তখন বেইলী রোডের আমলাদের আড্ডাখানায় সুনিধি চৌহান নামে এক ভারতীয় শিল্পীর কনসার্ট হচ্ছিল। অফিসার্স ক্লাব ছোট্ট জায়গা। তার দেয়ালের ফাকা ফাকা গ্রীলের মধ্য দিয়ে তাকালে ভেতরের মাঠে ঘটায়মান সব কিছু দেখা যায়। সেই দেয়াল ঘিরে আজ দাঁড়িয়ে ছিল হাজারো জনতা । ভেতরে অপসংস্কৃতিতে লিপ্ত বিত্তশালীদের কদর্য্য উন্মাদনা আর বাইরে গ্রীলের ফাক দিয়ে বিত্তহীন মানুষজনের চকচকে দৃষ্টি। রিক্সাচালক, বাদামওয়ালা, ডিউটি পুলিশ, মোটরবাইকআরোহী যুবক এবং আমি এক টিউশনি সর্বস্ব বেকার- আমিও কয়েক মিনিটের জন্যে ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকেছিলাম। ভেতরে কি হচ্ছে দেখার কৌতুহল হচ্ছিল। এক লোক মোবাইলে গান রেকর্ড করছে। আরেকজন আবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো, বললো ” কি কয়? কিছুইতো বুঝি না।”
আমিও কিছুই বুঝলাম না শুধু কতগুলো শব্দ-
” মাতো এমি এমি এমি এমি, এমি লুকায়া”
হেটে হেটে রমনার দিকে চলে আসছিলাম। রাস্তায় শতশত গাড়ি। পেছন থেকে উচ্চগ্রামের লাউডস্পীকারের কল্যানে তখনো কানে ভেসে আসছে সুনিধি চৌহানের গলা।
রমনার গেইটের পাশে একটা পার্ক করা গাড়ি থেকে খুব লো ভলিউমে একটা গান ভেসে আসছিলো-
” কারে দেখাবো মনের দুঃখগো আমি বুক চিড়িয়া-
অন্তরের তুষেরি অনল জ্বলে রইয়া রইয়া।”
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে শুনলাম। এত সুন্দর গান যেই দেশের শিল্পীরা গায়, সেই দেশের মানুষের কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজাতীয় শিল্পীর কোয়ালিটিলেস যৌন সুড়সুড়ি মুলক গান শুনতে হয় আমি বুঝতে পারলাম না।
দুটি ব্যাপারে প্রশ্ন জাগলো-
১. অফিসার ক্লাব সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসারদের জায়গা। হিন্দী গানের কনসার্টে যারা লাফাচ্ছিলেন- বুকে তাদের অবশ্যই হিন্দী সংস্কৃতির জন্যে অনেক মায়া, অনেক আগ্রহ। এত মায়া বুকে ধরে তারা ইন্ডিয়ার সাথে ডিল করেন কি ভাবে? নাকি এজন্যেই সীমান্তে প্রতিদিন পাখির মত মানুষ মারা গেলেও কেউ একটু টু শব্দ করে্ন না।
২. অনেককেই দেখেছি মাইকে ওয়াজ করার কারনে শব্দদুষনের ব্যাপারে উচ্চকন্ঠ। কেউ কেউ মাইকে আজান দেয়া নিয়েও বজ্রকন্ঠী। এই সব কনসার্টে যে তার চেয়েও বহুগুণ বড় লাউডস্পীকার ব্যাবহার করা হয় ( আমি মৌচাক থেকে রমনা পার্ক পর্যন্ত কনসার্টের শব্দ শুনেছি) সে ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলেন না কেন?
পরিশেষে একটা কথা বলি এতদিন ধারনা ছিল হিন্দী সিনেমা এবং সিরিয়াল প্রিয়তা শুধু কাজের বুয়া আর অশিক্ষিত বিত্তশালী (যারা ইংরেজী বোঝেন না) তাদের মাঝে সীমাবদ্ধ। এখন দেখলাম পচন অনেক গভীরে।
হঠাৎ মনে পড়লো অফিসার্স ক্লাবে আমি কখনো বাংলাদেশি ঐতিহ্যবাহী কোন শিল্পীর কোন প্রোগ্রাম দেখি নি।
আমাদের ইলেক্ট্রিকাল ডের অনুষ্ঠানে আমরা কুদ্দস বয়াতিকে এনেছিলাম। যে পরিমান আনন্দ পেয়েছিলাম অনেক বড় বড় আধুনিক শিল্পীর কনসার্টেও তা পাই নাই। এইসব শিল্পীদের মাঝে তো নয়ই। আনন্দ শুধু অনেক টাকা খরচে আর বিদেশ থেকে আরো স্পেসিফিকালি ইন্ডিয়া থেকে যাকে তাকে ধরে আনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না।
কাকে কি বলছি, যে দেশের মন্ত্রী জায়গা না পেয়ে মাটিতে বসে পড়েন- শাহরুখের লাফালাফি দেখার জন্যে, সে দেশে তো এসবই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক জিনিসের প্রতিবাদ করে আমি বরং অন্যায় করে ফেলছি।
আমি ক্ষমাপ্রার্থী!
মিজানুর রহমান পলাশ
নজরুল ইসলাম হল, বুয়েট।
কিছুই বলার নাই; শুধুই মনে হচ্ছে-
“ কারে দেখাবো মনের দুঃখগো আমি বুক চিড়িয়া-
অন্তরের তুষেরি অনল জ্বলে রইয়া রইয়া।”
সেটাই
🙁 আসলেই পচন অনেক গভীরে…
🙁
🙁
🙁