১১ই ফেব্রুয়ারী, ২০১২…
সকালের সোনাঝরা রোদ আর আসন্ন ফাল্গুনের মৃদু বাতাসে ঘুম ভেঙ্গে গেল মেঘের| প্রতিদিন সকালে মিম্মি-বাবা’র আলতো চুমুতে ঘুম ভাঙ্গে তার| আজ সে আগে উঠেছে| মেঘ ঠিক করলো, মিম্মি-বাবা’কে সে চমকে দেবে| ঘুমকাতুরে চোখ দুটি কচলে পা টিপে এগিয়ে চলল তাদের ঘরের দিকে| চারদিক শুনশান নিরবতা| মেঘের চোখে দুষ্টুমির ছায়া| আজ মিম্মি-বাবাকে বলবে, সে এখন বড় হয়ে গেছে, সেও এখন সকালে নিজে নিজে ঘুম থেকে উঠতে পারে| ঘরে ঢোকার আগে সে দেয়ালের পিছনে লুকিয়ে থাকলো| তারপর হঠাৎ উঁকি দিয়ে ‘হাঃ’ করে জোরে শব্দ করলো| এবার সে নিজেই চমকে উঠলো| মিম্মি-বাবা যে লাল রং মেখে মেঝেতে শুয়ে আছে| হুমম, আবার তার সাথে দুষ্টুমি শুরু করেছে! মেঘ কচি পায়ে দৌড়ে গেল মিম্মি-বাবাকে উঠাতে| উঁহু, মেঘ মোটেও ভয় পায়নি| সেও লাল রং হাতে মাখলো| বেশ কিছু সময় ধরে সে মিম্মি-বাবাকে ডাকলো| কিন্তু তারা যে উঠে না| কি হলো আজকে? মেঘ ভাবতে শুরু করলো| মিম্মি-বাবা তো কখনো এত দুষ্টুমি করে না| মেঘ বিরক্ত হলো| ফোন করলো তার নানুকে| নানু-মামা তাদের বাসায় এলো| নানু-মামাকে কাঁদতে দেখে সে অবাক হলো| সে জিগ্যেস করলো, তারা কাঁদছে কেন| নানু বলল, তোর বাবা-মা মরে গেছে, তারা আর কখনো ফিরে আসবে না| মেঘ বুঝতে পারে না| সে ভাবতে থাকলো, মিম্মি-বাবা তো ঘুমিয়ে আছে লাল রং মেখে| তাদের ডাকলেই তো উঠে যাবে| কিন্তু তারা তো উঠছে না| আচ্ছা, লাল রং মাখলেই বুঝি মানুষ মরে যায়| কিছুক্ষণের মধ্যে সে দেখল তাদের বাসা জুড়ে মানুষ আর মানুষ| সবাই কাঁদছে| মেঘ কিছু বুঝতে পারে না| সবাই শুধু বলে ওর মিম্মি-বাবা মরে গেছে| মেঘ চুপচাপ সারাদিন বসে থাকে, কখনোবা শুয়ে থাকে| এভাবে অনেকদিন কেটে যায়| মিম্মি-বাবা আর আসে না…
বাবা তাকে আর কোলে নেয় না|
মিম্মির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সে আর আবদার করতে পারে না|
বাবার ক্যামেরা এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে ছবি তুলতে পারে না|
মেঘের মনে পড়ে, তারা যখন জার্মানিতে থাকত, বাবার সাথে সে ছুটির দিনে সাইকেল চালাত|
মিম্মি-বাবার হাত ধরে সবুজ মাঠে অবিরাম ছুটে বেড়াত|
খুব বেশি দুষ্টুমি করলে মিম্মি গালটা টিপে দিত| সেও অভিমান করে চুপটি করে থাকত| তারপর মিম্মির হাসি দেখে তার অভিমান কেটে যেত|
মেঘ ভাবে, সে তার মিম্মি-বাবাকে কত ভালবাসত! বাবার জন্মদিনে বাবার ছবি এঁকে দিয়েছিল| সারপ্রাইজ গিফট পেয়ে বাবা বলেছিল, আমাদের মেঘ সোনাটা এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারে!
প্রতি জন্মদিনে মিম্মি-বাবা তার জন্য কেক নিয়ে আসত| তিনজন মিলে কেক কাটত|
নাহ! এবার তার জন্মদিনেও মিম্মি-বাবা এলো না| মেঘ একা একা কেক কেটেছে| সবাই তার জন্য কত গিফট এনেছে!
