ডাক্তার, ওষুধ আর বাংলাদেশ ব্যাংক!!!

আজকে প্রথম আলোর দুইটা ভালো নিউজ দিয়েছে দেখলাম, “অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যর্থতায় হুমকিতে মানবস্বাস্থ্য” আর “হাতুড়ে চিকিৎসা”। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে আসল সমস্যাটা কোথায়? সমাধানই বা কি!

প্রথম প্রতিবেদনে অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্টেন্স আর তার ভবিষ্যত নিয়ে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে আর দ্বিতীয়টা একটি খবর যেখানে এক হাতুড়ে চিকিৎসকের হাতে পরে জীবন দিতে হয়েছে এক শিশুকে

এই দুইটা খবরই গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত, একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে! তবে যেই খবরটি আসে নাই সেটাই এই দুইটারই মূল খবর! বন্ধুরা খুব পাজেল্ড হয়ে গেলেন মনে হয়! পরিষ্কার করছি…

বাংলাদেশে ডাক্তার কারা? এই প্রশ্ন করলে উত্তর একাধিক আসবে- মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি যাদের তাদেরই হওয়ার কথা! কিন্তু না! আমাদের দেশে ডাক্তার হলো LMAF নামক বাতিল ডিগ্রিধারীরা, মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট আর টেকনোলজিস্টরাও আজকাল আবার নিজেদের “ডাক্তার” বলে দাবী করছে। অনেক ক্ষেত্রে আবার নার্স ও মেডিকেলের সাথে জড়িত অন্য পেশার লোকজনো ডাক্তার হয়ে বসে।
ব্যাপারটা অনেকটা সামাজিকো বটে- পাশের বাড়ির কেউ মেডিকেলে কাজ করে কিন্তু ডাক্তার না- অশিক্ষিতরা/ এমনকি নিম্নবিত্ত শিক্ষিতরাও যায় যারা ডাক্তার না তাদের কাছে।
গ্রাম গঞ্জে LMAF, স্বাস্থ্যকর্মীরাই বড় ডাক্তার, সরকারী কোন বিধি নিষেধের প্রয়োগ নাই, যে যেমন খুশী অনুমতি না থাকলেও ওষুধ দিয়ে বেড়াচ্ছে রুগীকে এমনকি ডিস্পেন্সারি খুলে প্রাকটিসও  চালিয়ে যাচ্ছে! আর এরা তো সাধারণ জ্বর-সর্দি হলে অনেক শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক দিবেই… তাতে রেজিস্টেন্স গ্রো করবে না কেন?

আরেকটা বড় সমস্যা হলো চায়ের টঙ্গের দোকানের মত লক্ষ লক্ষ ফার্মেসি দোকান খুলে বসা, আর খোলা বাজারে চাল-তেলের মত ওষুধ বিক্রি করা। অনেক ক্ষেত্রে এই ফার্মেসির ক্লাস ৮ পাস/ মেট্রিক/ ইন্টারপাস দোকানদারেরা দেদারসে দিয়ে চলে ওষুধ। এছাড়া প্রেসক্রিপশন ছাড়া তো ওষুধ বিক্রি চলেই।

সমাধান কী এই সমস্যার?  সমাধান ধাপে ধাপে হতে হবে। প্রথম কথা কারা ডাক্তার এটা স্পষ্টভাবে নির্ধারিত থাকতে হবে। এখন যেমন অগা-মগারা “ডাক্তার” নেমপ্লেট লাগিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তা স্পষ্ট ভাবে নিষিদ্ধ করে বন্ধ করতে হবে।
আর নিয়ন্ত্রন করতে হবে ওষুধের দোকানগুলোকে ও বন্ধ করতে হবে ওষুধের প্রেসক্রিপশন ছাড়া যথেচ্ছা  বিক্রি। এখন প্রশ্ন হলো কে করবে? স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়-অধিদপ্তর আর ওষুধ প্রশাসন তো এই ব্যাপারে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

