বাহিরে বৃষ্টি হয়। স্নিগ্ধা মুগ্ধ চোখে বৃষ্টি দেখছে। ঝুম বৃষ্টির একটা অদ্ভুত সুন্দর শব্দ আছে, আছে একটা আকর্ষন যা মানুষকে সব ছেড়ে তার কাছে ছুটে যেতে বাধ্য করে। অন্য সময় হলে স্নিগ্ধা হয়ত এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যেতে চাইত কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম, স্নিগ্ধার জন্য তো অবশ্যই এই পুরো পরিবারটার জন্যই অন্যরকম তাই হাজারবার চেষ্টা করেও স্নিগ্ধার মনে এই বৃষ্টি দোলা দিয়ে যেতে পারছে না।
“স্নিগ্ধা মা, কি করিস?”,বাবার ডাকে স্নিগ্ধা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে নেয়।
“কিছু না বাবা, বসে বসে বৃষ্টি দেখছি, তুমি বসবে?”
স্নিগ্ধার বাবা জামিল সাহেব আস্তে করে মেয়ের পাশে বসে পড়লেন, বাবা-মেয়ে এক সাথে বৃষ্টি পড়া দেখছে। কে বলবে এই দুজন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখি মানুষগুলোর মাঝে দুইজন মানুষ?
সকাল ৭টার সময় জামিল সাহেব বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। জামিল সাহেবের স্ত্রী, মোর্শেদা রহমান, বারবার স্বামীকে নিষেধ করলেন বাহিরে যেতে, দেশের অবস্থা ভালো না। কিন্তু জামিল সাহেবের যেতেই হবে। অফিস বন্ধ প্রায় সাতদিন যাবত তার উপর যোগ হয়েছে স্নিগ্ধার ঝামেলা, সব মিলিয়ে খুব বাজে পরিস্থিতিতে আছে সে। স্নিগ্ধাকে বোঝাবে নাকি নিজের অফিসে সময় দিবে কিছুই বুঝতে পারছে না। হাসান ছেলেটা এর মাঝে এসব না করলে কি পারত না? নিজের উপরই ভীষণ রাগ উঠছে জামিল সাহেবের।অফিসে ঢুকতে ঢুকতে বেয়ারাকে বলে দিলেন যেন হাসানকে তার রুমে পাঠিয়ে দেয়।
-স্যার আসব ?
-হুম, হাসান ভেতরে আসো।
-জ্বী স্যার, আমাকে ডেকেছিলেন?
-হুম, বস।
হাসান একটা চেয়ারে বসে পরল, সে জানে তাকে কেন ডাকা হয়েছে। আজ হয়ত চাকুরীটাই চলে যাবে তার কিন্তু তার কিছু করার ছিল না, স্যার যা যা জিজ্ঞাস করবে সত্যি সত্যি বলার চিন্তা করেই এসেছে সে।
– হাসান, কেমন আছ ?
– জ্বী স্যার , মানে . .
-কেমন আছ? তোমার স্ত্রীর কি অবস্থা ? অসুস্থ ছিল শুনেছিলাম, ছুটিও তো চাইলে?
