অগোছালো কিছু আর্তনাদ!!

এক মাসের বেশি ছুটি পেয়ে সারাদিন বিভিন্ন ধরনের অকাজ করে বেড়াচ্ছি। মুভির পর মুভি গিলছি। যেভাবে মাসব্যাপী ছুটি পাচ্ছি, মনে হয় না ছয় বছরেও অনার্স পাস করা সম্ভব। তাও খুব একটা খারাপ লাগে না! ভার্সিটি লাইফটা মন্দ না! বুয়েটে পড়ছি, টিউশনির অভাব নাই। যতদিন স্টুডেন্ট থাকা যায় , ততদিনই ভাব নেয়ার সময়! এরপর তো বাস্তবতা ফেইস করতেই হবে। আত্মীয় স্বজন আজকাল মা কে দেখলে বলে , “ আর বেশিদিন তো মেয়ে সাথে থাকবে না। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আমেরিকায় যাবে।“ বুয়েটে চান্স পাওয়ার পর মা বলত “দেশের মানুষের টাকায় পড়তেসিস। যাই করিস না কেন, এই মানুষদের প্রতিদান দিতে ভুলিস না। আল্লাহ পাক অকৃতজ্ঞ মানুষদের ভালবাসেন না। “ কিন্ত দিন দিন হিসাব বদলাচ্ছে, নতুন চিন্তা ভাবনা করতে বাধ্য হচ্ছে মা, বাধ্য হচ্ছি আমি। হয়ত এদেশে চাকরি করলে আমি বেতন কম পাব, শ্রমের উপযুক্ত মর্যাদা পাব না, গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ পাব না, মেধার উপযুক্ত স্বীকৃতি পাব না ( অবশ্য এইটা নিয়ে টেনশন নাই, কারণ আমার মেধাই নাই, সো স্বীকৃতি নিয়ে টেনশন নাই :P)। কিন্তু যে দেশ আমাকে জন্ম থেকে তার বুকে লালন পালন করেছে, যে দেশের শিক্ষা আমাকে হারভার্ড , MIT এর স্টুডেন্টদের সাথে কম্পিট করার যোগ্য করে তুলছে, সেই দেশের জন্য তো এইটুক ত্যাগ স্বীকার করাই যায় । কিন্তু যখন দেখি আমার চারপাশে মৃত্যু ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছে, প্রতি মুহুর্তে আমাকে মারার চেষ্টা করা হচ্ছে, তবুও আমি কৈ মাছের প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছি, তখন অভিমান হয় দেশটার উপর। খাবারের কথা যদি বলি, প্রতি মুহূর্তে বিষ খাচ্ছি আমরা। শাক সবজি, মাছ, মাংস, ফল – দেশের বেশির ভাগ এগুলা নিয়মিত জোটাতে পারে না। যে ভাগ্যবানরা এগুলা কিনতে পারে, তাদের অবস্থা কি? তারা টাকা দিয়ে নিজের ইচ্ছায় বিষ খাচ্ছে। সারা দেশ যখন লোডশেডিঙের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে যায় , তখনও আমাদের বুয়েটে কারেন্ট যায় না। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় , মেডিকাল কলেজগুলায় যখন ভর্তি নিয়ে দুর্নীতি হয়,প্রশ্ন আউট হয়ে যায় , তখনও  আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়া ১০০% স্বচ্ছ । বুয়েটের সিস্টেমের নিয়মতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাধ্য কারও নাই। বিভিন্ন জায়গায় লটারি হয়, তখন বুয়েটকে ডাকা হয়; বিভিন্ন তদন্ত কমিটিতে বুয়েটের প্রতিনিধিকে রাখা হয়; কারণ এখনও মানুষ এই প্রতিষ্ঠানটাকে বিশ্বাস করে। এই প্রতিষ্ঠানটা আমার গর্বের জায়গা, এখনো দেশের মানুষের অহঙ্কারের জায়গা আমার এই ভার্সিটিটা । কিন্তু আমার এই ভার্সিটিটা যখন দুই মাস অচল হয়ে থাকে, যখন আমার এই পবিত্র মাটিতে দুর্নীতির কলঙ্কের ছাপ পড়ে , তখন আমার নিজেকে অসহায় মনে হয়। যখন আমরা নিজেদের রক্ত দেয়ার পরও কারো টনক নড়ে না, এমনকি দেশের নামকরা বুদ্ধিজীবিরা পর্যন্ত এই ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয় না, তখন আমার ভিতরে প্রবল অভিমান জমে উঠে। যখন দেখি আমার সময়ের কোন মুল্য নাই, সেশনজট বাড়তে থাকুক, কারো কিছ আসে যায় না, তখন নিজের ভিতরের রাগকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য বলি, “ আর না, শুধু পাস করার দেরি, যেভাবে পারি বাইরে চলে যাব ।” যখন আমার সামনে দিয়ে ফ্লাইওভার মানুষের মাথায় ভেঙ্গে পড়ে , তখন চিৎকার করতে ইচ্ছা করে আমার। আমি জরুরি কাজ থাকা সত্ত্বেও সন্ধ্যার পর বাইরে থাকতে পারি না , কারণ আমার মা বাবা সন্ধ্যার পরের সময়টা আমি বাইরে থাকলে এক অজানা আশঙ্কায় থাকেন। কারণ বাইরের পৃথিবীটা আমার জন্য নিরাপদ না। তখন আমার নিজেকে সত্যিই পরাধীন মনে হয়। নিজের দেশের রাস্তায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার অধিকার আমার নাই, যখন তখন আমি যে কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে পারি- তখন ইচ্ছা করে মরে যাই ! যখন ছয় বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, অথচ বিচার হয় না- তখন মনে হয় আমার আত্মা মরে গিয়েছে।

