প্রথমে ঘটনাটিকে সৌভাগ্যই ভেবেছিলাম, কিন্তু সেই ভাবনা উল্টো হয়ে দেখা দিল অবশেষে।
চার বৎসর আগে চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে যখন বাস এ ঢাকায় ফিরছিলাম আমার পাশের সিটে বসেছিল একটি মেয়ে। বাস এ পাশে একটি মেয়ে বসা একটি ছেলের জন্য ভালোলাগার তো অবশ্যই, কিন্তু কিছুটা অস্বস্তিকরও বটে। যেমন, ধরুন যদি নাক ঝারার প্রয়োজন হয় অত্যন্ত সাবধানে কাজ সারতে হয়, কারণ মাথায় আসে মেয়েটা কি ভাববে! কিংবা যদি ঘুম পায় সেখানেও ভয় হয়! মুখটা যদি হা হয়ে থাকে প্রেস্টিজ তো পুরোটাই যাবে!! এইসব ছাড়াও আরো একটি প্রবলেম আছে। এত দীর্ঘ একটা জার্নিতে আপনি তার সাথে কথা বলবেন কি বলবেন না সেই ডিসিশন নেয়াও কম কঠিন না। যদি কারণ ছাড়াই কথা বলেন মেয়েটি ভাবতে পারে আপনার পার্সোনালিটি লুজ, আবার কথা যদি একেবারে না-ই বলেন সে মনে করতে পারে আপনি ভাব নিচ্ছেন! যাহোক, মূলকথা কুমিল্লা পৌঁছনোর আগে আমার পাশের মেয়েটির সাথে আর কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
কুমিল্লায় নূরজাহান হেটেলে বিরতির পর আবার আমি বাসে উঠলাম। আমার সিট ছিল জানালার পাশে। মেয়েটি তখনও ফেরেনি। কিছুক্ষণ পর সে এসে খানিকটা ইতস্তত করে বলল:
-আমি কি কিছুক্ষণ জানালার পাশে বসতে পারি?
আমি ঝটপট ওঠে ওনাকে বসার সুযোগ দিলাম। বাস চলতে শুরু করল। মনে মনে ভাবলাম বরফ যেহেতু গলিল এবার কথা বলা যেতে পারে। মেয়েটি বসার কিছুক্ষণ পর আস্তে করে বলল:
-থ্যাংক য়্যু।
-ওয়েলকাম। আমি সৈকত। চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম ভার্সিটিতে এডশিন টেস্ট দিতে।
-ও আচ্ছা।
-আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
-ঢাকায়।
-সেটা তো বুঝতেই পরছি। জানতে চাচ্ছিলাম ঢাকায় কি বেড়াতে যাচ্ছেন না নিজের বাসা?
-আমার নিজের বাসা বলে কিছু নেই। ছিলাম একজনের বাসায়, এখন যাচ্ছি অন্য জনের বাসায়।
-বুঝলাম না। যদি আর একটু ডিটেইলছ বলতেন …
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি বলতে শুরু করল:
-ঠিক আছে শুনুন। আমার বাবা-মা ঢাকায় থাকেন। চট্টগ্রাম আমার স্বামীর বাসা এবং তার চাকুরিস্থল।
-আপনাকে দেখে মনেই হয়না বিয়ে হয়েছে। আপনার পড়াশুনা কোন পর্যন্ত ?
