কালের দেয়ালে… (শেষ খণ্ড)

৩য় প্রকাশের পরঃ – (http://shorob.com/?p=12065)

মা রান্না ঘরে ব্যস্ত আর আমি মামাদের সাথে হংকং এবং আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের গল্প শোনাতে লাগলাম। মামা জানতে চাইলেন লেখাপড়া শেষ তাই আমি কে করার কথা ভাবছি। মামী এর মধ্যে প্রায় মামা কে থামিয়ে দিয়ে বললেন, মাত্র তো আসলো, এখনি চাকরির কথা বলতে হবে কেন?” মামা থেমে গেলেও আমি আমার কিছু আগাম চিন্তা ভাবনার কথা মামাকে বলতে লাগলাম। এরই মধ্যে মা খাবার নিয়ে আসলেন। ভাই-বোনদের সাথে বসে খেতে লাগলাম। মায়ের হাতের খাবার আমাকে হংকং এর দিন গুলর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল যখন আমি মায়ের হাতের খাবারের জন্য পাগল হচ্ছিলাম। অপেক্ষা পূরণের অপেক্ষায় থাকার নেশায়।

রাতে খাবারের পরই কথা হয়েছিল মেঝো মামার সাথে যে কাল সকালের মধ্যেই বাবার কবরে যাচ্ছি আমরা। মাকে আমি বললাম, “চল মা কালকে বাবার সাথে দেখা করে আসি।” মা অনেক বিচলিত হয়ে আমার দিকে চাইলেন। আমি এবার আর মায়ের স্তব্ধতাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না। মা আমাকে আগে কখনও বাবাকে দেখতে যেতে নিষেধ করেন নি এবং আজও করলেন না। তবে মা কেন এমন করছেন। একটা কেমন যেন ভয় আমার মাথায় চাক বাঁধতে লাগলো। মামা আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন আমি কি ভাবছি। বিষয়টা খুলে বলাতে মামা বললেন, “হয়তো তোর মা তোর সাথে একান্তে কিছু বলতে চাচ্ছে, কত দিন পরে আসছিস বাসায় খবর আছে?” –আমি মামার কথায় শান্ত হলাম। কাল সকালেই মায়ের সাথে কথা বলতে হবে স্থির করলাম।

পরদিন সকালেও মা রান্না ঘরে ব্যস্ত। আমার আসা উপলক্ষে আমার সাথে দেখা করতে অনেকেই আমাদের মিরপুরের বাসায় এসে পরেছেন। আমি আমার আত্মীয়দের সাথে কথা বলতে লাগলাম আর মা তাদের আপ্যায়নে লেগে গেলেন। মায়ের সাথে কথা বলার কোন সুযোগই খুজে পাচ্ছিলাম না আমি। হঠাৎ মা বললেন, “নাস্তা করে ফেল, তোর মেঝো মামা এসে পরবে এখনি।” আমি বললাম, “মা তুমি যাবা না আমার সাথে?” জবাবে মা বললেল, “আজ তুই হয়ে আয়, আমরা কালকে একসাথে যাব আবার।” এখন মাকে দেখে আমি প্রায় অবাক। কালকে পর্যন্ত যার চোখে আমি এক অস্বাভাবিক চিন্তা দেখলাম, এখন তার চিহ্ন মাত্র নেই। আমি আর কিছু বুঝে উথার আগেই মামা এসে গেলেন- “কই তুই তৈরি? জলদি নাস্তা কর দেরি করা যাবে না।” আমি নাস্তা সেরে মাকে বলে মামার সাথে বেরিয়ে পরলাম।

আমরা বাসে উঠে রওনা দিলাম। অনেক দিন পর ঢাকার রাস্তায় বাসে উঠলাম। কিছুই বদলায়নি বলতে হবে, বরং রাস্তায় ঝুঁকি কিছুটা বেড়েছে। তবে চার বছর আগে রেখে যাওয়া ঢাকা আর ২০১২ সালের ঢাকার মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অনেক উঁচু উঁচু শপিংমলে রাস্তা ভরে গেছে যার প্রায় অর্ধেকেরও বেশি নতুন। রাস্তা গুলো সামান্য প্রশস্থ হয়েছে তবে যানবাহনের তুলনায় সেটা চোখে পরার মত না। মামা বললেন অনেক দিন ধরেই রাস্তা বাড়ানোর কাজ চলছে। পুরান ঢাকার রাস্তাও ঠিক করা হচ্ছে তবে সামান্য কিছু কাজই সম্ভব হচ্ছে যেহেতু ওই এলাকার বেশির ভাগ জুড়েই বাড়ি-ঘর। বাস থেকে আমরা নীলক্ষেতে নামলাম। একটা রিকশা করে সোজা আজিমপুর গোরস্থানের দিকে রওনা দিলাম।

