চলে গেলেন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম: ১৬ মার্চ,২০১৩

Dr. Jamal Nazrul Islam

খুব আস্তে আস্তে একটা একটা করে সিঁড়িভেঙ্গে উঠতেন চারতলায়। স্টুডেন্টরা আসার খানিক আগে থেকেই একা একা বসে থাকতেন।বয়সের ভারে ক্লান্ত  সেই Smart Old Man এর মুখ টা ছিল না কখনই মলিন। পুরো ক্লাস টা নিতেন মায়াবী এক মুচকি হাসি ভরা মুখে।

গণিত তাঁর কাছে তাঁর আলাদা পৃথিবী। সাদা বোর্ড টা হয়ে যেত তাঁর অংক কষবার খাতা। ছোট বাচ্চার মতো আস্তে আস্তে হিসেব করে বিভিন্ন সমীকরণ মিলাতেন। অংক করতেন। যা করছেন টা মুখেও বলে যাচ্ছেন, বুঝিয়ে যাচ্ছেন নিজের মতো। তাঁর কথা গুলো ছিল অসম্ভব রকমের ধীর। মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চিন্তার ভঙ্গিতে বলতেন, আমি কিন্তু ক্যালকুলেটর ব্যাবহার করি না, এজন্য আমি গর্বিত নই, (হেসে) আবার লজ্জিত ও নই। এরকম আরো অনেক কথা। মনীষীদের কথা,তাঁর বন্ধু দের কথা , গনিতের term গুলোর পিছনের ইতিহাসের কথা……

গনিতের term গুলোর বাংলা জানতে চাইতেন আমাদের কাছে, অনেক বেশি খুশি হতেন উনার ভুলে যাওয়া শব্দ টা মনে করিয়ে দিলে। শিখিয়ে দিতেন বোর্ডে লিখার সময় মার্কারটা নিচের দিকে মুখ করে থাকে যেন। প্রায়ই বলতেন এই কথাটা।

বলতেন, যে বিষয়ই হোক না কেন সেটাতে জ্ঞান অর্জনের জন্য যেমন অনেক বেশি পড়তে হবে, তেমনি অনেক বেশি লিখতেও হবে। কোন কিছু না বুঝলে সেটা ৪০ বার এরও বেশি পড়ে ছাড়তেন বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। বুঝতেই হবে।

স্যার চা খেতে খুব বেশি পছন্দ করতেন। চামচ না থাকলে  নিজের কলম টা দিয়ে চা নেড়ে নিতেন। তাঁর সহধর্মিণী ফোন করে তাঁর খোঁজ নিতেন। ফোন রেখে স্যার পকেট থেকে কাগজের ছোট্ট প্যাকেটে এ করে আনা ফলের টুকরো গুলো বের করে খেতেন। সেও অনেক আস্তে আর আস্তে। বলতেন তাঁর wife  এর কথা। তাঁর মেয়েদের কথা। “আমার দুই মেয়ে, দশজন ছেলের চেয়েও বেশি”।

একেবারে শুরুর দিকে ‘প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম’ নামটা কোনও আলাদা কিছু মনে হয় নি। হ্যাঁ, নতুন একজন স্যার। আলাদা কিছু? পরে কারো কারো মুখে শুনতে পাই উনি অনেক বড় একজন বিজ্ঞানী। আরও পরে উনার ………  নিজে খুব অবাক হলাম, আমাদের দেশের এই মহান মানুষ টার সম্পর্কে এতো কম জানি!

নিজের মতো করেই পড়াতেন স্যার। সত্যি কথা, গতানুগতিক স্টুডেন্ট দের জন্য এটা খুব সুখের বিষয় ছিল না। তবু যেদিন থেকে জানতে পারি স্যার এতো এতো বড় মাপের এতো ভালো একজন মানুষ, আর সেই সাথে স্যার কে ভালো ও লেগে যায় প্রচণ্ড, আমরা কয়জন স্যার এর একটা ক্লাস ও মিস দিতাম না।

ভুলেই গিয়েছিলাম স্যার কে। কিছুদিন আগে গেলো স্যার এর জন্মদিন (২৪ ফেব্রু) , সেদিন মনে পড়ছিল স্যার এর এই কথাগুলো। অসংকোচে অনেক গল্প করা সেই মানুষ টার কাছ থেকে যেন পাওয়ার শেষ নেই। ভেবেছিলাম স্যার এর সাথে সবাই মিলে গিয়ে দেখা করে আসবো একদিন।  কিন্তু তা আর হবার নয়।

