আজ রাতটি কেমন যাবে তাদের?

ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় আঘাত হেনেছে টর্নেডো, এখন পর্যন্ত নিহত ১০ জনের অধিক ও ৩০০+ আহত! শুরু হবে এখন স্থানীয় উপজেলা আর সদর হাসপাতালে এই সকল আহত রুগীদের ভীড়। চারপাশে মানুষের আর্তনাদ ৷তন্মধ্যে ৩০-৪০ জনের অবস্থা আশংকাজনক…

কিন্তু জানেন কী ওখানে কতজন ডাক্তার আছে? সর্বোচ্চ ১০-১২ জন, তাও আবার যদি রোস্টারে ভাগ করি তাহলে এই মুহূর্তে সেখানে থাকার কথা ৩-৪ জনের! জরুরী অবস্থা যেহেতু তাই এখন সবাইকে চলে আসতে হবে এই সকল দুর্গতদের চিকিৎসায়, বাসা বাড়ি ফেলে কেউ আসবেন আত্মীয়-স্বজন ফেলে, কেউ আসবেন খাওয়ার মাঝখান থেকেই, কেউ আসবেন বন্ধুদের সাথে জমানো আড্ডা ছেড়েই, কেউ আসবেন প্রিয় মানুষটির সাথে সুন্দর সময়কে ফেলেই, কেউ আসবেন মায়ের কোল ছেড়েই…

এভাবেই সবাই যার যার নিজের কাজগুলো ফেলে চলে আসবেন, হয় তো এতক্ষণে এসে গিয়েছেন ও হাসপাতালে। এসেই দেখবে এমার্জেন্সিতে পড়ে আছে শত শত মানুষ, কিন্তু তাদের ভর্তি নিতে থাকবে সর্বোচ্চ একজন বা দুই জন, মিনিটে মিনিটে আসছে রুগীর পর রুগী, আর সাথে তো ৫-৬ জন এটেডেন্ট আছেই, তাদের চিৎকার চেচামেচি আর রুগীর আর্তনাদের মাঝেই কাজ করে যেতে হবে, নির্নয় করতে হবে রুগীর সমস্যাকে, দিতে হবে প্রয়োজনীয় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা।

কারো বা মাথা ফেটে গিয়েছে, কারো বা ভেঙ্গেছে হাত- কারো বা পা, কারো বুক ফেরে ফুসফুসে হয়েছে ছিদ্র, কারো আঘাত চোখে, কারো পীঠে, কেউ বা আবার ভয় পেয়েই চলে এসেছে সবাই কাতরাচ্ছে চিকিৎসার জন্য… কিন্তু ডাক্তার তো নাই… না আছে তো ওই যে ডাক্তার কে দেখা যাচ্ছে! কিন্তু বেচারার কীই বা করার আছে? ৩০০-৪০০ রুগীর জন্য মাত্র ১০-১২ জন ডাক্তার, এর মধ্যে কেউ আবার মেডিসেনে, কেউ আবার সার্জারীতে, কেউ গাইনীতে, তার মানে সর্বসাকুল্যে একজন বেচারা ডাক্তারকে একসাথে দেখতে হচ্ছে ৩০+ জন রুগীকে… কীভাবে সম্ভব বলেন? হ্যাঁ সে নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার বলেই সম্ভব, আর আছে উপরওয়ালার করুণা। সে সব রুগীকে আগে দেখে ক্যাটেগোরাইজ করবে ALTS এর মাধ্যমে কার চিকিৎসা আগে দরকার, কার পরে দরকার। সাথে সাথেই তাকে আবার দেখতে হবে কোন রুগীটির অবস্থা খারাপ, তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে দ্রুত।

 

