মুভি রিভিউ “Incendies”

আমি সাধারণত মুভির রিভিউ লিখি না, সহজ স্বীকারোক্তি এই বিষয়ে আমার জ্ঞান কম। তবে আমাদের এখানে যারা রিভিউ লিখেন তাদেরকে দেখে করুণা হয়, কারণ তারা মুভির ত্রুটি ধরতেই ব্যস্ত থাকেন ফলে মুভির যে প্রধান উদ্দেশ্য ” বিনোদন ” ঐটা থেকেই বঞ্চিত হতে হয়।

যাই হোক, আমাকে খুব ভাবালো এবং আমাকে এখনো কিছুটা অন্ধকারে রেখে দিলো যে মুভি সেটা ২০১০ সালের ১৭সেপ্টেম্বার মুক্তি পাওয়া। বড় ভাইয়ের পিসি নিয়ে অলস সময় কাটাচ্ছিলাম তাই দৈবক্রমে একটা মুভি বেছে দেখা শুরু করলাম। টেনে দেখে নিলাম কোন মার দাঙ্গা নেই, এবং সরল যুদ্ধের কাহিনী। নেট না থাকার সুবাদে আইএমডিবি’র তথ্যবঞ্চিত হলাম।

ভিনদেশী ভাষা হওয়ার কারণে ইংরেজি সাবটাইটেল আবশ্যক। মধ্যপ্রাচ্যের বেনামী কোন দেশের গৃহযুদ্ধের উপর নির্মিত কাহিনী। তবে এখানে যুদ্ধের কিছুই ফোকাস করা হয়নি। ফোকাস করা হয়েছে এক মায়ের জীবনের চরম,নির্মম কিংবা অবিশ্বাস্য জীবন কাহিনী। পুরো সময়টা মুভির ভেতরেই ছিলাম, নিজেকে পর্দার বাইরের দর্শক অপেক্ষা ভেতরের দর্শকই মনে হয়েছে বেশি।

মূলত ফ্ল্যাশব্যাক হিসেবেই চিত্রণ হয় মুভির প্রায় অংশ, আমি সরলভাবে বর্নণার চেষ্টা করি। আরব দেশীয় এক খৃষ্টান নারী প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলো এক মুসলিম শরণার্থীর। নাওয়াল মারওয়ান নামের মেয়েটি প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে মুখোমুখি হয় তার ভাইদের। তারা কোনরূপ বিবেচনা ছাড়াই খুন করে বসে প্রেমিককে। খুন করতে প্রস্তুত হয় বোনকেও। কিন্তু দাদী এসে তাড়িয়ে দেয় দুই ভাইকে, নাওয়ালকে ঘরে নিয়ে তিরষ্কার করতে থাকলে সে দাদীকে জানায় সে গর্ভবতী। দাদী আরও ভেঙে পড়ে।

সন্তান জন্মের পর পরই মুখ রক্ষার জন্যে মায়ের কাছ থেকে জন্মের পর পরই আরেক মহিলার কাছে দিয়ে দেন। নাওয়াল শুরুতে ভেঙে পড়লেও পরে তার দাদীর কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় পড়াশোনা করার দারেশ নামক কাল্পনিক শহরে। এটি চলচ্চিত্রের কথিত শহর। এই নামে আদৌ কোন শহর নেই খুব সম্ভবত। সেখানে তখন যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিলো এবং নাওয়াল সেখানেও তার সন্তানকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো। তার সেই হারানো সন্তানকে যে এতিমখানায় দান করা হয়েছিলো সেটা ততদিনে ধ্বংসস্তূপ। আবারও ভেঙে পড়ে নাওয়াল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এতিমখানার কিছু মানুষ চলে গিয়েছিলো আরেক জায়গায়। সে হাঁটতে থাকে সেখানে উদ্দেশ্য। পথিমধ্যে একটি মুসলিমদের বাস আসতে দেখলে সে তার গলার ক্রুশ খুলে ব্যাগে নিয়ে নেয়, মাথায় কাপড় দিয়ে মুসলিম বেশে বাসে উঠে পড়ে। যাত্রাপথে বাসের অধিকাংশ যাত্রী ঘুমিয়ে পড়লে পরে ঘুম ভেঙে আবিষ্কার করে তাদের বাস আটক করা হয়েছে। ড্রাইভারের অনুনয় বিনয়তে লাভ হলো না। গুলি করে ঝাঝরা করে দেয়া হয় পুরো বাস। শুধু শুয়ে পরে বেঁচে যায় নাওয়াল, এক মা আর তার মেয়ে। ২য়বারের মত নিদারুণ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করে আটককারী খৃষ্টানদের। বাসে তেল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয়া হলে নাওয়াল তার ক্রুশ বের করে খৃষ্টান পরিচয়ের জোরে বেঁচে যায় এবং মায়ের সাথে থাকা মেয়েটিকে নিয়ে আসে নিজের মেয়ে বলে। কিন্তু মেয়েটি ছুটে যায় তার আগুণে দগ্ধ হতে থাকা মায়ের কাছে। গুলি করে হত্যা করা হয় ছোট মেয়েটিকেও।

