কানে হেডফোন লাগিয়ে খুব জোরেই গান শুনছে রাতুল। রাতুলের বাবা ঢাকা মেডিক্যালের প্রফেসর, ছেলেকে হাজারবার না করেছেন এত উঁচু শব্দে গান না শুনতে এতে কানের মারাত্মক ক্ষতি হয়। কিন্তু এ যুগের ছেলে সকাল বেলা যার ঘুম ভাঙে ডেথ মেটালের কোন এক কান ফাটানো অ্যালার্ম টোনে সে কি আর বাবার এই উপদেশ মানবে? তার প্রতিদিনের রুটিনটা দেখার মত বটে ! বাবুর ঘুম ভাঙে ভোর এগারোটায়, তাও আবার অ্যালার্ম আর মা’র চিল্লানিতে। এরপর খুব ফিটফাট হয়ে ভার্সিটিতে দৌড় দেন বাবু। প্রায়ই একটা ক্লাস মিস হয়ে যায় তার, কখনও দুইটা, আবার মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই একটাও ক্লাস করে না সে। “বন্ধু-আড্ডা আর গান এখানেই” এই মূল মন্ত্রে উজ্জীবিত এই রাতুল সাহেব পড়াশোনায় যথেষ্ঠ পরিমাণে অমনোযোগী হলেও গান বাজনায় তার খুবই নাম ডাক। গিটারে দারুন সুর তুলতে পারে সে, বন্ধুদের আসর মাতিয়ে রাখার জন্য তার গলাই যথেষ্ঠ। তবে একটু ঝামেলা হচ্ছে চেইন স্মোকার যাকে বলে রাতুল তাই। বাসায় ব্যাপারটা এখনও জানে না, তবে রাতুলের ধারণা তার মা বুঝতে পেরেছেন ছেলে যে সিগারেটের পোকা হয়ে গেছে ! যদিও রাতুলের ধারণা ফিজিক্সের মত ভীষণ রকমের পাগলাটে একটা ব্যাপার নিয়ে যারা পড়াশোনা করে তাদের জন্য কিঞ্চিৎ ধুমপান করা হালাল ! মাথা কাজ করতে হবে তো ! ও বলাই হয় নাই, রাতুল সাহেব দেশের নামকরা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের উপর ডিগ্রি নিচ্ছেন সাথে নিজে একটা অপদার্থ জীবে পরিণত হচ্ছেন।
বায়োকেমিস্ট্রির পুতুল, তিন সেমিস্টার কাটিয়ে দিল কিন্তু এখনও কোন শিক্ষক তার খাতায় একটা দাগও দিতে পারে নি, নাহ এতটা বলা বেশি হয়ে যাবে। এখন পর্যন্ত হায়েস্ট মার্ক্স নিয়ে সে আসলে বায়োক্যামিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে রাজত্ব করছে। খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তার প্রথম কাজ বই নিয়ে বসা। আঁতেল সম্প্রদায়ের যদি প্রেসিডেন্ট পদ বলে কিছু থাকত পুতুল তাহলে সেটার যোগ্যতম প্রার্থী হত। পুতুল থাকে তার মামা’র বাসায়, মামার খুব আদরের ভাগ্নি সে, পুতুলের একটা ছোট ভাই আছে পরাগ নাম তার। মামা-মামী, পুতুলরা দুই ভাই বোন, আর পুতুলের এক মামাত ছোট ভাই এই পাঁচ জন নিয়েই পুতুলের সংসার। পুতুল তখন এসএসসি পরীক্ষা দেবে যখন বাবা-মা দু জনই রোড অ্যাকসিডেন্টে মারা যায় আর এরপর থেকেই মামার কাছে বড় হচ্ছে সে। ছোট বেলায় খুব ভালো ছাত্রী না থাকলেও হঠাত করে পুতুল বদলে গেছে, হয়ত ছোট ভাইটার কথা চিন্তা করেই।
-হ্যালো, মিস। শুনছেন।
-জ্বী আমাকে ?
-নাহ, আপনার পাশের ঐ সুদর্শন গাছটাকে !
-আচ্ছা বলুন।
-নীহারদের ক্লাসটা কোনটা ?
-কোন ব্যাচের নীহার ?
-উমম, ষোল কিংবা সতের ?
-ফাজলামি করছেন ? এখানে কোন ষোল-সতের ব্যাচ নেই, আমরাই পঁচিশ তম ব্যাচ থার্ড ইয়ার ! নিজের সম্মানটা বজায় রাখুন দেখে তো ফটকাই মনে হয় !
“আরেহ ! এই শুনেন ! এই দাড়ান . . ”
এই ছিল পুতুল আর রাতুলের প্রথম সাক্ষাৎকার। রাতুল বেচারা নিজের বন্ধু নিহারের খোঁজ করতে গিয়ে পুতুলের হাতে নাকানি চুবানি খেল ! বাংলা সিনেমা হলে এরপর যা হত সেটা হচ্ছে রাতুলের প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যেত পুতুল, আর সেই ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মত ডানা ঝাপটাতো রাতুল-পুতুলের প্রেম কাহিনী। কিন্তু বিধি বাম ইহা বাংলা সিনেমা ছিল না, আর তাই প্রতিশোধ তো দূরের কথা তারা দুজনেই গ্র্যাজুয়েশন করে বের হয়ে গেল ভার্সিটি থেকে একজন আরেকজনের নাম পর্যন্ত জানল না।
প্রায় বছর দুই এক পর. . .
