১..
অর্ক চলে যাচ্ছে । অর্ক আমার কাছ থেকে অনেকদূরে চলে যাচ্ছে । এরকম টাই হওয়ার কথা ছিল আমি জানি , কিন্তু মেনে নেয়াটা এতো কষ্টের হবে জানতাম না । অর্ক আস্তে আস্তে দূরের একটা বিন্দু হয়ে যাচ্ছে , অনেক দূরের কালো একটা বিন্দু । প্রায় ছ ফুট লম্বা মানুষটা কত দূরে গেলে তাকে একটা বিন্দু মনে হয় ?
ছেলেবেলার মাংস চোর , কানামাছি আর বউচি খেলার দিন গুলো থেকে অর্ক আর আমি প্রাণের বন্ধু । প্রথম প্রথম অবশ্য প্রাণের শত্রু ছিলাম । অর্ক টা এত্তো হ্যাংলা পাতলা আর বাঁটুল ছিলো যে ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে আমার একটুও কষ্ট হতো না । তখন আমি অর্কের থেকে আধ বিঘা লম্বা ছিলাম । আমি পিচ্চিবেলায় খুব বিচ্ছু টাইপ ছিলাম । অর্ক আমাকে দেখলেই পালিয়ে যেতো । যাবেইবা না কেন ? কে আর সেধে সেধে ল্যাং খেতে চায় ? একদিন ওকে ল্যাং মেরে ফেলে দেয়ার পর আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওর মুখ থেকে রক্তের একটা স্রোত নেমে আসছে । তিড়িং বিড়িং করা আমার রক্তের প্রতিটা কণায় ঘুরে বেড়ালেও রক্ত আমি খুব ভয় পেতাম , এখনো পাই । অর্কের মুখ থেকে রক্ত পড়তে দেখে আমি স্কুল থেকে পালিয়ে গেলাম । ক্লাস বাঙ্কারের খাতায় সেই প্রথম নাম উঠলো , কে জানতো গাধার বাচ্চাটার একটা দাঁত নড়তো ! পরদিন থেকে আমি আর স্কুলে যাইনা । আমি ভেবেছিলাম অর্ক মরে গেছে । মুখ থেকে রক্ত বের হলেই মানুষ মরে যায় এরকম একটা ধারনা বাংলা সিনেমা দেখে আমার ভেতর বেশ শক্ত পোক্ত গেঁথে গিয়েছিল । অর্ক মরে গেছে আর আমি ওকে মেরে ফেলেছি বাচ্চা বয়সে এরকম একটা ব্যাপার মনের ভেতর গেঁথে যাওয়া খুব ভাল ব্যাপার না , খুব টেনশন হয় । টেনশনের চোটে আমার জ্বর এসে গিয়েছিল । চিন্তা করলে এইতো সেই দিনের কথা মনে হয় । আমি মুখ তুলে তাকালাম , অর্ক কে এখন ও দেখা যাচ্ছে , অনেক দূরে ঝাপসা একটা বিন্দুর মতো । অর্ক আমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে , অনেক দূরের কাল একটা বিন্দু হয়ে যাচ্ছে । একটা মানুষ কত টা দূরে গেলে তাকে একটা ঝাপসা বিন্দু বলে মনে হয় ?