খুব বেশি কিছু তো চাই না আমি। অন্তত স্বাভাবিকভাবে মরার অধিকার তো আমি চাইতেই পারি! কিন্তু এখনকার দিনে স্বাভাবিকভাবে মরতে পারাটাও এক বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার। একটু আগে বসে “ RANG DE BASANTI” মুভি টা দেখলাম। নিজের ভেতরের কান্নাটা খুব ভাল করে টের পেলাম। দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তাটা কাপুরুষের কাজ। দেশের জন্য জীবন দিতে পারাটা অতি সৌভাগ্যের ব্যাপার। দেশের জন্য রক্ত দিতে পারলে মানবজন্ম সার্থক । কিন্তু এই মুহূর্তে আমি , কিংবা আমার মত ১০০ জন জীবন দিয়ে দিলেও হয়ত কারও টনক নড়বে না। দেশ ছেড়ে পালানোর চিন্তা করতে নিজেরই লজ্জা লাগে।পালাব না।  দেশকে ভালবাসি , মাঝে মাঝে একটু অভিমান তো করতেই পারি! চোখের সামনে খাবারে ভেজালের কারণে প্রিয় জনের ক্যান্সার হতে দেখলে খারাপ তো লাগতেই পারে। শুধুমাত্র মেয়ে হয়ে জন্মানোর কারণে , বাইরের পশুদের ভয়ে সারা জীবন খাঁচায় থাকতে হবে- এটা ভেবে রাগ লাগতেই পারে! যখন তখন আমার প্রিয় জনের উপর ফ্লাইওভার, ওভারব্রিজ ভেঙ্গে পড়তে পারে, তাদের উপর দিয়ে বেপরোয়া বাস ট্রাক চলে যেতে পারে ভেবে হাত পা কাঁপতেই পারে! নিজেকে বড় দুর্বল মনে হয়। কি করতে পারি আমি! নিজের অবস্থানে সৎ থাকতে পারি। এর বেশি কি করতে পারি আমি! প্রতিটা সিস্টেমে দূষণ ঢুকে পড়েছে । শিক্ষিত কেউ আর রাজনীতিতে আসতে চায় না। ভেঙ্গে পড়ছে সব কিছু। তাও আজও কিছু আশার বাণী শুনি। আজও কিছু মানুষ নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যকে বাঁচায় । প্রত্যন্ত অঞ্চলের রিকশাওয়ালা যখন নিজের কঠোর পরিশ্রমের টাকায় হাসপাতাল বানায়, তখন আবারও আশায় বুক বাঁধি । যখন আমার ছোট পিচ্চি ভাই বাংলাদেশের পতাকা এঁকে গভীর মমতায় তাকায় আর পাকিস্তানের পতাকা এঁকে আমাকে দেখিয়ে বলে “ বুবু, এরা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে, না? আল্লাহ এদেরকে আগুনে পোড়াবে , তাই না?”, তখন আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস নেই। আমি জানি না কি করলে দেশের অবস্থা বদলাবে, কি করলে ঘুণে ধরা সিস্টেমে শুদ্ধ করা যাবে । আমি শুধু জানি , কিছু করার এটাই সময়, আওয়াজ তোলার এটাই সময়।

