সময়টা দেশ বিভাগের। ডানে বামে চান-তারা পতাকার আধিক্য দেখে হাজার মাইলের দুরত্ব সত্ত্বেও জুড়ে দেয়া হলো দুইটি দেশ, নাম পাকিস্তান। সে দেশের ধর্মাধিক্য মুসলিম। আর মাঝে ভারত, হিন্দু আধিক্য এলাকা। তবুও, নিজ বাড়ি-ভিটা ছেড়ে অনেকেই যেতে চাইলো না, ফলাফল “সংখ্যালঘু” নামের এক নতুন শব্দের উৎপত্তি। হিন্দু রাষ্ট্রের জন্য মুসলিমরা সংখ্যালঘু, আর মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য হিন্দুরা তখন সংখ্যালঘু।
পাকিস্তান আরও ভাগ হলো। পুর্ব আর পশ্চিম। পশ্চিমেরা সুঠাম দেহের অধিকারী, শ্বেত বর্ণের চকচকে শরীর, মুখে সাহেবী উর্দুয়ানী। আর পুর্বে? কালো-শ্যামলা, দুর্বল বোকাসোকা বাঙ্গালী। মুখে তাদের বাংলা ভাষা, পশ্চিমেরা একে বলতো হিন্দুয়ানী ভাষা। ঝামেলায় পরে গেলো পুর্বে রয়ে যাওয়া হিন্দুরা। সংখ্যায় এরা তখন কম, কিন্তু সংখ্যায় কম হওয়া কেনো ভয়ের কিংবা দোষের সে সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিলো না, ঠিক যেমনটা এখন আমার নাই।
অবিচারের শুরুঃ
দেশে নতুন আইন করা হলো। তার নাম “শত্রু সম্পত্তি আইন”। ওই অধ্যাদেশের ১৬৯ উপবিধি অনুযায়ী তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের আগে থেকে ভারতে ছিল এবং সেই তারিখ থেকে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিল, তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই সঙ্গে তাদের বাড়িঘর ও জমিজমা শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয় যার মালিকানা সরকার অস্থায়ীভাবে নিয়ে নিতে পারে।
শুরু হলো হত্যাকাণ্ডঃ
হিন্দু-মুসলিম চমৎকার সম্প্রীতি থাকলেও প্রশাসক স্তরের মানুষদের এই সম্প্রীতি পছন্দ হলো না। ১৯৬৪ সালের ৩রা জানুয়ারী কোন ক্ষোভ ছাড়াই খুলনায় এক রাতে হাজারখানেক হিন্দু খুন করা হলো। পরবর্তীতে এই গনহত্যা বৈধ করবার জন্য গুজব রটানো হলো যে, কাশ্মীরের হজরতবাল মসজিদে রক্ষিত হজরত মোহাম্মদ (স) এর পবিত্র চুল হিন্দুরা চুরি করেছে।
তবুও, পাকিস্তানের অবিচার, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে এদেশের হিন্দু-মুসলমান কাধে কাধ মিলিয়ে প্রতিবাদ শুরু করলো। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান নির্বিশেষে দেশকে রক্ষার্থে গুলির সামনে বুক পেতে দিলো বাঙ্গালী।
যুদ্ধ চলাকালীন অনাচারঃ
১) ৭১ এ হিন্দু বাড়ি চেনার একটা উপায় ছিলো। মিলিটারি কিংবা রাজাকারেরা হিন্দু বাড়িতে ইংরেজিতে বড় করে এইচ (H) লিখে রাখতো। এতে খুজে বের করে খুন করা, জ্বালাও-পোড়াও কর্মসুচী সহজ হয়ে যেতো তাদের জন্য। (সুত্রঃ সিডনি শ্যানবার্গের কলাম “দা পাকিস্তানী স্লটার দ্যাট নিক্সন ইগনোরড, এপ্রিল ২৯, ১৯৯৪)
২) ৭১ এ দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়াদের মাঝে ৮০ শতাংশই ছিলো হিন্দু। অর্থাৎ, যদি এক কোটি শরনার্থি হিসেব করা হয়, তবে আশি লক্ষই ছিলো হিন্দু। ধারণা করা যায়, আশি লক্ষ “মানুষ” ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, ক্ষেত-খামার সর্বোপরি নিজের দেশ ছেড়ে কি পরিমান অত্যাচারের সম্মুখীন হলে পালাতে বাধ্য হয় ? (সুত্রঃ সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি, ১লা নভেম্বর, ১৯৭১ এ আমেরিকার সিনেট কমিটিতে উত্থাপিত টেস্টিমোনি)