-জ্বী স্যার ও ভালো আছে, আপাতত ওর বাবার বাড়ি আছে।
-আচ্ছা, ভালো থাকলেই ভালো। আচ্ছা যে জন্য ডাকা, দেখ আমাদের অফিসটাতে কিছু নতুন মানুষ নিয়োগ দিতে হবে তাই তোমাকে এখন আর আমাদের প্রয়োজন নেই। তোমার পাওনা টাকা নিয়ে যাবে ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে, এই মাসের টাকাটাও দিয়ে দিয়েছি কিন্তু তোমাকে এই মাস অফিস করতে হবে না। আর তোমার স্ত্রীর জন্য আলাদা কিছু টাকা দেওয়া আছে নিয়ে নিও। এখন আসতে পারো। আর কিছু লাগলে জানাতে পারো।
-জ্বী আচ্ছা স্যার।
উঠে গেল হাসান, তার চাকুরী চলে গেছে। অনেক কথা বলবে বলে ঠিক করে এসেছিল সে, কিন্তু কেন যেন কিছুই বলতে পারল না। “আচ্ছা সমস্যা কি এই মাসের বেতন তো আছেই! এই কয়দিন তো চলবে আর কিছু দিনের মাঝে নাহয় আরেকটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে ফেলা যাবে।” মনে মনে ভাবে হাসান।
হাসান ছেলেটাকে খুব পছন্দ ছিল জামিল সাহেবের, অনেক কর্মঠ, সময়নিষ্ঠ, সত্যবাদী বলেই ভালো লাগত কিন্তু আজকে তার চাকুরী নিয়ে নিতে হল। জামিল সাহেবের পক্ষে সম্ভব ছিল না কাজটা করা তারপরও এই কাজটি করতে সে বাধ্য হল, যেই ছেলেটির জন্য তার মেয়েটা আধমরা হয়ে পরে আছে তাকে কিভাবে সে লালন পালন করে ! কিন্তু হাসানের কি দোষ? “নাহ। এক্ষুণি শওকতকে একটা ফোন দিয়ে হাসানের অন্য কোথাও একটা চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিতে হবে।” জামিল সাহেব তার মোবাইলটা বের করে শওকত সাহেবকে ফোন করে।
-মুক্তি কেমন আছিস?
-কে স্নিগ্ধা? ভালো না রে, একটু অসুস্থ। তোর খবর কি?
-এইতো আছি ভালোই, তা তোর জামাইয়ের কি খবর? নতুন নতুন বিয়ে করলি, জানালিও না !
-দোস্ত, সত্যি, কি এক ঝামেলার মাঝে যে বিয়েটা হয়ে গেল, টের পাইনি। হাসান হঠাৎ পরশু বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় আর বাবা সঙ্গে সঙ্গে রাজি, তাই কাউকে না জানিয়েই বিয়েটা। মানে কি যে হল. . .
-কিন্তু আমাদেরকেই তো জানালি না! শালী, তোর জামাইকে কি নিয়ে নিতাম নাকি? মজা দেখাবো তোমাকে, এখন রাখি।
হাসতে হাসতে ফোন রেখে দেয় স্নিগ্ধা। কিন্তু তার দু’চোখে পানি। মুক্তি যদি জানত কি করেছে সে তাহলে হয়ত এতক্ষণে স্নিগ্ধার কাছে ছুটে চলে আসত।
মেয়ের বন্ধু, অফিসের সেরা ছেলেটার সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিল জামিল সাহেব। পাত্র-পাত্রী দু পক্ষই রাজি। সব ঠিক ঠাক, বিয়ের ঠিক দুই দিন আগে হাসান ফোন করে জানায় স্নিগ্ধার বান্ধবী মুক্তিকে বিয়ে করে ফেলেছে সে, স্নিগ্ধাকে বিয়ে করতে পারবে না। জামিল সাহেব কিছুই বলতে পারে নি। শুধু আস্তে করে ফোনটা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর ভাবছিল স্নিগ্ধা কি এটা মেনে নিতে পারবে?
মুক্তির বিয়ের আট মাসের মাথায় মুক্তির স্বামী লিখন মারা যায়, এর মাস তিনেক পরই মুক্তির কোলে চলে আসে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান, মোহনা। কিন্তু লিখনের পরিবার মুক্তিকে থাকতে দেয় নি, বাসা থেকে মা-মেয়ে দুইজনকেই তাড়িয়ে দেয় আর তাই এত বিশাল পরিবারের অংশ হয়েও মোহনা হয়ে যায় পুরোই একা। মুক্তি যখন মোহনাকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফিরে আসে সেখানেও তাকে সইতে হয় অনেক রকমের অপমান। কিন্তু পাশে ছিল সেই বন্ধু দুইজন স্নিগ্ধা আর হাসান। কিন্তু পরশু হঠাত করে হাসান মুক্তির বাবাকে বলে মুক্তিকে বিয়ে করে নিয়ে চলে গেল ! মুক্তি এখনও ঘোরের মাঝেই আছে, কি হচ্ছে এসব !
