শুনলাম আমার অনুবাদে অরুন্ধতী রায়ের ব্রোকেন রিপাবলিক এখন বইমেলাতে শুদ্ধস্বরের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। অনুবাদ বিষয়ে আমার নোটটা দুই একটা পত্রিকায় আসছে, ভাবলাম ব্লগেও রেখে দেই।
ঋণ স্বীকার
অনুবাদ খুব কঠিন কাজ মনে হয় আমার। অরুন্ধতী রায় ইংরেজীতে যে রকম তেজ ও আবেগের সাথে কথাগুলি বলেছেন, বাংলাতেও আমি সেরকম স্বর রাখতে চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানি না। বিভিন্ন সময়ে আমার অনুবাদ পড়ে, মূল লেখার সাথে মিলিয়ে দেখে, তাঁদের প্রতিক্রিয়া ও অনুভুতি জানিয়ে উৎসাহ দিয়েছেন প্রিয় কয়েকজন মানুষ –
দোলনচাঁপা চক্রবর্তী, নুশেরা তাজরীন, তারেক রহিম, অরুণাভ সিংহ, নবারুণ চাকমা, ইকরাম মাহমুদ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, শিবু কুমার শীল, আহমেদুর রশিদ টুটুল, সানিয়া রুশদী, চিংখৈ অঙোম এবং আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক আমার বাবা আলী আহমেদ রুশদী।
সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

যে কারণে ব্রোকেন রিপাব্লিক অনুবাদের প্রয়োজন বোধ করেছি
“আমরা দাঁড়াই প্রতিদিন
নব নব জানাজায়…”
-মৃদুল শাওন
শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর আহমেদুর রশিদ যখন আমাকে বললেন “The Broken Republic” অনুবাদ করে দিতে তখন বেশ অবাক হয়েছিলাম। গল্প, উপন্যাস আর কবিতার বাইরে পড়াশোনা খুব কম আমার।
অরুন্ধতীর তেজস্বী প্রকাশভঙ্গীর ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও আরেকটা ইতস্তত ভাব কাজ করছিল মনে। তাঁর এই বইটা ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার উপরে একটা কেস-স্টাডি, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? ২০১০ সালের মার্চ মাসে সানফ্রানসিসকোর মিশন হাইস্কুলে অরুন্ধতী বক্তৃতা করেছিলেন তাঁর বই Listening to Grasshoppers – Field Notes on Democracy প্রকাশিত হওয়ার পর। বক্তৃতার শুরুতেই তিনি বললেন ‘‘গত এক বছরে আমার প্রায় সমস্ত সময় গেছে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা দেখে এবং সে বিষয়ে লিখে। যত দিন যাচ্ছে, যত দেখছি, কাজ করছি এবং লিখছি, ততই ‘ভারত’ ‘পাকিস্তান’ ‘যুক্তরাষ্ট্র’ ‘আফগানিস্তান’ এই শব্দগুলি অর্থ হারাচ্ছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে যেন এ দেশগুলোর প্রভাবশালীরা ধরাছোঁয়ার বাইরের এক দুনিয়ায় পৌঁছে গিয়ে নিজেদের জন্য একটা দেশ বানিয়ে নিয়েছেন আর আমরা বাকিরা পড়ে আছি আমাদের ভিসা-পাসপোর্ট আর সীমান্ত-নিয়ন্ত্রণের চক্করে। আর তাই এ শব্দগুলোর সঠিক ব্যবহার এখন আর জানিনা আমি’’। এই কথাগুলো শুনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে The Broken Republic এর প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে আমার প্রাথমিক দ্বিধা কেটে গেছে।