স্বাধীন দেশে অনাচারঃ
১) স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৭৪ সালে এক সরকারি গ্যাজেটে শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিল ঘোষনা করা হলো। তবে, আইনের ফাক ফোকর ঠিকই রয়ে গেলো। ফলাফল? প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত ’৯৭ সালে ‘Inquiry into Causes and Consequences of Deprivation of Hindu Minorities in Bangladesh through the Vested Property Act’ নামের একটি গবেষনা মূলক গ্রন্থতে এসব তথ্য প্রকাশ করেন। ওনার গবেষনায় বেরিয়ে আসে যে মোট ৯২৫,০৫০ হিন্দু বসতবাড়ি (বাংলাদেশের শতকরা ৪০% হিন্দু পরিবারের) এই আইনে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। চাষাবাদের জমি হারায় ৭৪৮,৮৫০টি পরিবার। মোট জমির পরিমান ১.৬৪ মিলিয়ন একর, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের মালিকানাধিন মোট ৫৩% ভূসম্পত্তি। এই সম্পত্তির পরিমান সমগ্র বাংলাদেশের ৫.৩% ভাগ। অন্যদিকে সম্পত্তি দখল করে লাভবান হয়েছে মাত্র ০.৪% লোক। (সুত্রঃ ২১শে এপ্রিল, ২০০৭ এ প্রকাশিত দি ডেইলি স্টারের Vested Property Act A story of deprivation and exploitation আর্টিকেল, কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার আদিল মাহমুদ)
২) স্বাধীন দেশে নব্বই এর দশকে ভাঙ্গা হলো ঢাকেশ্বরি মন্দির। উদ্দেশ্য, ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙবে ভাঙবে অবস্থা। যদিও কারণ ছিলো স্বৈরাচার নিপাত আন্দোলনকে স্তিমিত করে জনগনের উদ্দেশ্য ব্যাহত করা। ৯২ এর ৬ই ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলাম চট্টগ্রামে শুরু করে তার আসল খেলা। মন্দির ভাঙ্গন, দোকান-পাট লুট থেকে শুরু করে হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তারা। তাজা তিনটি শিশুপ্রাণ জ্বলে যায়। (সুত্রঃ হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস এর রিপোর্ট)
৩) ২০০১ এ ক্ষমতায় এসেই শুরু হলো তাণ্ডবলীলা। হাজারও হিন্দু জনগন প্রাণের মায়ায় আবারও জান নিয়ে পালালো ভারতে। পশ্চিম বঙ্গের বাম নেতা বিমান বোস রেফুজি ফিরিয়ে নেবার কথা জানালে বিএনপি সরকার বললো, তারা অনুসন্ধান করে দেখবে। (সুত্রঃ বিবিসি ১৫ই নভেম্বর ২০০১)। সে রেফুজিদের সাক্ষাতকার নেবার কারণে শাহরিয়ার কবিরকে কারাগারে যেতে হয়।
৪) সে অনুসন্ধানে কি কি বের হয়ে আসলো না? সে রিপোর্টে বের হয়ে আসে না পূর্নিমা রানী ধর্ষনের কথা। যার মা আকুতি করে বলেন, “বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো, মরে যাবে।” আসে না ছবি রানীর কথা, বিভা রানীর কথা। আরও আসে না ধর্ষিতা কিশোরী মহিমা’র কথা। (সুত্রঃ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, নাম দিয়ে সার্চ দিলেই পাওয়া যাওয়ার কথা)