এই ক্ষেত্রে আমাদের জন্য আদর্শ হতে পারে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক অর্গানাইজেশন বিজিএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকিং সিস্টেম! অবাক হলেন!
বলছি ওষুধকে দেখতে হবে “কাগুজে টাকার” মত, প্রেসক্রিপশনকে মর্যাদা দিতে হবে “ব্যাংক চেক” বা “এটিএম কার্ডের” মত। আর ওষুধের দোকান হতে হবে ব্যাংকের মত, যার উপরে থাকবে “বাংলাদেশ ব্যাংকের” মত কড়া নজরদারি, আর শুধুমাত্র মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তারই হবে “ডাক্তার” এই ক্ষেত্রে তার ক্ষমতা “ব্যাংক ম্যানেজার” এর মত, যার অনুমতি ছাড়া একটা ওষুধো নড়বে না, অন্য কারো ক্ষমতা থাকবে না ওষুধ প্রেসক্রাইব করার।

এটা কি সম্ভব? অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যখন এরকম উদারণ আমরা দিতে পেরেছি জাতি হিসেবে তখন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন পারব না! অবশ্যই পারব আমরা! মনে রাখবেন, “অর্থের থেকেও জীবনের মূল্য অনেক অনেক বেশি”।
সকল রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে বিএমএ কে কাজ করতে হবে বিজিএমই এর মত ঐক্যবদ্ধ ভাবে, স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপারে “নো কম্প্রোমাইজ” যার মাধ্যমে তৈরী করতে হবে “বাংলাদেশ ব্যাংকের” মত শক্তিশালী Regulator অর্থোরিটি, সেটা হতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর না নতুন কোন রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান যারা এই কোয়ালিটি এন্সুরেন্স এ বা নজরদারিতে থাকবে। এরজন্য রাজনীতির প্রভাবকে মুক্ত রাখতে হবে ডাক্তার সমাজকে নিজের স্বার্থেই! এখন সময় এসেছে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে নাকি একটা নিরাপদ ভবিষ্যত নির্মান করবে, তা সিদ্ধান্ত নেওয়ার। নীতি নির্ধারকদেরো এক্ষেত্রে উদার মনের ও শক্ত কাজের পরিচয় দিতে হবে। নইলে অডাক্তার নামক হাতুরের হাতেই হোক বা রেজিস্টেন্স গ্রো করতে করতে অনেক অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সত্তেও অকার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের জন্যই হোক আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম এমনকি আমদের জীবন চলে যাবে হুমকির মুখে!

তবেই আমরা পারবই একটি নিরাপদ, সুস্বাস্থ্যের ও মানসম্মত চিকিৎসার ব্যবস্থার বাংলাদেশ, স্বপ্ন হবে সত্যি!! আমরাই করব সত্য!!!

এই লেখাটি পোস্ট করা হয়েছে ইতিবাচক, বিবিধ-এ এবং ট্যাগ হয়েছে , , , স্থায়ী লিংক বুকমার্ক করুন।

14 Responses to ডাক্তার, ওষুধ আর বাংলাদেশ ব্যাংক!!!

  1. বোহেমিয়ান বলেছেনঃ

    দারুণ চিন্তা।
    একদম পলিসি লেভেল এ।
    মেডিকেল এর ছাত্রছাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

    • অদ্ভুত ছেলে বলেছেনঃ

      ধন্যবাদ! পলিসি লেভেলের চিন্তাগুলো কে আরো বিসৃত করা দরকার। আমাদের পলিসিগুলো একেবারেই জগাখিচুরী

  2. স্বপ্ন বিলাস বলেছেনঃ

    অত্যন্ত চমৎকার চিন্তা। অবশ্যই মুগ্ধ হবার মতো এবং বাস্তবায়ন করার মতো একটা পরিকল্পনা। 🙂

    তবে, এটা করার জন্য যতটুকু কঠোর হওয়া দরকার সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হতে রাজি কি না সেটা একটা প্রশ্ন। একই সাথে, এমন নীতি প্রয়োগ করার সাথে সাথে সকল ফার্মেসীগুলো একসাথে ‘স্ট্রাইক’ করে বসবে। সেটার-ই বা সমাধান কী হতে পারে?

    • অদ্ভুত ছেলে বলেছেনঃ

      যেসকল ফার্মাসি নিয়ম মানছে এখন থেকেই তাদের সমস্যা হয় তো হবে না, আর এরকম ফার্মেসিই দরকার, তার থেকেও বেশি দরকার জনসচেতনতা… একটু একটু করে শুরু করতে হবে, একবারে না
      আর, ফার্মেসির দোকানের লোকজনকে প্রশিক্ষণের আওতায় এনেও এর সমাধান করা সম্ভব

  3. অনুজ বলেছেনঃ

    অসাধারণ চিন্তা!!
    কিন্তু ভাইয়া, এই লেখা কোন ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী পড়লে নির্ঘাত কেজিখানেক গাল দেবে আপনাকে! কতকজন আবার গাল ফুলিয়ে বলবে, ‘সামান্য গা গরম হয়েছে। প্যারাসিটামল কিনতে গেলেও প্রেসক্রিপশন লাগবে!!’
    স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয় বা বিএমএ কি এতটা চেঞ্জ করতে পারবে খুব সহজে?