সেই একই বক্তৃতায় গণতন্ত্রের বর্তমান ব্যবহারিক রূপ ব্যাখ্যা করার সময় অরুন্ধতী তাঁর ছোটবেলার কথা বলছিলেন, ‘‘যখন স্কুলে পড়তাম, আমার এক শিক্ষকের সব্জি বাগানের সমস্ত গাজর চুরি করেছিলাম একবার। মাটির নীচ থেকে গাজরগুলো তুলে নিয়ে উপরে গাছের অংশটুকু আবার একইভাবে পুঁতে রেখেছিলাম যাতে বাইরে থেকে কিছু বোঝা না যায়। তারপরে আরো বেশ কিছুদিন ধরে আমার সে শিক্ষক তাঁর গাজর-বাগানে পানি দিতে দিতে ভেবেছেন গাছগুলো কেন সব মরে যাচ্ছে? মাঝেমাঝে আমার মনে হয় এরকমই কিছু একটা হচ্ছে এখন, যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিতভাবে গণতন্ত্র কায়েম করার কথা, সংবাদমাধ্যম, আদালত, সংসদ সবকিছুই ফাঁপা করে ফেলা হয়েছে ভেতর থেকে, আমরা তবুও ভোট দিয়ে যাই, আশা করে যাই কিন্তু আরো বেশি করে আশাহত হতে থাকি…’’।
The Broken Republic প্রকাশিত হয়েছে ২০১১ সালে। তিনটি রচনা আছে এতে ‘চিদাম্বরম মহোদয়ের যুদ্ধ’ (Mr Chidambaram’s War), ‘কমরেডদের সাথে পথ চলা’ (Walking with the Comrades) ও ‘চুঁইয়ে পড়া বিপ্লব’ (Trickledown Revolution)| ভারতের নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নের জাঁতাকলে কিভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে গ্রাম ও বনাঞ্চলের লোকজন, বিশেষ করে আদিবাসী ও দলিতরা, তার বিবরণ রয়েছে বইটিতে। পাঠকের সাথে আলাপচারিতার মত করে দেয়া এই বিবরণগুলোর মাধ্যমে ভারতের বর্তমান আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন অরুন্ধতী। সেইসাথে প্রাসঙ্গিকভাবেই যোগ হয়েছে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের নানা খন্ডচিত্র। বইটির রচনাকাল ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল।
রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে আমি বর্তমান সময়ের একজন সাধারণ নাগরিক যেটুকু জানেন তার বাইরে তেমন কিছু জানি না। জন্মের পর থেকেই লাগাতার যুদ্ধ, বিদ্রোহ, আক্রোশ, দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িকতা, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, অপহরণের কথা শুনতে শুনতে এবং দেখতে দেখতে আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো যা দেখায়, যেভাবে দেখায় আমরা তাই দেখি। যেন নেপথ্যে একই বৃত্তে অনর্গল বাজছে একঘেয়ে সুর যা উপেক্ষা করে আমরা দৈনন্দিনতায় ডুবে থাকতে পারি। ‘প্রাণ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়’, ‘দেশ টা আর থাকার যোগ্য থাকলো না’, ‘খবরে খুন, ধর্ষণ অথবা যুদ্ধ ছাড়া আর কি থাকে?’ বাক্যগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই পরিচিত। আমরা জানি এরকমই হয়, এরকমই চলে। তবুও মটরশুঁটির মধ্যে মটর দানার মতন গুটিশুটি বেঁচে নিতে হয় যেটুকু পারা যায়।
অরুন্ধতী রায়ের The Broken Republic বইটি পড়ার সময় মনে হচ্ছিল একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতরে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে- আমার দমবন্ধ হয়ে এসেছে আতঙ্কে, রাগে, লজ্জায়, দুঃখে, বিস্ময়ে এবং অবিশ্বাসে। অথচ তাঁর কথাগুলি বিশ্বাস না করেও উপায় নেই, এরকম সাজানো গণতন্ত্র তো বাংলাদেশেও দেখেছি – অতীতেও দাপটের সাথেই অধিষ্ঠান করেছে এবং এখনো করছে।
