মাধবীলতা তুমি বীরাঙ্গনা নও, মুক্তিযোদ্ধা

আর কেঁদো না মাধবীলতা
তোমার চোখের তপ্ত জল মাটি ফুঁড়ে নেমে এসে
আমার বক্ষপিঞ্জরকে বড্ড জোরে আঘাত করে,
সে আঘাত সইতে পারে না ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া
ফুটোওয়ালা দুর্বল পর্শুকাগুলো।
ওরা তো তৈরী হয় নি তপ্ত লাভায় গলে যাবে বলে
বরং ওরা চেয়েছিল তোমার ঐ নরম বুকের সুগন্ধে
ধুকপুকিয়ে ওঠা হৃদপিন্ডে বাধ দিতে।

মাধবীলতা
তুমি ব্রেসিয়ার পরতে না, আমি জানতাম না
যেদিন জানলাম, সেদিন আমার সামনে নগ্ন তুমি,
নগ্ন গোটা বাংলাদেশ।
সেদিন তোমার নিটোল মাংসে
হেঁদো-মজা ডোবার খনন চলছে অবিরত,
তোমায় উল্টো করে ঝুলিয়ে রক্ত লালাসিক্ত এদেশের স্তনে
চলছে বক্সিং প্র্যাকটিস।
তুমি ব্রেসিয়ার পরতে না, আমি জানতাম না
আমি জানতে চাইনি কখনো
আমার বড় ভয় হতো মাধবীলতা
তোমার ঐ কোমল দুটো ডুমুরের ফুলে নাক ডুবিয়ে শ্বাস নিতে
যদি আঁচড় লাগে ফুলের শরীরে
যদি কেঁদে ওঠে স্পর্শের আঘাতে!
মাধবীলতা দুঃখ করো না
তোমার পুষ্পশব দুটো তো এখন আল্পসের মতই বজ্রকঠিন হয়ে গেছে
তোমার কিসের ভয়?
তুমি আজ বীরের অঙ্গন, ধর্ষিতা নও।
তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।
ঐ শুয়োরদের রেখে যাওয়া বীজে
তুমি জন্ম দাও নি কোন পাপ
বরং মুক্তি দিয়েছ তোমার পিতৃহীন সন্তানকে
তুমি যুদ্ধ করে যাচ্ছ একাত্তরের পর থেকে আজ অবধি
তুমি পাও নি ঘর, পাও নি পর
পেয়েছ শুধু সতীচ্ছেদের যন্ত্রনা, কেবল আমায় সেদিন
আশ্রয় দিয়েছিলে বলে।

 

beauty-pain and white-rose

 

মাধবীলতা
আর কেঁদো না
তোমার তপ্ত জলে আমার ঘুণে ধরা পাঁজর গলে যায়,
গলে যায়…
আমি সেদিন ২৬ রাউন্ড গুলি খেয়েও এভাবে গলি নি
তোমার বুকে ঝাঁক ঝাঁক হাঙরের দাঁত বসে যেতে দেখেও
আমি গলি নি
আমি গলি নি তোমার আকাশ কাঁপানো আর্তচিৎকার শুনেও
গলি নি তোমার উরু বেয়ে নেমে আসা রক্তধারায় জ্বলন্ত সিগারেট
চেপে বসে যেতে দেখেও।
আমি কেবল ছুটে আসতে চেয়েছিলাম ঐ ভাগাড়ের শুয়োরগুলোর
ঘোঁৎ ঘোঁৎ অট্টহাসির শব্দে,
ওদের মুখে এক রাশ থুথু ছুঁড়ে দেব বলে।
আমি ছুটতে পারি নি মাধবীলতা
ওরা আমার পায়ের শিরা কেটে নিল
খানিক বাদে ফুটো করে দিল আমার পাঁজর
পর্শুকাগুলো বাধ দিতে পারল না ঘৃণায় ছিটকে আসা রক্তস্রোতকে
সরু ধারায় মিশে গেল সব তোমার স্রোতের সাথে।
আমার যুদ্ধ থেমে গিয়েছিল সেদিনই
কিন্তু মাধবীলতা তুমি তো যুদ্ধ থামাও নি
বিতাড়িত হয়েও লড়ে গেছ বীরের মত
তবে আজ কাঁদছ কেন?
তোমার চোখের তপ্ত ধারায় ভূপৃষ্ঠের শীতল মাটিতেও
অগ্লুৎপাত হয়,
আমার অবশিষ্ট পাঁজরগুলো গলে যায়
এদেশের মাটিতে মিশে থাকা ৩০ লাখ শহীদের অস্থিগুলো গলে যায়
মাধবীলতা
তুমি আর কেঁদো না
তুমি তো বীরাঙ্গনা নও
জেনে রাখ
তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।

অহর্নিশ অশ্রুস্মিতা সম্পর্কে

যে নারী অহর্নিশি চোখে জল নিয়েও হাসতে পারে, সকল পরাজয়ের গ্লানিকে উড়িয়ে দিয়ে অশ্রু মাঝেও স্মিতা হয়- আমিই সেই নারী; 'অহর্নিশ অশ্রুস্মিতা'
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে কবিতা-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

24 Responses to মাধবীলতা তুমি বীরাঙ্গনা নও, মুক্তিযোদ্ধা

  1. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    “মাধবীলতা
    তুমি আর কেঁদো না
    তুমি তো বীরাঙ্গনা নও
    জেনে রাখ
    তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।” :dhisya:

    অসাধারণ। এদেশের জন্য বীরাঙ্গনাদের অবদান কোন দিনও কারো ভুলে যাওয়া উচিত না।
    :clappinghands:

    • অহর্নিশ অশ্রুস্মিতা বলেছেনঃ

      “এদেশের জন্য বীরাঙ্গনাদের অবদান কোন দিনও কারো ভুলে যাওয়া উচিত না।” কিন্তু তবু আমরা ভুলে যাই যে আজ তাদের জন্যই আমরা এদেশে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছি…

  2. অচেনা রাজ্যের রাজা বলেছেনঃ

    চমৎকার করে লিখেছেন। আপনার কবিতাটা পড়েই লগিন করলাম মন্তব্য দেয়ার জন্য। :voypaisi: :voypaisi:

    • অহর্নিশ অশ্রুস্মিতা বলেছেনঃ

      আমার কবিতা পড়ে লগ ইন করে ফেলেছেন!!! সত্যিকারের বীরাঙ্গনাদের জন্য যদি এরকম কিছু প্রত্যয়ী মানুষ পাওয়া যেত…

  3. প্রজ্ঞা বলেছেনঃ

    আমি মাঝে মাঝে ‘নারী মুক্তিযোদ্ধাদের’ উপর লেখা কিছু বই পড়ি! হাতে গোনা যে ক’টা বই পড়েছি তাতে তাঁদের শুধু কষ্টের কথাই শুধু বলা; বীরত্ব, ত্যাগের কথা বলে নি কেউ! 🙁

    খুব সুন্দর করে তুলে এনেছেন তাঁদের বীরত্বগাঁথা! :dhisya:

    • অহর্নিশ অশ্রুস্মিতা বলেছেনঃ

      বীরাঙ্গনা শব্দটাতে সবাই ব্যঙ্গের গন্ধ খোঁজে…আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এত সম্মান দেই কিন্তু একজন বীরাঙ্গনাকে?? তিনিও যে একজন মুক্তিযোদ্ধা তা একটিবারও ভাবি কি?

  4. সামিরা বলেছেনঃ

    কী ভয়ানক কবিতাটা!

  5. খুব অল্প কিছু লিখার একটা যেটা পড়ে মনে হয়েছিলো, আমরা বুঝি এখনো বেঁচে আছি, শুধু তোমাদের জন্যই… :huzur:

  6. নিশম বলেছেনঃ

    ষোড়শ তম বার পড়া হলো এইবার নিয়ে ! পড়লেই ঘামিয়ে উঠি এই কবিতাটা। আমার কোবতে জীবনের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য একটা। রবী, নজরুল, জীবন – কম পড়েছি। প্রায় পড়িনি বললেই চলে। কিন্তু, এটা একটা কবিতা না শুধু, অনেক অর্থকে বন্ধ চোখেও দেখিয়ে দেয়। কেউ উপেক্ষা করে যেতে পারেনা। অসম্ভব সুন্দর লিখা !

  7. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    কবিতার আসল কথাটা যেন বুঝি।

    আমাদের বীরাঙ্গনাদের আমরা আসলে কীভাবে দেখি?

    তাঁদের ত্যাগকে কীভাবে দেখি?

  8. কিনাদি বলেছেনঃ

    সুন্দর 🙂

  9. শিশিরকণা বলেছেনঃ

    বীরাঙ্গনাদের বীরত্ব, ত্যাগের কথা খুব সুন্দর করে তুলে এনেছেন…. :clappinghands:

  10. সাথী বলেছেনঃ

    কিভাবে লিখ এত সুন্দর করে তুমি………?!!!!
    আমার গায়ের লোম দাড়িয়ে যায় , চোখে পানি এসে যায় ।
    অসাধারণ !!!! :huzur:

  11. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    বীরাঙ্গনাদের নিয়ে আমতা কী ভাবি? কেন ভাবি? তাদের বীরত্ব কি শুধু ধর্ষনের মাঝেই সীমাবদ্ধ?

    ভাল লেগেছে কনসেপ্ট।

  12. মুবিন বলেছেনঃ

    ভালো লাগলো 🙂

  13. রাইয়্যান বলেছেনঃ

    পুরাই অছাম 🙂

  14. মাসরুর বলেছেনঃ

    এত এত এত ভালো লাগল কবিতাটা। :dhisya: :dhisya: :dhisya:

    মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের অবদান কোনভাবেই খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। কিন্তু “বীরাঙ্গনা” কথাটির মধ্যেই অন্য অর্থ নেওয়ার চেষ্টা করে। এখনো আমরা তাঁদের প্রকৃত মূল্যায়ন করতে পারি নি..
    🙁

  15. অনাবিল বলেছেনঃ

    “মাধবীলতা
    তুমি আর কেঁদো না
    তুমি তো বীরাঙ্গনা নও
    জেনে রাখ
    তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা।”

    এই কথাগুলো যেন আর শুধু মুখের উচ্চারণ না হয়……
    চমৎকার লিখেছেন।

  16. অচেনা রাজ্যের রাজা বলেছেনঃ

    আপনার কবিতার শিরোনামটাই আমাকে একটা মোহের মধ্যে ঢুকিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে। বীরাঙ্গনাদের নিয়ে লেখা কবিতাটি বেশ লাগলো।

  17. নিলয় বলেছেনঃ

    অসাধারণ! :huzur:

  18. অনুজ বলেছেনঃ

    মাধবীলতা
    তুমি আর কেঁদো না
    তুমি তো বীরাঙ্গনা নও
    জেনে রাখ
    তুমিও একজন মুক্তিযোদ্ধা

    আচ্ছা, এই কবিতাটা পড়ে কততম বার আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল?
    পড়তে যেতে যতটা সময় খরচ করলাম, তার কিছুটা যদি সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে খরচ করতে পারতাম, তবু হয়ত মনটা কিছুটা সান্ত্বনা পেত!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।