ঐ তো এক রুগী আসল প্রচুর রক্তপাত হচ্ছে, ছুটে গেল ডিউটি ডাক্তার তার কাছে, দেখল শরীর একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে, পালস খুব দুর্বল কিন্তু অনেক, তার মানে এক্ষুনি তার রক্ত লাগবে। সব কিছু মাপ ঝোক করে দেখল রক্ত লাগবে কম করে হলেও তিন ব্যাগ। রুগীর লোকজনকে বলল এই মুহূর্তে গ্রুপ মিলিয়ে রক্ত জোগার করার কথা, পরিবারের একজন বলল তার সাথে মিলে, ডাক্তার বলল আরেকটা লাগবেই খুব দ্রুত। ছুটে বাইরে গেল রুগীর লোক…

 

একি! আরেক রুগী এসেছে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে, কোনমতেই শ্বাস নিতে পারছে না। প্রচন্ড চিৎকার আর চেচামেচি করে অনেক লোকজন ধরাধরি করে আনছে রুগীকে। বাঁশের কঞ্চি ঢুকে গিয়েছিল বুকে, খুব দ্রুতই তাকে সামলাতে হল। এরই মধ্যে দেখল আগের রুগীর অবস্থা খারাপের দিকে, রুগীর লোক পারল না আরেক ব্যাগ রক্ত যোগার করতে। ডাক্তার রুগীর দিকে তাকিয়ে খুব হতাশ হয়ে গেল, ফ্লুইড চালু করেছে, কিন্তু রক্ত না হলে এনিমিক হার্ট ফেইলুর হয়ে বিপদ হবে। হঠাৎ তার মনে পরল, “আচ্ছা আমার এক কলিগেরই তো রক্ত এই গ্রুপের” সেই কলিগও তখন ব্যস্ত আরেক রুগী নিয়ে। কোন মতে তাকে মেনেজ করে তার রক্ত নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করল। করতে না করতেই আরেক রুগী এসে হাজির…

 

সারা রাত ধরে আহত রুগী আসবে, খাটতে হবে সারারাত ধরে, নাওয়া খাওয়ার কথা তো বাদই দিলাম… আবার সকালে উঠে সারা রাত ধরে সেবা দেওয়া রুগীগুলো কেমন আছে তা দেখতে হাজির হতে হবে হাসপাতালে… আগামী কয়েকদিন ধরে চলবে এরকমই অবস্থা। যেই শত শত রুগী আসবে তারাই এই পুরো সপ্তাহ জুরে থাকবে, তাদেরকে সুস্থ্য করে মুখে একটা হাসি দিয়ে ধন্যবাদ দিবে- এটাই ভুলিয়ে দিবে এত কষ্টের কথা! সে হবে পরিতৃপ্ত, ভুলে যাবে পরিবার- নিকটজনের সাথে তার না পাওয়া সময়ে কথা, ভুলে যাবে সে অভুক্ত থেকে সারা রাত জেগে কষ্ট করার কথা, তার মন সেগুলো ঝেড়ে ফেলে পূর্ণ হয়ে যাবে সুস্থ্য হওয়া রুগীর প্রশান্তিময় হাসি আর রুগীর লোকের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন দিয়ে।

হ্যাঁ এইভাবেই সব কিছু ফেলে যে মানবতা সেবক দল সেবা দানের জন্য নিজেদেরকে বিলীন করে দেন, তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা। সাথে সাথে সহমর্মিতা ব্রাহ্মনবাড়িয়ার দুর্গত মানুষের প্রতি

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে বিবিধ-এ। স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

4 Responses to আজ রাতটি কেমন যাবে তাদের?

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    লেখাটির জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ

    ডাক্তারদের অন্যভাবে দেখি আমরা।
    সুযোগ পেলেই গালি দেই… ওদের চোখ থেকে বিষয়গুলো দেখা হয় না

  2. সামিরা বলেছেনঃ

    খুব খুব ভালো লিখেছেন ভাইয়া।
    আসলেই এই ত্যাগগুলির দিকে আমাদের চোখ পড়ে কম।
    “এইভাবেই সব কিছু ফেলে যে মানবতা সেবক দল সেবা দানের জন্য নিজেদেরকে বিলীন করে দেন, তাঁদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।”

  3. কানিজ আফরোজ তন্বী বলেছেনঃ

    খুব ভালো লাগলো পড়ে।

  4. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    :huzur:

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।