যে কারণে দ্যা ব্রোকেন রিপাব্লিক অনুবাদের প্রয়োজন বোধ করেছিএই বইটির দুই বছর আগে প্রকাশিত হয়েছে Listening to Grasshoppers-Field Notes on Democracy। সেখানে শুরুতেই অরুন্ধতী লিখেছেন ‘‘মৃত্যুর পরেও জীবন রয়েছে কিনা এই তকের্র সাথে কি আমরা আরেকটা তর্ক যোগ করতে পারি? গণতন্ত্রের পরেও কি রয়েছে আরেক জীবন? কি রকম জীবন হবে সেটা? গণতন্ত্র বলতে আমি গণতান্ত্রিক আদর্শ বোঝাচ্ছিনা। বলছি এর ব্যবহারিক মডেল নিয়ে…
এখানে আসল প্রশ্নটা হচ্ছে গণতন্ত্রের কি অবস্থা করেছি আমরা? কিসে পরিণত করেছি? গণতন্ত্রের ব্যবহার ফুরানোর পর কি হবে যখন এর ভেতরটা ঝাঁঝরা হতে হতে অর্থহীন হয়ে পড়বে আর এর সমস্ত সংগঠনগুলো রূপ বদলে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে? কি পরিণাম ডেকে আনবে গণতন্ত্র আর মুক্তবাজারের দ্রবনে রূপান্তরিত এই লুটেরা অবয়ব যার কেন্দ্রে রয়েছে সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়ের ধারণা? এই প্রক্রিয়া কি উল্টে দেয়া সম্ভব? আবার আগের মতন হওয়া সম্ভব হবে কি?
আমাদের এই পৃথিবীটা টিকিয়ে রাখার জন্য এখন প্রয়োজন দূরদৃষ্টির। কিন্তু যেসব সরকারের নিজেদের টিকে থাকা নিভর্র করে তাৎক্ষণিক, নিষ্কর্ষ, স্বল্পমেয়াদী মুনাফার ওপর তারা কিভাবে আমাদের পথ দেখাবে? আবার এমন হবে না তো যে আমাদের স্বল্প-মেয়াদী আশা ও প্রার্থণার পবিত্র উত্তর, আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতার রক্ষক এবং আমাদের লোলুপ স্বপ্নগুলোর প্রতিপালক এই গণতন্ত্রই একদিন সমগ্র মানব-জাতির ধ্বংস রচনা করবে? আমাদের সবচেয়ে বড় বোকামি অদূরদর্শিতাকে প্রতিফলিত করে বলেই কি আধুনিক মানুষের মধ্যে গণতন্ত্র এতটা জনপ্রিয়? আমরা পশু-পাখির মতন সর্বক্ষণ বর্তমানেও বাস করতে পারি না আবার খুব দূরের ভবিষ্যৎও আমাদের নজরে আসেনা বলে আমরা অদ্ভুত এক মধ্যবর্তী জীব হয়ে রয়েছি। আমাদের বিস্ময়কর বুদ্ধিমত্তা হয়তোবা টিকে থাকার সহজাত বোধটুকু কেড়ে নিয়েছে। আমরা প্রকৃতি ও পৃথিবীর উপর ক্রমাগত লুঠতরাজ চালাই আর মনে করি প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুগত সম্পদ জমা করলেই বুঝি হারিয়ে ফেলা সেই অথই-স্পর্শাতীতের শূন্যস্থান পূরণ করা সম্ভব’’।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের বদ্দারহাটে উড়ালসেতুর গার্ডার ভেঙে অথবা নিশ্চিন্তপুরের তাজরিন ফ্যাশনস ভবনে আগুন লেগে নিহত মানুষগুলো এবং তাদের মত আরো অনেকেই শিকার এই ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বাজারী গণতন্ত্রের। মুনাফার তলায় চাপা পড়ে, মুনাফার আগুনে পুড়ে মরছে মানুষ। আমরা টেলিভিশনে দেখি নিহতদের আত্মীয়দের পাশে দুঃখিত চেহারার নেতা-নেত্রীদের, সংবাদপত্রে পড়ি সরকার ও বিরোধীদলগুলোর পরস্পর দোষারোপ এবং আহাজারির বিবৃতি। দুর্নীতির কোন স্তর এবং অর্থলোলুপতার কোন পৈশাচিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে এই ঘটনাগুলো? সব জেনে বুঝেও প্রতিবাদ জানাতে পারছি না আমরা অথবা প্রতিবাদী স্বরগুলোর কন্ঠরোধ করা হচ্ছে গুমখুন, মারামারি, নির্যাতন আর অপপ্রচারের মাধ্যমেু এটাই বা দমনের কোন পর্যায়?