– রাত জাগা তারা

অন্য স্বর সম্পর্কে

ননরেজিস্টার্ড সদস্যগণও যেন সরবে লিখতে পারেন সেই জন্য এই একাউন্ট। যোগাযোগ পাতায় কিছু লিখে জমা দিলে সরব এর মডারেটরগণ তা মূল্যায়ন করবেন। মনোনীত হলে এই একাউন্ট দিয়ে ছাপা হবে।
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

9 Responses to অগোছালো কিছু আর্তনাদ!!

  1. সুবর্ণরেখা বলেছেনঃ

    MIT, Stanford, আর Cambridge থেকে ডিগ্রী নিয়ে মাহবুব মজুমদার স্যার যখন দেশে এসে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করেন, উনাকে নাকি DU থেকে বলা হয় যে তারা এই ভার্সিটিগুলার নাম জানেনা !
    অথচ তিনি কিনা USA এর প্রেসিডেন্ট এর হাত থেকে পদকপ্রাপ্ত একজন !
    আর এখন কিনা তিনি নর্থ সাউথ এর বিজনেস ফ্যাকাল্টিতে ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিক্স পড়ান !
    এই হল অবস্থা । স্যার হল বাংলাদেশের একমাত্র পদার্থবিদ, যিনি স্ট্রিং থিওরী নিয়ে কাজ করছেন । সারা বিশ্ব যাকে চিনে, সেই মানুষটাকে দেশে এসে এইভাবে অপমাণিত হতে হয়েছে !
    অবিশ্বাস্যই বটে !
    এখন DU তে টিচার হওয়ার জন্য মেধা লাগেনা, দল এর সাথে লিংক থাকা লাগে, দলের হয়ে কাজ করা লাগে । এই হল দেশের অবস্থা । বুয়েট ও সেই পথেই এগুচ্ছে ।
    দেশ ছাড়ার সুযোগ পাওয়ার পরে, যারা দেশে থাকেনা, আগের মত আজকাল তাই আর তাদেরকে খুব বেশী দোষ দিতে ইচ্ছা করেনা ! 🙁

    • হাসান বলেছেনঃ

      আপু আপনার নিকট থেকে এমন দায়ীত্বহীন কথা আশা করিনি।
      DU এর কর্তৃপক্ষ MIT, Stamford, Cambridge চেনেনা এটা কি বাস্তব কোন কথা হতে পারে??? নিজেই ভেবে দেখেন। ওনাকে নিয়োগ না দেয়ার ঘটনাটি অন্য কিছু হবে হয়ত।
      আর আমি খুব ভাল করে জানি DU এর কমপক্ষে ৮০% টিচার এখনো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। DU এর টিচার স্টাফ সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান থাকলেই এমন উলটাপাল্টা মন্তব্য করা সম্ভব।

      • সুবর্ণরেখা বলেছেনঃ

        কথাটা অবাস্তব হতে পারে । তবে কথাটা স্যার এর সাথে পার্সোনালি কাজ করে এমন মানুষের মুখেই আমার শোনা। DU থেকে “শুধুমাত্র” এই কথাটাকেই কারণ হিসেবে দেখাবে, এইটাও আমি মনে করিনা ।
        কথাটা হয়ত তার ক্ষোভ থেকেই এসেছিল এমনটাও হতে পারে । তবে আমি পার্সোনালি বিশ্বাস করি, আমাদের দেশে অবাস্তব বলে কিছুই নাই ।
        যাই হোক, দায়িত্বহীন মন্তব্য দেয়ার জন্য দুঃখিত ।

