্পিউটারের পর্দা ছেড়েও।
- রাজনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকদের ধর্ষণের শাস্তি নিশ্চিত করার ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। এই ব্যাপারে কোন আপোষ করলে এই দেশে পশুর জন্ম দেয়া হয়।
ভেবে দেখুন, আপনি কি চান আপনার মা, বোন, মেয়ে বেড়ে উঠুক পশুদের মাঝে? পশুরা ঝাঁপিয়ে পড়ুক তাদের উপর যে কোন সময়? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ কি সেই অন্ধকারের পথ দেখায় আপনাকে?
উত্তর যদি ‘না’ হয়, তবে সোচ্চার হোন ধর্ষণের বিরুদ্ধে। তীব্র দাবি জানান ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করার দাবিতে। এই ব্যাপারে কোন আপোষ হতে পারে না।
আমার মেয়ের জন্য আমি একটা মানুষের সমাজ রেখে যেতে চাই, পশুদের সমাজ নয়। আপনি কি চান……?
কী করলে যে আসলে কী হবে…
সবচেয়ে আগে ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করা দরকার।
ধর্ষণ একটা টারশিয়ারি লেভেলের আপরাধ। একজন মানুষ হুট করে ধর্ষণ করতে পারে না। এই সমাজ ব্যবস্থা যখন প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি লেভেলের অপরাধগুলোর কোন শাস্তি দিতে পারে না বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত(!) হয় কেবল তখনই একজন মানুষ টারশিয়ারি লেভেলের অপরাধ করবে।
আগাছার পাতা কেটে দিলে আগাছা কখনো দূর হয় না। আগাছাকে শিকড়সহ উপড়াতে হয়।
সহমত প্রকাশ করছি। তবে, একটা একটা করেই পাতা ছেটে অবশেষে আগাছা শেকড়সহ উপড়াতে হবে।
I do agree with you to fhe full. Action must be taken from both sides (root & shoot) at a time, immediately…
🙂
“আপনি কি চান আপনার মা, বোন, মেয়ে বেড়ে উঠুক পশুদের মাঝে? পশুরা ঝাঁপিয়ে পড়ুক তাদের উপর যে কোন সময়? আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ কি সেই অন্ধকারের পথ দেখায় আপনাকে?”
যাকে বলা উচিত সে নিজেই কি একজন পশু নয়? পশুকে বলে লাভ কি? এরচে কথা না বাড়িয়ে উপড়ে ফেলাই ভাল। ঝামেলা কম, লাভ বেশি।
কিন্তু দূর্ভাগ্য, এই কাজটা যাদের করা উচিত, তারাই এর সাথে জড়িত।
আর আমরা তো কেবলি পথে নেমে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করতে জানি – “বদলে যাও, বদলে দাও”, কখনো বলি না নিজেকে বদলাবার কথা। এই দেখুন না, আমি যে বলছি, আমি নিজেই তো কিছু করতে পারছি না! ফাঁকা মাঠে ধর্মের বুলি ছড়াচ্ছি কেবল!
এটা ঠিক যে, ধর্ষককে শাস্তি দেয়াটা খুবই জরুরী। কিন্তু তার চেয়েও বেশি জরুরী ধর্ষণের মানসিকতার মূলোৎপাটন করা। আপনি একজন ধর্ষককে শাস্তি দেবেন, কিন্তু এই সমাজে এমন পশু তো আর একজন নেই। যত যাই করুন, মানুষ অভ্যাসের দাস, আর অভ্যাস মানসিকতার। আমাদের মানসিকতা বদলানো এর চেয়েও অনেক অনেক বেশি জরুরী। যে সমাজে একটা ছেলে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখে ধর্ষনের খবর, চাক বা না চাক ফেইসবুকে লগ ইন করে ১৮+ পেইজের পোস্ট দেখে, দোকান থেকে নতুন মুভির সিডি কিনে এনে দেখে তার ভেতরে অন্য কিছুর সিডি- তার কাছ থেকে ভাল কিছু আশা করা যায় না, তার মন-মানসিকতা নষ্ট হয়ে যায়, অসুস্থ হয়ে যায় সে। সে ভাল হতে চাইলেও ভাল হতে পারে না, ভালটা শিখবে কোত্থেকে সে?? আগাছার পাতা ছেটে দেয়া যায়, তাকে উপড়ে ফেলা যায়। কিন্তু তার চেয়েও ভাল, আগাছা যেন না জন্মায় সেদিকে নজর দেয়া। যা আগাছা আছে, তা উপড়ানোর সাথে সাথে পাশে যেন আর নতুন কোন আগাছা না জন্মায়, সেটাও দেখতে হবে। নইলে মোটের উপর লাভের খাতায় ঋণাত্বক চিহ্ন বৈকি শূন্যও জুটবে না।
প্রতিরোধ ও প্রতিষেধক- দুই-ই দরকার।
কড়া শাস্তি বাস্তবায়িত না হলে কিছু মানুষ টাইট হবে না।
প্রাণের মায়ায় টান লাগলে নিষিদ্ধ ইচ্ছাতেও টান লাগবে।