The Broken Republic বইয়ে অরুন্ধতী রায় পুলিশের গুলিতে নিহত এক কমরেডের মায়ের কথা লিখেছেন
‘‘২০০৯ সালের জুলাই মাসের ৬ তারিখে কমরেড দিলীপকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল, দেখা হলো তাঁর মা চামরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, দিলীপকে মেরে ফেলার পরে ওরা তার দেহ মৃত পশুর মতন বাঁশে ঝুলিয়ে নিয়ে গেছে সাথে করে। (নগদ পুরষ্কার পাওয়ার জন্য মৃতদেহ দেখাতে হয়, নয়তো অন্য কেউ এসে টাকা নিয়ে চলে যায়।) চামরী তাদের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে পুলিশ ফাঁড়ি পর্যন্ত চলে গেছিলেন। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে মৃতদেহের গায়ে একটা সুতাও ছিল না। চামরী জানান যাওয়ার পথে একটা ধাবায় থেমে চা বিস্কুট খাওয়ার সময় (যার দাম মেটায় নি) ওরা মৃতদেহ ফেলে গেছিল রাস্তার পাশে। এই মায়ের মুখটা কল্পনা করে দেখেন এক মূহুতের্র জন্য, যিনি জঙ্গলের মধ্য দিয়ে দৌড়েছেন তাঁর সন্তানের লাশের পিছনে, দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন কখন তার খুনীদের চা খাওয়া শেষ হবে। ছেলেটাকে ঠিক মতন দাফন করার জন্য লাশটাও ফেরত দেয়া হয়নি তাঁর কাছে। শুধু একটা গর্তে সেদিনের সদ্য খুন হওয়া আরো কয়েকটা লাশের সাথে ফেলে দেয়া তাঁর ছেলের মৃতদেহে এক মুঠ মাটি ছড়াতে পেরেছিলেন তিনি’’।
কমরেড দিলীপ তো তবু রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। নিশ্চিন্তপুরের নিহত গার্মেন্ট কর্মীদের আত্মীয়দের হয়রানির কথা জানার পর নিদারুণ এক অসহায়তা ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকে না। প্রথম আলো পত্রিকায় ১১ ডিসেম্বর ২০১২ তে ফারুক ওয়াসিফ লিখেছেন
‘‘চাঁদপুরের স্বর্ণা গ্রামের আসমা আক্তারের সঙ্গে দেখা হয়়ছিল ২ ডিসেম্বর। তিনিও খুঁজতে খুঁজতে চলে এসেছেন ঢাকায়। তাজরীন ফ্যাশনসে তাঁর বোন নাসিমা, বোনজামাই আর কন্যা কাজ করতেন। অন্তিম সময়ে আগুনের মধ্যে থেকে বোন তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘আমরা আর বাঁইচত পারতাম না, তুমি আমাগো লাশ নিত আইস।’ আসমা আক্তার তাই আশুলিয়া থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিজিএমইএ ভবন থেকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের রাজদুয়ার পর্যন্ত স্বজনের লাশ দাবি করে গেছেন। পাননি। বুক চাপড়় তিনি বলছিলেন, ‘আমাগো লাশ গুলা না দিক, আমারেসহ জ্বালাইয়া দিক। আমার টাকা লাগত না।’ কেউ শোনেনি, শোকে আর রাগে তিনি একাই জ্বলছেন। সরকার ভুলতে পারে নাগরিককে, মা কীভাবে ভুলবেন নাড়়ছেঁড়া কন্যাকে? জীবনের অধিকার না হোক, লাশ পাওয়ার অধিকার ছাড়বেন কেন তিনি? তাই ছুটে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের রাজধানীতে।’’