দুইজন যুবক-যুবতি একে অপরের হাত ধরে বসে আছে যার মাঝে একটা আমাদের সেই রাতুল সাহেব আর অন্যটি তাহার প্রেমিকা অধরা। “আচ্ছা সরি, একটু ঝামেলায় পড়েছি। আপনাদের কারো কাছে দুইটা পঞ্চাশ টাকার নোট হবে, খুব জরুরী।”
একটা নারী কন্ঠ শুনে ফিরে তাকালো রাতুল, “একটা কাপলকে কোন অধম এইভাবে বিরক্ত করতে পারে ?” ভেবে পেছনে তাকিয়ে মেয়েটার মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাতুল। পরিচিত মুখ অনেক। কোথায় যেন দেখা !
-ভাইয়া, ভাংতি হবে ?
“ও, অধরা! তোমার কাছে আছে থাকলে দাও তো !”
অধরার কাছ থেকে একশ টাকার ভাংতি নিয়ে চলে গেল পুতুল। আজ তার ল্যাবের প্রথম দিন আর তার কাছে ভাংতি না থাকায় রিক্সা ভাড়া দিতে পারছিল না, এমন সময় সামনের একটা কাপলকেই ধরে বসল সে ! হঠাত করে লজ্জা লাগতে থাকে তার ! তার কি আক্কেল জ্ঞান নেই !
“আচ্ছা ছেলেটাকে চেনা চনে লাগল না ? ” ধুর কে না কে হবে ! পুতুল কাজে মন দিল।
মাস চারেক পর . . .
পুতুলের সামনে বসে আছে রাতুল। ডাক্তার কিছু টেস্ট করাতে দিয়েছে, শরীরটা বেশিই খারাপ রাতুলের। রাতুল যেখানে টেস্ট করাতে এসেছে সেই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের হেড পুতুল। সাধারণত সে রিসার্চে ব্যাস্ত থাকে, আজকে বড় স্যার একজন রোগির রিপোর্ট সহ তার কাছে পাঠিয়েছেন ভালো করে টেস্ট করে রিপোর্টগুলো আবার নতুন করে তৈরি করে দিতে। রোগিটা আর কেউ না, সেদিনের সেই টাকা দেওয়া ভদ্রলোকটা !
-আমাকে চিনতে পেরেছেন ?
-হুম ! নাহ ঠিক ! তবে কেন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে !
-আরেহ আপনাদের কাছ থেকে একশটাকার ভাংতি নিলাম , মনে আছে ?
– হুম ! মনে পড়েছে ! কিন্তু আমাদের বোধহয় আগেও দেখা কোথাও দেখা হয়েছে !
-তাই নাকি ? কই মনে পড়ছে না তো !
-আচ্ছা আপনি কি আমাকে ঝাড়ি দিয়েছিলেন ? আই মিন আমি নীহারকে খুজতে গিয়ে আপনার পাল্লায় পরি নি তো ?
-আচ্ছা ! এর জন্যই তো বলি ! তা এখনও কি তা করেই বেড়ান নাকি ? বন্ধুর নাম ধরে মেয়েদের সাথে টাঙ্কি বাজি ?
-কি যা তা বলেন ? আমি সেদিনও সত্যিই আমার ফ্রেন্ডকে খুজছিলাম , কিন্তু ও আসলে মাইক্রোবায়োলজির ভুলে বায়োক্যামিস্ট্রিতে খোঁজ করছিলাম, পরে বুঝতে পেরেছি।
-আচ্ছা , আপনার রিপোর্টগুলো দেখি !
-হুম
পুতুল রাতুলের রিপোর্টগুলো বারবার চেক করল ! তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না রিপোর্টগুলো সত্য। লিউকোমিয়ার সিম্পটম্পস সব ! পুতুল আবার রাতুলের টেস্ট করালো নিজে সামনে থেকে, এরপর রাতুলকে পর দিন আসতে বলে নিজের কেবিনে ফিরে গেল সে।
পরদিন . .
-রাতুল, বস।
-হুম। তা কেমিস্ট রিপোর্ট তৈরী ? নিয়ে যেতে পারব ?
-হুম পারবে, এত তাড়াহুড়া কি ? তোমার ডাক্তারের চেয়ে আমি ভালো বুঝি, তোমার রিপোর্ট পড়া শেষ ! আগের রিপোর্টগুলো মিথ্যা ছিল। লিউকোমিয়া হয় নি তোমার টেস্টিং এ ভুল ছিল !
-যাক আরো কয়েকদিন বাচছি তাহলে ? একটু আলতো করে হাসত রাতুল। কিন্তু হাসিটা খুব শুষ্ক হাসি !