কিন্তু মেঘ তার মিম্মি-বাবার জন্য অপেক্ষা করে| ভাবে, তারা হয়তো ইচ্ছে করেই তাকে ছেড়ে চলে গেছে| হয়তো তার উপর রাগ করেছে| হয়তো একদিন এসে তাকে জড়িয়ে ধরবে| মেঘ ঠিক করেছে, মিম্মি-বাবা একবার ফিরে এলে তাদের হাত আর কখনো ছেড়ে দিবে না, শক্ত করে ধরে রাখবে যেন হারিয়ে যেতে না পারে|
মেঘ প্রশ্ন করে, মানুষ মরে গেলে কোথায় চলে যায়? সবাই বলে, মানুষ মরে গেলে আকাশের তারা হয়ে যায়| তাইতো মেঘ প্রতি রাতে আকাশের জ্বলজ্বলে তারার দিকে তাকিয়ে থেকে নিঃশব্দে তার মিম্মি-বাবাকে ডাকতে থাকে| সেই ডাক হয়তো তারা শুনতে পারে, হয়তো পারে না| কিন্তু মেঘে মেঘে যখন আকাশ ঢেকে যায়, আকাশের বুক চিরে যখন মৃদু গর্জন ধ্বনিত হয়, সাগরের বুকে যখন হাহাকারের জোয়ার উঠে, তখন এক পশলা বৃষ্টি নেমে আসে ধরণীর বুকে আর তা ছুয়ে যায় মেঘের নরম গাল| সোঁদা মাটির গন্ধে মুখরিত বাতাসের হু-হু শব্দ মেঘের কানের কাছে বলে যায়, ‘ভালো থেকো মেঘ’|
[১১ই ফেব্রুয়ারী ভোররাতে রাজধানীর রাজারবাগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি নিজ বাসায় নিহত হন| এই নৃশংস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন আন্দোলন, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে|এই হত্যাকান্ডের বিচার দাবিতে প্রথমে সবার সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে সময়ের স্রোতে যেন তা বিস্মৃতির অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে। এই হত্যাকান্ড এখন কেবলি দুর্ঘটনা কিংবা দুঃস্বপ্ন বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। অনেককে বলতে শুনেছি, ‘এটা পুরনো বিষয়। দেশের আরো অনেক সমস্যা আছে। সেগুলো সমাধান করা দরকার। এরকম বহু সাংবাদিক মারা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের দোষেই মারা যায়। এ নিয়ে এত উঠেপড়ে লাগার কি আছে? সব মিডিয়ার ব্যবসা! সামান্য ঘটনাকে ফলাও করে প্রচার করতে চায়।’ এরকম আরো অনেক কথা মানুষকে বলতে শুনি। তবে গুটিকয়েক মানুষের কথায় কি এত আন্দোলন, এত দাবি আদায়ের প্রচেষ্টা- সবকিছু কি থেমে যাবে? সবাই কি সাগর-রুনিকে ভুলে যাবে? এই হত্যাকান্ডকে কেবলি নিছক দুর্ঘটনা বলে আমাদের মেনে নিতে হবে? মেঘের জীবনের শূণ্যস্থান কি তাতে আরো বেশি আর্তনাদ করে উঠবে না? হয়তো অনেকে বলবেন, ‘এরকম আরো বাবা-মা হারা ছেলেমেয়ে বাংলার ঘরে ঘরে আছে। এ নিয়ে এত প্রচার করার কি প্রয়োজন আছে?’ মানছি, এধরনের হত্যাকান্ড আগেও বহু হয়েছে। কিন্তু আমরা এখন ডিজিটাল, আরো বেশি আধুনিক, সভ্য ও নিরাপদ জীবন প্রত্যাশী হয়ে উঠছি। আমাদের সামাজিক সচেতনতাও বাড়া দরকার। সমাজে যত অপরাধ হচ্ছে তা নিয়ে চুপটি করে থাকাটাকে কেউ যদি শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের চাবিকাঠি মনে করে তা মানতে আমরা নারাজ। সাগর-রুনি ইচ্ছে করলেই বিদেশ-বিভুইয়ে স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারতেন বাকি জীবন। তারপরও তারা দেশে ফিরে এসেছিলেন। দেশের জন্য, দেশের হয়ে কাজ করবেন বলে।
দেশে ফিরে মে ২৩, ২০১১ তে সাগর সরওয়ারের ফেসবুক স্টেটাস আপডেট ছিল এরকম-
সব ঠিকঠাক। এয়ারপোর্টে কোনো মালামাল হারাল না। পথে তেমন জ্যাম পেলাম না। গরম তেমন মোটেই নয়। ভাল লাগার বৃষ্টি হতে শুরু করলো কিছুক্ষণ পর….. ঠান্ডা একটা রাত…আহা দারুণ করে স্বাগতম জানালো আমায় আমার দেশ…বাংলাদেশ।
দেশে ফেরার পরিণতি যদি এতটাই নির্মম হয়, তবে জীবনপ্রেমী মানুষের বিদেশে বসে থাকাটাই কি নিরাপদ?