অরুন্ধতীর বইয়ে ভারত সরকারের অপারেশন গ্রীনহান্ট বিষয়ে বলতে বলতে তিনি লিখেছেন
‘‘নিরাপত্তা বাহিনী, মাওবাদী বা বেসামরিক মানুষ, এই ধনী মানুষের যুদ্ধে সবচাইতে গরীব মানুষগুলোই মারা যাবে।’’
এরকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই বাংলাদেশে। গত এক বছরে দেখা অসংখ্য সংবাদ শিরোনাম মনে উঠে আসছে। বার্মা থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের নিয়ে তর্ক বির্তক, গলাবাজি, গালাগালি দেখেছি, কেউ তৎপর হয়েছেন ‘মুসলিম ভাই’ দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার জন্য (অন্য সময় যাদের মানবতা ঘুমিয়ে থাকে) আর কেউ দাবী করেছেন রোহিঙ্গারা ‘জামাতের ভোটব্যংক’। রামুর বৌদ্ধমন্দিরের উপর হামলা, নিরীহ মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে তাদের পথে বসাতে দেখেছি। আরো দেখেছি পাঁচ বছরের শিশু ঘুম ভেঙে উঠে এসে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে বাবা মায়ের রক্তাক্ত লাশ, তার বিস্মিত, ভয়ার্ত দৃষ্টি প্রশ্ন করতেও শেখেনি এখনো। আর এখন দেখছি রাজনৈতিক অবরোধ ও দলীয় সংঘর্ষে হত্যা করা হয়েছে বোকা অরাজনৈতিক বিশ্বজিৎকে। জেনেছি শিক্ষক-ছাত্র ও শ্রমিকদের প্রতিবাদ মিছিলের উপ নির্দ্বিধায় পেপার-স্প্রে ব্যবহার করা হয়েছে আর আমাদের নির্বিকার সরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘পেপার স্প্রে নিয়ে কারো মত দেবার অধিকার নাই’। এ সবকিছু নিয়েই খুব শোরগোল হয় কিছুদিন আর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল শোনায় তাদের নানারঙের গল্প, কেউ ধর্ম ব্যবসায়ী আর কেউ বিক্রী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। শেষ পর্যন্ত মানুষগুলো শুধুই সংখ্যা হয়ে যায়। আমরা এসব জানি, মেনে নিয়েছি, তাই ভুলে যাই। আমাদের স্বার্থপরতাও এই ভুলে যাওয়ার অংশ। নিজেদের পরিবারের বা আপন কাউকে না হারালে কোন নৃশংসতাই দাগ কাটে না আমাদের মনে, তাই সেভাবে কোন পদক্ষেপও নেই না। অরুন্ধতীর কথার প্রতিধ্বনি তুলেই বলছি, যদি আমরা মনে করি এ বীভৎসতা কখনো আমাদের স্পর্শ করবে না, তাহলে ভুল ভেবেছি।
The Broken Republic বইটিতে বিবৃত প্রতিটি ঘটনার সাথে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ দিয়েছেন অরুন্ধতী। এ সম্পর্কেও বলেছেন তার আগের বইয়ে ‘‘একজন গল্পকার হিসাবে প্রায়ই আমার ভয় হয়েছে সবসময় সম্পূর্ণ নির্ভুল হওয়ার এবং বাস্তব ঘটনাগুলো ঠিকভাবে প্রকাশের আমার এই চেষ্টা হয়তো কোনভাবে ঘটনাগুলোর ব্যপক ভয়াবহতার ধার কমিয়ে দেবে। তথ্যের ব্যপারে এই সাবধানতার কারণে কি কোনভাবে আরো বড় সত্য আড়ালে থেকে যাচ্ছে? এই নিরস, বাস্তবিক নির্ভুলতা নয় আমাদের প্রয়োজন এক বুনো চিৎকারের অথবা কবিতার রূপান্তর ক্ষমতা এবং