– কিছু হয়েছে তোমার রাতুল ? আমাকে বলতে পারো।
-বাবা মারা গেছেন কিছুদিন আগে, বাবা’র সব সম্পত্তি ছিল বড় চাচার নামে। এখন সেখানে আমার কোন হক নেই, মা খুব অসুস্থ। অধরা ছেড়ে চলে গেছে সেই কবেই ! লিউকোমইয়ার নিউজটা পেয়ে খুশি হয়েছিলাম। ভাবলাম যাক শেষ কয়দিন নিজের মত আবার আগের মত করে বেঁচে ফিরে যাই কিন্তু তাও করতে দিলে না ! বল কিনা আমার লিউকোমিয়াই হয় নাই ! আমাকে আরও বাচতে হবে ?
-রাতুল জীবন কি শেষ তোমার ? এখনোও তো অনেকটা পথ বাকি তাই না ?
-পুতুল আমার জীবনে কিছু নেই আর ! কিচ্ছু না !
-ভুল রাতুল, জীবন মাত্র শুরু!
-তুমি কি বুঝবে ! তুমি তো আর আমার জায়গায় নেই !
পুতুল হাসে। সে জানে রাতুও কতটা অসহায় হয়ে কথাটা বলছে। কিন্তু পুতুল জানে এর চেয়ে বেশি কষ্ট কি ? যখন বাবা-মা হারা একটা মেয়েকে এত অল্প বয়সেই একটা পরিবারের দ্বায়িত্ব নিতে হয় যেখানে তার মামা-মামী তার সন্তান নিয়ে বাস করে ! আদরের ছোট ভাইটা যখন অভিভাবকের অভাবে অসৎ পথে হাটতে শুরু করে , এর সবই দেখেছে পুতুল। ভার্সিটি শেষ হতে না হতেই মামার ব্যবসায় লস সহ সব বিপর্যয় দেখে ফেলে পুতুল কিন্তু কখনও নিজেকে ছোট হতে দেয় নি, স্বপ্নকে ছোট হতে দেয় নি, ভাইটাকে রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছে, নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ! সেখানে রাতুলের তো এত পিছুটান নেই, রাতুল কেন ভেঙ্গে পরবে ?
. . . . . . . . . গল্প চলতে থাকে, রাতুলের জীবন, পুতুলের জীবন আলাদা আলদা ভাবে চলে। পুতুল খুব সুন্দর একটা জীবন পায়, রাতুলেরও তাই পাওয়া উচিৎ ছিল কিন্তু সবাই পুতুলের মত ঘুরে দাড়াতে পারে না। বিধাতা সবাইকে একই পরিমান মানসিক শক্তি দিয়ে পাঠান নি। এখনও মাঝে মাঝে একটা ছেলেকে মাঝ রাতে নগরীর বিভিন্ন মোড়ে খুব সুন্দর করে গাইতে শোনা যায়. .
“ব্যস্ত শহরে ঠাসা বুনোটের ভীড়ে
আজও কিছু মানুষ স্বপ্ন খুজে ফেরে”
ঠাশ করে শেষ হয়ে গেল…
আমি গল্প টানতে পারি না , ঠাশ করে শেষ হয়ে যায় ! 😛
এরপর থেকে ধাম করে শেষ করে দিয়েন… 😛 😛
আচ্ছা ! :happy:
ভালো লাগলো… 😀
কিন্তু একটা খটকা- গল্পের প্লট কি ৩০/৩৫ বছর আগের? বায়োকেমিস্ট্রিতে এখন ৬১ তম ব্যাচ চলছে… :thinking:
আমি বায়োক্যামিস্ট্রির কোন ব্যাচ চলে জানি না :crying:
ধরে নেই, আমরা ঢাবি’র কথা বলা হয় নাই :happy:
তাহলে তাই ধরে নিই… :happy:
সত্যি করে বললে তোর এতগুলো লেখার পর এই লেখাটা পড়ে মনে হলো যে তোর হাত পেকেছে। আগের চেয়ে যথেষ্টই পরিণত মনে হচ্ছে এই লেখা। :beshikhushi:
আমার অসম্ভব ভালো লাগল।
গল্পে ‘ফিনিক্স’ নামের জন্য না কিন্তু! 😛
আসলেই ?????
কিঞ্চিৎ সন্দিহান ! 😛 .
:happy:
সত্যি কথা বললে মানুষ বিশ্বাস করে না! 🙁
মন খারাপ করে দিলি পুঁইচকা!
🙁
অক্ষর নামটা শুনলেই মনে হয় এই মানুষটা ভালো গল্প লিখতে পারে।
নাহ্ নামের প্রতি আপনি মোটেও অবিচার করেন নি।
পুতুল আর রাতুলের হ্যাপি এন্ডিং দিলে বেশি ন্যাকামো হয়ে যেত। অন্তত আমার তাই মনে হয়। তার চেয়ে আপনার উপসংহারটাই বেশি জীবন ঘেঁষা হয়েছে।
আরো গল্পের অপেক্ষায় থাকলাম…..