আসলে আমরা “কেউ না”

জীবনে যখন মগ্নতার দিন আসে তখন উপলব্ধিগুলো ছেঁড়া কাঁথার মত বিস্তৃত হতে থাকে। আমাদের সময়গুলো হয়ে ওঠে বিষাক্ত।

তুই আমি আমরা, সত্যিকার অর্থে কেউ না, নো-বডি। শতাব্দী আমাদের ঘাড়ে পা রেখে নিজের খোলস খুলে নিত্যই নতুন হচ্ছে। আমরা কেবল সময়ের ভার বহনকারী গাধা। এতো বাতচিত, এতো আয়োজন, এতো রাজনীতি, অর্থনীতি সবই তো আগামীর জন্য। সওয়ার হয় মানব পিঠে। এইসব উৎকর্ষতা আসলে বেকার মনকে আকার দেয়ার প্রচেষ্টা।

আশেপাশে তাকিয়ে দেখ!! মানুষগুলোর আচরণ কেমন অদ্ভুত ঠেকছে না? তারা বুঝতে পারছে যে তাদের শেষ চলে আসছে খুব দ্রুতই? তুই কি মনে করিস এরা কেউই মৃত্যুর কথা ভাবে না? আসলে সবাই ভাবে। অথচ সবাই কত নির্দ্বিধায় কাজ করে যাচ্ছে। মোটেও মাথা ব্যথা নেই।

হয়তো এদের আচরণে তুই অনেক অনেক হাসিতে ভুবন ভরিয়ে দিচ্ছিস, কিন্তু যাদের কারণে হাসছিস তাদের কারণে কাঁদবি না? এটা ক্যেমন কথা? হাসি আর কান্না তো আসলে একটা সরল রেখার দুই প্রান্ত। আজ একপাশে তো কাল ঠিকই অন্যপাশ।

এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে কেটে জীবনের তৃষ্ণার্ত রাতগুলো। চাঁদের আলোয় অশ্বত্থের ছায়াটা ক্যেমন ভুতুড়ে লাগছে। ভয় লাগা প্রয়োজন, কেননা ভয়টা খুবই মূল্যবান একটা উপলব্ধি। আর সঠিক সময় এবং সঠিক যায়গায় যদি সে না আসে তার মানে বেঠিক কোন একটা যায়গায় সে হুট করে এসে হাজির হয়ে যাবে হয়তো। হতে পারে এমন কোন একটি বিষয় যেখানে ভয় পাওয়া মোটেও উচিত নয় সেখানে ভয় পেয়ে কান চেপে ধরে চোখ টিপে বসে আছি।

বটের নিচে পাকা করা চত্বর। দু একটা পাতার ঝরে পড়ার শব্দ। পাতারা ঝরে পড়ছে? হুম, আচ্ছা যে পাতাটা এই মাত্র ঝরে পড়লো তার পাশের পাতাটার কি দুঃখ লাগছে? জগদীশ চন্দ্র বসু থাকলে জিজ্ঞেস করতাম, দাদা এই পাতাটা কি তার সঙ্গীর বিদায়ে দুঃখ বোধ করছে? উনি কিছুটা গোল গোল চোখে আমার দিকে তাকাতেন বোধহয়, অথবা হতে পারে আমাকে সন্তুষ্ট কিংবা অসন্তুষ্ট করার মত কোন একটা জবাব ধরিয়ে দিতেন, সে যাই হোক, চল জিজ্ঞেস করি?

কিরে পাতা? তোর কি দুঃখ লাগছে? পাতা চুপচাপ, অথবা বাতাসের ঘর্ষণে মৃদু শব্দ… ওটাই তার জবাব? হুম। জীবন থাকলেই কি তার মানুষের মত আনন্দ বেদনা হিংসা অভিমান এসব থাকে? থাকে না বোধহয়। যদি থাকতো তাহলে অন্য প্রাণীরা অন্তত হাসতে জানতো। আমি তো তাদেরকে সারাজীবন গোমড়া মুখোই দেখেছি। তাহলে? ওরা প্রাণী বলে ওদের মন খারাপ?

প্রাণ আছে বলেই ভাবি অনেক কিছু। কিন্তু তোকে বলবো- তুই গাছ হয়ে যা। গাছের প্রাণ আছে, তোর ও প্রাণ আছে। তুই চুপচাপ বেদনা সয়ে যাবি গাছের মত। হুংকার করবি না, অশ্রু ও ঝরাবিনা, কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবি। আর কষ্টগুলো সব বাকলের নিচে সযত্নে লুকিয়ে রাখবি। সবাইকে কেবল ভালবাসবি।

যেহেতু আমরা “কেউ না”, সেহেতু আমরা “কেউ না”। পৃথিবীর সময় মনে রাখবে ভালোবাসা।

অহনিশ সম্পর্কে

আলো কি কখনো অন্ধকারে পথ হারায়??
এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

23 Responses to আসলে আমরা “কেউ না”

  1. মাধবীলতা বলেছেনঃ

    মানুষগুলো সব নির্লিপ্ত হয়ে গেছে…আমি, আমরা সবাই… 🙁

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      ধরুন আপনি আর সময় পাশাপাশি হাটছেন, বলাতে পারেন কার চোখে জল?? বলতে পারেন কে কাদছে?? সময়? নাকি আপনি?