স্পষ্টতার। কিন্তু ভারতের এই চতুর, বুর্জোয়া, ফাইল-বন্দী, কূট ‘সঠিক-মাধ্যমে-আবেদন-করা’র শাসন ও বশ্যতার পদ্ধতি আমাকে কেরানী বানিয়ে ছেড়েছে। তবে এটুকু বলতে পারি ভারত প্রশাসনের কর্মপদ্ধতির এই হিপোক্রেসি, ঠান্ডা মাথার নৃশংসতা, উপেক্ষা ও অনুভুতিহীনতার গোলকধাঁধাঁ উন্মোচন করার জন্য আমাকেও বেছে নিতে হয়েছে অস্বাভাবিক পদ্ধতি। ‘সঠিক-মাধ্যমের’ নিপীড়ন মাঝে মাঝে জন্ম দেয় ‘সঠিক-মাধ্যমের’ প্রতিরোধের। আমি জানি প্রতিরোধ হিসাবে এটুকু যথেষ্ট নয় কিন্তু আপাতত এটুকুই সম্বল আমার। হয়তো কোনদিন এর থেকেই রচিত হবে সেই নতুন কবিতা আর বুনো চিৎকার।’’
ভারত প্রশাসনের দমন পদ্ধতির সাথে অরুন্ধতী মিল খুঁজে পেয়েছেন জর্জ বুশের সরল বাইনারির, হয় তোমরা আমাদের সাথে আছ আর নাহয় তোমরা মাওবাদী। তিনি বলেছেন ‘যখন ওয়ার অন টেররের এই যমজ ভাই সমস্ত অক্সিজেন শুষে নিতে ব্যস্ত থাকবে, প্রশাসন সেই সুযোগে যাবতীয় প্রতিরোধমূলক আন্দোলনকে ‘মাওবাদী সমব্যাথী’ তকমা এঁটে দিয়ে সামরিক কায়দায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে।’
এই সরল বাইনারি বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও খুব পরিচিত মনে হচ্ছে।

প্রচ্ছদ – শিবু কুমার শীল
প্রকাশক – শুদ্ধস্বর (অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩, স্টল নং – ৪৩৬, ৪৩৭, ৪৩৮)
অরুন্ধতীর প্রেমে পড়েছিলাম ক্লাস টেন এ থাকতে।
সে কী চিন্তা!
ভাবছি পরিবর্তন আসলে আসবে কীভাবে? র্যাশনালিজম কাজ করবে না… করে না… [র্যাশনালিজম এর নিজেরও প্রবলেম আছে… আপনার এই অনুবাদ তো শেষ বিচারে এক প্রকারের র্যাশনালিজম…চিন্তা করে আগাতে বলছেন]
কাজ করে আবেগ।
গার্মেন্টস নিয়ে চিল্লাচিল্লি ২ দিন (আবেগ, যুক্তিবিবর্জিত) তারপর ভুলে যাওয়া…যে অল্প কয়েকজন যুক্তির কথা বলছেন/বলবেন তাদের ভাত/বেইল নাই…
অরুন্ধতীর এই প্রচেষ্টা প্রায় ১ দশক ধরেই চলছে, পরিবর্তন হচ্ছে কী? ভারতীয়রা এখন সুপারপাওয়ার হতে চায়। বলিউড আর ক্রিকেট ওদের ঈশ্বর… বদলাচ্ছে কি ইতিবাচকতার দিকে?
আর আমরা তো ওদের পিছুপিছুই হেঁটে যাচ্ছি।
(আপু সময় পেলে জনাথন হাইট এর দ্যা রাইচাস মাইন্ড বইটি পড়ে দেইখেন, বাইনারিকরণ এর পেছনের মানসিক কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে।)
কি যে কাজ করবে জানতাম যদি! আমি তো আবেগে চলা মানুষ তাই যুক্তি বুঝতে চাইছি। জানো আমি ঘুমের মধ্যেও এইসব দেখি এখন? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি আর কিছু নিয়ে ভাববো না, পাগল হয়ে যাবো হয়ত। কিন্তু ভাবনা তো আসেই, আমার বাধ্য না তো। আমার পরিসর টা এত ছোট, তার মধ্যে এইসব ব্যপক বিষয় আটাতে পারি না। এখন সবচেয়ে বেশি ভয় লাগছে একটা কথা চিন্তা করে – যদি এমন হয় যে ঘৃনার শক্তি আসলে ভালোবাসার চেয়ে বেশি, তাহলে?