নাওয়াল ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখানোর জন্যে নিয়োগ পায় খৃষ্টান লীডারের কাছে, হতাশা আর ক্ষোভ থেকে একদিন লীডারকে হত্যা করে বসে। শাস্তিসরূপ কারাগারে পাঠানো হয় ১৫বছরের কারাদন্ডপ্রাপ্ত নাওয়াল ছিলো ৭২ নাম্বার কয়েদি।

কারাগারে বসে গান গাইতে থাকে মেয়েটি এবং পরিচিত হয়ে উঠে ” দ্যা ওমেন হু সিংস ” নামে। তার স্পিরিট শেষ করতেই তাকে তুলে দেয়া হয় দুর্ধর্ষ নির্যাতনকারÌ আবু তারেকের হাতে। সেখানে নিয়মিত নাওয়ালকে ধর্ষণ করতে থাকে আবু তারেক। কিন্তু গান বন্ধ হয় না নাওয়ালের। তার পরিচিতি বাইরেও ছড়িয়ে পরে। মুক্তি পাওয়ার আগেই ধর্ষিতা নাওয়াল জন্ম দেয় জমজ সন্তানের। কারারক্ষীরা সদ্যজাত সন্তানদ্বয়কে নদীতে ফেলে আসতে গেলে নার্স অনুনয় করে সন্তান দুটি রক্ষার এবং গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।

নাওয়াল মৃত্যুর আগে তার দুই জমজ সন্তানের কাছে উইল আর অনুরোধ করে যায় তাদের বাবা তথা মায়ের ধর্ষক আর নাওয়ালের হারিয়ে যাওয়া প্রথম সন্তানকে খুঁজে বের করতে।

আসলে এখানে অতিত আর বর্তমান পাশাপাশি দেখাতে থাকে, তাই ভড়কে যাওয়ার কারণ নেই। নাওয়ালের জমজ সন্তানদের একটি মেয়ে আরেকটি ছেলে। তারা মায়ের উইল অনুযায়ী খুঁজতে থাকে তাদের বাবা আর ভাইকে। এটাই বর্তমান অংশ। আর নাওয়ালের ঘটনা অতীতের ফ্ল্যাশব্যাক মাত্র। যাই হোক, নাওয়ালের সন্তানেরা তার মা’কে সাহায্য করা নার্সের কাছে যায়। তাদের নাম জিন আর সিমন রাখা হয়েছিলো গোপনীয়তার জন্যে। তারা জানতে পারে তাদের হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের নাম নিহাদ। মুসলিমদের নেতার কাছে গেলে তিনি খুলে বলেন ঘটনা। এতিমখানা ধ্বংসের পর তারাই এতিমদের নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধে পাঠায়। নিহাদ স্নাইপার শ্যুটার হয়ে উঠে এবং খুঁজতে থাকে তার মাকে। সে যুদ্ধে অংশগ্রহণে অতি উত্সাহী হয়ে আসল যুদ্ধে যেতে চাইলে লীডার তাকে ফেরত পাঠায় মারা পরতে পারে এই ভয়ে। সে দারেশে ফিরে গেলে শত্রুদের হাতে বন্দি হয় এবং তারা তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নির্যাতনকারী বানিয়ে কারাগারে পাঠায় সাজাপ্রাপ্তদের নির্যাতনের জন্যে। সেখানেই নিহাদ আবু তারেক নাম ধারণ করে।