অর্কের বাবা যখন ট্রান্সফার হয়ে ঢাকা চলে গেলো , আমার তখন একটুও খারাপ লাগে নি । আমার কি শুধু একটা অর্কই আছে বন্ধু ? একটা অর্কের সাথেই কি শুধু পাখির ছানা চুরি করা যায় ? একটা অর্কের সাথেই কি পাশের বাসার তিন্নিদের আচার চুরি করে খাওয়া যায় ? সাত চাড়া খেলতে কি শুধু একজন অর্ককেই লাগে ? টিচার শাস্তি দিলে কি শুধু একজন অর্কের মুখের দিকে তাকিয়ে স্কুলের বারান্দায় কান ধরে দেড় ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায় ?? একটা অর্ক ছাড়াও শেষ বিকেলে গোত্তা খাওয়া একটা ঘুড়ির পিছনে লম্বা দৌড় দিয়ে হাপাতে হাপাতে খালি মাঠে হোঁচট খেয়ে পড়ে হাঁটু ছিলে ফেলা যায় । আমার শুধু একটা অর্কই বন্ধু না । আমার অনেক বন্ধু । তাই যেদিন অর্ক শেষ স্কুলে এলো আমি সেই দিন সারাদিন আমার ঘর থেকেই বের হলাম না । প্রতিদিন তো স্কুলে যাওয়ার কোন মানে নাই । আর আমি হলাম ক্লাস বাঙ্কার । আমার একটা প্রেস্টিজ আছে না ? প্রতিদিন স্কুলে গেলে চলে ? অর্ককে এখনো দেখা যাচ্ছে । আশ্চর্য ছেলেটার কায়া মিলায় না কেন ? কত দূরে গেলে একটা মানুষ দৃষ্টির সীমা থেকে হারিয়ে যায় ? কত দূরে গেলে ??
তার অনেকদিন পর অর্ক যখন ফিরে এলো , আমি তখন অবাক হলাম । যে যায় সে কি ফিরে আসে ? কিন্তু অর্ক এসেছিল । ও তখন আমার থেকে আধ হাত লম্বা ! আমি ফিচিক করে হেসে ফেলেছিলাম । অর্ক উচ্চতায় বড় হলেও গাধার বাচ্চাই রয়ে গিয়েছিল । এতো দিন পর দেখা অথচ ওর প্রথম কথা ছিল,”দেখেছিস কত লম্বা হয়েছি ? আর আমাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারবিনা ! ”
“হু , আমি এর আগে ছ ফুট লম্বা গাধার বাচ্চা একটাও দেখিনি । ”
উত্তর দিয়েই হেসে ফেলেছিলাম , আবার শুরু হয়েছিল আমাদের গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির পিছে ঘুরে বেরানোর দিন ।
কে কাকে কখন ভালবাসি বলেছি মনে নাই । ভালবাসা কি দিনক্ষণ দিয়ে হয় ? ৩৬৫ দিন , ২৪ ঘন্টা , ৬০ মিনিট , ৬০ সেকেন্ড গুনে ভালবাসা কি পরিমাপ করা যায় ? সময় গুণে আবেগ মাপা তো সম্ভব না । তাই ছ’টা বছর কিভাবে ফুড়ুৎ করে চলে গেলো , বুঝতেই পারলাম না । বুঝতেই পারিনি আমি অনেক বড় হয়ে গেছি , বুঝতেই পারিনি ঘুড়ির পিছে ঘুরে বেরানোর দিন শেষ আমার । বাবা যেদিন মা কে বিয়ের কথা বলল আড়াল থেকে শুনে চমকে গিয়েছিলাম । আমি এতো বড় হলাম কবে ? আবার ভালো ও লাগছিল , অর্কের সাথে সারা দিন কাটানোর সময় এসেছে ভেবে । নিজের ঘরে তড়িঘড়ি করে ফিরে অর্ক কেই ফোন দিলাম । কে জানতো সেদিন থেকে অর্ক একটু একটু করে আমার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে , কে জানতো অর্ক আস্তে আস্তে একটা বিন্দু হয়ে যাবে ? অনেক দূরের ঝাপসা একটা বিন্দু হয়ে যাবে ?
২..
তুমি বুঝতে পারছো না তনিমা , আমার বাসায় তোমাকে মেনে নিবে না ।
কেন নিবে না ?
তোমার ষ্ট্যাণ্ডার্ড কখনোই আমাদের সাথে মিলে না ।
ও ।
এইটা আমার আম্মার কথা । তিনি তোমাকে মানতে পারছেন না । তিনি বলেন …
কি ? কি বলেন তিনি ?
তিনি বলেন যে মেয়ে ৬ বছর প্রেম করে সে ভাল মেয়ে না ।
ও । তুমি কি বললা ?
কিছু বলিনি , আম্মার সামনে কিছু বলতে পারি না ।
ও ।
আমি কনফিউসড তনিমা , আমার একটু সময় দরকার ।
ও , আচ্ছা ।
রাখি তাহলে ?
অর্ক শুনো , এভাবে আসলে হয়না । এর থেকে আমাদের ব্রেক আপ করা ভাল । ৬ বছরে তুমি আমাকে চিনো নাই ? আমার বাসা থেকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছে । আমি বাসায় কি বলব বলো ?
আমি রাখি তনিমা , বাই ।
৩…
আমার বাসায় কেউ আমার সাথে কথা বলে না । প্রেম করে যে মেয়ে তার সাথে কেউ কথা বলে না । বাবা বলে না , মা বলে না এমন কি ছোট বোন টা ও বলে না । আমার সাথে কেউ কথা বলে না । বন্ধুরা বলে না , যে মেয়ে সামান্যতেই ব্রেক আপ চায় তার সাথে কিসের কথা । আমার সাথে অর্ক কথা বলে না । মা বাবার গুড বয় অর্ক আমার সাথে কথা বলে না । আমি সারাদিন কাঁদি । কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ ফুলে গেছে । আমার খুব ইচ্ছে করে সবার সাথে কথা বলতে । কেউ আমার সাথে কথা বলে না । আমার সব কথা যেই অর্কে যেয়ে শেষ হয় সেই অর্কও আমার সাথে কথা বলে না । আমার কেমন বন্দী বন্দী লাগে । আমি কতদিন প্রাণ খুলে হাসি না , আমি কতদিন বুক ভরে শ্বাস নেই না , কেউ জানে না , কেউ না । আমি সারাদিন কাঁদি । আমি অনেক কাঁদি । অনেক , অ-নে-ক !!!
৪…
প্রিয় অর্ক …
কবিতা শুনবি ? তোকে আজ হেলাল হাফিজের একটা কবিতা শুনাই ?? আমি জানি তোর এইসব কবিতা ভালো লাগে না । তবু আজ না হয় আমার জন্যই একটা কবিতা শুনলি ।
ইতি
তনিমা
আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর
বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,
একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় ছেলে গড়ি চারু আনন্দলোক।
দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণ একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।
৫…
প্রিয় অর্ক ,
তুই আমার সবসময়ের প্রিয় মানুষ , অনেক ভালবাসলেও তুই প্রিয় , অনেক কাঁদালেও তুই ই প্রিয় । মানুষের প্রিয়জন তো একটাই হয় । তাইনা ? আচ্ছা অর্ক আমি কি অনেক খারাপ ? অনেক বেশি খারাপ ? কেন তুই আমাকে বিয়ে করবি না ?
তোর মনে আছে আমার লাল টুকটুকে বউ সাজার অনেক ইচ্ছে ছিলো । তোর সাথে বসে আমি প্ল্যান করেছিলাম আমি গায়ে হলুদে হলুদ জামদানি পরবো , মেহেদীতে সবুজ জামদানি , এঙ্গেজমেন্ট এ পরবো আম্মার বিয়ের শাড়ি , বিয়েতে তোর জন্য লাল টুকটুকে একটা বউ সাজবো ।
তুই হাসতে হাসতে বলেছিলি আমাকে বিয়ে করার আগে তোর একটা শাড়ির দোকান কিনতে হবে ।
আবার জানতে চেয়েছিলি তোকে বিয়ে না করলে কি পরবো ? আমি মুখ কালো করে বলেছিলাম, “সব উলটাপালটা করে পরবো । মেহেদি তে হলুদ শাড়ি , বিয়েতে সবুজ , রিসেপশনে ক্যাটক্যটা ম্যাজেন্টা শাড়ি ।”