      অথবা ধরুন এই দেয়ালের ভিরে আপনি এবং নিরবতা পরস্পরের হাত ধরে বসে আছেন, বলতে পারেন কার হাতটা বেশি উষ্ণ? কার?

      এভাবে আমরা আমাদের অনুভুতির সাথেই অবিরাম সহবাস করি, তবুও অনুভুতিদের অনুভুতিগুলো জানা হয়না বহুকাল। এই শতাব্দির কোল ঘেঁসে আমাদের অনবরত পদঘর্ষণে ইতিহাসের দৈত্যের ঘুম ভাঙ্গেনা, তারা এইসব কালো হরফে কুম্ভকর্ণের বিন্যাস্ত অনুসারী হয়।

  2. হাসান বলেছেনঃ

    “যাদের কারণে হাসছিস তাদের কারণে কাঁদবি না? ”
    উত্তর দু’রকম:
    -না কাঁদবো না… কারণ “আমরা কেউ না…. নো বডি।”
    – হ্যা কাঁদবো… কারণ “পৃথিবীর সময় মনে রাখবে ভালোবাসা।’’

    • ফিনিক্স বলেছেনঃ

      হাসান এত কিছু খেয়াল করছে!
      আমার তো এইরকম কিছু মাথাতেই আসে নি!

      কী চমৎকার পাঠক!

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      না এবং হ্যা এর মাঝেই আমাদের বসবাস, তাবৎ জীবনদর্শন কেবল এই সাদা কালোকে উপভোগ্য করতে বিস্তর রঙ সৃষ্টি করেছে, জীবনকে নিয়ে খেলেছে, হেসেছে, মানুষকে মানব অবস্থান থেকে কেউ সরিয়ে নিয়েছে কেউ বা আবার যথাস্থানে বসানোর চেষ্টা করেছে, অসংলগ্ন এই হ্যা এবং না এর মাঝে আমরাও কখনো হ্যা, আবার ক্ষণ যেতেই জল ভরা চোখে না হই।

  3. ডুবসাতার বলেছেনঃ

    চারপাশে এত ‘কেউ না’ যখন দেখি, তখন মনে প্রশ্ন জাগে… আসলেই কি আমরা ‘কেউ না’ ?

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      যেহেতু আমরা কেউ না, সুতরাং চুড়িতে ঝন করে ওঠা শব্দটাও আমাদের বিভ্রম, ঝাকড়া চুলে মাথা ঝাকিয়ে গোসলের পর পানি ঝরানোটাও অনুভুতির বিভ্রম।

      ভ্রম এবং অবাস্তবতার মাঝে একতা কঠিন বাস্তবতাকে সামনে নিয়েই আমাদের পর্যায়ক্রমে শুঁয়োপোকার মত “কেউ না” থেকে “কেউ” এবং “কেউ” থেকে আবার “কেউ না” তে অনবরত ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে, জীবনটা অদ্ভুত এক আধপাগলা রাধুঁনির মত বেকুব হয়ে রান্না করে কালের পাতিলে আগামিকালের অন্ন।

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    দ্বিতীয়বারের মত লেখাটা পড়লাম এবং যতারীতি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ।
    বলা বাহুল্য, আরো একবার পড়েও পুরনো বলে মনে হয় নি! আবারো পড়লেও হয়তো অনুভূতিটা একই রকম থাকবে।

    অল্প কিছু বানানে একটু এদিক সেদিক হয়ে আছে।
    উঠে> দৃশ্যমান ‘উপর’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। এই লেখার নির্দিষ্ট বাক্যে দৃশ্যমান অর্থ নেই কারণ সময় দেখা যায় না। তাই এখানে বানানটা হওয়া উচিত ‘ওঠে’।
    ক্যেমন >> কেমন
    সব-ইতো >> সবই তো
    অশুত্থের >> অশ্বত্থের
    থাকেনা >> থাকে না (না-বোধক শব্দ স্পেস দিয়ে লেখা ভালো)
    ঝড়াবিনা >> ঝরাবি না (পাতা ঝরা, কিন্তু ঝড়- দুটো র/ড় আলাদা)

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      উস্তাদ, ঠিক করে দিয়েছি…

      আমিও জানিস, মাঝে মাঝে টাইম ব্লকে পড়ি, মনে হয় চারপাশ আটকে আছে, কেউ নড়ছেনা, হয়তো কালের গ্রামোফোনে বাজছে মেহেদি হাসানের— জিন্দেগী ম্যা তো…

      অনেক আকাশ এক হয়ে ধির লয়ে সুফী সঙ্গীতের মত এক দিকে কাঁত হয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে…।