    • গাঙচিল বলেছেনঃ

      ভাইয়া, ফার্মেসী সাবজেক্টটিতে Over-the-Counter drug (OTC) নামক একটি টার্ম আছে। এই OTC ড্রাগগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই dispense করা যায়। প্যারাসিটামল ঠিক সেই রকম একটি ড্রাগ। এটি কেনার জন্য প্রেসক্রিপশন প্রয়োজন হয় না। 🙂

      • অনুজ বলেছেনঃ

        🙂
        এইটা জানা ছিল না।
        ধন্যবাদ জানানোর জন্যে। 🙂
        তবে এই ইনফোটা মনে খুব কম মানুষই জানে। প্রাথমিক ভাবে তাই এটা বলতেই পারে। আমি সে হিসেবেই বলেছি।

        “এক্ষেত্রে শক্তিশালী রেগুলেটরি অথোরিটির পাশাপাশি ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, সাধারণ জনগণের সচেতনতা এবং ফার্মেসীগুলোতে ওষুধ ডিসপেন্সিং এর ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।” একদম ঠিক।

        • অদ্ভুত ছেলে বলেছেনঃ

          OTC এখানে আলোচনার বিষয় না। বিষয় হলো OTC বহির্ভুত ড্রাগ গুলো। বিশেষ করে এখানে আমি অ্যান্টিবায়োটিকের কথা তুলে ধরেছি, আন্টিবায়টিকের যথেচ্ছা ব্যবহার তাকে অকার্যকর করে দেয়। আর OTC ড্রাগ গুলো ডিস্পেন্স তখনই প্রেস্ক্রিপশন ছাড়া করা যায় যখন ফার্মাসিস্ট এই ব্যাপারে শিক্ষিত। কারণ রুগীর সিম্পটম দেখে আন্দাজে ওষুধ দিতে পারেন কিন্তু তার ভয়াবহ পরিনাম আছে, যেমন বুকে ব্যাথা… এসিডিটির হতে পারে সাথে সাথে হার্ট অ্যাটাকেরো হতে পারে… MI তে OTC ড্রাগ এন্টাসিড দিলে কী হবে বুঝতেই পারছেন!

  4. গাঙচিল বলেছেনঃ

    খুবই গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। ব্যাংকের সাথে তুলনাটিও যথোপযুক্ত মনে হচ্ছে। সত্যিই তো……… “অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যখন এরকম উদারণ আমরা দিতে পেরেছি জাতি হিসেবে তখন স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন পারব না!……অর্থের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।”

    এক্ষেত্রে শক্তিশালী রেগুলেটরি অথোরিটির পাশাপাশি ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, সাধারণ জনগণের সচেতনতা এবং ফার্মেসীগুলোতে ওষুধ ডিসপেন্সিং এর ক্ষেত্রেও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার।

  5. অবন্তিকা বলেছেনঃ

    স্বপ্ন সত্যি হোক সবার প্রচেষ্টায়..!

  6. ফিনিক্স বলেছেনঃ

    চিন্তাগুলো ভাষায় তুলে ধরার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
    পুরো সিস্টেমকে ঢেলে সাজানো গেলে ভালো হতো।
    বিজিএমইএ, বাংলাদেশ ব্যাংক, ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট- এতগুলো আলাদা সাইকেল হলে দুর্নীতি থামানো খুব কঠিন। প্রতিটা সাইকেলে আলাদাভাবে কোন কন্ট্রোল পাওয়ার নেই বলে অবস্থা এত খারাপ।

    • গাঙচিল বলেছেনঃ

      সেটাই আপু! পুরো সিস্টেমকে ঢেলে সাজানো গেলে সত্যিই ভাল হত……

      কিন্তু এই রকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শুধু ব্লগেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত না মোটেই। এই ধরণের ভুল চিকিৎসায়, ভুল ওষুধ প্রদানে মৃত্যুর খবর তো প্রায়ই দেখা যাচ্ছে! আমাদের কি কিছুই করার নেই…… 🙁

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।