আমাদের সবার ভালবাসা আর দোয়া, প্রিয় স্যার এর জন্য। আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতের শান্তি দিন।

http://bn.wikipedia.org/wiki/জামাল_নজরুল_ইসলাম

 

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে স্মৃতিচারণ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

24 Responses to চলে গেলেন শ্রদ্ধেয় প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম: ১৬ মার্চ,২০১৩

  1. মুবিন বলেছেনঃ

    স্যারের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুবই কম জানি না। লেখা পড়ে বুঝা যাচ্ছে আপনি স্যারের সরাসরি ছাত্র। তাই ধরেই নেয়া যায় আপনি স্যারের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে আমাদের থেকে অনেক বেশি জানেন। তাই লেখাটা আর একটু বড় হলে ভালো হত।
    কিংবা স্যারকে নিয়ে আর একটা লেখা দিতে পারেন।

    আমাদের সবার ভালবাসা আর দোয়া, প্রিয় স্যার এর জন্য। আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতের শান্তি দিন।

    • মুবিন বলেছেনঃ

      *স্যারের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে খুবই কম জানি।

    • সিরফল বলেছেনঃ

      ওভাবে লিখতে বসিনি। এই প্রচারবিমুখ অনেক সফল ভালো মানুষ টা কে নিয়ে অনেকে অবশ্যই অবশ্যই অনেক লিখবে আশা করছি। আর কিছু না পারি স্যার কে অমূল্য সম্পদ মনে করে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ যেন করতে পারি বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে প্রযুক্তিপ্রেমী রা।
      আশাবাদী মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

  2. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আপনি কখনও জানবেন না স্যার। এক কিশোরের স্বপ্ন ছিলো আপনাকে দেখার, আপনাকে নিয়ে লেখার।

    জীবিত কালের স্যারকে নিয়ে লেখা হলো না 🙁

    লেখাটার জন্য ধন্যবাদ

    • সিরফল বলেছেনঃ

      এ করুণ আক্ষেপ অনেকেরই, বাপ্পি ভাইয়া।
      কিন্তু আপনি লিখে ফেলবেন। ভালোবেসে লিখে ফেলবেন। বড় বড় বিজ্ঞানী মনীষীদের নিয়ে আপনার পরবর্তী লিখাটাই হোক আমাদের দেশের এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে। আশায় রইলাম।

  3. তারেক বলেছেনঃ

    আফসোস হচ্ছে চিটাগাং এ থেকে ও স্যার এর কোন প্রোগ্রাম এ যাওয়া হইনি।।
    লেখক কে অনুরধঃ স্যার এর পারসনাল লাইফ সহ বিস্তারিত পোস্ট দেওয়ার…
    আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর কাছে স্যার এর জন্য উত্তম মর্যাদার জন্য দুয়া করছি।

    • সিরফল বলেছেনঃ

      এ খারাপ লাগা টা বুঝানোর মত না। : (
      আশা রাখি, অনেক বিস্তারিত লিখা আসবে সরবে।
      আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর কাছে স্যার এর জন্য উত্তম মর্যাদার জন্য দুয়া করছি।

  4. অনুজ বলেছেনঃ

    আকজন আশাবাদী মানুষ হারালাম আমরা… একজন স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষ… 🙁

  5. সিরফল বলেছেনঃ

    স্যার সম্পর্কে আমিও খুব কম জানি। আসলেই অনেক দুর্ভাগ্য। হয়ত আমার জ্ঞান এর দৌড় অতটুকুই। স্যার কে নিয়ে লিখতে হলে অনেক কিছু জেনে, পড়াশুনা করে লিখতে হবে, তাই দুঃসাহস টা হয়ে উঠে নি। এই লিখাটা কিছু আবেগ ভরা স্মৃতি মাত্র।
    শুধু উইকি তে পড়লেও বুঝা যায় স্যার কত বড় এক নক্ষত্র।