মৃত্যুর পূর্বে একদিন সুইমিং পুলে সাঁতারের সময় নাওয়াল উপরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের পায়ে ট্যাটু আবিষ্কার করে যা তার দাদী নাওয়ালের সন্তানের পায়ে এঁকেছিলো সনাক্তকরণ সম্ভবের জন্যে। নাওয়াল সুইমিং পুল থেকে উঠে দেখতে পারে সে তার ধর্ষণকারী।

হুম ধাক্কা দিয়েই শেষটা হলো। নিহাদ নাওয়ালের জমজ সন্তানের পিতা সাথে ভাই ও। নিহাদের জন্মের পর নাওয়াল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো সে নিহাদকে সবসময় ভালোবাসবে। তাই জমজ সন্তানের জন্যে রেখে যাওয়া উইলের সাথে নিহাদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে তার ভালোবাসাজ্ঞাপন করে এবং নিজের পরিচয় দেয়। প্রথমে কয়েদী নাম্বার ৭২ এবং তার দুই সন্তানের জনক পরে তার গর্ভধারিণী মা হিসেবে।

মুভিটা দেখে হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিলাম।

সব বয়সীদের জন্যে প্রযোজ্য, কোন সেক্স সিন নেই, কোন বাজে শব্দের ব্যবহার বর্জিত। অভিনয় নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। যে সময় যে এক্সপ্রেশান দরকার ছিলো তাই ফুটে উঠেছে পারফেক্টভাবে। তাই সোয়া দুই ঘন্টার মুভিতে পুরো সময় জুড়ে একটুও ক্লান্তি আসেনি। শুরু থেকেই মুভির গভীরতা টের পাওয়া যায় এবং হারিয়ে যেতে হয় মুভিতেই। ২০১১সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিবেচনায় সেরা দশের তালিকায় স্থান পায় মুভিটা যোগ্যভাবেই। এটিতে কোন নির্দিষ্ট দেশ, পাত্রের উল্লেখ নেই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিভিন্ন সময়ে ঘটে যাওয়া গৃহযুদ্ধের সব ব্যাপার সুন্দরভাবে ফুটে আসলেও মূল বিষয় একটাই। একটা অবহেলিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত, ধর্ষিত মায়ের জীবনের করুণ পরিণতি।

Name: Incendies
IMDb rating: 8.1/10

একটা জিনিস মাথায় রাখবেন আইএমডিবি রেটিং সব নয়, শাটার আইল্যান্ডের রেটিং ৮ এর নীচে ছিলো। ” অবশ্যই দেখবেন ” রেকমেন্ডেড একটা মুভি।

মুভির নামের অর্থ কেউ ইংলিশ টু বাংলা অভিধানে খুঁজতে যাবেন না। এটি একটি ফ্রেঞ্চ শব্দ। যার উচ্চারণ ” আনসানজি ” এবং অর্থ ” Fire “

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

11 Responses to মুভি রিভিউ “Incendies”

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    টাইটেল দেখেই লেখাটা পড়তে চলে এলাম। আমার পছন্দের লিস্টে প্রথম ৫টি মুভির একটি হবে এটি। এত বেশি ধাক্কা খেয়েছিলাম মুভিটা দেখে তা বলারও বাইরে। অসাধারণ ফ্লো, ক্যামেরার কাজ। গল্পের গতি সময়ের সাথে সাথে প্রাণ পেয়েছে। এক কথায় পুরো মেকিং, কাহিনী অনবদ্য।

    তবে আগে কখনো বোধহয় আপনি মুভি রিভিউ লেখেন নি।
    ভবিষ্যতে অন্য মুভি রিভিউ লেখার আগে অন্যদের রিভিউ পড়ে নেবার অনুরোধ থাকল। কারণ দুঃখের বিষয় হলো, আপনার রিভিউ পড়ার পর কেউ কেউ আর মুভি দেখার আগ্রহ বোধ না-ও করতে পারে। আপনার রিভিউতে আপনি মুভির পুরো কাহিনী বলে দিয়েছেন, স্পয়লার না দিয়ে রিভিউ লেখা উচিত আসলে। একটা সাসপেন্স রেখে রিভিউ শেষ করলে হয়তো পাঠকরা অনেক বেশি আগ্রহ বোধ করতো পরের কাহিনী জানার জন্য।