৫) ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ১০ বছরে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা কমেছে প্রায় ৯ লক্ষ। কেনোইবা কমবে না? একটি বিশেষ দল নির্বাচনে হারলে ক্ষোভে হিন্দু নিধনে নামে। জিতলে উল্লাসে হিন্দু নিধনে নামে। দেশে অপরাধীর বিচার হলে হিন্দুদের বাড়ি জ্বলবে। ভারতে মুসলমান আক্রান্ত হলে এই দেশে হিন্দু আক্রান্ত হবে। নিরাপত্তার অভাব, শত্রু সম্পত্তি আইন আর প্রতিকুল পরিবেশ – সব মিলিয়ে সহায় সম্পত্তির থেকে জীবনকে অধিক মুল্য দেবার কারণে দেশে হিন্দুর সংখ্যা ক্রমশ হ্রাসমান। (সুত্রঃ প্রথম আলোর ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০১২)
৬) ২০১৩ সাল। ফেব্রুয়ারী-মার্চ মাস। শত শত ঘরবাড়ি জ্বলে গেলো, কয়েক শত মন্দির টুকরো টুকরো হলো। খুন হলো সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্র শিবিরের হাতে। তাদের দোষ – তারা হিন্দু।
যুগে যুগে ধর্মান্ধ ফ্যানাটিকেরা একই কাজ করে এসেছে। তবুও এ দেশে দুর্গাপুজায় দুনিয়ার যে কোন প্রান্তের থেকে বেশী আনন্দ হয়। হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ নির্বিশেষে বাড়ি বাড়ি পৌছে যায় সে পূজার নাড়ু-সন্দেশ। ঈদের বাজারে দোকানি জিজ্ঞেস করে না সেমাই ক্রেতাকে সে মুসলিম ভিন্ন কেউ কি না। ফ্যানাটিকেরা আগুন দিয়ে বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে চলে গেলেও, ধর্মের পরিচয় দূরে ঠেলে তাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে এই দেশের “মানুষ”। ধর্মান্ধ ফ্যানাটিকেরা হাজার চেষ্টা করেও এ দেশের মানুষের মগজ থেকে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান মুছতে পারবে না –
বাংলার হিন্দু,
বাংলার বৌদ্ধ,
বাংলার খ্রীষ্টান,
বাংলার মুসলমান।
আমরা সবাই বাঙ্গালী।।
এই দেশ কোন পাকিস্তানী জ্বীনের বাদশাহের নয়, চাঁদে দেখতে পাওয়া কোন অশুভ প্রেতাত্মার নয়। এই দেশ সব ধর্মের মানুষের, এই দেশ ৭১ এর শহীদের রক্ত দিয়ে কেনা দেশ। সে রক্তের রঙ লাল, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে লাল।
ভালো হয়েছে
পড়বার জন্য ধন্যবাদ 🙂
খারাপ হচ্ছে যাদের জন্য এই লিখা, তারা কখনো বুঝতে চায় না, কেন জানি মনে হয় পুরোটা নিরেট উপরের লেভেলে! 🙁
না বুঝলে ধরে ধরে বোঝানো লাগবে। তাও না বুঝলে হাজমোলার সাথে চমৎকার স্বাদ যুক্ত করে বোঝাতে হবে। যে পাবলিক যেভাবে খায়, তবে খাওয়াতে হবেই। অস্তিত্ব সংকটের মুখে, না খেয়ে যাবেটা কই !
সাবাশ ব্যাটা। বহুত দিন পর।
খাটা খাটনি ভালোই করতে হইছে
নিশম ছেলেটা ফেইসবুকের সেলিব্রেটিদের মতো ২ দিনের জন্য না। দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবে! – লিখতে থাক।
আমার কিছু দ্বিমত আছে জানামু খাড়া।
আর লিঙ্ক দিলে বেশি ভালো হয়।
বোহেমিয়ান এর প্রশংসা পেয়ে ভালো লাগলো। ধারণা করা যায়, হয়তো ভালোই হয়েছে ! একটু খাটুনি করা লাগছে। একজন গীতিকার (গুঞ্জন চৌধুরী)-কেও ফোন দেয়া লাগছে রাত পৌনে একটায় 😛 😛
দ্বিমত জানতে অপেক্ষায় রইলাম 🙂
লিংক? পরেরবার থেকে দেবানি !
দুর্দান্ত!
এত কিছু জানতাম না আসলেই।
তবে রেফারেন্সের লিংকুগুলাও সাথে দিয়ে দিলে সুবিধা হইতো পাঠকের।
দুর্দান্ত। এবং একই সাথে বিশাল দুঃখজনক। ধর্মনিরপেক্ষতার চাদর আমরা পরিধান করে আছি ঠিকই তবে চাদরের নিচেই বাজে একটা টার্ম – সংখ্যালঘুরা আরও লঘু হয়ে যাচ্ছে।
এরপর থেকে রেফারেন্স লিংক আকারে দেয়া হবে, মাথায় থাকলো 🙂