-আমার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। বাবা-মায়ের পাঁচ মেয়ের মাঝে আমি ছিলাম বড়। অন্তত একটি ছেলের আশাও পূরণ হয়নি বলে বাবার মনে যে আক্ষেপ ছিল তার জের আমাদের সবগুলো বোনকেই দিতে হত মাঝে মাঝে। এমনকি বাবার রাগ মাঝে মাঝে মা’র ওপর গিয়েও পড়ত। যাহোক, কন্যাদায় মেটাতে আমার প্রিয় বাবা আমাকে সুপাত্র দেখে দ্রুত বিদায় করলেন। কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, ইচ্ছে ছিল অন্তত আই. এ. টা কমপ্লিট করব। কথা ছিল আমার স্বামীই আমাকে বাকীটা পড়াবেন। ভর্তি হয়েছিলাম কলেজে। সব ভালোই চলছিল। কিন্তু…
এই পর্যন্ত বলে মেয়েটি থামল এবং দম নিল। সে কথা বলার শুরুতে ভাবিনি বরফ এতটা গলবে এত সহজেই। হয়ত মনের কষ্টগুলো বের করে দেয়ার মত জায়গা খুব একটা ছিলনা তার। তাই আমি জিজ্ঞেস করায় এত সহজেই সব বলছিল। তবে ‘কিন্ত’র পরের অংশ শোনার জন্য মন আনচান করতে লাগল। ধৈর্য্য বেশীক্ষণ ধরতে পারলাম না। প্রশ্ন করলাম:
-কিন্তু কি?
-থাক, তা আর না শুনলেন।
-আপনি আমাকে বিশ্বাস করে বলতে পারেন, যদি আপনার কোন ক্ষতি না হয়। প্লিজ…
-না, কোন ক্ষতি হবে কেন? আপনার বা আমার কারো কোন লাভ বা ক্ষতি কিছুই হবেনা সেসব শুনে।
-তবে বলুন।
-আমি ঢাকায় আমার বাবার বাসায় যাচ্ছি, স্বামীর কাছে কোনদিন আর ফেরা না-ও হতে পারে।
-কারণ?
-কারণ, বিয়ের পর পাঁচ বৎসর হয়ে গেল, অথচ আমি আমার স্বামীকে কোন সন্তানের সুখবর দিতে পারিনি। কিছুদিনের মাঝে পরিবারের চাপে তিনি আরেকটা বিয়েও করতে পারেন। কিন্তু তাকে ছাড়া আমি কিভাবে থাকব বলেন, পাঁচ বছরে তাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। আমি বুঝি সেও আমাকে চায়। কিন্তু অভাব শুধু একটা সন্তানের…
কথাটা শুনে মনটা এতই খারাপ হয়ে গেল যে আমি আর কিছু বলতে বা জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। মনে মনে শুধু ভাবতে লাগলাম আপুটার ভবিষ্যৎ কি কি হতে পারে, তবে কোন ভাবনাই সুখকর ছিলনা। আপু বলছি কারণ, ততক্ষণে হিসেব করে দেখলাম তিনি আমার থেকে তিন বৎসরের বড়।
আর তেমন কোন কথা হয়নি আমাদের। বাস থেকে নামার পূর্বে আমি শুধু ওনার মোবইল নাম্বারটা চেয়ে রেখেছিলাম।
ঢাকায় ফিরে অনেক ব্যস্ততার মাঝেও এই আপুটার কথা মনে পড়লে অনেক খারাপ লাগত। ওনার সাথে পরিচয় হওয়টাকে শুধু এই কারণেই যে সৌভাগ্য বলতে বাঁধা তা নয়। কিছুক্ষণ পরেই আপনারা সেটা বুঝতে পারবেন।
আমার ভর্তির ব্যস্ততা শেষ হল। সেই ঘটনার প্রায় তিন মাস পর কোন এক কারণে আপুটার কথা মনে হল। খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল পরবর্তিতে তার কি হল। অনেক সাহস নিয়ে একদিন ফোন করেই ফেললাম। পরিচয় দিতে সহজেই চিনে ফেললেন। যতটুকু জানতে পারলাম: আপুর বাবা-মা’র কথায় তার স্বামী একবার ঢাকায় এসেছিলেন এবং কিছুদিন পর তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। আপু নিজের ব্যপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেবার ঢাকায় গিয়ে ডাক্তার দেখিয়েছিলেন। আপুর