        • ষূমীথ বলেছেনঃ

          DU তে জাফর ইকবাল স্যারও যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সুযোগ পান নি।

        • ষূমীথ বলেছেনঃ

          DU তে জাফর ইকবাল স্যারও যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু সুযোগ পান নি। ভেতরে বারুদ থাকলে একদিন না একদিন আগুন জ্বলে ঊঠবেই। ভার্সিটি ফ্যাক্টটাকেও এখন আর তেমন বিশাল কিছু মনে না।

      • ডালিম কুমার বলেছেনঃ

        ” DU এর কমপক্ষে ৮০% টিচার এখনো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়।”

        শুন ভাইয়া আমি জানি না তুমি ঢাবি তে পড় কি না কিন্তু তোমার ধারনা সম্পূর্ণই ভুল । হয় তুমি এসবের কোন খবরই রাখো না অথবা বোকার স্বর্গে বাস করছো তুমি ।

        বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এমআইটি থেকে স্নাতক, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (এমএস) এবং যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর বিষয় ছিল ফলিত গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা। এর পর লন্ডনে ইম্পিরিয়াল কলেজে তিনি পোস্ট ডক্টরাল করেন।দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনার জন্য আবেদন করেন। কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ পেলেন না। কিন্তু মাহবুব অদম্য। কাজ করে চলেছেন। এখন তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস ফ্যাকাল্টির ফিন্যান্সিয়াল ম্যাথমেটিকসে শিক্ষকতা করছেন।
        http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-25/news/324191
        পড়ে দেখো

        সাথে এটাও পড়
        http://www.ishafi.com/2006/11/painful-funny-story.html

        এখানে প্রবাসে মাহবুব স্যার কে এক নামে সবাই চিনে । তিনি যখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এর কাছ থেকে পদক পান পুরো বাংলাদেশীরা সবাই দেখতে এসেছিলো তাকে । তার মধ্যে জাফর ইকবাল স্যার ও ছিলেন ।

        • হাসান বলেছেনঃ

          অনেক ধন্যবাদ আপনার তথ্যের জন্য।
          আমি আমার ডিপার্টমেন্টসহ আশেপাশের যে কয়টা ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে জানি বিশেষ করে ইঞ্জিনীয়ারং এবং বায়োলজিক্যাল ফ্যকাল্টিতে এমন কম হয়। আপনি যার কথা বলছেন তিনি যথেষ্ট যেগ্যতাসম্পন্ন এবং নিশ্চয় ব্যতিক্রমদের মাঝেই পড়েন (মানে ২০% দুর্নীতির স্বীকার তিনি) ।

  2. হাসান বলেছেনঃ

    আপনার শঙ্কা ও অভিমানগুলো অনাকাংক্ষিতভাবে বাস্তব 🙁
    কোথাও আশার আলো দেখার পরপরই আন্য অনেক অন্ধকার এসে সব ঢেকে দেয়।

    তবু স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাই…. পরিবর্তন আসবেই ইনশাল্লাহ্।

  3. রাত জাগা তারা বলেছেনঃ

    হুম আপু, অনেককেই দেখি দেশ ছাড়ার সুযোগ পাওয়ার পরও দেশ ছাড়েন না এবং পরবর্তী সময়ে তারা দেশের জন্য কাজ করতে চাইলেও করার সুযোগ এবং উপযুক্ত পরিবেশ পর্যন্ত ঠিকভাবে পান না!! 🙁
    হ্যাঁ , ভাইয়া,পরিবর্তন অবশ্যই আসবে , ইনশাল্লাহ 🙂 কারণ এত অন্ধকারে থেকেও দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও স্বপ্ন দেখতে ভুলে নাই। প্রতিদিন পত্রিকা খুললে শত শত খারাপ খবর যেমন পাই, তেমন এক দুইটা হলেও সাধারণ মানুষের ব্যাক্তিগত সাফল্যের গল্প, সাহসিকতার কাহিনী এখনও চোখে পড়ে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।