১ম ঘটনা:
ভোর ৬টা। শাহবাগের মোড়ের দিকে ছুটে যাওয়া রিকশা।
রিকশাওয়ালা: শাহবাগের গ্যাঞ্জাম এহনো থামে নাই?
যাত্রী: না। থামবে কেন? আপনি চান না রাজাকারদের ফাঁসি হোক?
রিকশাওয়ালা: তা চাই। কিন্তু, রাস্তা বন্ধ করনের কী দরকার।
যাত্রী: ৭১-এ যুদ্ধের সময় মানুষ এমন ভাবলে এখনো তো পাকিস্তানে থাকতেন।
বাকী পথ রিকশাওয়ালা নীরবে প্যাডেল চালিতে যায়।
২য় ঘটনা:
মোহাম্মদপুরগামী চলন্ত বাস। শাহবাগ আন্দোলনের কারণে বন্ধ থাকায় ঘুরে অন্য পথ দিয়ে যেতে হচ্ছে বাসকে।
জনৈক যাত্রী: কী শুরু করসে! শাহবাগের মোড় বন্ধ করে রাখসে! মানুষের কত কষ্ট হয়। রাত্রে বেলা থেকে যত গাজা-মদ খেয়ে বেড়ায়। মানুষ নাকি এসে বিরিয়ানি দিয়ে যায়। টাকাও দিয়ে যায়। আছে তো শুধু ছাত্রলীগের পোলাপান। এটা সাধারণ মানুষের আন্দোলন হলো নাকি? একদম মেলা বসায় ফেলসে। আরও তো অনেক ঝামেলা আছে দেশে, সেগুলো সমাধান কর। আন্দোলন করলে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কর। তা করবে না, শুধু শুধু মানুষের কষ্ট।
কিছু যাত্রী সমর্থন করে কথা বলার চেষ্টা করে। একই সাথে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে কয়েকজন। কিন্তু, নাছোড়বান্দা যাত্রী কিছুই বুঝতে চায় না।
এই মুহূর্তে দেশে আলোচনার সবচেয়ে বড় বিষয় শাহবাগে চলতে থাকা আন্দোলন। যার একটাই দাবি-‘রাজাকারদের ফাঁসি’। এই বিষয়ে আলোচনা চলছে সব জায়গায়। দোকানে, বাসে, অফিসে, রিকশায়, ক্লাসে, ঘরে, ফেসবুকে, ব্লগে……সব জায়গায়।
কিন্তু, দুঃখের সাথে দেখা যায় কিছু ব্যাপার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আন্দোলনের প্রতি মানুষের মনে প্রশ্নের তৈরি করেছে। এমন কিছু প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা থেকেই এই পোস্টের জন্ম।
তবে, এমন কেউ যদি থেকে থাকেন যার মনে “রাজাকারদের ফাঁসি” কথাটার পাশে কোন প্রশ্নবোধক চিহ্ন আছে, তারা এই পোস্ট না পড়লেও হবে।
ভাবনা ১: রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন করার কী দরকার? মানুষের শুধু শুধু কষ্ট।
উত্তর: রাস্তা বন্ধ করা হয়েছে দেখেই এই আন্দোলন মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। নইলে কেউ হয়তো এর কোন গুরুত্বও দিতো না। রাস্তাটা ছেড়ে দিলে ধরে রাখা কষ্ট হতো এই জনতা, যারা দেশকে ভালোবাসার জন্যই রোদের মধ্যে বসে প্রতিবাদ করে যায় প্রতিদিন। প্রতিদিন কষ্ট করে একটু ঘুরে অফিসে যাওয়ার সময় ভাববেন ৪২ বছরের পুরনো অপরাধীদের সাজার জন্য কি এতটুকু কষ্ট স্বীকার করবেন না?
ভাবনা ২: দেশে তো আরও অনেক সমস্যা আছে। সেগুলোর বিচার না চেয়ে এটা কেন?