স্বামী ঢাকায় যখন এসেছিলেন তাকেও আপু অনেক অনুরোধ করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। টেস্ট করে জানতে পেরেছিলেন- প্রবলেম আপুর নয়, তার স্বমীর। সেটা আপু তখনও তার স্বামীকে জানান নি, কারন আপু ভাল করেই জানেন তার স্বামী সেটা বিশ্বাস করলেও তার শ্বশুর-শ্বাশুরী কোনভাবেই মেনে নেবেন না। আর তাছাড়া আমি কখনো চাইনি সেটা জানাজানি হয়ে আমার স্বামী কারো কাছে ছোট হয়ে যাক।
ফোনের কথা এতটুকুই। তবে এটা ভেবে আমি আশ্বস্ত হলাম যে, আপু স্বামীর সাথে থাকতে পারছে এবং ইনফার্টিলিটি প্রবলেমটা তার না হওয়ায় তার ওপর হয়ত কোন অত্যাচার হবেনা।
ঘটনা এখানে শেষ হলে মন্দ হতনা। কিন্তু তা হলনা।
প্রায় চার বৎসর পর আপুকে আবার দেখলাম একটা শপিং মলে। চিনতে একটু প্রবলেম হলেও সেটা সহজ করে দিলেন আপু নিজেই। চোখে চোখ পড়তে তিনিই কাছে এসে জিজ্ঞস করলেন চিনতে পেরেছি কি না। সাথে তার স্বামী এবং ছোট একটি ছেলে। আমার সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। যাবার সময় এবার আপু নিজেই আমার ফোন নাম্বার টা রাখলেন।
তার পরদিন আপুর ফোন। চিনতে পেরে আমি কিছু বলার আগেই আপু জিজ্ঞেস করলেন:
-আমার সাথে আমার ছেলেকে দেখে কি একটু অবাক হয়েছেন?
-তা তো একটু না, যথেষ্ট পরিমাণেই হয়েছি।
-এই সন্তান আমার গর্ভের, কিন্তু আমার স্বামীর বীর্যের নয়।
-কি বলেন এইসব ?!
-যা বলছি ঠিক বলছি, কিন্তু এইসব আপনাকে বলার কোন কারণ ছিলনা। শুধু আপনাকে কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে বলেই সব বললাম। আপনি আমাকে হয়ত এখন ঘৃণা করছেন, কিন্তু বিশ্বাস করেন আমার স্বামীর সুখের জন্যই এটা করেছি, আর আমি এটাও কখনো চাইনি শুধু একটি সন্তানের অভাবে আমার স্বামী আমাকে কম ভালোবাসুক। আমি তাকে ছাড়া বাঁচতাম না, আর আমি তাকে ছেড়ে চলে গেলে সে-ও অনেক কষ্ট পেত। তাই এছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলনা।
-তাই বলে আপনি …
-আমি জানি আমার স্বামী ঐ সত্য ব্যপারটা জানতে পারলে আমি তার ভালোবাসা পুরোটাই হারাবো, এমনকি সংসার সন্তান সে সবও হয়ত হারাব। শুধু ভেবে দেখুন তিনি না জানলে কিন্তু কোন সমস্যাই নেই, বরং আমাদের সংসারটা অনেক সুখের হবে। আশা করি আপনার প্রতি আমার বিশ্বাসটা ভঙ্গ করবেন না কোনদিন।
ভালো থাকবেন।
-আপনি নিশ্চন্ত থাকতে পারেন।
আমি চেষ্টা করেও আর কিছু বলতে পারলাম না। অনেক রকম ভালোবাসা দেখেছি, সিনেমা, উপন্যাস বা বাস্তব জগতে। তবে তার এমন নমুনা দেখব ভাবিনি কখনো। একারণেই হয়ত জিলেন বাগেস একদা বলেছিলেন: “মেয়ে মানুষ চিনেছেন বলে অহংকার করবেন না। কেননা আপনি জানেন না আর একটি মেয়ে আপনাকে কি শিক্ষা দেবে।”
পরিশেষে, চিরদিনের মত হয়ত মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়েই যাবে- না পারব আপুর ভালোবাসাটাকে অস্বীকার করতে, না পারব তার করা অন্যায়টাকে মন থেকে গ্রহন করতে। আর দুইটা একসাথে মেনে নেয়া তো সম্ভব-ই না ।।
প্রথম যে প্রশ্নটা মনে এলো সেটা হলো- এটা কি সত্যি কাহিনী?