আমার লেখার প্রারম্ভে মেঘের যে মানসিক ও পারিপার্শ্বিক চিত্র আমি বর্ণনা করেছি তা নিতান্তই কল্পনাপ্রসূত। ১১ই ফেব্রুয়ারী সকালে মেঘ কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মুখোমুখি হয়েছিল তা চিন্তা করার পরিসর বা ক্ষমতা হয়তো আমার মস্তিষ্কে নেই। মেঘ আর কখনই তার বাবা-মার বুকে ফিরে যেতে পারবে না, এটাই এখন নির্মম বাস্তবতা| এখন মেঘ হয়তো মৃত্যুর মর্মার্থ ও গভীরতা কিছুই বুঝতে পারছে না| কিন্তু ও একদিন বড় হবে| ওর বুকের ভেতরে তখন পাহাড়সমান দুঃখ স্তরীভূত হবে| ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার কেউ থাকবে না| এর চেয়ে হতাশাজনক পরিণতি আর কিইবা হতে পারে?
আমাদের দাবি, আমরা সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই। আমরা এটুকু স্বস্তি পেতে চাই যে আমাদের দেশে তদন্ত-বিচার ব্যবস্থা এখনো জননিরাপত্তাকে গুরুত্বের চোখে দেখে। কিন্তু সরকার-প্রশাসন আমাদের কি সেই স্বস্তি এনে দিতে পারবেন? প্রায় এক বছর কেটে গেছে। অনেক প্রশ্নে বিদ্ধ হয়ে আছি। এত প্রশ্নের উত্তর হয়তো পাওয়া সম্ভব নয়। তারপরও আমরা অন্ধকারের চাদরে মোড়া বাস্তবে বসবাস করেও নতুনভাবে আশার আলো দেখতে চাই, মিথ্যে আশ্বাস নয়, নিশ্চয়তা চাই।
শেষ করব কিছু কথা দিয়ে (সংগৃহীত)—
They had a family,
They had a dream to fly against all odds.
But they were made to be stopped…
Yet the dream remains inside our heart,
As we all know,
Good spirits never die!]
আমি প্রথমে এক প্যারা তারপর একটু স্ক্যান করে সাধারণত লেখা শুরু করি। শুরুতে বুঝি নাই কাকে নিয়ে লিখেছেন।
ভালো লাগছে
আমরা কেন যে একটা ইস্যু ধরে রাখতে পারি না
সরব ফিনিক্স এরও একাধিক লেখা আছে।
বলতে পারেন ফিনিক্সের লেখা পড়েই কিছুটা উত্সাহ পেয়েছি। মেঘকে নিয়ে লেখার কথা বেশ কয়েকমাস ধরেই মাথায় ঘুরছিল। একটু রহস্য দিয়েই শুরু করলাম লেখাটা। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব খুশি হলাম।
আলো আসবেই। 🙂 ইনশাআল্লাহ্।
অনেক দুঃখ নিয়েই বলতে হয় ‘ইনশাআল্লাহ’। প্রায় এক বছর তো হয়ে গেল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্তা ব্যক্তিদের কথায় আশা দেখতাম। এখন কিছুটা হতাশ লাগে।
প্রায় এক বছর আগে একই ধরণের একটি লেখা আমিও লিখেছিলাম। আজ এক বছর পরে একই লেখার পুনরাবৃত্তি দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কেন আবারো কাউকে এমন করে লিখতে হবে? তার আগেই কেন এই বিষয়টার কোন সুরাহা হবে না?
আমি জানি, আমার এই প্রশ্নের উত্তর আমার মত সাধারণ কেউ দিতে পারবে না। তবু কাকে যে এই প্রশ্নগুলো ভুল করে করি বারবার, সেটাও জানা নেই।
They had a family,
They had a dream to fly against all odds.
But they were made to be stopped…
Yet the dream remains inside our heart,
As we all know,
Good spirits never die!
সরব নিস্তব্ধ শৈশব ‘এর ডিজাইন করা ফেসবুকের একটা কাভার ফটোতে আপনার পোস্টের শেষের এই কথাগুলো লিখেছিলাম আমি। কষ্টের এই কথাগুলোর পুনরাবৃত্তিও দেখতে হলো আমাকে!
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
আপনার লেখা পড়েই কিন্তু আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। তবে এই বিষয়টা নিয়ে আবারও লেখার উদ্দেশ্য একটাই, মানুষকে নতুন করে মনে করিয়ে দেয়া। আমরা যেই ভুলোমনা জাতি, তাতে এক কথা, এক দাবি হাজারবার তুললেও কাজ হয়না। মেঘের জন্য অনেক কষ্ট হয়। তাই এই সামান্য কয়েকটা বাক্য লিখে যদি কিছুটা হলেও প্রভাবিত করতে পারি তাতেও নিজেকে সার্থক মনে হবে।
এইজন্যই তো আমাদের সব লেখালেখি আপু।
খুব ভালো করেছেন আবার লিখে।
আমার লেখা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছে জেনে সম্মানিত বোধ করলাম।
অনেক ধন্যবাদ।
এই লেখাটিরও ৪৮ ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে, আমরা আবার সব ভুলে যাব…
হাহ… :bigyawn:
🙁