    সামনেরবার আরো পরিপক্ব রিভিউ আশা করছি আপনার কাছ থেকে। 🙂

    • অনির্ণেয় অন্তরক বলেছেনঃ

      আমার প্রথম রিভিউ। এর চেয়ে ভালো মুভি দেখেছি তবে এতো আবেগ আর কখনও কাজ করেনি। আমি এক জায়গায় জিজ্ঞেস করলাম রিভিউ কিভাবে লিখতে হয়! মূলত কাহিনী স্পয়েলের ব্যাপারেই জিজ্ঞাসা। তারা বলেছে রিভিউ লেখার আদৌ কোন নিয়ম নেই। আমি তাই আমার মত লিখে বসলাম। এখন জানলাম স্পয়েল করা অনুচিত। আগ্রহ হয়তো পাবে তবে মজাটা হারিয়ে ফেলবে!!

      আমি এর কোন ভালো রিভিউ পাইনি। কোন টুইস্টেড আর শক লাগানো মুভিরই ভালো রিভিউ পেলাম না অনলাইনে!!!!

      • সামিরা বলেছেনঃ

        স্পয়লার তুমি চাইলে রাখতে পারো, তবে লেখার একদম শুরুতে *স্পয়লার অ্যালার্ট* লিখে রাখতে পারো অন্যদের সুবিধার জন্য।

      • ফিনিক্স বলেছেনঃ

        সামিরার এই বুদ্ধিটা খুবই ভালো!
        ‘স্পয়লার অ্যালার্ট’ হেডিং দিয়ে রাখলে ঐ অংশটুকু স্কিপ করা যায় সহজেই!

        আমি এই মুভির আরেকটা রিভিউ পড়েছিলাম ‘দারাশিকো ব্লগ’এ। ওটা পড়েই মুগ্ধ হয়ে মুভিটা দেখেছি। ভাইয়ার রিভিউগুলো আমার কাছে বেশ ভালো লাগে। চাইলে ওক্ষান থেকে একবার চোখ বুলিয়ে আসতে পারেন। 🙂

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    প্রথম রিভিউ অনেক ভালো লাগলো। মুভিটা হাতে পেলে দেখে ফেলবো।

    শেষের ধাক্কাটা ইডিপাসের কথা মনে করিয়ে দিল।

  3. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    বিশাআআআআল ধরনের শক খাইলাম… 😯 তবে সুযোগ পেলে দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে। ভালো লেগেছে।

    • অনির্ণেয় অন্তরক বলেছেনঃ

      আমার মনে হয় এই মুভি না দেখলে বিরাট মিস!

      অবশ্যই দেখে ফেলবেন। এই কয়দিন শকের উপর আছি এই টাইপ মুভি দেখতে দেখতে! ধন্যবাদঃ 🙂

  4. দারাশিকো বলেছেনঃ

    যারা মুভি রিভিউ লেখার চেষ্টা করেন তাদের করুণার দৃষ্টিতে দেইখেন না, একটা ভালো রিভিউর বৈশিষ্ট্যই হল সিনেমাটা কতটুকু ভালো হল সেটা বের করে আনা। আর ব্যাপারটার এরকম না যে, তারা ওৎপেতে বসে থাকেন, কোথায় কি ভুল আছে সেটা ধরার জন্য। সাধারণত সিনেমার আভ্যন্তরীন বিষয়গুলো জানা থাকে বলে গুনাবলী ও ত্রুটিগুলো চোখের সামনে চলে আসে – বিনোদিত হতে না পারলে বছরের পর বছর সিনেমার রিভিউ লেখা আসলে সম্ভব হতো না।
    এই তো 🙂 ভালো থাকুন 🙂

  5. শারমিন বলেছেনঃ

    মুভিটা দেখতে হবে তো
    দেখা হয় নাই
    ভালো লেগেছে 😀

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।