জনাথন হাইটের বইটা খুঁজবো।
আপনার বইটা গতকাল কিনেছি
একটু ব্যস্ততায় যাচ্ছে…পড়ে জানাবো
অপেক্ষায় থাকবো 🙂
“the blind are leading the blind”– যিযেকের এই কথায় আমি চলমান বাজারবাদী গণতন্ত্রের সঠিক সংজ্ঞা খুঁজে পাই।
ব্রোকেন রিপাবলিক বইটা পড়া হয় নি। তবে, অরুন্ধতীর অন্য লেখার সাথে পরিচয় আছে। অরুন্ধতী ইংরেজীতে যে তেজ আর সাহস নিয়ে লেখেন, আমাদের মাঝে এ ধরনের লেখক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
আমি লুনা রুশদীকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাবো এই বইয়ের অনুবাদের জন্য। :huzur:
কারণ, বহুভাষার ভারতে ইংরেজীর যে চর্চা, তাতে অরুন্ধতীর লেখাগুলো অন্তত শিক্ষিত তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কিন্তু, আমাদের এক ভাষার দেশে ইংরেজী বই পড়ার চল নেই বললেই চলে। এ অবস্থান থেকে তাকালে, অনুবাদই আমাদের প্রথম দরকার। প্রয়োজন প্রচুর প্রচারের। যাতে অন্তত একটা পাঠক শ্রেণী গড়ে উঠতে পারে। তা থেকে হয়তো উঠে আসবেন লেখকেরা। অরুন্ধতীরা।
আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো শিশু। মাত্র বাইশ বছর বয়েস তার। কিন্তু, ইতোমধ্যেই এর বিষফোঁড়াগুলো জ্বালা করা শুরু করে দিয়েছে।
“আমাদের এই পৃথিবীটা টিকিয়ে রাখার জন্য এখন প্রয়োজন দূরদৃষ্টির। কিন্তু যেসব সরকারের নিজেদের টিকে থাকা নিভর্র করে তাৎক্ষণিক, নিষ্কর্ষ, স্বল্পমেয়াদী মুনাফার ওপর তারা কিভাবে আমাদের পথ দেখাবে?”– লুনা রুশদী এই কথা বলেছেন, আমার দৃষ্টিতে, কঠিন ভদ্রতাবোধ থেকে। কারণ, চিন্তাটা অত নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি দেখতে পারি না। কারণ, যতই দিনে দিনে রাজনীতিটা একটা আরোপিত ‘সিস্টেম’ বা ব্যাবস্থা হয়ে পড়ছে, ততই আসলে, তাদের দূরদৃষ্টি বৃদ্ধি পাচ্ছে, তবে প্রজাদের জন্য নয়। কেবল প্রভাব বলয়ের ভেতরের সত্ত্বাগুলোর স্বার্থ পোষণ করার জন্য। তাদের অবস্থান দিনে দিনে সুসংহতই হচ্ছে। মায়াজাল আরো সুক্ষ হচ্ছে।
তার উপর, আরব বসন্তের নাম করে, সেই আরোপিত আধিপত্যের দিকে চলে যাওয়া মধ্যএশিয়ার হাওয়া এসব দেশেও কম লাগছে না। ভারতে, ধর্ষন নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। বেশ কিছুদিন আগে দুর্নীতি নিয়েও তোড়জোড় হয়েছে।(মনে নেই, সেটা আরব বসন্তের আগে, না কি পরে?) তবে কোথায় জানি, সাজানোর গাছের নিচে গাজরটিই নেই।
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিষয়ে আমার অনুভুতিটুকুই প্রতিধ্বনিত হতে শুনছি আপনার কথায়, নিজেকে তাই কম একা লাগছে। 🙂 ভাল থাকবেন সব সময়।
বইটা কেনামাত্র ছিনতাই হবার দুঃখে এখনো কাতর আমি! :crying:
এইরকম একটা বই এই মুহূর্তে অনুবাদের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। আপুকে অনেক ধন্যবাদ সেটি করার জন্য। :clappinghands: