শুধু ভ্রূণ থেকে প্রাণী নয়, প্রাণীকোষ থেকেও সম্ভব ভ্রূণ উৎপাদন: চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল অ্যাওয়ার্ড প্রেজেন্টেশন স্পীচ ২০১২

[ক্যরোলিন্সকা ইন্সটিটিউট এর সম্মানিত সদস্য এবং ২০১২ সালের ‘চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল প্রদান’ কমিটির সদস্য থমাস পার্লম্যান ২০১২ সালে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যে ভাষণটি দেন তা ছিল সত্যই চমৎকার। জীববিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য স্যার জন বি. গার্ডন এবং শিনিয়া ইয়ামানাকা যৌথভাবে ২০১২ সালের চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।থমাস পার্লম্যান ১০ ডিসেম্বর ২০১২ সালে তাদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার পূর্বমূহুর্তে এই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। খুব অল্পতে হলেও বক্তৃতাটি আমাদের সহজেই পরিচয় ঘটিয়ে দিতে পারে উক্ত বিজ্ঞানীদ্বয়ের যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাথে।]

ইউর রয়েল ম্যাজেস্টীস, ইউর রয়েল হাইনেস, সম্মানিত নোবেল পুরষ্কার প্রাপকবৃন্দ, ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্রমহিলাগণ,
আমরা ধরে নিতে পারি যে এই স্টকহোম কনসার্ট হলে উপস্থিত আমাদের মাঝে বেশীরভাগই জীবনে কখনো না কখনো পুনরায় তারুণ্যদীপ্ত, উন্মত্ত বা কিছুটা আদিম হতে চেয়েছেন, কিংবা অন্তত এমন একটা সুযোগ চেয়েছেন যাতে জীবনটিকে নতুন করে শুরু করা যায়, একটু ভিন্নভাবে যা এই জীবনের শুরুতে করেননি এমন কোন পথ বেছে নেয়ার মাধ্যমে।

এখন, যদি এই ব্যক্তি একটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ এর পরিবর্তে একটি পূর্ণাঙ্গ কোষ হতো,  তবেই সময়ের মাধ্যমে এমন যাত্রা তার পক্ষে সম্ভব হত। যেসব আবিষ্কারের মাধ্যমে (কোষের বিপরীত দিকে যাত্রার) এই বিষয়টি আজ ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয়েছে এই বছরের শারীরবিজ্ঞান বা চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়ার মাধ্যমে সেসব অসাধারন আবিষ্কারকেই আমরা সম্মানিত করতে যাচ্ছি।

আমরা প্রত্যেকেই কোষ বিভাজনের মাধ্যমে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে আজকের এই পরিণত অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছি এবং এই কোষ বিভাজনের মাধ্যমেই আমাদের পূর্ণাঙ্গ মানব দেহের সকল কোষ তৈরী হয়েছে। কোষের এমন নিয়ন্ত্রিত বিকাশগুলো  চলাকালীন ধারাবাহিকভাবে অপূর্ণাঙ্গ কোষসমূহ থেকেই আমাদের দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সমস্ত বিশেষ কোষগুলো (যারা গঠন ও কাজের দিক দিয়ে ভিন্ন) তৈরী হয়,  যেমন যকৃত, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের কোষসমূহ।
দীর্ঘদিন যাবৎ এটিই বিশ্বাস করা হত যে উপরের প্রক্রিয়াটি একটি একমূখী যাত্রা (অর্থাৎ বিশেষ অঙ্গের কোষটি থেকে প্রাথমিক কোষে প্রত্যাবর্তন সম্ভব নয়)। আমরা জানতাম, কোষের এই বিকাশ সবসময় প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রূণের অপূর্ণাঙ্গ কোষ (immature cells) থেকে পূর্ণবয়স্ক মানুষের বিশেষায়িত কোষ (মানে বিশেষ টিস্যুর কোষ) তৈরীর দিকেই এগোয়। এটা  ধরে নেয়া হত  যে সম্ভবত কোষবিভাজনের সময় পূর্ণাঙ্গ কোষগুলোতে প্রাথমিক অবস্থার মত সকল জীনগত তথ্য অটুট থাকেনা, যেকারণে (পূরণঅঙ্গ অবস্থা থেকে পুনরায় ভ্রূণ অবস্থায়) ফিরতি যাত্রা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না।

জন গার্ডনের (John Gurdon) ক্লোনিং সংক্রান্ত গবেষণার মাধ্যমে আমাদের উপরিউক্ত ধারণাটি মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়, যে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬০ সালে। গার্ডন ঐ গবেষণায় একটি ব্যাঙ এর ডিম্বাণুর নিউক্লিয়াস ও সকল জেনেটিক তথ্য নষ্ট করে দেন, এবং তার বদলে সেখানে ব্যাঙ এর লার্ভার অন্ত্র থেকে নেয়া একটি কোষ ঢুকিয়ে দেন। যদিও ডিম্বাণুর জেনেটিক তথ্যগুলো একটি বিশেষ অঙ্গ তথা অন্ত্র থেকে নেয়া হয়েছিল তবুও ব্যাঙটির পরিবর্তিত ডিম্বাণুটি থেকে সকল ধরনের বিশেষিায়িত কোষ সম্পন্ন একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাঙ বিকাশ লাভ করে। পরীক্ষাটির মাধমে গার্ডন প্রমাণ করেন একটি প্রাণীর সকল অঙ্গ তৈরী হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্যই একটি বিকশিত পূর্ণাঙ্গ কোষে অটুট থাকে। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনিই সর্বপ্রথম একটি মেরুদন্ডী প্রাণীর ক্লোন করেছিলেন।

তার গবেষণার ফলাফল গবেষক সম্প্রদায়কে দারুণ চমৎকৃত করে এবং এ কারণেই গার্ডনের আবিষ্কারটি সর্বমহলে গ্রহনযোগ্যতা পেতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল। তার আবিষ্কারটি ছিল একদম সুনিশ্চিত। পৃথিবীর প্রথম ক্লোন করা স্তন্যপায়ী ডলির নাম প্রায় সকলেই শুনেছে, যেটি তৈরী করা হয়েছিল গার্ডনের ব্যাঙ নিয়ে পরীক্ষার মূলনীতির উপর ভিত্তি করেই।

গার্ডনের আবিষ্কারটির ৪০ বছরেরও বেশী পরে শীনিয়া ইয়ামানাকা (Shynia Yamanaka) আরো কিছু পলীক্ষা করেন যা বিজ্ঞানে নতুন যুগান্ত স্থাপন করে। গার্ডন দেখিয়েছিলেন যে কোষের অপূর্ণাঙ্গ অবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু এই যাত্রা কি একটি পূর্ণাঙ্গ কোষের ক্ষেত্রেও সম্ভব? কোন ভ্রূণের সাহায্য ছাড়া? ইয়ামানাকা কিছু জীন নির্বাচন করেন যেগুলো তথাকথিত অপূর্ণাঙ্গ (immature) প্লুরিপটেন্ট স্টেমসেল তৈরীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং সেগুলো দেহের চামড়ার একটি পূর্ণাঙ্গ কোষে স্থাপন করেন (এবং দেখতে পান চামড়ার কোষটি স্টেম সেল এ রূপান্তরিত হয়েছে)। চারটি জীন এর একটি কম্বিনেশনই সেজন্য যথেষ্ট ছিল। এই আবিষ্কারটি বিজ্ঞান-বিশ্বকে আবাক করে দেয়, কারণ খুব কম বিজ্ঞানীই ভেবেছিলেন এত সহজে একটি পূর্ণাঙ্গ কোষকে স্টেম সেল এ রূপান্তর করা সম্ভব!

ইয়ামানাকার আবিষ্কারটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হবার পর আশ্চর্যজনকভাবে (গবেষণা ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে) দ্রুত বিভিন্ন অগ্রগতি সাধিত হয়। মানবদেহের চামড়ার কোষ থেকে আজ পুনরায় স্টেম সেল তৈরী করা সম্ভবপর হয়েছে, এবং টিস্যু কালচারের সময় সেগুলো স্নায়ু কোষ বা হৃৎকোষ তৈরীতে সাহায্য করতে পারে। তাছাড়া এই আবিষ্কার আমাদের বিভিন্ন রোগ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার পথ সুগম করেছে।
এক কথায় এই বছরের পুরস্কার প্রাপকবৃন্দ আমাদের (প্রথমিক অবস্থায় যাবার) ফিরতি টিকিটসহ একটি পূর্ণাঙ্গ কোষ উপহার দিয়েছেন, এবং এর মাধ্যমে তারা মানুষের বিকাশ ও কোষের বিশেষীকরণের বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছেন।
(অত:পর নোবেল প্রাপকদের পুরস্কার নেয়ার জন্য মঞ্চের দিকে আহ্বান করা হয়)

দ্রষ্টব্য: পার্লম্যানের মূল ভাষণটি পাবেন এখানে

হাসান আল বান্না সম্পর্কে

নিজের সম্পর্কে এখনো উল্লেখযোগ্য কিছু জানতে পারিনি। তবে চেষ্টা চলছে জানার। চেষ্টা চলছে সবরকম বিলাসিতার সাথে; কর্মবিলাস, ভ্রান্তিবিলাস, দুঃখবিলাস, স্বপ্নবিলাস . . . https://www.facebook.com/hasan.bmbdu
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে অনুবাদ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

13 Responses to শুধু ভ্রূণ থেকে প্রাণী নয়, প্রাণীকোষ থেকেও সম্ভব ভ্রূণ উৎপাদন: চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল অ্যাওয়ার্ড প্রেজেন্টেশন স্পীচ ২০১২

  1. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    উফ কী অসাধারণ!
    মাঝে মাঝে মনে হয় যে আমাদের দেশেও যদি একটা স্টেম সেল ব্যাংক থাকত! তাহলে আমার জন্মের সময়ে বাবা-মা আমার আম্বিলিকাল কর্ডটা রেখে দিতে পারতেন! ভবিষ্যতে কাজে যে লাগবে না, তা তো আর নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না, তাই না? কিন্তু পরক্ষণেই আফসোস হত। যেটা হয় নি, সেটা নিয়ে ভাববার জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দারুণ তো! আমার সাধারণ কোষ থেকেই কি তাহলে স্টেম সেল তৈরি করা সম্ভব না? :happy:

    অনুবাদ ভালো হয়েছে হাসান। কিছু টাইপো আছে মানে ‘টাইপ করার সময় অক্ষর এদিক-ওদিক হয়ে গেছে কিছু জায়গায়’। সেগুলো ঠিক করে নিও। আর অবশ্যই নিয়মিত লিখবা। তুমি কিন্তু খুব ভালো লেখো।

    পোস্টে পাঁচটি তারা দিলুম। :beshikhushi:

    আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয় বলতো?
    তুমি-আমি মিলে দেশেই এইরকম একটা ব্যাংক খুলে ফেলি, চলো! 😛

    • হাসান বলেছেনঃ

      আপু ব্যাংক খোলার জন্য তো আমি পুরেপুরি রাজি, কিন্তু মানুষগুলো কি এত সহজে permit করবে তাদের স্টেম সেল জমা রাখতে? তাহলে তো আবার সল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী কিছু মুনাফার ব্যবস্থাও করতে হবে তাদের জন্য
      😛
      তাছাড়া ethical প্রবলেম ও আছেই, ভবিষ্যতে কাওকে ক্লোন করলে সবই same হবে ঠিক আগের মানষটার মত শুধু আত্মা টা ছাড়া !! কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার :voypaisi:

      আর অবশ্যই, অনেক অনেক ধন্যবাদ মূল্যায়নের জন্য :happy:

      • ফিনিক্স বলেছেনঃ

        আরে পুরা ক্লোন করব কেন? ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য তো ঐটুকু করা ছাড়া উপায় নাই। ঐটারে ক্লোনও বলে না।

        এথিকাল প্রবলেম কই? আমি তো মানুষ ক্লোন করব না! 🙁

        • হাসান বলেছেনঃ

          ও তাহলে ঠিক আছে… আমি ভাবছি মানব-ক্লোন এর কথা বলেছিলেন।
          ট্র্যান্সপ্ল্যান্টেশনের জন্য এইরকম একটা ব্যাংক সত্যি প্রয়োজন, এখন ভালো করে অনুধাবন করতেছি… :thinking:
          আমরা করতে পারি আসলেই, অসাধারন হবে ব্যাপারটা। আপনার সাথে আছি ….

  2. মাঝে মাঝে চিন্তা করি কয়েকটা বায়োলজিক্যাল ডিভাইস বানাব। যেগুলো দিয়ে… না থাক। এইখানে না বলি, লোকে পাগল ভাবতে পারে। 😐

    আমার একটা ক্লোন বানিয়ে রাখা দরকার, নইলে আমার বেশি মাত্রায় ‘ফারটিল’ মস্তিষ্কে জন্মানো এই চিন্তাগুলো আমি মরে গেলেই নাই হয়ে যাবে… মানবজাতির বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে… :crying: :crying:
    আপনি আর ফিনিক্স আপু মিলে বানিয়ে ফেলেন!! 😛

    অসাধারণ লেখা! :beshikhushi:

  3. হাসান বলেছেনঃ

    মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞ…. :happy:
    আর স্টেম সেল ব্যাংক ?!! ভাবছি :thinking: 😛

    আপনার আপনার বায়োলজিক্যাল ডিভাইস টার জন্য শুভকামনা রইল, পৃথিবী নিশ্চয় সেটার সুফল একদিন ভোগ করবে আশা করি……….

    • অনুজ বলেছেনঃ

      আসলে বায়োলজিক্যাল না বলে বায়োমেকানিক্যাল ডিভাইস বলা ভাল…

      বানিয়ে ফেলেন। আমি সেই ব্যাঙ্কের স্টেশিয়ার হব!!

      সোহাগ ভাইয়াকে একবার বলেছিলাম এই আইডিয়ার কথা। উনি শুনে হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমাকে বলছ বলে বাইচা গেলা! স্টিভ জবস বা জুকারবার্গ শুনলে আন্তর্জাতিক মামলা করবে তোমার নামে…’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।