  6. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    ছোট্ট এই স্মৃতিচারণ বেশ মন ছুঁয়ে গেল। আমি খুবই লজ্জিত এই মহান মানুষটির সম্পর্কে আসলে জানতামই না বলে। বুঝতে পারছি উনি অনেকেরই চেনা, কিন্তু আমার মত অধমের সংখ্যাও মনে হয় কম না। দোষটা নিজের প্রথমে, হয়তো জানার চেষ্টা করি নি আশেপাশের মানুষগুলোকে। কিন্তু তবু মনে হচ্ছে, স্যারকে নিয়ে কোন কথাই শুনি নাই তেমন আমাদের মিডিয়ায়। গুণীর কদর না করা শিখলে গুণী জন্মাবে না এটাই স্বাভাবিক। সরবের পক্ষ থেকে জীবিত অবস্থায় গুণীর কদর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, এরকম চিন্তা আরও অনেকের করা উচিত। এইরকম লজ্জায় ফেলে স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।

    আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করে জান্নাতের অধিবাসী করে নিন স্যার।

    সবশেষে লেখিকাকে আমারও অনুরোধ, সম্ভব হলে আরও জানাবেন স্যার সম্পর্কে।

  7. এটি সরব -এর সহস্রতম প্রকাশিত পোস্ট।

    সবাইকেই অভিনন্দন! :penguindance:

  8. হৃদয় বলেছেনঃ

    ‘ইহারা থাকে শক্তির পেছনে রুধির ধারার মত গোপনে
    ফুলের মাঝে মাতির মমতা রসের মত অলক্ষে্য।’

    কাজী নজরুল ইসলামের ‘যৌবনের গান’ প্রবন্ধে ‘ইহাদের’ কাতারে স্যারের মত মানুষরাই পড়ে।

    আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে ‘ইহাদের কাতারে’ পড়া এই মানুষগুলোর সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারি না 🙁

  9. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    মূল্যায়ন হোক জীবিত মানুষের! স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা। আল্লাহ্‌ তাঁকে জান্নাতের শান্তি দিন…

  10. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    এই মানুষটাকে যে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করি আমি! মানুষটা কেমব্রিজের সোয়া লাখ টাকা বেতনের অধ্যাপনার চাকরী ছেড়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র হাজার তিনেক টাকা বেতনে অধ্যাপনায় যোগ দেন- কীসের টানে? দেশের জন্য বিনা স্বার্থে কাজ করে যায়- এমন সত্যিকারের মানুষ আর কয়জন আছে?

    আপনাকে নিয়ে কত কত প্ল্যান ছিল, স্যার। সেসব আর পূরণ হলো না!

    যেখানেই থাকুন না কেন, আপনি অনেক অনেক ভালো থাকুন স্যার।
    ছাত্র হিসেবে আমরা আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।

    • সিরফল বলেছেনঃ

      এমন সফল মানুষ টার জন্য শ্রদ্ধা না এসে পারে না।কিন্তু উপরের এই কারণ টার জন্যই শ্রদ্ধা টা হয়ে যায় আকাশ্চুম্বী।
      এই মন্তব্য টার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

  11. শুকপাখি বলেছেনঃ

    এই মানুষটি সম্পর্কে প্রথম জেনেছি সম্ভবত প্রথম আলোর ছুটিরদিন পড়ে ।তাকে নিয়ে লেখা সেই ফিচারটি আমি অনেকবার পড়েছি ।মুগ্ধ হয়েছি তার ব্যক্তিত্বে ।

    এরপর যেখানেই তাকে নিয়ে কোন আর্টিকেল বের হয়েছে ,আমি আগ্রহসহকারে পড়তাম ।এমন প্রিয় মানুষের প্রস্হান মেনে নেওয়া কষ্টের ।
    প্রার্থনা করি আল্লাহপাক তাকে জান্নাতবাসী করুন এবং তার পরিবারকে ধৈর্য ধারনের তৌফিক দিন ।আমীন ।

  12. নিশম বলেছেনঃ

    তানভীর ভাইয়া ফোন দিয়েছিলো মাস কয়েক আগে। “জামাল নজরু ইসলাম স্যার আসবে, পরমানু শক্তি কমিশনে, থাইকো আজকে। একসাথে দেখা করতে যাবো নে”। চিরকাল এই আফসোস যাবে না আমার, আমি সেইদিন যেতে পারি নাই।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।