      • ফিনিক্স বলেছেনঃ

        ধির> ধীর

        আমি অনেক জ্বালাই, না? 😛
        অবশ্য কেউ বেশি অফেন্ডেড ফিল করলে জীবনেও আর তারে জ্বালাই না। মানুষ বুঝে জ্বালাতন করি। এখনো অফেন্ডেড ফিল করো নাই দেখে বললাম। করলে বলতে পারো নির্দ্বিধায়। 🙂

  5. নূহা চৌধুরী বলেছেনঃ

    যেহেতু আমরা “কেউ না”, সেহেতু আমরা “কেউ না”। পৃথিবীর সময় মনে রাখবে ভালোবাসা। 🙁

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      এবং এভাবেই দিনের পর দিন, প্রজন্মের প্রজন্মে আমরা বিস্মৃত হয়ে রইবো, কেউ খোঁজ নেবেনা, বলবেনা হে প্রাচীন, কেমন আছিস?? কেমন আছিস অহনিশ তুই?? আমার যে তোকে খুব জানতে ইচ্ছে করে…

      হয়ত কেবল ভালবাসাবাসি চলবে…

  6. অনুজ বলেছেনঃ

    কেউ না। কেউ কারো না। আমরা কেউই কেউ না। পৃথিবীর সময় মনে রাখবে ভালোবাসা।

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      সময় আসলে অনেক কিছুই মনে রাখতে ভুলে যায়, ঠিক আমার মত। হতে পারে সে ভালোবাসার কথাও ভুলে যাবে। ক্লান্ত পৃথিবীর চোখের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বুলেটের খোসাগুলোতে যদি প্রাচীন শান্তির সময়েরা ডিম পেড়ে আসতো…!!

  7. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    আসলে কি পৃথিবীর সময়ে ভালোবাসা মনে রাখবে?

    জানি না… জানি না।

    হয়তবা আমরা কেউ না!
    কার্ল সেগান এর একটা লেখা থেকে

    Consider again that dot. That’s here. That’s home. That’s us. On it everyone you love, everyone you know, everyone you ever heard of, every human being who ever was, lived out their lives. The aggregate of our joy and suffering, thousands of confident religions, ideologies, and economic doctrines, every hunter and forager, every hero and coward, every creator and destroyer of civilization, every king and peasant, every young couple in love, every mother and father, hopeful child, inventor and explorer, every teacher of morals, every corrupt politician, every “superstar”, every “supreme leader”, every saint and sinner in the history of our species lived there – on a mote of dust suspended in a sunbeam.

    The Earth is a very small stage in a vast cosmic arena. Think of the rivers of blood spilled by all those generals and emperors so that, in glory and triumph, they could become the momentary masters of a fraction of a dot. Think of the endless cruelties visited by the inhabitants of one corner of this pixel on the scarcely distinguishable inhabitants of some other corner, how frequent their misunderstandings, how eager they are to kill one another, how fervent their hatreds.

    Our posturings, our imagined self-importance, the delusion that we have some privileged position in the Universe, are challenged by this point of pale light. Our planet is a lonely speck in the great enveloping cosmic dark. In our obscurity, in all this vastness, there is no hint that help will come from elsewhere to save us from ourselves.

    The Earth is the only world known so far to harbor life. There is nowhere else, at least in the near future, to which our species could migrate. Visit, yes. Settle, not yet. Like it or not, for the moment the Earth is where we make our stand.

    It has been said that astronomy is a humbling and character-building experience. There is perhaps no better demonstration of the folly of human conceits than this distant image of our tiny world. To me, it underscores our responsibility to deal more kindly with one another, and to preserve and cherish the pale blue dot, the only home we’ve ever known.

    • বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

      (btw আমি কিছু জায়গার সাথে একমত না। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গা এত্ত প্রিয়!)

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      মনে হলো আমি সবটাতেই একমত, হতে পারে অন্য কোথাও অন্য মতেও আমি একমত হয়ে যাবো। যেখানে আমিই কেউ না, সেখানে আমাদের ভাবনার আর শক্তিশালী বটগাছের মত দাঁড়িয়ে থাকার কি মানে?

  8. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    দুইবার পড়লাম। বসে আছি চুপচাপ। কী বলবো জানি না। বাপ্পিদার মত আমারও প্রশ্ন ‘পৃথিবীর সময় কি আদৌ মনে রাখবে ভালোবাসা?’

    • অহনিশ বলেছেনঃ

      আমার মনে হয় মনে রাখবে, মানুষ আসলে সময়ের খরস্রোতায় বেঁচে থাকে কিছু আশা নিয়ে, যা হতে পারে কোনদিনই সত্য হবার নয়, আবার হতে পারে তা এমন ভাবে সত্য হয়ে আছে যা আমাদের চোখে লাগছেনা, কিংবা অনাগত সময় তাকে এড্রেসই করতে পারেনা, কারণ আমরা বরাবরই অতীতের চেয়ে ভিন্ন।

  9. সামিরা বলেছেনঃ

    এত সুন্দর সব চিঠি কাকে লিখেন? দুটো লেখা পড়তে পড়তেই এই একই কথা ভাবলাম।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।