যদিও গল্প বিভাগে প্রকাশিত তবুও লেখকরা তো জীবনকেই গল্পের উপজীব্য করেন, সেজন্য মনে হলো।
কষ্ট হলো পড়ে।
আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে মেয়েটা টেস্ট টিউব বেবি নিয়েছে এবং তার স্বামী সেটা জানেন। কিন্তু পরের অংশটুকু পড়ে সত্যিই কষ্ট পেলাম। ভালোবাসার আসলেই অনেক রকম রূপ আছে। আমি কিছু কিছু রূপ বুঝতে পারি না। এটাও সেরকমই লাগলো। ভালোবাসার পাবার জন্য এই কাজের পেচনের যুক্তিটাকে মানতে পারছি না, আবার মেয়েটার কষ্টকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। ঘটনাটা জীবন না হয়ে গল্প হলে আর সেটা আমি লিখলে হয়তো মেয়েটির স্বামীকে তার অক্ষমতার কথা জানাতে দ্বিধা বোধ করতাম না। কারণ পড়ে যা বুঝলাম, মেয়েটিকে তার স্বামী যথেষ্ট ভালোবাসেন এবং সাপোর্ট দেন।
প্রার্থনা করি, কারো জবনের অঙ্ক যেন এতটা কঠিন না হয়।
লেখা চালিয়ে যাও।
তোমার প্রথম লেখাতেই আমি ভীষণ চমকিত হয়েছি।
চর্চায় রাখলে তোমার লেখা আরো ভালো হবে, আমি সেটা জানি।
অনেক ধন্যবাদ আপু আপনার বিশ্বাসের জন্য:D
এটা গল্প বলা যায়, কারণ কাহিনীটা কাল্পনিক। কিন্তু যে অংশটুকু পড়ে আপনি ‘সত্যিই কষ্ট’ পেয়েছেন সেই অংশটুকু শতভাগ সত্য ঘটনা। 🙁
বাস্তবে মেয়েটার ও তার স্বামীর টেস্ট যে ডাক্তার করিয়েছিলেন তার কাছ থেকেই শোনা মেয়েটি যেভাবে সন্তান নিয়েছিল সেই ঘটনাটি।
যাক তবু এটা গল্প।ঘটনা যদি সত্য হতো, তাহলে বিষয়টা মোটেও ভাল হতো না।
তবে পড়ে অনেক ভাল লেগেছে ভাই।http://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_happy.gif
ভালো লেগেছে জেনে ভাল লাগলো… 😀
আমরা কেউ-ই চাইনা এমন ঘটনা কখনো সত্য হোক ।
•সহমত ।
ভাইয়া , আমি নতুন ব্লগ ব্যবহার করছি । অনেক কিছুই জানি না।তার মধ্য একটি হল,আইকন কি ভাবে ব্যবহার করবো বুঝতে পারছি না।কি ভাবে করতে হয়,জানতে পারলে একটু ভাল হতো ।
লেখার মাঝে যেখানে কিছু আইকন দিতে চাও সেখানে ক্লিক করবা, তাহলে নিচে অটোমেটিক আইকন গুলো আসবে, সেখান থেকে যেটা লাগে সেটা সিলেক্ট করলেই হয়ে যাবে… 😐
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়াhttp://shorob.com/wp-includes/images/smilies/icon_happy.gif