[গল্প শেষ হয় নি, গল্পের শুরুটাই এখানে]
গল্পটা তিন বন্ধুর ছিল বা দুই প্রেমিক-প্রেমিকা বা একজন অসহায় স্বামী হারা নারীর, কিংবা কিংকর্তব্যবিমূড় একজন বাবার। কিন্তু গল্পটা আসলে এখন মোহনার যার জন্য সবাই বাঁচবে, তবে একটু নতুন ভাবে। আরেক জনের জন্য, স্নিগ্ধা যেমন ভেবে নেবে মুক্তির এই মুহূর্তে হাসানকেই দরকার ছিল পাশে পাওয়ার জন্য, তেমনি হাসানও ভেবে নেবে স্নিগ্ধা তার জীবন থেকে চলে যায় নি, হয়ত কর্তব্য তাকে দূরে ঠেলে দেবে। মুক্তি মোহনাকে নিয়ে অনেক সুন্দর ভাবে জীবন যাপন করবে সাথে থাকবে হাসানের বন্ধুত্ব, স্নিগ্ধার ভালোবাসা। আর মোহনা বড় হবে সবার ভালোবাসা নিয়ে তাই লিখনের অভাব সে কোনদিনও জানবে না।
[হাসানের কাছে এর চেয়েও ভালো সমাধান ছিল, হয়ত আরেকজনের উপস্থিতি সব কিছু বদলে দিতে পারত, গল্পে আরেকটি চরিত্র থাকলেই সব অন্যরকম হতে পারত, তাহলে আর হাসান-স্নিগ্ধাকে এই ত্যাগ স্বীকার করতে হত না। কিন্তু বাস্তবতায় সবসময় ঐ আরেকটি চরিত্র থাকে না, তবে আমরা আশা করতেই পারি আরেকটি চরিত্রের।]
তুই নিয়ম করে গল্প লিখতে থাক। একদিন শিওর গল্পের বই চলে আসবে! নোবেল আর কইলাম না! ঐটা একুয়ার জন্য তোলা থাক!
তুমি যে পড়ছো তাতেই তো বাতাসে ভাসি ! ইচ্ছা আছে, দোয়া কইর।
:happy:
এই পিচ্চি খালি মন খারাপ করা গল্প লিখে :haturi:
এমনি ভালো লেগেছে 😀
:happy:
ভালো লাগছে শুনে ভালো লাগছে :happy:
বেশ ভালো লাগলো রে গল্পটা।
তুই লিখতে থাক। শুধু গল্পের শেষে এসে কোন তাড়াহুড়া করিস না তাহলেই দেখবি গল্প দিব্যি দাঁড়িয়ে যাবে। :guiter:
আচ্ছা আপুনি :love:
এটা কী লিখলি! কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম এমন কিছু হবে, কিন্তু তারপরেও, শেষটুকুতে এসে আরেকবার থমকালাম! দারুণ! চালিয়ে যা!! :dhisya:
ছোট ছোট সুন্দর কিছু অক্ষরের সমাবেশ আর অসাধারণ বিন্যাস… :clappinghands:
দারুণ!!
গল্প লেখা ছাড়িস না! তোর গল্পের বই দেখতে চাই- আমি একদিন।
অন্যরকম একটা গল্প। ভালো লাগলো খুব।
সবাই বলে গল্পকাররা শুধু মন খারাপ করা গল্প লেখে কেন। এর একটা ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। দুঃখী মানুষদের নিয়ে গল্প বানানো সহজ এবং তাতে যত ইচ্ছে বৈচিত্র আনা যায়। যারা একমত না তাদের জন্য লিও তলস্তয়ের লেখা আন্না কারেনিনার প্রথম লাইনটা , “Happy families are all alike; every unhappy family is unhappy in its own way”
আরো গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম। আশা করি অপেক্ষার দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসবে।
ধন্যবাদ অনেক 🙂