মামার কথাই ঠিক, রাস্তাগুলো অনেক বাড়ানো হয়েছে। অনেক পুরান পুরান বাড়ির পাঁচিল ভেঙ্গে রাস্তা গড়া হয়েছে। আমি চিন্তাই করছিলাম এ এলাকার বাসিন্দারা কেমন করে তাদের এত শখের বাড়ির আঙিনা রাস্তা বানানোর জন্য দিয়ে দিল, ঠিক এমন সময় আমাদের রিকশা ডানে মোড় নিয়ে থেমে গেলো গোরস্থানের প্রধান ফটকের সামনে। দরজা পাড় করে ঢুকেই কোণ বরাবর ডান দিকে দু’টা সেগুন গাছ পেরিয়ে প্রথম আম গাছটার গোঁড়ায় বাবার কবর। সেদিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল জীবনে প্রথম এ জায়গায় আসা হল আমার। কই গাছ গুলো! একটাও তো দেখছি না। শুধু মাত্র ছোট ছোট কিছু চারা গাছ বাঁশের কঞ্চির সাহায্যে দাড়িয়ে আছে। দেয়ালটাও আরও বড় আর নতুন লাগছে। আমি অবাক হয়ে মামার দিকে তাকালাম। মামা বলে উঠলেন, “কেন জানিস না, আপা তোকে বলে নাই? রাস্তা বাড়ানোর জন্য ওই দিকের দেয়াল ভেতরে সরিয়ে নতুন করে বানানো হয়েছে। প্রায় ছয় ফুট এর বেশি। গাছ গুলো এতে কাটা পড়ে, সাথে অনেক কবর গোরস্থানের সীমানার বাইরে চলে যায়, তোর বাবারও”। আমি হতবাক হয়ে মামার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, কেন মা এক বছর আগে টেলিফোনে কেঁদেছিলেন আর কেনইবা কাল মাকে এত বিচলিত লাগছিল। আমি নির্বাক হয়ে বাবার কবরের পাশের নতুন দেয়ালের এপাড়ে দাঁড়ালাম, বাবার কাছ থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে দাড়িয়ে আমি, তবুও কত দূর।।

সমাপ্ত।।

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে গল্প, সাহিত্য-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , , , , , , , , , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

6 Responses to কালের দেয়ালে… (শেষ খণ্ড)

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    ওহ্‌ হো, গল্প দেখি!
    প্রথম পর্ব থেকে পড়ে আবার মন্তব্য করবো তাহলে। 🙂

  2. হাসান বলেছেনঃ

    “আমি নির্বাক হয়ে বাবার কবরের পাশের নতুন দেয়ালের এপাড়ে দাঁড়ালাম, বাবার কাছ থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে দাড়িয়ে আমি, তবুও কত দূর।” -লাইনটি সবচেয়ে ভালো লাগল 🙂

  3. সাঈদ আনোয়ার অনুজ বলেছেনঃ

    ৩ টে একসাথে পড়লাম।
    অজানা কোন কারণে শেষটুকু একটু আগেই বুঝে ফেললাম, এমনটা তো হবার কথা ছিল না…
    “আমি নির্বাক হয়ে বাবার কবরের পাশের নতুন দেয়ালের এপাড়ে দাঁড়ালাম, বাবার কাছ থেকে মাত্র ছয় ইঞ্চি দূরে দাড়িয়ে আমি, তবুও কত দূর।”
    কেন জানি, আমার বাবার কথা মনে পরে গেল…
    যা হোক, ভাল লেগেছে। 🙂

    • Chronose বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ আপনাকে…
      কারণটা না জানলেও বলা যায় গল্পটাকে আর Mysterious করলে ভালো লাগত না। তাই simplicity কিছুটা integrity কে খুন্ন করেছে… 🙁

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।