উত্তর: সেগুলোর বিচার হবে না বললও কে? কিন্তু, রাজাকাররা দেশের জাতীয় শত্রু। এমন কোন অপরাধ নেই যুদ্ধের সময় তারা যেটা করে নি। রাজাকাররা যতদিন বেঁচে আছে, ততদিন এই দেশের স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ হবে না। তাছাড়া, বিচার কার্য শেষেই এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। সাধারণ জনগণ চাচ্ছে রাজাকারদের এমন জঘন্য অপরাধের জন্য একটাই শাস্তি তারা পেতে পারে, সেটা-ফাঁসি।
একই সাথে এটাও আশা রাখতে হবে, প্রত্যেক অপরাধের বিচার হবেই হবে।
ভাবনা ৩: ওখানে রাতের বেলা ছেলেমেয়েরা একসাথে থাকে। কত আকাম-কুকাম হয়। মদ খাওয়া, নেশা করা চলে।
উত্তর: এমন কথা শুধু কিছু মানুষের ফেসবুক স্ট্যাটাস বা মুখে শোনা যায়, যারা এই আন্দোলন সামনে গিয়ে দেখেন নি এবং বোঝেন নি। শুধু মনের বাঘের ভয়েই আহত হচ্ছেন বারবার।
আজ ৮দিন হলো এই আন্দোলন। সত্যি সত্যি-ই এমন কোন অভিযোগ পাওয়া যায় নি।
ভাবনা ৪: এটা তো শুধু আওয়ামী লীগের আন্দোলন। ওখানে তো শুধু ছাত্রলীগের ছেলেরা থাকে।
উত্তর: এটা সকল সাধারণ বাঙালীর আন্দোলন। ২ বছরের শিশু, অফিস ফেরত যুবক, পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, রাতদিন ধরে বসে থাকা ব্লগার-এদের সাধারণ পরিচয় একটাই-এরা বাংলাদেশী। এটা কোন রাজনৈতিক দলের মঞ্চ নয়।
ভাবনা ৫: ওখানে আছে নাস্তিক আর বামপন্থীরা শুধু।
উত্তর: সকল বয়স, সকল ধর্ম, সকল মনের মানুষরা আছে সেখানে। বাংলাদেশকে যেমন কোনভাবে জেনারালাইজ করা যায় না, তেমনি ভাবে শাহবাগের মোড়ের এক টুকরো বাংলাদেশের জনতাকেও কোনভাবে জেনারালাইজ করা যায় না।
ভাবনা ৬: এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা।
উত্তর: এই আন্দোলন সাধারণ জনতার মাঝে পৌঁছে গেছে একটা এবং কেবলমাত্র একটা দাবি নিয়ে। সেটা হলো:
“রাজাকারদের ফাঁসি দিতে হবে।”
অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলন নয়।
৪২ বছর বয়স হলো আমাদের এই দেশের। এই দেশের জন্ম মুহূর্তে যারা এই দেশের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে, তাদের শাস্তি হোক সর্বোচ্চ। সেটা হবার পথে একটু কষ্ট না হয় করলেন-ই। নতুন একটা শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাতে কী মায়ের কষ্ট হয় না?
ভেবে নিন রাজাকারহীন বাংলাদেশ একটা নতুন শিশু, যাকে পৃথিবীতে আনতে একটু কষ্ট করছেন আপনারা। ভুল না বুঝে আন্দোলনের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করুন, প্রমাণ করুন আপনি এই বাংলা মায়ের সন্তান।
শেষ করার আগে ছোট্ট একটা ঘটনা বলি।
আজ বিকেল ৪টায় ছিলো এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণার জন্য তিন মিনিট নীরবতা পালনের কর্মসূচী। যে যেখানে থাকে সেখান থেকেই।
আমি ছিলাম বইমেলায়। ৪টা বাজতেই বন্ধ হয়ে গেলো মাইক, কিছু ইতঃস্তত পদধ্বনি থমকে গেলো একটু পরেই। হাজারো লোকের স্তব্ধ নিঃশ্বাসের মাঝে থমকে গেলো যেন বাতাসও। শুধু দূর হতে শোনা যেতে লাগলো কিছু পাখির ডাক।
এমন হাজারও লোক যেন দেশের কোটি মানুষের সাথে একসাথে মনে মনে বলে উঠলো:
“বাঁচো গণদাবী, বাঁচো গণদাবী
আসল বিচার চাই,
যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও
গণদাবী একটাই।”
রাজাকারদের ফাঁসি চাই।
আমি সোচ্চার প্রজন্ম চত্ত্বর দেখেছি,
আমি স্তব্ধ বইমেলা দেখেছি।
আমি গভীর রাতেও তীব্র শ্লোগান শুনেছি,
আমি কাঠফাটা রোদে বিচার পিপাসু জনতার ঢল দেখেছি।
আমি তেরো লক্ষবার
তেরোশ গুন জোরে
তেরো’র শ্লোগান গেয়েছি।
:clappinghands:
কার লেখা এটা? তোর?
মাত্র লিখলাম, পোস্ট পড়ে 😛 ক্যান ?