জানিস সামনের সপ্তাহে আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে । আগামি কাল আমি বিয়ের শপিং এ যাবো । যেমন বলেছিলাম তেমন শাড়ি ই কিনবো । আমার লাল টুকটুক বউ সাজা হবে না রে । আমি তো শুধু তোর জন্য লাল টুকটুকে বউ সাজতে চেয়েছিলাম । এখন আমি সবুজ ক্যাটক্যাটা বউ হব ।
অর্ক আমার সাথে একবার দেখা করবি ? তুই দেখেছিস আমি কিন্তু তোকে তুই তুই করে বলছি । তার মানে কি বুঝেছিস ? আমরা আবার শুধু বন্ধু হয়ে গেলাম । শুধু বন্ধু । আমার সাথে একবার একবার দেখা কর না , শুধু একবার ।
অর্ক , আমার সাথে একবার দেখা কর , প্লিজ , প্লিজ ,প্লিজ ।
ইতি
তনিমা ।
৬…
অর্ক মিলিয়ে গেছে । বিন্দু হয়ে যাওয়া অর্ক মিলিয়ে গেছে । অর্ক চলে যাবে আমি জানতাম । কিন্তু সত্যি ই চলে যাবে তা কখনোই ভাবিনি । অর্ক আজ ছ বছরের স্মৃতি নিয়ে চলে গেল । একবার ফিরেও তাকালো না । একটা বার ও না । আমার অনেক ইচ্ছে হচ্ছিলো অর্ক কে যেতে না দেই । ওকে একবার বলি
চল আমরা পালিয়ে বিয়ে করে ফেলি । তোর বাসায় আমাকে মেনে নিবে না তো কি হইসে তুই তো আমাকে ভালবাসিস , তুই তো মেনে নিবি ।
একবার ইচ্ছে হল বলি , “দ্যাখ ছেলে , আমি তোকে ছাড়া এই জীবনে সুখি হবো না , আমার এই জীবনের সব সুখ তোকে ঘিরে । তুই আমাকে এভাবে ফেলে চলে যাস না । প্লিজ প্লিজ প্লিজ ।”
আমি কিছু বলতে পারলাম না । তীব্র অভিমানে , নীল একটা কষ্ট নিজের মাঝে চেপে ধরে আমি অর্ক কে চলে যেতে দেখলাম । এবং অর্ক আমাকে একা রেখে চলে গেলো । একটা মানুষ কতটা বদলে গেলে নিজের আত্মা ছেড়ে দূরের বিন্দু হয়ে যায় ? একটা মানুষ কতটা দূরে গেলে ঝাপসা একটা বিন্দু থেকে নাই মানুষ হয়ে যায় ? কত টা বদলে যেতে হয় ? কতো টা ??
হায় হায় এত মন খারাপ করা গল্প 🙁
প্রেম ব্যাপারটা, বিশেষ করে বন্ধুত্ব থেকে প্রেম বা বন্ধুত্বময় প্রেম তোমার গল্পে দারুণ থাকে।
ভাল্লাগছে 😀
😀
থেঙ্কু ভাইয়া !!
লেখনীর কথা বলতে গেলে–সত্যি অনবদ্য। খুব ঝরঝরে লাগে আপনার লেখা গুলো পড়তে।
কিন্তু এই বিষয়বস্তুর গল্প পড়তে কেমন জানি লাগে। ভালোবাসা এত্তো ঠুনকো??? কোন রকম গভীরতা ছাড়া?? চলতে-ফিরতে-উঠতে-বসতে… এভাবে-ই ভালোবাসা হয়ে যায় কেন, অন্তরের অন্তরতম মিল ছাড়া???
খুব বেশি প্রশ্ন জাগে মনে……
অহরহ হচ্ছে তো ! 🙁
আমারও প্রশ্ন জাগে।
আর এই চিঠির মতন বা হেলাল হাফিজের কবিতার মতন কথাগুলিও যে বহুজনের জন্য বহুবার লেখা হয় আজকাল একজনের কলম থেকেই, সেটা ভাবলে এসব আর স্পর্শও করে না তেমন।
এই গল্প লেখাটা সুন্দর হয়েছে। 🙂
বহুজনের জন্য লেখা চিঠি তে অনুভূতির তীব্রতা কি আর থাকে আপু ??
শেষের মন্তব্যের জন্য এক কেজি ধন্যবাদ ! 😀
কেন এত সস্তা দামে বিক্রি হয় এখনকার ভালোবাসাগুলো? 🙁
দুর্মূল্যের বাজারে সস্তা হয়ে গেছে ভালোবাসা আর ছোট ছোট অনুভূতি ! 🙁
🙁
ভালো লেগেছে
যদিও অনেক মন খারাপ করা গল্প 🙁
🙁