ভালো হয়েছে 😀
ইতিহাসের অংশ হয়ে গ্যাছে এ আয়োজন। এখন, সাফল্য গাঁথা হয়ে উঠতে হলে, চাই নিশ্বঙ্ক চিত্ত। বেজন্মাদের প্রচার প্রচারণায় আমার মনে হয়, তাদের মুখোশ আরো উন্মোচিত হচ্ছে।
এখন দরকার আধাআধি দাবী পূরণে যাতে খুশি না হয়ে যায় জনতা। পুরো বিজয় নিয়ে ফিরতে হবে, এই চেষ্টাই থাকুক।
অবশেষে তকে ফিরতে দেখে ভালো লাগল। :beshikhushi:
ভাবনা ৪ এর সাথে তীব্র দ্বিমত।
ঐখানে সকল ধর্ম দল [জামাত ছাড়া] পাওয়া গেলেও মঞ্চ একটা আছে। তা আওয়ামী প্রভাবিত লোকদের দ্বারা পরিচালিত।
এই আন্দোলনের সাথে আছি মূল কারণ ২ টা।
১। রাজাকারদের সুবিচার
২। জামাত বিরোধিতা
বিটিভি যখন এই আন্দোলন দেখায় + শেখ হাসিনা যখন ছুটে আসতে চান শাহবাগে তখন এই প্রশ্ন মানুষের মনে উঠতেই পারে।
তবে ভাবনা ৪ এর প্রশ্নটাও বড্ড এক পেশে।
অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এই আন্দোলন নয়। এই কথাটাও ভুল।
শুরুর দিনের দাবির সাথে শুক্রবারের দাবিগুলার কিছুটা পার্থক্য অবশ্যই আছে।
শুরুর দিনের প্রশ্নগুলা কিন্তু আমরা আর এখন করছি না।
বিটিভি যখন এই আন্দোলন দেখায় >> এই কথাটার সাথে তীব্র সহমত। আমারও এইরকম মনে হয়েছে।
ভাইয়া, আমি আজকেও শুনলাম ঠিক আমার বয়সের এক ছেলে বলল, ঐখানে গেলেই নাকি ১০০০ টাকা পাওয়া যায়। আমাকে প্রশ্ন করল আমার কত income হইসে…
মানুষ কবে মানুষ হবে…।??????
তাই সবার জন্য আবারও বলছি…
একটাই দাবী, রাজাকারদের ফাঁসী। 😀
অনেকদিন পর লিখলেন, ভালো লেগেছে লেখা।
রাস্তায় আসলেই অনেক কষ্ট হয়, তবে এই ব্যাপারেও ১০০% একমত যে রাস্তা বন্ধ বলেই এত মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। অভিযোগ না করে তাই আমাদের উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায় যেন হয় সেই জন্য দোয়া করা।
স্বাগতম বন্ধু সরব পরিবারে আবারো সরব হবার জন্য। :beshikhushi:
আমার একটা স্ট্যাটাস কপি পেস্ট করছিঃ
“আঙ্কেল, কিছু মনে করবেন না, ক’টা কথা বলি। আমার বয়স অল্প, অত বেশি বুঝি না। দু’এক কলম যা পড়াশোনা করেছি, এইটুকু জানি যে, জমি থেকে ভাল ফসল পেতে হলে আগাছা ছাটাই করতে হয়, নিড়ানি দিতে হয়, সার দিতে হয়। কিন্তু তারও আগে নিশ্চিত করতে হয় যেন কোন ক্ষতিকর পোকার আক্রমন না হয়। ফসল যত ভালই হোক, পোকার আক্রমন হলে লাভের একটা টাকাও চোঁখে দেখবেন না। আর ক্ষতিকর পোকার আক্রমন সারাতে গিয়ে আবার বন্ধু পোকাদের মেরে ফেলবেন না! সার যেমন সময়মত দিতে হয়, ফসল যেমন সময়মত কাঁটতে হয়, তেমনি ক্ষতিকর পোকাও সময়মত দমন করতে হয়। আর জমির পাশে বেড়াও দিতে হয়, তা নাহলে ছাগলে ফসল খেয়ে ফেলতে পারে।
মামা, নামায়ে যাও…”
কথাগুলো এক অচেনা মানুষকে বাসে ঝুলতে ঝুলতে গতকাল সন্ধ্যাবেলা বলা, খুব সম্ভবত একজন পঁচা মস্তিষ্কের মানুষকে বলা। যিনি বলছিলেন, ‘মানবতাবিরোধীর বিচার চায়, এইটা তো সবচেয়ে বড় মানবতাবিরোধী… রাস্তায় মানুষ চইলতে পারতেছে না। হুজুগে নাচলে দেশ চলে না। বিচার চায়, বিচার কি এই বেগানা পোলাপাইনে করব না জজে করব? হেরা আইন বুঝে? এই সব পোলাপাইনগুলারে নষ্ট কইরা ফালতেছে! রাজনীতি ভইরা ভাল পোলাপাইনগুলারে নষ্ট কইরা ফেলতেছে… ”
শুনে ঐটুকুন কথা বলে বাস থেকে নেমে এসেছি। পরে দূর থেকে দেখলাম লোকটাকে বাসের অন্য লোকেরা ঠেলে নামিয়ে দিয়েছে।